কোল
কোল
কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয় আজ। রাত নেমেছে। চরাচর ব্যাপ্ত নিস্তব্ধতায় কোথাও এতটুকু প্রাণের স্পন্দন নেই। আজ বুঝি পৃথিবী দোর লাগিয়ে নিদ্রা গেছে নিশ্চুপে, বাইরে ক্লিষ্ট তারা-খসা আকাশ।
এক মালিনী শুধু সারাটা দিন অপেক্ষায়। সারাটা রাত ঘরের বাতি নিভিয়ে আবারও অপেক্ষায়। মাসের পর মাস অপেক্ষায়। এই অপেক্ষার অবসান হতে আর কত দেরী? তর সয় না যে। শরীরটা আজকাল আর বইছে না, বড়ো হাঁফ ধরে যায় অল্পে।
'অ বউ, বলি দিন রাত হাঁ করে বসে থাকলেই তো আমার ছেলেটা ফিরবে না কো। সে আর ফিরবার নয়। যে আসছে, তার কতা ভেবে একটু নিজের যত্নআত্তি করলে পারো তো'
'আঃ, আপনি থামুন তো মা, অমন করে বলতে নেই' মালিনী ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। এইসময় অত কঠোর সত্য শুনতে মন চায় না। একটু নিজের মতন থাকতে দিতে যে কি ক্ষতি কে জানে? সারাক্ষন কানের কাছে বগরবগর করতেই আছে বুড়ি।
পূর্ণিমাদেবী ভাবেন তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না মোটে। না ফেরা ছেলের শোক ভুলে কোলের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন এই সদ্য প্রস্ফুটিত কুঁড়িটিকে। তাঁর মতো করে আগলে না রাখলে, কবেই সে সমূলে উৎপাটিত হয়ে যেত, সে কি আর উনি জানেন না? এখন অপেক্ষা আর কয়েকটা দিনের, তারপরই বউয়ের কোলের নবজন্মাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারলে, শাশুড়ি-বউয়ের পিপাসার্ত সংসার আলোয় আলোয় ভরে উঠবে।
আশায় বুক বাঁধেন পূর্ণিমাদেবী। টনক নড়ে মালিনীর কাতরানিতে। প্রসবযন্ত্রণায় মলিন সে আঁকড়ে ধরে তাঁর হাত দুটি। দূরে কোনো একাকী বিহঙ্গ ডেকে ওঠে। চমকে ওঠে চরাচর।
ভোরের প্রথম আলোয় রাঙা আকাশতলে আড়মোড়া ভাঙ্গে কচি পৃথিবী। ভাসমান আকাশকে নতুনভাবে দেখে, নতুন করে চেনে অবাক বিস্ময়ে। নবজন্মা তার মাতৃক্রোড়ের উত্তাপে মিশে থাকে। অমৃতসুধায় মোহাবিষ্ট হয়ে ঢলে পরে নিশ্চিন্ত নিদ্রায়।
'একেবারে আপনার ছেলের মুখ বসানো হয়েছে যে, তাই না মা?' বহুদিন পর আজ বড় শান্তি আসে মালিনীর হৃদয় জুড়ে। চোখ দুটো বুজে যাচ্ছে শ্রান্তিতে।
'হ' পূর্ণিমাদেবী বিলি কেটে দেন বউয়ের চুলে। পরম আদরে সে নবজন্মাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোয় তাঁর উষ্ণ কোলে। ফোকলা হাসি হাসেন বুড়ি।
নীল আকাশ উঠোনে রোদ ফেলে চেয়ে চেয়ে দেখে।
সমাপ্ত।।
