শেষ যাত্রা
শেষ যাত্রা
ট্রেনের জানালার ধারে বসে আধো ঘুমে ঢুলছিলেন কমলাকান্ত বাবু। বয়স ওনার দুকুড়ি পার হলেও দেহ ও মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উৎফুল্ল ও প্রাণবন্ত একজন মানুষ । তবুও সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে অফিস যাওয়ার সময়। যদি ট্রেনে বসার জায়গা পাওয়া যায়। তাহলে সব বাঙালির চোখ ই আপনা থেকেই বুজে আসে । তাই কমলাকান্ত বাবুর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটলো ।
আজ কমলাকান্ত বাবু ট্রেনের কামরায় বসার জায়গা পেয়ে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কোনো এক স্টেশনে এসে ট্রেনটা বেশ জোরে একটা হ্যাচকা মেরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে। ঘুমটাও ভেঙে গেলো কমলাকান্ত বাবুর। ঘুম জড়ানো ঢুলু ঢুলু চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে একবার স্টেশনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। আর স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ই অবাক হয়ে গেলেন কমলাকান্ত বাবু । এক ঝটকায় ঘুমের রেশ উড়ে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন কমলাকান্ত বাবু। আর এই উত্তেজনার কারণ হলো স্টেশনের মাঝে হলুদ হোডিং-এ লেখা নাম খানা। ওই হোডিং-এ লেখা ছিল নাম না জানা এক অদ্ভুত ধরণের নাম এবং সেই নামটা হলো " শেষ যাত্রা "। বাংলা হিন্দি ইংরেজি এই তিন ভাষাতেই লেখা আছে নামটা " শেষ যাত্রা "।
ততক্ষনে ট্রেনের সব যাত্রীরা যথারীতি ট্রেন থেকে মানতে শুরু করে দিয়েছে স্টেশন চত্বরে। স্টেশন কর্তৃপক্ষ থেকে মাইকে বলা হচ্ছে।" শেষ যাত্রা " এক্সপ্রেসের এই হলো অন্তিম স্টেশন। " তাই দয়া করে সকল যাত্রীদের জানানো হচ্ছে আপনারা দোয়া করে ট্রেনের কামরা খালি করে দিন আর নিজের নির্ধারিত কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গিয়ে সুষ্ঠ ভাবে লাইন দিয়ে নিজের পরবর্তী অবস্থা সম্মন্ধে জেনে নিন "।
এই সব কান্ড কারখানা দেখে শুনে কমলাকান্ত বাবুর তো মাথায় হাত পড়ার জোগাড়। রোজ ই তো উনি শিয়ালদাহ স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে রোজ ডানকুনি স্টেশনে নামেন। তাহলে আজ এই "শেষ যাত্রা" স্টেশন কোথা থেকে চলে এলো। তাহলে কি তিনি কোনো ভাবে ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছেন । কিন্তু ভুল ট্রেনে উঠলেও এই " শেষ যাত্রা " নামের কোনো স্টেশনের কোথা তো তিনি কোনোদিন শোনেননি। ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য তিনিও বাকি যাত্রীদের সাথে নেমে পড়লেন সেই নাম না জানা অপরিচিত স্টেশনে " শেষ যাত্রা "তে।
এবার স্টেশন চত্বরে নেমে তো কমলাকান্ত বাবুর আরও অবাক হওয়ার পালা। কারণ ট্রেন থেকে মেনে সামনে তাকিয়ে তিনি দেখেন বিশাল বড়ো খোলা সাদা ধবধবে খোলা প্রান্তরের মতো ফাঁকা জায়গা। যত দূর পর্যন্ত চোখ যায় শুধুই এই সাদা আলোর বাহার বিস্তিতি ভাবে ছড়িয়ে আছে দূর দিগন্ত পর্যন্ত। যেন তার কোনো পরিসীমা নেই । আর এই খোলা প্রাঙ্গন সময় জায়গার উপর ট্রেনের থেকে আগত মানুষেরা যে যার মতো ছোট ছুটি শুরু করে দিলো নিজ নিজ উদ্যেশে।
আবার মাইকে স্টেশন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে নির্দেশ বাণী শোনা গেলো। " শেষ যাত্রী " এক্সপ্রেসে থেকে আগত সকল যাত্রীদের জানানো হচ্ছে তারা যেন তাদের নির্ধারিত কাউন্টার নম্বরে গিয়ে নিজের পরবর্তী অবস্থার সূচি সম্মন্দে জেনে নেন । এর পরেই মাথার উপর দিকে তাকাতেই কমলাকান্ত বাবু খেয়াল করলেন। সাদা পুরু আলোর ছটার মধ্যে থেকে পরিস্ফুটিত হলো বড়ো বড়ো ডিজিটাল ভিজ্যুয়াল স্ক্রিন। ঠিক যেমনটা আমরা দেখতে পাই হাওড়া বা শিয়ালদাহ স্টেশনের টাইম টেবিল হিসাবে।
আর পরেই সামনের ফাঁকা চত্বরে আভির্ভুত হলো ট্রেনের টিকিট কাউন্টারের মতো অসংখ্য কাউন্টার এবং সেই প্রতি কাউন্টারে লাইন দিয়ে ভিড় জমিয়েছে "শেষ যাত্রী " এক্সপ্রেস থেকে মানুষেরা । তাদের পরবর্তী অবস্থার সূচি জানার জন্য। কমলাকান্ত বাবুর বড়োই অদ্ভুদ লাগতে লাগলো এই সব কান্ডকারখানা । নিজেকে প্রশ্ন করেও এই দৃশ্যের কোনো উত্তর ও বেখ্যা তিনি খুঁজে পেলেন না।
এবার কমলাকান্ত বাবুর চোখ গেলো মাথার উপরের বড় বড় ডিজিটাল স্ক্রিন গুলোর দিকে। সেই স্ক্রিন গুলোতে বাংলা ইরেজি সহ নানা ভাষায় কাউন্টার নম্বর ও আরো কিছু লেখা। কমলাকান্ত বাবু সে গুলোকে ট্রেনের টাইম টেবিল মনে করে ভালো ভাবে চেয়ে দেখেই বিস্মিত হয়ে পড়েন। তিনি দেখতে পেলেন ওই ডিজিটাল স্ক্রিন গুলোতে একাধিক ভাষায় লেখা আছে ...
"আত্মহত্যা কাউন্টার নম্বর - ৬৭৮ , জলে ডোবা কাউন্টার নম্বর - ৬৭৯ , অপঘাত কাউন্টার নম্বর - ৬৮০"।
এই পর্যন্ত পড়ার পর ভীষণ ভাবে বিস্মিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন কমলাকান্ত বাবু। তিনি এবার দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে যাকে সামনে পেলেন তাকেই জিজ্ঞাসা করতে থাকলেন। এটা কোন জায়গা ? এখান থেকে শিয়ালদাহ যাওয়ার ট্রেন কথা থেকে পাবো ? এছাড়া আরো অনেক কিছু। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ওই বিশাল জন রাশির মধ্যে কেউ ই কোনো উত্তর বা সাড়া দিলেন না কমলাকান্ত বাবুর প্রশ্নের। এখানে সবাই যেন নিজের গন্তব্য কাউন্টারে যাওয়ার জন্য বেতিব্যেস্ত হয়ে আছে। অন্যের কথা শোনে বা সেই দিকে দেখার কোনো সময়ই নেই তাদের কাছে । কমলাকান্ত বাবুকে যেন তারা কেউ দেখতেও পাচ্ছেনা এমনি তাদের আচরণ। আর স্টেশনের শব্দ যন্ত্রে সমানে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। " শেষ যাত্রা " এক্সপ্রেস থেকে গত সকল যাত্রী নিজ নিজ কাউন্টার নম্বরে গিয়ে আপনার পরবর্তী অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করে নিন। এই এক কোথা শুনে শুনে কমলাকান্ত বাবু ঠিক করতে পারলেন না তিনি কি করবেন। এই স্টেশন থেকে বাইরে যাওয়ার কোনো পথ ও তিনি খুঁজে পেলেন না। এবার তিনি একটু ভয়ই পেলেন বুঝি।
এই ভাবে তিনি স্টেশন চত্বরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই স্টেশন থেকে পরিত্রান পাওয়ার আসায় । ঠিক এমন সময় কেউ একজন পিছন দিক থেকে গম্ভীর ও বাজখাই গলায় কমলাকান্ত বাবুকে ডাক দিলেন। কি মশাই এদিক ওদিক এই ভাবে ঘুরছেন কেন তখন থেকে ? সেই গগন ভেদি ডাক শুনে সেই দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন কোমলকান্ত বাবু। উনি দেখেন তার সামনে কালো কোট পরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকারের এক বয়স্ক ব্যাক্তি।
কমলাকান্ত বাবু লোকটির দিকে ভালো করে একবার তাকাতেই। লোকটি আবার সেই বাজখাই গলায় বলে ওঠেন ; কি মশাই এই ভাবে চারিদিকে ঘুরে বানাচ্ছেন কেন আপনি। বলি মুক্তি পাওয়ার কোনো ইচ্ছা টিচ্চা নেই নেই নাকি আপনার ?
কমলাকান্ত বাবু লোকটির কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারলেন না । কিন্তু এতক্ষন পর কথা বলার মতো কাউকে পেয়ে তিনি এক নাগাড়ে অনেক কিছু বলে গেলেন। আর সেই সব কথার মর্মার্থ হলো ; তিনি ট্রেনে করে অফিস যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঘুম ভাঙতে তিনি দেখেন যে এই স্টেশনে চলে চলে এসেছেন ভুল করে। এক নাগাড়ে এতো গুলো কোথা গুলোর কমলাকান্ত বাবু যে উত্তর প্রত্যাশা করেছিলেন। বরং তার উল্টোই পেলেন।
কামলান্ত বাবুর মুখে এই সব কথা শুনে হো-হো করে হেসে ওঠেন ওই আগুন্তক ব্যাক্তি। তারপর তিনি বেশ জোর গলায় কমলাকান্ত বাবুকে উদ্যেশ্য করে বলেন। কি বললেন ভুল করে এখানে চলে এসেছেন। এই বলে আবার হো-হো করে হেসে ওঠেন সেই আগুন্তুক ব্যাক্তি। সেই হাসি দেখে কমলাকান্ত বাবু ওই আগুন্তুক ব্যাক্তিকে বলেন। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন আসলে এখানে চলছে টা কি। আর আমি এখানে এলাম ই বা কি করে।
তখন ওই আগুন্তুক ব্যাক্তি হাসি বন্ধ করে শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বলেন। এই "শেষ যাত্রা" স্টেশনে মানুষ তখনি আসে যখন তার জীবনের যাত্রার অবসান ঘটে। এই যেমন আপনার জীবন যাত্রা শেষ হয়ে গেছে বলেই আজ আপনি এই "শেষ যাত্ৰা" স্টেশনে আস্তে পেরেছেন। কমলাকান্ত বাবু এবার রেগে গিয়ে বললেন। জীবন যাত্রা শেষ হয়ে গেছে মানে ; আপনি কি বলতে চান। আমি মারা গেছি। উত্তরে ওই আগুন্তুক ব্যাক্তি বলে একদমই তাই। এই বলে পকেট থেকে একটা ট্যাব বার করে। তাতে কিছু টেপাটেপি করে। সামনের একটা ভিজ্যুয়াল ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বাবুকে উদ্যেশ্য করে বলেন। ওই দিকে দেখুন দেখি একবার । এবার কমলাকান্ত বাবু সেই দিকে তাকিয়ে দেখেন। ভিজ্যুয়াল ডিজিটাল স্ক্রিনে ছবি ফুটে উঠেছে। শিয়ালদাহ থেকে ডানকুনি গামী ট্রেনের কামরায় জানালা ধারে বসে ঘুমাচ্ছেন উনি। ট্রেনটা যখন বালি খাল ব্রীজ পার হচ্ছে। তখনি হঠাৎ ট্রেনটা লাইন ছুতো হয়ে ব্রিজ ভেঙে গিয়ে পরলো গঙ্গার জলে। আর নদীতে পরার আগে কমলাকান্ত বাবুর ঘুমন্ত শরীর থেতলে যায় ওই ট্রেন ও ব্রিজের ঘর্ষণে। আর গঙ্গার জলে ভেসে যায় ওনার দেহ।
তারপর ওই আগুন্তুক ব্যাক্তি কমলাকান্ত বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলেন। এবার বুঝতে পারছেন আপনার কেন কিছু মনে নেই। কারণ আপনার মৃত্যু আপনার ঘুমের মধ্যেই হয়েছে। আপনার মৃত্যু আপনাকে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অবকাশ পর্যন্ত দেয়নি ।
এই সব দেখে ও ওই আগুন্তুক ব্যাক্তি কোথা শুনে এবার কমলাকান্ত বাবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। মুখে হাত দিয়ে সেখানেই বসে পড়েন তিনি। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওনার স্ত্রী আর দুই মেয়ের মিষ্টি খুব গুলো।
এবার ওই আগুন্তুক ব্যাক্তি বুঝি কমলাকান্ত বাবুর মনের কথা বুঝেই বলে উঠলেন। নিন নিন অনেক হয়েছে। এখন আর স্ত্রী ও মেয়ের কথা ভেবে কি করবেন। ওনারা এখন আপনার থেকে অনেক দূরে। যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবেন ওদের কথা ততই আপনার পক্ষে ভালো।
তারপর ওই আগুন্তুক ব্যাক্তি আবার সেই ট্যাব টা খুলে নিজের মনেই হিসাব করতে করতে করে বলে ওঠেন। তাহলে আপনার কাউন্টার নম্বর কি হবে বলুন তো ? অপঘাত , না জলে ডোবা। এই বলে ট্যাব হাতে আরও বেশ কিছুক্ষন ধরে হিসাব নিকাশ করার পর।ওই আগুন্তুক ব্যাক্তি বললেন। বুঝলেন আপনি গঙ্গা নদীর জলে পরার আগেই আপনার প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গিয়েছিলো ব্রীজে আঘাত লেগে । তারপর আপনার লাস ভেসে যায় গঙ্গা নদীর জলে। মানে আপনার মৃত্যু অপঘাত কোটাতেই পড়ছে। এরপর কমলাকান্ত বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আগুন্তুক ব্যাক্তিটি বলেন। তার মানে আপনার কাউন্টার নম্বর হলো ৬৮০। যান তাহলে চলে যান ; এই বলে লোকটিও বিদায় নেয় সেখান থেকে।
এতো কিছু জানার পর কমলাকান্ত বাবু আবার ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। দেখতে পান সেই লেখা গুলো আত্মহত্যা কাউন্টার নম্বর ৬৭৮ , জলে ডোবা ৬৭৯ , অপঘাত ৬৮০। এই সব আর সহ্য করতে না পেরে দূরের কাউন্টার গুলোর লম্বা লাইন এর দিকে তাকিয়ে এবার করুন সুরে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন কমলাকান্ত বাবু। চিৎকার করে বলে ওঠেন ; না এমনটা হতে পারেনা , কিছুতেই হতে পারেনা। এই বলে হাত দিয়ে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েন তিনি।
এবার কমলাকান্ত বাবু একটা খুব ক্ষীন শব্দ শুনতে পান। যেন শব্দটা অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। যেন এক মহিলা কণ্ঠ বলছে। কি গো ; কি হতে পারেনা ? কি সব বলছো তুমি ? কিগো বেলা নয়টা বাজে এবার কি তুমি উঠবে ঘুম থেকে। নাকি রবিবার বলে সারাদিন বিছানাতেই পরে থাকবে। সেই ডাক শুনে ধড়ফড় করে বিছানার উপর উঠে বসেন কমলাকান্ত বাব। চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেন ওনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওনার স্ত্রী ; হাতে তার ঝাঁটা। সেই ঝাঁটা নেড়ে এবার ওনার স্ত্রী বললেন। কিগো রবিবার বলে এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমোবে তুমি। আরও কি সব যেন বলছিলে তুমি ঘুমের মধ্যে। কি সব যেন হতে পারেনা। স্বপ টপ্ন দেখছিলে নাকি ? এই বলে নিজের মনে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন কমলাকান্ত বাবুর স্ত্রী। আর হাফ ছেড়ে বাঁচেন কমলাকান্ত বাবু। রোজকার বউয়ের মুখের এই গোজগোজনী শুনে যেখানে অতিষ্ঠ হয়ে যান তিনি। আজ সেই গোজগোজনীও যেন কোটি কোটি গুন্ মধুর শোনায় ওনার কানে।
