ফিরে পাওয়া
ফিরে পাওয়া
নাচের ক্লাস থেকে ফেরার পথে সৌমি রিনি কে বললো , কিরে রিনি চুপ করে আছিস কেন ? রিনি তাও চুপ করে থাকে । তখন সৌমি বলে ও বুঝেছি আল্পনা ম্যাম আজ ওই ডান্স স্টেপ টা পারিসনি বলে বকেছে বলে তোর মন খারাপ । রিনির চোখে জল দেখতে পায়ে সৌমি। সৌমি বলে রিনি তুই কাঁদছিস। রিনি তখন সৌমি কে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে আমার নাচ ভালো লাগেনা রে। তুই কত সুন্দর করে করে প্রতিটা নাচের স্টেপ গুলি করে ফেলিস করতেই আমি পারিনা । আমাকে ওরা কথা সোনায় হাসে আমাকে নিয়ে । আমার একদম ভালো লাগেনা রে একদম ভালো লাগেনা। তখন সৌমি রিনি কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে কেন পারবি না তুই , সব কিছু তুই পারবি তোকে পড়তেই হবে। এই বলে রিনির চোখের জল মুছিয়ে দেয় সৌমি ।
সৌমি আর রিনি ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড যাকে বলে একদম প্রাণের বন্ধু। পাশাপাশি বাড়িতে থাকতো তারা। সৌমীর বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার আর রিনির বাবা ছিলেন উকিল। সৌমি আর রিনি সেই ছোট বেলা থেকেই একসাথে বড়ো হয়েছে। তাদের দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ও ছিল খুব ভালো। তাই সৌমি ও রিনির একে অপরের বাড়িতে যাওয়ার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। সেই ছোট বেলা থেকেই তারা একসাথে খেলা ধুলা স্কুল পড়াশোনা সব কিছু এক সাথে করে বড়ো হয়েছে। দুজনের ছিল একই স্কুল একই মাস্টার আর তার সাথে একই নাচের মাস্টার ছিল। আর এখানেই যত সমস্যা , কারণ সৌমির নাচের খুব শখ ছিল। ছোট বেলা থেকেই সৌমি স্কুল প্রোগ্রামে নাচতো। এই দেখে সৌমীর বাবা অনিল বাবু সৌমীকে পাড়ার একটা নৃত্যশালা ভর্তি করে দেন। সেই দেখে রিনির বাবা অম্বরীষ বাবুও রিনিকে ভর্তি করেন সেই নৃত্যশালায়। দুই বন্ধু যখন সব কিছু এক সাথে করে তখন আর এইটাই বা কেন বাকি থাকে । কিন্তু রিনির নাচ একদম পছন্দ ছিলো না। রিনি খেলা ধুলা খুব পছন্দ করতো। বর্ধমান জেলার পলাশ ডাঙা গ্রামে বাস করতো তারা। ছুটির সময় সারাদিন , আর স্কুল ছুটির পর তারা দুই বন্ধু মিলে সেই পলাশ ডাঙা গ্রাম ময় ঘুরে বেড়াতো। কোথায় আমগাছ থেকে ঢিল মেরে আম পারা ধান খেতে লুকিয়ে চুরি করা তেতুলের আচার খাওয়া , বাঁশের সাকোতে বসে পা দোলানো। এই সব কিছু নিয়ে মেতে থাকতো সে। এদিকে সৌমি ছিল একটু সংযত মার্জিত ও বুদ্ধিমান। আর অন্য দিকে রিনি ছিল প্রাণ খোলা ছেলে মানুষ চঞ্চল ও খামখেয়ালি। তাই সৌমীর মতো রিনি পড়াশোনাতে তেমন ভালোছিলো না , কোনো রকমে পরীক্ষাতে উর্তীর্ণ হতো। তারপর এই নাচের স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর রিনির পায়ে ঘুঙুরের সাথে সাথে পায়ে বেরিও পড়লো। কারণ স্কুল থেকেই ফিড়ে তাদের ছিল নাচের ক্লাস। সৌমির তাতে আনন্দ হলেও রিনির মন খারাপ হয়ে যায়। সৌমি নাচের সব গুন্ ভালো ভাবে রপ্ত করতে পারলেও রিনি কিছুই পারতো না। কারণ রিনির মন পরে থাকতো সেই আম বাগান ধান ক্ষেত ও সেই বাঁশের সাঁকোর দিকে। এই নিয়ে রোজ রোজ আলাপনা দি মানে তাদের নাচের দিদিমনির কাছে বোকা খেতো রিনি। আজ রিনির সেই একই অবস্থা। আজ রিনি সৌমীকে বলেই বসে যে নাচ তার ভালো লাগেনা। শুধু সৌমি যায় বলেই রিনি যেত নাচের স্কুলে।
সেই দিন বাড়ি ফিরে সৌমীর মনটাও খারাপ হয়ে থাকে । সৌমী বাড়ি গিয়ে নিজের মাকে সব কিছু খুলে বলে । সব কথা শুনে সৌমীর মা বলেন , রিনি তোমাকে কতটা ভালোবাসে তাহলে ভাবো একবার । যে জিনিসটা ওর একদমি পছন্দ নয়, তাও সে চার মাস ধরে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তাই করে যাচ্ছে এতো কথা শোনার পরেও যাচ্ছে । কেন জানিস শুধু তোর সাথে থাকার জন্য , কারন তোর সঙ্গ ও কোনোদিন ও ছাড়েনি ।। তোর থেকে আলাদা হওয়ার কথা ও ভাবতেই পারে না । সৌমিও ভাবলো ঠিক তাই তো সেই ছেলে বেলা থেকে আজ পর্যন্ত সব কাজ তো একসাথে করেছে । সৌমীর মা বলে রিনি কে যদি কেউ সাহায্য করতে পারে তাহলে সে তুমিই একা । তুমি ছাড়া ও কারর কথা শুনবে না । রিনি সেই জল ভরা চোখের কথাটা মনে পরে গেল সৌমির । সৌমি তখনি রিনির কাছে চলে গেল , আর গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো বললো রিনি আমরা কোনোদিন কখনো আলাদা হবো না বলে সৌমী কেঁদে ফেলে । রিনি বলে আমিও তোর সাথ কখনো ছাড়োবো না রে । সৌমি রিনি কে বলে তাহলে বল আমি আজ থেকে তোকে যা বলবো তুই আমার সব কথা শুনবি । রিনি বলে তোর তো সব কথাই আমি শুনি , সৌমি ছোটদের মতো জেদ করে বলে না তুই আগে কথা দে আমাকে । রিনি বলে ঠিক আছে দিলাম কথা । সৌমি বলে পরশু থেকে গরমের ছুটি পরছে , রিনি বলে হ্যাঁ পরছে তো কি । সৌমি ভলে তুই পরশু দুপুরে স্কুল ছুটির পর আমার সাথে মনোহরদের আমবাগানে আসবি । রিনি বলে কেন ? সৌমী বলে আমি বলছি তাই ।
তারপর সেই দিনটা এলো কিন্তু স্কুল ছুটির পর রিনি সৌমী কে খুঁজেই পেল না এমন তো কোনোদিন ও হয় না। তখন রিনির সৌমীর সেই কথা মনে পরলো , ছুটির পর মনোহরদের বাগানে আসার কথা । রিনি তাড়াতাড়ি ছুটে পৌচ্ছে যায় মনোহরদের বাগানে । সেখানেও সৌমি কে না দেখতে পেয়ে একটু ভয় পায় রিনি । কয়েক বার জোড়ে জোড়ে সৌমির নাম ধরে ডাকে রিনি , কিন্তু সৌমির কোনো সারা না পেয়ে চিন্তিত মুখে বাড়ির দিকে ছুট দিতে যাবে রিনি । ঠিক তখন রিনি ঘুঙুরের আওয়াজ শুনতে পেলো । ছন ছন করে কাছেই কোথাও ঘুঙুরের আওয়াজ আসছে । রিনি পিছনে ফিরতেই দেখে যে সৌমি একটা আম গাছের আড়াল থেকে হাসি মুখে বেরিয়ে আসছে পায়ে তার ঘুঙুর। সেই ঘুঙুরের শব্দ তুলে সৌমি রিনির কাছে এলো , আর এসে রিনির হাতে একজোড়া ঘুঙুর দিয়ে বলে আজ থেকে তুই পুরো গরমের ছুটিতে আমার সাথে দুপুর বেলা এখানে নাচ প্রাক্টিস করবি। রিনি বলে তুই তো জানিস আমার নাচ ভালো লাগেনা , সৌমি নাচ শেখার জন্য জোড় করে রিনিকে। সৌমি বলে আমার বন্ধু কে রোজ নাচের ক্লাসে সবাই অপমান করবে এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না। রিনি বলে আমার দ্বারা নাচ হবে না আমি কিছুই বুঝতে পারিনা। এই নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। যখন অনেক বোঝানোর পরেও রিনি রাজি হলোনা তখন সৌমি বলে। ঠিক আছে তুই আমার কথা শুনবি না তো , তাহলে আমিও তোর জীবন থেকে চলে যাবো আজ যেমন স্কুল থেকে না বলে চলে গিয়েছিলাম তেমনি তোর জীবন থেকে সারাজীবনের মতো চলে যাবো । এই বলে কাঁদতে কাঁদতে মুখে হাত দিয়ে সেই খানেই মাটির উপর বসে পরে সৌমি। মুখে হাত চাপা দিয়ে সৌমি কাঁদতে থাকে , ঠিক তার খানিক বাদে সৌমির কান্না থেমে যায় একটা শব্দে ' ঘুঙুরের শব্দ ' সৌমি সেই শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি মুখ থেকে হাত নামিয়ে তাকিয়ে দেখে রিনি সেখানে নেই । একেবারে ফাঁকা ছিল সেই আম বাগান। সৌমি মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর চারিদিকে তাকিয়ে রিনি কে খুঁজতে থাকলো কিন্তু কোথায় রিনি। সৌমি ভাবলো তাহলে কি রিনি ওকে একা রেখে বাড়ি চলে গেলো। মনে আরো বেশি দুঃখ পায় সৌমি। সৌমিও বাড়ির দিকেই পা বাড়াবে ঠিক এমন সময় ঘুঙুরের সব আবার শুনে পেল সৌমি , সৌমি ছিপনে ফিরে তাকালো , তারপর তার চোখের শুকিয়ে যাওয়া পাতা আবার জলে ভোরে উঠলো। আর এই বার কিন্তু সেই জল কষ্টের ছিলো না , সেটা ছিলো আনন্দের। সৌমি দেখে ঠিক সেই গাছের আড়াল থেকে কোমরে ওড়না আর পায়ে ঘুঙুর পরে এক মুখ কাহি নিয়ে বেড়িয়ে আসছে রিনি। ঠিক কিছু ক্ষন আগে যেমন বাড়িয়ে এসেছিলো সৌমি। রিনি সৌমীর দিকে নাচের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে আস্তে বলে , বুঝিয়ে দেয় যে সে নাচ শেখার জন্য তৈরী। সৌমি তখন ছুটে গিয়ে রিনি কে জড়িয়ে ধরে আর দুই বন্ধুই কাঁদতে থাকে।
তারপর থেকে প্রতিদিন দুপুর বেলা সেই মনোহরদের বাগানে দুই বন্ধু নাচ প্র্যাক্টিস করতো। আস্তে আস্তে রিনির নাচের প্রতি সব জড়তা কেটে যেতে লাগলো। যে ভুল গুলো রিনি করতো সব সেগুলো আর হতো না। রিনিও সৌমীর মতোই ভালো নাচতে শিখে গেলো। এই দেখে রিনির ও সৌমীর বাবা মা খুব খুশি হয় । আর সব থেকে বেশি খুশি হয় তাদের নাচের ম্যাডাম রিনির এই পরিবর্তন দেখে । তারপর থেকে রিনি সৌমি মন দিয়ে নাচের নানান কলা কৌঁসুলি শিখতে থাকে। স্কুল প্রোগ্রাম থেকে শুরু করে তাদের নাচের গন্ডি আরও দুরে যায় । তাদের নাচের স্কুল থেকেও নানা অনুষ্ঠানে একসাথে নাচের প্রোগ্রাম করে অনেক মেডেল ট্রফিও পায় তারা। আজকের এই রিনি কে দেখে কেউ বলবে না যে এই রিনি এক সময় নাচ কে এতো ভয় পেত। এখন নাচ তার জীবনের ধ্যান জ্ঞান হয়ে দাড়িয়ে ছিলো ।
এই ভাবে কেটে যায় ১৩ টা বছর , এখন তারা দুজনেই বিবাহ যজ্ঞা। আর সৌমীর বাবা রিটায়ারমেন্টের পর অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য সৌমীর বিয়ে দিয়ে দেন তাড়াতাড়ি । মেদিনীপুরের এক বোনেদী পরিবারের ব্যবসায়ী ছেলের সাথে বিয়ে হয় সৌমির। সৌমির বিদায়ের সময় অনেক কান্নাকাটি করলে রিনি । তার এক মাত্র সই চলে শশুর বাড়ি যাওয়ার পর রিনি এক হয়ে পরে খুব । এই দেখে তার ১ বছরের মধ্যেই রিনির বাবাও রিনির বিয়ে ঠিক করে দেন। রিনি বিয়ের পর চলে যায় জোকা। রিনির হাসবেন্ডের নাম ছিল অভিরুপ । সে ছিলো এক বেসরকারি আই টি কোম্পানির ইনজিনিয়া । এর পর সেই শেষ দেখা হয় রিনির সাথে সৌমির । তার পরের বছর সৌমির বাবা মারা জান , আর তারপর, সৌমির মা তাদের পৈতৃক বাড়ি বেচে দিয়ে চলে যায় সৌমির কাছে । দুই এতো কাছের বন্ধু চলে গেলো একে ওপরের থেকে অনেক দূরে। প্রথম দুই বছর জামাইষষ্টীতে দুই বন্ধুর দেখা হলেও সৌমীর বাবা মারা গেলে। তাদের বাড়ি বেচে দিয়ে সৌমীর কাছেই চলে যায়। শেষ কথা হয়েছিল রিনির সাথে সৌমির এই যে বিয়ের পর সৌমীর নাচ একদম বন্ধ হয়ে যায় । বনেদী বাড়ি তাদের নাচ করা ওরা পছন্দ করে না । অনেক অনুরোধ কান্নাকাটি করার পরেও তার বড় ও পরিবারের থেকে নাচ চালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ পায়নি সে । সৌমি রিনির দুহাত ধরে বলেছিলো তুই কিন্তু নাচ বন্ধ করবি না রিনি । সেই কথা এখনও মনে পরে রিনির ।
অন্য দিকে রিনির বড় আভিরুপ ছিল খুব ফ্রিনেডলী । বিয়ের পর রিনির নাচের কথা শুনে তাকে আরও উৎসাহিত করে অভিরুপ। রিনিও তার সেই পরম বন্ধু উপহার তার সেই নাচ কে চালিয়ে যায়। আজ প্রায় কেটে গেছে ১০ বছর সৌমীর কোনও খবর জানেনা রিনি । না এই ১০ বছরে একবার দেখা হয়েছে তার সৌমীর স
াথে। রিনির সব সময় সৌমির কথা মনে পরে । রিনির বড় সিভিল ইঞ্জিনীয়ার ছিল। তাই মাঝে মধ্যই রিনির হাসব্যান্ড কে শহরের বাইরে যেতে হতো। এই জন্য রিনি একাকিত্ব কাটানোর জন্য নিজের বাড়িতেই একটা নাচ শেখানোর স্কুল খুলেছিলো। আর এই স্কুল খুলতে রিনির হাসব্যান্ড ও সমান সাহায্য ও উৎসাহ দিয়েছিলো রিনি কে। রিনিও সেই স্কুল নিয়ে খুব আনন্দে থাকতো। কারণ এই নাচের মধ্যে দিয়ে সে তার মনে বাঁচিয়ে রেখেছিলো তার বন্ধু সৌমীর সব স্মৃতিকে। কত চেষ্টা করেও কোনো খোঁজ পাইনি রিনি তার। শুধু রয়ে গিয়েছিলো রিনির বিয়েতে তোলা সৌমীর সাথে ছবি গুলো তার ফটো এলবামের পাতায়।
এরপর একবার রিনির হাসব্যান্ড মালদা জেলায় গিয়েছিলো কাজের জন্য। প্রায় ১০ দিন পর ফেরে অভিরুপ সন্ধ্যা বেলায় । সে রিনিকে কিছু না জানিয়ে চলে আসে সে। রিনি দরজা খুলে দেখে যে অভিরূপ হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে দরজাটা আড়াল করে। রিনি অভিরূপের এই সব কায়দা গুলো জানতো। যখনি সে রিনির জন্য কোনো গিফট নিয়ে আস্ত তখনি সে এমন করতো। রিনিও অভিরূপের এই আপভাব দেখে বলে কি মহারাজ আজ কি এনেছেন আমার জন্য। অভিরূপ হেসে বলে আজ তোমার জন্য সত্যি মহা গিফট এনেছি রিনি। রিনি এবার বিরক্ত হয়ে বলে কি এনেছো এবার দেখাবে। অভিরূপ বলে তুমি নিজেই দেখে নাও না , এই বলে দরজা থেকে সরে যায় অভিরূপ। সামনে তাকিয়ে রিনি দেখে সৌমি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। রিনি অবাক ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো কিছু সময়ের জন্য। অভিরূপ বলে কিগো কেমন লাগলো আমার আনা গিফট। রিনি যেন অভিরূপের কোনো কোথায় শুনতে পেলোনা। সোজা পা পা করে চলে গেলো সৌমীর দিকে। সৌমিও নীরব চোখে তাকিয়ে ছিল রিনির দিকে। রিনি সৌমির কাঁদে হাত দিয়ে সৌমীকে পরম যত্নে বুকে টেনে নিয়ে প্রাণ ভোরে কাঁদতে থাকে। সৌমিও রিনিকে জড়ায়ে ধরে কেঁদে ফেলে। তারপর রিনি চোখের জল মুছে অভিরূপের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে তুমি কোথায় পেলে সৌমি কে। অভিরূপ বলে সব বলবো , আর এখন থেকে সৌমি আমাদের সাথেই থাকবে। রিনি বলে মানে। তারপর সৌমির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলে সত্যি সৌমি সত্যি তুই আমাদের সাথে থাকবি , কিন্তু তোর বড় কিছু বলবেনা। অভিরূপ বলে তুমি আগে সৌমিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে ওর ঘরটা দেখিয়ে দাও , ওকে ফ্রেশ হতে দাও আমি তোমাকে সব বলছি। রিনি কিছু বুঝতে পারলো না। এতো দিনের পর দেখা হওয়ার পরেও সৌমি রিনির সাথে কথা বলছে না , মনটা মরা করে চুপ করে আছে। রিনি সৌমিকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে ওয়াশরুম টা দেখিয়ে দিলো। তারপর হল ঘরে এসে অভিরূপকে ধরলো। রিনি বললো সৌমীর কি হয়েছে গো ও এমন হয়ে গেছে কেন। অভিরূপ বলে ৩ দিন আগে অভিরুপদের অফিসে কাজের জন্য ইন্টারভিউ দিতে আসে সৌমি। অভিরূপ সৌমিকে চিনতো , তাদের বিয়েতে দেখেছিলো। অভিরূপের সৌমীকে দেখে প্রথমে চেনা চেনা লাগে। তারপর সৌমির সিভি টা নিয়ে দেখে যে এই হলো সৌমি। তখন ওর সাথে কথা বলে অভিরূপ রিনির কথা বলতে সে কেঁদে ফেলে সৌমি । তারপর অভিরূপ সব কিছু জানতে চাইলে সৌমি সব বলে। ৩ বছর আগে সৌমির হাসব্যান্ড মারা গেছে , তারপর ওর শশুর বাড়ির লোকেরা ওকে আর ওর মা কে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। যাওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিলোনা তাদের। সৌমির মায়ের ব্যাঙ্ককে সৌমীর বাবার পেনসেন ও বাড়ি বিক্রির যা টাকা ছিল সেই দিয়ে তারা মালদা শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতো। কিন্তু চিন্তায় চিন্তায় সৌমির মায়ের অসুখ হয় , মায়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে যেকুটু টাকা ছিল সেটাও চলে যায় । কিন্তু মা কে বাঁচাতে পারে না সৌমি। তারপর যখন হাত একদম খালি হয়ে গেলো। তখন সৌমি চরকির জন্য ঘুরতে থাকে , আর অভিরূপের অফিস দেখা হয়ে যায় সৌমীর সাথে। এর মধ্যই সৌমি সেই ঘরে চলে আসে। এখন সৌমি কে একটু স্বাভাবিক লাগলো রিনির। রিনি কে দেখে সৌমি বললো কিরে থাকতে দিবিতো আমাকে তোর কাছে। রিনি মুহূর্তে কেঁদে ফেলে আর ছুতে গিয়ে সৌমীকে জড়িয়ে ধরে বলে তুই সারাজীবন আমার কাছে থাকবি তোকে আমি কোথাও যেতে দেব না। সব শুনেছি আমি সব , আমরা দুই বন্ধু আবার একসাথে থাকবো ঠিক যেমন আগে থাকতাম। সৌমি চুপ করে রইলো শুধু তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকলো। যেন সৌমির বুক ফাটলেও মুখ খুলছে না। যেন শক্ত পাথরের মতো হয়ে গাছে রিনি। রিনি বলে জানিস সৌমি তুই আমাকে সেই মনোহরদের আম বাগানে জোর করে নাচতে শিখিয়ে ছিলি । আমার বিয়ে তে আমার হাত ধরে বলেছিলি যেন আমি কখনও নাচ বন্ধ না করি ।সৌমি আমি আজ বন্ধ করিনি রে তোর সেই সেখানো নাচ। জানিস আমার নিজের একটা নাচের স্কুল আছে আমার বাড়িতেই। আমি সেটা চালাই , এবার থেকে আমরা দুজনে মিলে চালাবো এই স্কুল। আরও বড়ো করে তুলবো এই স্কুল কে আমাদের দুজনেরই তো স্বপ্ন ছিল এই নাচ । অভিরূপ বলে হ্যাঁ ঠিক বলেছো রিনি , তুমি আর সৌম মিলে সাজিয়ে তোলো এই স্কুল কে তোমাদের স্বপ্ন কে । আমি না হয় একটা বাড়ি ভাড়া করে দেব তোমাদের স্কুল বড়ো করার জন্য । ঠিক তখন সৌমি সবাই কে অবাক করে বলে ওঠে না আমি নাচ শেখাতে পারবো না আমি সব কিছু ভুলে গেছি। রিনি বলে কি বলছিস তুই নাচ ছিল তোর প্রানের থেকেও প্রিয় । আর আজ তুই বলছি নাচ তুই ভুলে গেছিস । সৌমি বলে আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে আমার মধ্যে আর কিছুই বেচে নেই । তোর সেই বন্ধু আর বেচে নেই রে সে তার সব স্বপ্ন মরে গেছে তার বিয়ের সাথে ই । এরপর রিনি আর অভিরূপ অনেক করে বুঝিয়েও রাজি করাতে পারলো না সৌমি কে ।শুধু সৌমি বললো আমাকে জোর করিস না রিনি তোকে না বলতে আমার খুব কষ্ট হয়। এই বলে চলে যায় সৌমি নিজের ঘরে। তারপর অনেক দিন কেটে যায়। রিনি রোজ তার বাড়িতে হল ঘরে নাচের ক্লাস করাতো । সৌমি দূর থেকে দেখলেও কখনো সেই হল ঘরে যেত না ওই সময়। রিনি সব কিছুই লক্ষ করতো , একদিন নাচ শেখাতে শেখাতে কোনো কাজে রিনি ঘরে গিয়েছিলো ফেরার পথে দেখে সৌমি সিঁড়ির পাশে দিয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোকে নাচ প্র্যাক্টিস করতে দেখে মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদছে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে তার। রিনি গিয়ে সৌমির কাঁদে হাত দিতেই সে তাড়াতাড়ি করে চোখের জল মুছে চলে যায়। অভিরূপ বাড়ি এলে রিনি সব কথা তাকে খুলে বলে । অভিরূপ বলে যে রিনির মনে তার দুঃখটা চেপে বসে আছে। তাই সৌমি নিজেকে এমন গুটিয়ে রেখেছে সব কিছুর থেকে। ওকে আনন্দ দিতে হবে , ওর বন্ধ মনের দরজা খুলতে হবে। তখন রিনি বলে ঠিক বলেছো তুমি , ওর মনের দোর খুলতে হবে । আর কি ভাবে ওর মনে দরজা খুলবে তা আমি খুব ভালো করে জানি । রিনি বলে তুমি অফিসে বলে তিন দিনের জন্য ছুটি নাও তো । আমরা রিনি কে নিয়ে এক জায়গায় যাবো । যেমন কথা তেমন কাজ , পরের দিন সকালেই তাড়া তিন জন মিলে বেড়িয়ে পরে তাদের প্রাইভেট গাড়ি করে । সৌমি জানতে চাইলেও রিনি সৌমিকে জানায় না যে তাড়া কোথায় যাচ্ছে । অভিরুপ নিজেই ড্রাইভ করছিলো পিছনে রিনি আর সৌমি বসে ছিলো । কোথায় যাচ্ছে কোনো ধারনা ছিলো না সৌমির ।তাই সৌমি গাড়ির মধ্যে মনমরা করে বসেছিল আর তাকিয়ে ছিল গাড়ির কাঁচের বাইরে দুধ দিগন্তের দিকে । এইভাবে ঘন্টাখানেক গাড়ি চলার পরে যখন তাদের গাড়ি মেন হাই রোড থেকে গ্রাম্য পথের রাস্তা নিলো । তখন থেকেই সৌমির মধ্যে একটা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলো রিনি ও অভিরূপ । সৌমি যেন চিনতে পেরেছে সেই জায়গা । সৌমির মনে যেন দাগ কাটছে এই জায়গায় । তারপর এক জায়গায় এসে গাড়িটা থামতে বলে রিনি । এবার সৌমি ভালো করে চিনতে পারে , হ্যাঁ এই হলো সেই পলাশ ডাঙা যেখানে গোটা ছেলে বেলা কেটেছে সৌমি ও রিনির। গাড়ি থামানোর সাথে সাথেই সৌমি গাড়ি থেকে নেমে প্রায় যেন ছুটতে আরম্ভ করে । যেন অনেক দিন পর এখানে এসে বাঁধন খোলা পাখির মতো ডানা মেলে দিয়েছে সে । সৌমি যেতে থাকে তার ছোট বেলার চেনা পথ দিয়ে, আর রিনি উজ্জ্বল চোখে সৌমির দিকে তাকিয়ে চলতে থাকে তার পিছু পিছু । ধান ক্ষেত পার করে সেই বাঁশের সাঁকো পার করে চলে আসে সেই মনোহরদের আম বাগানে । এখনও একি রকম আছে সেই বাগান । সৌমি সেই বাগানে এসে চারিপাশে দেখার পর মাটিতে হাঁটু গেরে বসে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে । সেই দেখে রিনি দৌড়ে যাচ্ছিল সৌমির কাছে ঠিক তখন অভিরুপ রিনি কে বাধা দিয়ে বলে । যেও না এখন ওর কাছে, ওকে একটু কাঁদতে দাও ওর মনের সকল দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা কে ধুয়ে যেতে দাও ওর ওই চোখের জলে । তারপর সৌমি চোখের জল মুছে নিজেই উঠে দাঁড়ায় । রিনি সৌমির কাছে গেলে রিনি কে সৌমি বলে তুই কেন আমাকে এখানে নিয়ে এলি । রিনি বলে তোকে বোঝাতে যে তোর জীবন শেষ হয়ে যায় নি তোর স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়নি আজও তা জড়িয়ে আছে এই আম বাগানের সাথে এই পুরো পলাশ পুরের সাথে । ফিরে আয় আমার বন্ধু ফিরে আয় তুই । মনে পরে এই বাগানে দাঁড়িয়ে তুই কুড়ি বছর আগে আমাকে কি বলে ছিলি যে তোর বন্ধু সব পারবে । আর তুই প্রমাণ করেও ছিলি তা । আমার মতো মেয়ে কে তুই শিখিয়ে ছিলি নাচতে । আর আজ তুই নিজে পিছিয়ে যাচ্ছিস । রিনি ব্যগ থেকে এক জোড়া ঘুঙুর বার করে বলে এই নে তোর সেই প্রিয় ঘুঙুর । সৌমি ঘুঙুর টা দেখে প্রায় হাত কয়েক দুরে চলে গিয়ে বলে না আমি পারবো না । রিনি বলে পারতেই হবে তোকে । সৌমির সে এক কথা আমি পারবো না । অনেক জোর করেও সৌমি রাজি না হওয়ায় । রিনি ঘুঙুর জোড়া ছুরে ফেলে দিয়ে বলে তুই এতো দিন আমার থেকে দুরে ছিলি তো দেখ এবার আমি তোর থেকে খত দুরে চলে যাই । এই বলে সেখানেই মাটিতে বসে মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকে রিনি । ঠিক তার কিছুক্ষণ বাদেইহালকা নূপুরের শব্দ পায় রিনি । সাথে সাথে ই সৌমির দিকে তাকিয়ে রিনি দেখে সেই আম গাছের পাশ থেকে বেড়িয়ে এলো সৌমি পায়ে তার ঘুঙুর । আর ঠিক সেই ছোট বেলা তে যেমন রিনি নাচের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে সৌমিকে ডেকে ছিলো । ঠিক সেই ভাবেই সেই ভঙ্গিতে হাত নেড়ে সৌমিকে ডেকে ছিলো । ঠিক সেই ভাবেই সেই ভঙ্গিতে সৌমি ডাকলো রিনি কে । রিনি বুজলো সৌমি রাজি হয়ে গেছে আবার নাচের জন্য । ফিরে এসেছে আবার সেই পুরনো সৌমি তার সেই চেনা বন্ধু । রিনি দৌড়ে গিয়ে সৌমিকে জড়িয়ে ধরে । তারপর কিছু দিন পর রিনিদের পাড়াতে সেই ভাড়া বাড়িতে বড় সাইনবোর্ড লাগানো হলো তার নাম " ফিরে পাওয়া নৃত্যালয় "।