সরস্বতী নদীর তীরে
সরস্বতী নদীর তীরে
পলাশীর উত্তরে অবস্থিত গিরিয়ার পাস দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সরস্বতী নদী। আর এই বিরামহীন সরস্বতী নদীর চঞ্চল জলস্রোতের দিকে এক মনে তাকিয়ে বসে ছিল অহনা। গিরিয়ার এই ভৈরবতলা নামক ঘাটের উপর দিয়েই বয়ে চলেছে সরস্বতী নদী। তার উত্তাল জলরাশির উপর বৈকালের পরন্ত রোদ পরে সোনালী রং ধারণ করেছে। আর সেই আলোর প্রতিফলনে অহনার চোখে ফুটে ওঠে ফেলে আসা দিনের মধুর রঙিন স্মৃতি কথার প্রতিচ্ছবি।
অনেক দিন পর গিরিয়ার এই ভৈরবতলার ঘাটে সরস্বতী নদীর তীরে আবার ফিরে এলো অহনা। আজ জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। যৌবন বিদায় নিয়েছে তার জীবন থেকে অনেক আগেই। তাই আজ সে একদম একা তার এই নিসংঘ জীবনে। ডোর থেকে কেটে যাওয়া ঘুড়ি যেমন নিস্তরঙ্গ ভাবে ভেসে চলে অজানার পথে। কোনো দিক দিশা ঠিকানা হীন ভাবে সে শুধুই ভেসে যায় হওয়ার সাথে তালমিলিয়ে। আজ তেমনি জীবন বাতাসে দিক দিশা তরঙ্গহীন ভাবে ভেসে চলেছে সেও সুদূর অজানার উদ্যেশে। এই উত্তাল সরস্বতী নদীর জলরাশি যেমন অবিরাম ও বাধাহীন ভাবে বয়ে চলেছে অজানা প্রবাহে মিলিত হওয়ার আসায়। তেমনি সেও আজ বয়ে চলেছে জীবন জোয়ারে তেমন কোনো এক খড়কুটোকে আঁকড়ে ধরার প্রত্যাশা বুকে নিয়ে।
জীবনের বেলা শেষে তাই সে ফিরে এসেছে সেই স্থানে , সেই সরস্বতী নদীর তীরে। যেখানে সে তার জীবনের সব কিছু প্রথম খুঁজে পেয়েছিলো একদিন । আজ থেকে ত্রিরিশ বছর আগে এই ভৈরবতলার ঘাটেই তার সাথে দেখা হয়েছিল অখিলের। আর অখিলের হাতের মুঠোতেই ভালোবাসার জমাট উষ্ণতা খুঁজে পেয়েছিলো অহনা। প্রকৃতির নিয়ম মেনেই তাদের ভালোবাসা পরিণয় পায় সুখী দাম্পত্য জীবনের।
কিন্তু তার উত্তাল যৌবন প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে নষ্ট করে ফেলে একটা সুন্দর সম্পর্ককে। প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে সে চরম আঘাত হানে অখিলের হৃদয়ে। আর এই যৌবনের উন্মাদনা তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে মরীচিকার অলীক আহ্বানের ডাকে। প্রলোভনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে যৌবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত যেদিন নিঃশেষিত হয় তার। তখন এই বিশাল পৃথিবীতে সে হয়ে পরে একদম একা। নিভে যায় তার চারিদিকে প্রলোভনের সমস্ত প্রজ্বলন্ত মরীচিকার আলো। তখন সে বুঝতে পারে যৌবনের উন্মাদনা তাকে কোথায় এনে ফেলেছে।
আজ যখন তার জীবনের আর কিছুই বেঁচে নেই। কোনো দিক নেই কোনো দিশা নেই , নেই কোনো ঠিকানা । তাই তার জীবনের শেষের দিনে সে আবার ফিরে আসে সেই জায়গাতেই , সেই সরস্বতী নদীর তীরে। যেখান থেকে সে সব কিছু পেয়েছিলো একদিন। আবার তা হারিয়েও ফেলেছিলো তার নিজের ই ভুলে । এই সব কথাই মনে মনে ভেবে তার জীবনের অনিশ্চিয়তার কথা কল্পনা করে অস্পুট ভাবে কাঁদতে থাকে অহনা। তার চোখ থেকে নিঃশব্দে ঝরতে থাকে জলের ধারা। মনে মনে সে শুধুই একই কথা ভাবতে থাকে। এই সরস্বতী নদীর জল বয়ে বয়ে কোনো না কোনো মোহনায় ঠিক মিলিত হবে। কিন্তু আজ সে সব কিছু হারিয়ে এই জীবন জোয়ারে কোথায় গিয়ে মিলবে কোন মোহনায় , এর কোনো উত্তর তার জানা ছিল না তার।
ঠিক এমন সময় তার পিছন দিয়ে একটা প্রৌঢ় পুরুষালি কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো ------
পেলেই কি বা জীবনে তুমি , আর হারালেই বা কি ?
জীবন তোমার শেষ হয়নি ,কিছু তো আছে বাকি।
এই লাইন দুটো বলেই একজোড়া হাত শক্ত করে এসে চেপে ধরলো অহনার প্রৌঢ় হাত দুটিকে । পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে যায় অহনা। তার সামনে তখন দাঁড়িয়ে আছে অখিল। অহনার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে প্রৌঢ় অখিল অশ্রুস্নাত চোখে বলে ওঠে। তোমার জন্য ত্রিশ বছর ধরে রোজ অপেক্ষা করেছি এই নদীর ঘাটে।তোমার ফেরার আসায়। বড়ো দেরি করে দিলে তুমি আসতে। অহনা তখন উঠে দুহাতে অখিলকে জড়িয়ে ধরে প্রাণ খুলে কেঁদে ওঠে । অখিলও তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে অঝোর ধারায়। আবার মিলে যায় দুটি মন দুটি হৃদয়। আবার শুভ পরিণয় পায় তাদের ভালোবাসা এই সরস্বতী নদীর তীরে। এই সরস্বতী নদীর তীরেই সব কিছু পেয়েও হারিয়ে ফেলেছিলো অহনা। আবার এই সরস্বতী নদীর তীরেই সব কিছু ফিরে পেলো অহনা জীবনের শেষে ।
তাই বলি ভুল মানুষ মাত্রই হয়। তাই বলে নিজের ভুল বুঝতে পারার পরেও নিজের আপন জনদের থেকে দূরে থাকতে নেই। সব কিছু ভুলে আবার ফিরে আসতে হয়। কারণ যেখানে জীবন শেষ হয়ে যায় , আবার সেখান থেকেই নতুন জীবনের শুরুও হয়।