STORYMIRROR

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Horror Classics Others

3  

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Horror Classics Others

পঞ্চমুন্ডীর আসন

পঞ্চমুন্ডীর আসন

7 mins
239

আমার কাকার নাম ছিল হারাধন পোদ্দার। হুগলি জেলার কৈকালা নামক গ্রামে তিনি বাস করতেন। সেই গ্রামের গুরু দয়াল পুর প্রাথমিক স্কুলে তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষক। টিটাগড়ের মতো শহরাঞ্চলে ছোট থেকে বড়ো হওয়ার পরেও ওনার মন বারে বারে ছুটে যেত গ্রাম বাংলার পল্লী প্রকৃতির দিকে। শহরের কচকচি থেকে সব সময় তিনি দূরে থাকাটাই বেশি পছন্দ করতেন। 

তাই প্রাইমারি স্কুল টিচার্স চাকরির পরীক্ষাতে ভালো ফল করার জন্য তিনি শহরাঞ্চলে পোস্টিংয়ের সুযোগ পেয়েও তা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ শহরের এই দূষিত পরিবেশে দম হয়ে আসতো ওনার। স্কুল কলেজের জীবন থেকেই তিনি যখনি সুযোগ পেতেন ছুঁটে যেতেন গ্রাম বাংলার বুকে। 

আমাদের পৈতৃক যে ব্যবসা ছিল সেই দিকেও কোনো নজরই দিতোনা কাকাবাবু। কেমন যেন বিবাগী ধরণের মানুষ ছিলেন তিনি। বাবা অনেক করে বুঝিয়ে ছিলেন কাকাবাবু কে ব্যবসার দিকে মন দেওয়ার জন্য। আর প্রতিবারই কাকাবাবু বলতেন এই সব ব্যবসার হিসাব নিকাশ আমার মাথায় একদম ঢোকেনা ; এই সব তুমি সামলাও দাদা। 

এরপর কৈকালা গ্রামের গুরু দয়াল পুর প্রাথমিক স্কুলে পোস্টিং পেয়ে সেখানেই চলে যান কাকাবাবু । আর তখন থেকে ওই কৈকালা গ্রামেই পাকাপাকি থেকে যান আমার তিনি। এই গুরু দয়াল পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনি ফোর্থ টিচার হিসাবে জয়েন করে প্রধান শিক্ষকের আসন পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন ওনার জীবন কালে । 

এই যে আমি আজ আমার কাকাবাবু কে নিয়ে এতো কথা বলছি আপনাদের কাছে । এর পিছনে একটা কারণ তো অবশ্যই আছে। সেটা আপনাদের নিশ্চয়ই বলবো ; আগে একটু আমার পরিচয়টা দিই আপনাদের। আমার নাম হলো বিপ্লব পোদ্দার। আমার বাবার নাম ধনঞ্জয় পোদ্দার , টিটাগড়ের পৈতৃক বাড়িতেই বাস করি আমরা। আমার দাদু ঠাকুমা বেঁচে থাকতে কাকাবাবু যদিও বা আসতেন আমাদের এই টিটাগড়ের বাড়িতে। দাদু ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর উনি একদমই এখানে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। 

আমার কাকাবাবু ছিলেন অকৃতদার ; বিয়ে তিনি করেননি। তাই সংসারের প্রতি তেমন কোনো টানও ছিলো না ওনার। সংসারের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়াটা হয়তো কাকাবাবুর পছন্দ হয়নি। তবে আমাকে উনি খুব ভালোবাসতেন । স্কুলের ছুটি পড়লেই আমাকে ওনার কাছে গিয়ে থাকার কথা বলতেন । আমিও অনেকবার গিয়েছিলাম ওনার কাছে। কিন্তু হাই স্কুলে ওঠার পর থেকে আর তেমন সময় পেতামনা কাকাবাবুর কাছে গিয়ে থাকার । খুব ছোট বেলায় গিয়ে থাকতাম সেখানে ; তাই এখন আর তেমন কিছু মনেও পরে না। কিন্তু একটা ঘটনা আজও আমার স্মৃতিতে গভীর দাগ কেটে বসে আছে। যে কথাটা না আমি আজও ভুলতে পেরেছি যার ; আর না কোনোদিন পারবো । কারণ সেই ঘটনার কোনো যুক্তি বা ব্যাখ্যা আমি আজও খুঁজে পাইনি। । 

অনেক বছর কেটে গেছে কাকাবাবুর সাথে আমাদের আর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। 

আমি তখন কলেজে সবে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। একদিন কৈকালা গ্রাম থেকে একজন লোক আসে আমাদের বাড়িতে। আর সাথে নিয়ে আসে এক হৃদয়মর্মি সংবাদ। সেটা ছিল আমার ছোট কাকার মৃত্যু সংবাদ। সেই সংবাদ পেয়ে আমি আর বাবা তখনি বেরিয়ে পড়ি কৈকালা গ্রামের উদ্যেশে। যেহেতু কাকাবাবুর কোনো সন্তান ছিলোনা না ; তাই আমাকেই ওনার শেষ কৃত্যের সব কাজ করতে হয়। কাকাবাবুর শেষ কৃত্ত সম্পন্ন করার জন্য ওনার দেহ নিয়ে যাওয়া হয় কৈকালা গ্রামের সব থেকে পুরোনো ও প্রাচীন বৈচিকাটার শ্মশানে। একটা বড়ো মাঠের ধারে ছিল এই বৈচিকাটার শ্মশান ; তাই এই মাঠটার নামই হয়ে গিয়েছিলো বৈচিকাটার মাঠ। 

সময় তখন দুপুর দুটো মতো হবে। সব রকমের আচার বিচার সম্পন্ন করে আমি মুখাগ্নি করলাম কাকাবাবুর। তারপর গ্রামের যিনি মুখিয়ে তিনি আমাকে ডেকে বললেন মুখাগ্নির পর নাকি আর সেই ব্যাক্তির শেষ কৃত্ত দেখতে নেই। তাই আমি সেখান থেকে একটু তফাতে চলে গেলাম। যাতে সেখান থেকে কাকাবাবুর অগ্নিদগ্ধ চিতা খানা দেখা না যায়। আমাদের শহরাঞ্চলে যেমন শ্মশান গঙ্গার ধরে হয়। এখানে কিন্তু তেমন না , কারণ এখানে গঙ্গা নেই । তবে একটা ছোট হাতে কাটা খাল মতো ছিল এই শ্মশানের সাথে সংলগ্ন। আমি সেই দিকেই এগিয়ে গেলাম। ওই খালটিতে নামার জন্য একটা ঘাট মতো করা ছিল। সম্ভবত শবদেহ দাহ করার পর মনে হয় এই ঘাট ব্যবহার করা হয়ে থাকে । 

আমি ওই ঘাটটিতে গিয়ে বসলাম। কি সুন্দর পরিষ্কার ও টলটলে জল এই খালের ; দেখে মনটা ভোরে গেলো। বিকাল তখন তিনটে মতো বাজে । বিকালের সেই শান্ত পরিবেশে নানা রকমের পাখির মধুর ডাক সব কিছু মিলিয়ে পরিবেশটাকে আরও যেন মনোরম করে তুলেছিল। 

তারপর আমার চোখ যায় শ্মশানের সংলগ্ন একটা বড়ো বট গাছের দিকে। গাছটার নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ খানিকটা অংশ মাটির বেদির মতো করে বাঁধানো ছিল। আর তার উপর গোল করে সাজানো ছিল পাঁচটা খানা নরমুণ্ড । সেই নরমুণ্ড গুলোর গোল গোল কঠোর গত চোখ গুলো যেন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে তাকিয়ে আছে বলে মনে হলো । আমি আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখে বুঝি । না ; এতো শুধু নরমুণ্ড না এতো নরমুণ্ড মালা। কারণ একটা বেশ মোটা লাল রঙের সুতো বা দড়ি মতো দিয়ে ওই পাঁচটা নর মস্তক এক ধাগায় বাধা ছিল । এই নরমুণ্ড গুলো এখানে কেনই বা রাখা তার কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি । এই দৃশ্য দেখে আমি খুব আশ্চর্য হলাম। সেই নরমুণ্ড গুলোর ঠিক পাশেই দেখি মাটিতে পোতা ছিল একটা বড়ো ত্রিশুল। সেই ত্রিশুল ও সব কটা নরমুণ্ডতে সিঁদুর মাখানো ছিল ; আর গোটা মাটির বেদীটা সাজানো ছিল লাল ফুলে দিয়ে। দেখে মনে হচ্ছিলো কিছু আগেই যেন কেউ এসে এই সিঁদুর ও ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়ে গেছে এই বেদি খানা। আমি এই জিনিস আগে কখনো দেখিনি। তাই আমার বন্ধুদের দেখাবো বলে পকেট থেকে ফোনটা বার করে ওই নরমুণ্ড গুলোর বেশ কিছু ফটো আমি তুলে নিলাম। তার সাথে ওই খাল সংলগ্ন পাশের জায়গার বেশকিছু ফটো তুললাম। ফোনের গ্যালারি খানা খুলে সবে ফটো গুলো কেমন হয়েছে সেটা দেখতে যাবো। এমন সময় দেখি গ্রামের মোড়ল মশাই আমার দিকেই হেটে এগিয়ে আসছেন। উনি আসতে আমি ওনার থেকে জানতে চাইলাম ; আচ্ছা এই নরমুণ্ড গুলো এখানে এই ভাবে সাজিয়ে রাখা কেন। তখন মোড়ল মশাই বললেন ; এটা হচ্ছে চন্ডীচরণ বাবার পঞ্চমুন্ডির আসন। আমি বলে উঠি পঞ্চমুন্ডির আসন সেটা আবার কি। মোড়ল মশাই বলেন ; আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এই বৈচি কাটার শ্মশানে বাস করতেন চন্ডীচরণ বাবা। রক্ত বস্ত্র ছাড়া তিনি অন্য কিচুই পরিধান করতেন না। আর এই বট তলাতেই তিনি প্রতি অমাবস্যার মধ্যেরাতে এই বাঁধানো বেদির উপর ওই পঞ নরমুণ্ড মালা পরে পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসে শব সাধনা করতেন। গ্রামের সকল গ্রামবাসী কোনো রকমের বিপদ আপদে পড়লে ছুঁটে আসতো এই চন্ডীচরণ বাবার কাছে । বাবার আশীর্বাদে গ্রামের মানুষদের সব বিপদ বাধা কেটেও যেত। বাবা কে এই গ্রামের সবাই ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। বাবার জন্য রোজ গ্রামের কেউ না কেউ ঠিক ভোগ রান্না করে অর্পণ করে যেত। তাই আজও এই গ্রামের মানুষ এই পঞ্চমুন্ডীর বেদির ও নরমুণ্ড গুলোর উপর সিঁদুর ও ফুল দিয়ে তাদের মনস কামনা জানিয়ে যায়। 

এই সব কথা শুনে আমি আবার সেই পঞ্চমুন্ডি আসনের আরও কিছু ভালো ছবি তোলার জন্য ফোনটা বার করতেই মোড়ল মশাই আমাকে বাধা দিয়ে বলে ওঠে। না বাবা না ; এই কাজ খানা একদম করো না। চন্ডীচরণ বাবা ওনার ছবি তোলা একদম পছন্দ করতেন না। উনি জীবিত কালে ওনার মহিমার কথা শুনে অনেকে অনেক বার বাবার ও এই পঞ্চমুন্ডীর আসনের ফটো তোলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কেউই সফল হতে পারেনি। এমন কি বাবার মৃত্যুর পরও অনেকে বাবার এই পঞ্চমুন্ডি আসনের ফটো তোলার চেষ্টা করেছে ; কিন্তু সফল কেউ হতে পারেনি। এই পঞ্চমুন্ডীর আসন যেন আমাদের কৈকালা গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এই হয়তো চাইতেন বা এখনো চান চন্ডীচরণ বাবা। 

এই কথা শুনে আমি মনে মনে মুচকি হেসে ফোনটা পকেটে রেখে দিলাম । আর এই মোড়ল মশাইয়ের বানানো মনগড়া কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে এই গ্রাম এখনো অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারে ডুবে আছে। কারণ মোড়ল মশাই বললো যে চন্ডীচরণ বাবার মৃত্যুর পরও নাকি কেউ এই পঞ্চমুন্ডীর আসনের ছবি তুলতে পারেনি। যেখানে এখন আমার মোবাইলেই এই পঞ্চমুন্ডি আসনের প্রায় দশ থেকে বারোটা ফটো গচ্ছিত হয়ে গেছে। আর এই ফটো গুলো এই গ্রাম থেকে বাইরেও চলে যাবে আমার সাথে। এই গ্রামের চন্ডীচরণ বাবাও কিছু করতে পারবেনা। এই ভেবে নিজের মনেই হেসে ওঠি আমি। 

তারপর কাকাবাবুর সব কাজ কর্ম মিটে গেলে আমি যখন বাড়ি চলে আসি। বাড়ি এসে আমি আমার মায়ের কাছে গল্প করি। জানো মা ওখানে বৈচিকাটার শ্মশানে আমি আসল নরমুণ্ড দেখেছি। তাও আবার আবার পাঁচ খানা একসাথে , তারপর দেখি ওটা একটা নর মুন্ডো মালা। মোড়ল মশাই বলছিলো ওই মালা পরে নাকি ৫০ বছর আগে চন্ডীচরণ বাবা পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসতেন । মা শুনে বলে তাই নাকিরে , তাহলে খুব ভালো জিনিস দেখে এলি বল। আমি বললাম তুমি দেখবে ; দাড়াও আমি ফটো তুলে এনেছি অনেক গুলো এই পঞ্চমুন্ডীর আসনের। 

কিন্তু পকেট থেকে ফোন বার করে ; ফোনের গ্যালারি খুলে আমি অবাক হয়ে যাই। সেই পঞ্চমুন্ডীর আসনের এতো গুলো ফটো তুললাম , কিন্তু এখন দেখি একটাও ফটো নেই আমার ফোনে। এদিকে বৈচিকাটা সেই খালের ও বৈচিকাটা মাঠের অন্যান্য সব কটা ফটো আছে গ্যালারি জুড়ে। শুধু সেই পঞ্চমুন্ডীর আসনের তোলা একটাও ফটো আমি দেখতে পেলাম না আমার ফোনে। আমি একটু অবাক হলাম । 

এদিকে আমি ফোন থেকে একটাও ফটো ডিলিট করিনি। সত্যি বলতে সেই মোড়ল মশাইয়ের সাথে কথা বলার পর থেকে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত মোবাইলের গ্যালারিটাও ওপেন করিনি আমি । তাহলে কিভাবে ফটো গুলো ফোন থেকে উধাও হয়ে গেলো। তাও আবার শুধু মাত্র পঞ্চমুন্ডীর আসনের তোলা ফটো গুলোই। তখনি আমার হঠাৎ মনে পরে যায় মোড়ল মশাইয়ের বলা সেই কথা গুলো। আজ পর্যন্ত কেউ চন্ডীচরণ বাবার ও তার পঞ্চমুন্ডীর আসনের ছবি তুলতে সফল হয়নি । না বাবার মৃত্যুর আগে না মৃত্যুর পরে। সকলেই নাকি অসফল হয়েছে এই কাজে। আর আজ আমিও অসফল হলাম। মোবাইলে ফটো তুলেও সেই ফটো গ্রামের বাইরে আনতে পারলাম না আমিও। তার মানে ওই মোড়ল মশাইয়ের কথাই ঠিক হলো। কেউ এই বৈচিকাটার শ্মশানের এই পঞ্চমুন্ডীর আসনের ফটো তুলে নিয়ে যেতে পারবেনা। চন্ডীচরণ বাবার তা পছন্দ নয়। 

যদিও আজ পর্যন্ত আমি এই ঘটনার কোনো বিজ্ঞান সম্মত যুক্তি খুঁজে পাইনি। তাও আমার মনে একটাই প্রশ্ন বারে বারে আসে। যদি ফটো গুলো ফোন থেকে ডিটেলে হয়ে গিয়ে থাকে বা অন্য কিছু ভাবে কিছু হয়ে থাকে। তাহলে শুধু মাত্র ওই পঞ্চমুন্ডীর আসনের তোলা ফটো গুলোই বা কেন ফোন থেকে উধাও হলো , বাকি গুলো কেন না।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror