Payel Guha

Romance Classics Fantasy

3.5  

Payel Guha

Romance Classics Fantasy

যদি বলো হ্যাঁ

যদি বলো হ্যাঁ

19 mins
1.5K



(১)

“প্রথম কলেজের দিনটা, আজ-ও ঠিক মনে পরে সিনটা”

হ্যাঁ, প্রথম কলেজের দিনটা সত্যিই মনে থাকার মতন হয়। তবে প্রথম দিন কলেজের একসাইটমেন্ট, আনন্দ এই সব গুলো ছাড়িয়ে যে সমস্যাটা কলেজে পা দিতেই প্রকট হয়, তা হল ক্লাসরুম খুঁজে বের করা। স্কুলের ছোট গন্ডীর বাইরে বেড়িয়ে এতো বড়ো ক্যামপাসে নিজের ডিপার্টমেন্টের ক্লাস খুঁজে বের করা মুখের কথা নয়। 


সকাল দশটা থেকে ক্লাস, রঞ্জিনী দশটার মধ্যে কলেজে ঢুকলেও ক্লাস খুঁজে পেয়ে যখন ক্লাসের দরজায় দাঁড়াল তখন সোয়া দশটা। বুকটা দুরুদুরু করছে। দরজা দিয়ে ক্লাসে উঁকি মারতে দেখতে পেল একটা লম্বা ঋজু চেহারার একজন টেবিলে হ্যালান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অফ হোয়াইট শার্ট গুঁজে পরা, ব্ল্যাক প্যান্ট— পুরো ফরমাল লুকস্। শুনে মনে হচ্ছে সবার সাথে আলাপ করছে। ও ধীর পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।

— মে আই কাম ইন স্যার!

— নো!

— স্যার!, থতমত খেয়ে যায় রঞ্জিনী। নো মানে! 

প্রফেসর ওর দিকে ঘুরে একবার ঘড়িতে চোখ বুলোলেন, তারপর বললেন, “পাক্কা ষোলো মিনিট লেট! আমার ক্লাসে আমি আমার ঢোকার পর কাউকে অ্যালাও করি না। আমি যেমন ডট্ দশটাতে এন্ট্রি নিই আমার ষ্টুডেন্টদের-ও আমার আগে এসে ক্লাসে বসে থাকতে হবে। গট্ ইট!", শেষ দুটি শব্দ গোটা ক্লাসের উদ্দেশ্যেই বলল সে।

— স্যার! আসলে ক্লাস খুঁজতে দেরী হয়ে গেল।

— আজ ক্লাস খুঁজতে দেরী হয়েছে, কাল কলেজের রাস্তা হারিয়ে ফেলবে, পরশু জ্যামে আটকে পরবে... সরি! ফাষ্ট দিন বলে কোনোরকম ফেভার করতে পারলাম না। এখন বরং চলে যাও তোমরা...

‘তোমরা’ কারন, রঞ্জিনী ছাড়াও আরো দু'জন এসে দাঁড়িয়েছিল। ওরা বুঝতে পেরেছে প্রথম ক্লাসটা আর করা হবে না, কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে চলে গেল তারা। কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল রঞ্জিনী। রঞ্জিনীর বড্ড রাগ হচ্ছে! কী বাজে তো প্রফেসরটা! কড়া মানলাম, তা বলে প্রথম দিন প্রথমদিনে প্রথম ক্লাসটাই করতে দিল না! মন বলে কী কিছুই নাকি? হার্টলেস! রঞ্জিনী বাইরে গেল না, কোথায় যেত! কাউকে তো চেনেই না। তাই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল একঘন্টা। শুনতে পাচ্ছিল প্রফেসরের ভারী কন্ঠস্বরটা। 


ঘন্টা পড়তেই বেরিয়ে এলেন তিনি। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রঞ্জিনী। ও চোখ না তুলেও বুঝতে পারলো লম্বা চেহারার মানুষটি ওর দিকে তাকিয়ে। ও পাশ কাটিয়ে ক্লাস ঢুকবে বলে পা বাড়িয়েছে এমন সময় ডাকলেন তিনি।

— তোমার নাম?

— রঞ্জিনী বিশ্বাস!

— বেশ! আমি রণদীপ লাহিড়ী, তোমরা আমার রোজ ক্লাস পাবে, পেপার টু-টা আমি দেখছি। 

রঞ্জিনী মাথা নাড়াল। 

— যাও ক্লাসে যাও, তোমাদের অন্য প্রফেসর চলে আসবেন।

রঞ্জিনী ঢুকে যায় ক্লাসে। 


রণদীপ ওর চলে যাওয়া অবধি দাঁড়িয়ে থেকে কমন রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে।

রঞ্জিনী ওর মনে একটা আলাদা ছাপ ফেলে গিয়েছে। চলে যেতে বলার পরেও একটানা দাঁড়িয়ে থাকার জন্য নয়। অদ্ভুত একটা ব্যাপার রয়েছে মেয়েটার মধ্যে। গোলগাল মুখটা কী অদ্ভুত লালিত্যে মাখা! আকাশী নীল-সাদা চুড়িদারে যেন ওই নীল আকাশটাই মাটিতে নেমে এসেছে।

কলেজে এই দেড় বছর পড়াচ্ছে। কম তো ষ্টুডেন্ট দেখলো না। ওর চোখে মুখে এখনো সেই ‘মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে’ ছাপটা রয়েই গিয়েছে। বুকের বাঁ দিকটায় একটা অন্যরকম অনুভূতি টের পেল ও... ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে, এই অনুভূতি যে বড়ো সর্বনাশা! 


(২)


কলেজের প্রথম একমাস কেটে যায় সিলেবাস বুঝতে, নতুন বই খুঁজতে আর নতুন বন্ধুদের সাথে জুঝতে!

কলেজটা রঞ্জিনীর মোটের উপর ভালোই লাগছিল, শুধু  পেপার টু আর রণদীপস্যারকে ছাড়া।  

এদিকে ক্লাসে সবাই রণদীপ স্যার নামে পাগল। হিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের চারজন টিচারের মধ্যে রণদীপ স্যার রীতিমতো ক্রাশ গোটা ক্লাসের। রণদীপ স্যারের ক্লাস কোনো মেয়ে মিস করে না। কোনোদিন যদি ব্ল্যাক শার্ট পরে স্যার আসেন... ব্যাস! গোটা ক্লাসের সবগুলো মেয়ে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকে স্যারের দিকে। শুধু রঞ্জিনী ছাড়া। যাকে নিয়ে গোটা ক্লাস পাগল, তার প্রতি রঞ্জিনীর ফাষ্ট ইম্প্রেশনটাই খারাপ। আর তারপর বাকিটা খারাপ করেছেন স্যার নিজেই। 


ওই তো কলেজে দ্বিতীয় দিন স্যার ক্লাসে ঢুকেই যেন সবার আগে ওকেই খুঁজছিল। দেখতে পেতেই বলে উঠলেন, “আজ তাহলে ক্লাস খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি!”

বেজায় রাগ উঠেছিল ওর। এমন অকারন খোঁটা শোনানোর কোনো মানে হয়? আর তারপর থেকে চলছে, রোজ কোনো না কোনো কারনে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করা, পড়া ধরা। ক্লাসে আর কাউকে জিজ্ঞেস না করলেও ওকে জিজ্ঞাসা করবেই। আর যদি না পারে, তাহলেই হয়েছে। এই তো আজকেই ক্লাসে পড়া বোঝাতে বোঝাতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল ওর দিকে, “chalcolithic period-এর একটা ভারতীয় উদাহরণ বল তো?”

যথারীতি আকস্মিক প্রশ্ন ছুটে আসায় একটু হতচকিত হয়েই গিয়েছিল। আর সত্যি বলতে প্রশ্নটার উত্তরটা ও জানতো না। মাথা নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্যার ওর দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, “হাঁ করে তাকিয়ে থেকে পড়া মন দিয়ে শোনার প্রিটেন্ড করার টেকনিকটা বেশ ভালো তো!”

— না স্যার! সত্যি পড়া শুনছিলাম।

— শুনলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতিস না... 

থতমত খেয়ে যায়! স্যার কখন এর উত্তরটা বলল!

— সত্যি শুনছিলাম...

— চোপ!


পরে স্যার চলে যেতেই ক্লাসমেটদের জিজ্ঞেস করে রঞ্জিনী,

“এই দীপা স্যার কী সত্যিই উত্তরটা পড়ানোর সময় বললো নাকি রে? আমি তো মন দিয়েই শুনছিলাম। খেয়াল করলাম না নাকি?”

— ধুর! না, স্যার বলেনি।

— তাইলে যে স্যার বলল... , খুব রাগ উঠল ওর। স্যারের কী গোটা ক্লাসের সামনে হেনস্থা না করলে পেটের ভাত হজম হয় না? উফ্! সবে একমাস হল। গোটা তিনটা বছর একে সহ্য করতে হবে! ভাবলেই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে ঠিক করে, এর শোধ নেবে। স্যার বলে কী মাথা কিনে নিয়েছে নাকি! কিন্তু, সেটা যে সম্ভব নয় তা ও ভালো মতোই জানে। 


(৩)


রণদীপের আঙুলটা তখন থেকে রঞ্জিনীর নম্বরের চারপাশ দিয়ে পাক খাচ্ছে। পিং করবে নাকি করবে না — তা নিয়ে শুরু হয়েছে এক বিশাল দ্বন্দ্ব। এই একমাসে রণদীপ ভালো ভাবেই বুঝেছে যে ওর সর্বনাশ হয়েছে, ওই রঞ্জিনীর স্বচ্ছ ঝিলের মতন চোখে ডুবে। এই মুহূর্তে ওর ন্যাকা ন্যাকা মহৎ প্রেমিক মন বলছে, “পাঠা না একটা মেসেজ"

প্রফেসর সত্তা চোখ পাকিয়ে বলছে, “ভুলে যাস না তুই একজন প্রফেসর। ও কিন্তু তোর ষ্টুডেন্ট। ব্যাপারটা ভালো দেখায় না।"

কী জ্বালা! প্রেমিক সত্তা জুলুজুলু চোখে চেয়ে রয়েছে আর প্রফেসর সত্তা কটমট করে। শেষমেশ প্রেমিক মনটাকে দেখে মনটা ভিজল, তাই চ্যাটবক্সটা খুলে একটা পিং করেই দিল রণদীপ, তবে প্রফেসারি ঢং-এ।

— কী রে! সকালে যে প্রশ্নটা করলাম, তার উত্তরটা পেলি?


রাত সাড়ে দশটা। ডিনারটা সেরে সবে ফোন নিয়ে বসেছে রঞ্জিনী। বন্ধুদের গ্ৰুপে পরের দিনের প্ল্যানিং চলছে। চলছে গালাগালি, গুলতানি। তার মধ্যে হঠাৎ একটা টিং করে আওয়াজ, নোটিফিকেশন জানাচ্ছে, একটা মেসেজ এসেছে, ফ্রম ‘খারুশ স্যার'। রনদীপের নামটা ওভাবেই সেভ করা ওর ফোনে। ভ্রু-তে ভাঁজ পড়ল। আর মেসেজটা সিন করতে মুডটাও গেল খিঁচরে ।

উত্তর দিল, হ্যাঁ।

— কী বলতো?

— Indus valley civilization.

— সেই তো গুগল দেখেই উত্তরটা দিলি।

— প্রত্যেককে হয় কোনো কিছু দেখেই জ্ঞান অর্জন করতে হয়, হয় বই দেখে নয় গুগল।

— মন দিয়ে ক্লাস করে মাথা খাটালেও জানা যায়। অবশ্য মাথা খাটানোর মতন ধূসর বস্তু থাকলে...

— স্যার! মন দিয়েই ক্লাস করি আমি।

— তার নমুনা তো দেখলাম-ই। 


সিন করে রেখে দিয়েছে দেখে রণদীপ টের পেল পেটের ভিতরটা কেমন যেন করছে! ইস্! আর কী বলা যায়? আর কী বলবে...

ভাবতে ভাবতে পাঠিয়ে দিল পরের মেসেজ, “এখনো অন আছিস? এরপর দেরী করে ঘুমোবি। উঠতে দেরী হলে তারপর তো কালকের দশটার ক্লাসটা মিস করবি। আবার দাঁড়িয়ে থাকবি ক্লাসের বাইরে ছলছল চোখে..."


রণদীপ দেখল, মেসেজগুলো সিন হতেই অফলাইন হয়ে গেল রঞ্জিনী। হাসি পেল ওর। ও দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে রঞ্জিনী ফর্সা নাকটা ফুলে উঠেছে রাগে লাল হয়ে। রঞ্জিনী যে ওকে একদম পছন্দ করে না, ওর কথাগুলোয় রেগে যায় তা ও বিলক্ষন বোঝে। কিন্তু, তারপরও রাগাতে বড্ড লাগে। রঞ্জিনীকে রাগলে বড্ড মিষ্টি লাগে...


(৪)


রণদীপ এই প্রথমবার বুঝল, আসলে আমাদের এই বয়স বেড়ে যাওয়া বড়ো হওয়াটা একটা খোলস। আসলে আমরা বড় হইনা। আমাদের মধ্যে সেই তেরো বছরের কিশোরটা, আঠারো বছরের যুবকটা রয়েই যায়। সেই সদ্য সদ্য যৌবনে পা দেওয়ার সময়ে, প্রথম প্রেমের অনুভূতি বুঝতে পারা ছেলেমানুষী আনন্দটা শুধু কোনো একটি বয়সেই আটকে থাকে না। বয়স বাড়লেও সেই অনুভূতি গুলোর বদল হয় না। যদি হত, তবে আজ এই আঠাশ বছর বয়সে এসে, নিজের থেকে দশ বছরের ছোট মেয়েটির প্রেমে নির্লজ্জ্বের মতন পড়ত না। আর আজ ক্লাসে ঢুকে মেয়েটিকে না দেখতে পেয়ে এমন ছটফট করত না।


এই তিন মাসে অনেক বুঝিয়েছে রণদীপ নিজেকে, এটা ঠিক হচ্ছে না। মেয়েটা ছোট ওর থেকে। সর্বপরি ও তো টিচার। 

সাথে সাথে মন-ও পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছে, “এর আগে কোনো টিচার ষ্টুডেন্টের সাথে প্রেম করেনি! নাকি দশবছরের গ্যাপে কারোর রিলেশন হয়নি! প্রেমে আবার বয়স হয় নাকি!"


পারেনি নিজেকে আটকাতে। অবশ্য প্রেম জিনিসটা কবেই বা মানুষের হাতে ছিল। কবি সত্যিই বলেছেন, “প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।” ওই ফাঁদে পরেই ওর কাঁদার দশা!


ওর ক্লাসে ঢুকেই প্রথম কাজ চক নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে যে টপিক নিয়ে আলোচনা করবে তা লেখা। তারপর কাউকে দাঁড় করিয়ে আগের দিন যা যা পড়িয়েছিল তা জিজ্ঞেস করে। তারপর শুরু করে সেদিনের পড়ানো। বেশিরভাগ দিন প্রথম দাঁড় করায় রঞ্জিনীকেই। আসল কথা হল, ক্লাসে ঢুকে সবার আগে রঞ্জিনীকেই খোঁজে ও। আজ-ও ওর ব্যাতিক্রম হয়নি। কিন্তু, আজ ওর দু'চোখ গোটা ক্লাসে রঞ্জিনীকে খুঁজে পায়নি। পাবে কীভাবে! আজ রঞ্জিনী আসেনি। আর সেটা বুঝতে পেরেই ওর মনটা কেমন যেন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল! 

যদিও পড়ানোতে কোনোরকম ফাঁকি দিল না। তবে অন্যদিনের মতন আজ লেকচারটা হল না। 


ক্লাস শেষে ফিরছে কমনরুমে। এরপর কতগুলো ক্লাস! পাসের ক্লাস রয়েছে, ওদিকে থার্ড ইয়ারকে ঔরঙ্গজেব পড়াতে হবে... এদিকে ওর মন তখন থেকে সব কিছুতেই এক লব্জ আওরে চলছে, “ধুর!”


মনে হচ্ছে, “কী হবে ঔরঙ্গজেব পড়িয়ে? আচ্ছা!আমার মতন পরিস্হিতিতে পড়লে কী ঔরঙ্গজেব যমুনা পাড়ে  মনমরা হয়ে বসে থাকতো?”

তৎক্ষনাৎ ওর প্রফেসারি সত্তা ধমকে উঠল, “কী সব ভাবছিস!”


চলতে চলতেই থমকে যায় রনদীপ, স্বগক্তি করে, “সত্যিই তো! কী সব ভাবছি!”


মাথাটা ঝাঁকায় ও। যেন এই অবাঞ্চিত ভাবনা গুলোকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। তারপর সামনে চোখ ফেলতেই আবার থমকে গেল...


এ কী দেখছে! এ কি দেখছে...


হলুদ চুড়িদার পরিহিত, খোঁপা বাঁধা ওই মেয়েটা কে? রঞ্জিনী না!

এগিয়ে আসছে সে। ঝিলের মতন চোখটায় ব্যস্ততা। গোলাপি ঠোঁটটা কামড়ে এগিয়ে আসছে...


মনে পড়ে গেল ওর, 

“তুমি নরম ঠোঁটে স্বেচ্ছা ব্যথার নীল/তুমি অন্য মনে একলা পাখির ঝিল…"


উফ্! মনটা নেচে উঠল ওর। ওর এমন ব্যবহারে ওর প্রফেসর সত্তাটি ধিক্কার করলেও...ও পাত্তা দিল না। উল্টে হ্যাংলার মতন এগিয়ে গেল সেদিকে।



(৫)


রঞ্জিনীর মনে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হচ্ছে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত! মানে কেমন একটা নরম তুলোর মতন কিছু যেন ভেসে বেরাচ্ছে মনজুড়ে...

“মেঘের পালক চাঁদের নোলক কাগজের খেয়া ভাসছে...”



পাশ থেকে দীপা বলে উঠল, “ব্যাপার-স্যাপার-ই আলাদা! তোর জন্য স্যার নিজের রুলস বদলে দিল!”

সামনে থেকে আরেকজন, “আরে! প্রিয় ষ্টুডেন্ট বলে কথা!"


গোটা ডিপার্টমেন্টে, রণদীপ স্যারের ‘প্রিয় ষ্টুডেন্ট' বলে রঞ্জিনীর ‘বদনাম' রয়েছে। এটলিস্ট রঞ্জিনীর কাছে ওটা ‘বদনাম'। অন্যদিন বন্ধুদের মুখে ওটা শুনলেই খচে যেত ও। কিন্তু, আজ শুনতেও যেন পেল না। ওর মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছে, “কেসটা কী হল?"


গতকাল রঞ্জিনীর প্রথম ক্লাসটা মিস যায়। সেকেন্ড ক্লাসের জন্য যখন নিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে যাচ্ছিল, তখন রাস্তায় দেখা রণদীপ স্যারের সাথে। রণদীপ নিজেই ওর সামনে যায়।


— প্রথম ক্লাসে এলি না যে! 

রঞ্জিনী কোনো রকম ভনিতা না করে বলে দিয়েছিল, “আজ কলেজ ঢুকতে একটু দেরি হয়েছে তাই। তবে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু, কলেজের গেটে যখন নামি তখন বাজে নটা আটান্ন। ক্লাসে যেতে পাক্কা সাত মিনিট লাগবে। আপনি তো ততক্ষনে চলে যাবেন। আবার ঢুকতে দেবেন না। তাই আমি নিজেই আর গেলাম না। সকাল সকাল  কথা শুনতে ইচ্ছে করল না।” 


আর আজ স্যার ক্লাসে ঢুকেই সবার আগে বললেন, “ আজ থেকে তোমরা যদি পাঁচ-মিনিট দেরি করো। তবুও ক্লাসে ঢুকতে পারবে... তবে দশটা পনেরোর পর কেউ এলে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। আমি চাই না আমার কড়াকড়ির জন্য তোমাদের ক্লাস মিস হোক। তোমাদের অ্যাটেনডেন্স-ও কমবে। আর পড়াটাও পিছিয়ে যাবে। জানো তো তোমাদের অ্যাটেনডেন্সের উপর নম্বর রয়েছে... " এইটুকু বলে রঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “ এরপর থেকে যেন অ্যাপসেন্ড না দেখি!”


সব ঠিক ছিল কিন্তু, রঞ্জিনী স্যারের মুখের দিকেই তাকিয়েছিল। ও খেয়াল করেছে, রণদীপ যখন ওর মুখের দিকে চেয়েছিল ওর চোখে কিছু একটা ছিল। কী তা জানে না...



(৬)


— এই জানিস আমার না মনে হয় স্যার তোর প্রেমে পড়েছে।

— কী বাজে বকছিস!, ঝাঁঝিয়ে ওঠে রঞ্জিনী। এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে। তার উপর দীপার এসব কথা...

— আহ! তুই নিজেই ভেবে দেখ না। নাহলে স্যার তোকে ক্যাফেতে যেতে বলল কেন? একটা খাতার-ই তো ব্যাপার। বেরোনোর আগে দিয়ে যাওয়ার কথাও তো বলতে পারতো! কোথায় আমাদের তো কখনো ডাকেনি...


কথাটা ও নিজেও যে ভাবেনি তা নয়। আর যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটাও খুব অদ্ভুত! 


পাঁচটা মাস কেটে গিয়েছে চোখের নিমেষে। সামনের মাসে সেমিষ্টার। আর এই সময়টায় শুরু হয় যত রাজ্যের ইন্টারনাল, অ্যাসাইনমেন্টের অত্যাচার। গতসপ্তাহে রণদীপের নেওয়া ইন্টারনালের খাতা আজ হাতে পায় ওরা। ও পেয়েছে বারো! প্রথমেই মনটা খারাপ হয়। খুব ভালো প্রিপারেশন নিয়ে এসেছিল। তবু নম্বর কম। এদিকে সবাই পনেরো, ষোলো, আঠারো...

ক্লাস শেষ হবার পর, মনমরা হয়েই খাতা উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে, চোখে পড়ল আসল গেরো। নম্বর ঠিক-ঠাক পেয়েছে ও। কিন্তু, সব প্রশ্নের নম্বর অ্যাড করা হয়নি। প্রচন্ড রাগ হয় ওর। ক্লাসে আরো কয়েকজনকে ব্যাপারটা বললে, দেখে কারোর সাথেই এমনটা হয়নি। তবে কী এটা ইন্টেনশনালি করা! ব্যস! হনহনিয়ে ছুটল কমনরুম।


পারমিশন নিয়ে কমনরুমে  ঢুকে, রনদীপের চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, “এসব কী স্যার!” যতটা সম্ভব গলাটা নামানো যায় ততটাই নামিয়ে কথাটা বলল। তবে এমন ভাবেই বলল, যাতে ওর কথার উষ্মাটা রনদীপ বুঝতে পারে।


— কি হয়েছে?

— আপনি সব নম্বর যোগ করেননি! দেখুন।

রনদীপ অবাক চোখে ওর দিকে তাকায়, তার পরক্ষনে খাতাটা হাতে ধরার জন্য হাতটা বাড়িয়েও নিল না। হাত গুটিয়ে নিল।

— এক কাজ কর, বিকেলে কলেজের পর আমি ওই উল্টো ফুটের ক্যাফেটায় যাই, তুই আসিস ওখানে দেখে নেবো। দেখতেই তো পাচ্ছিস সামনে এতো খাতা অলরেডি..., সামনের ছড়ানো খাতাগুলোকে দেখিয়ে বলল সে।


রঞ্জিনী কথা বাড়ায় না। তখন বেরিয়ে এলেও খচখচানি রয়ে যায়।


সত্যিই তো ক্যাফেতে!কেন!


(৭)



“ঝড় উঠুক নাইবা উঠুক,

বৃষ্টি নামুক নাইবা নামুক

ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ

বসন্ত"


হেডফোনে অঞ্জন বেজে চলছে। সামনে ছড়ানো অ্যাসাইনমেন্টের খাতা। বাইরে যদিও সত্যিই বৃষ্টি নেমেছে। কিন্তু, রণদীপ জানে বর্ষা নয় বসন্ত এসেছে সত্যিই ওর জীবনে।


স্কুল-কলেজ লাইফে কখনো প্রেমে পড়েনি কারোর ও। টুকটাক চাপ কারোর কারোর উপর থাকলেও ওইটুকুই। ওসব কলেজেই শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, জীবনে এই প্রথমবার ও বুঝতে পারছে ও প্রেমে পড়েছে। একজোড়া কাজল টানা দীঘল চোখ, ওই ছোট ঠোঁট ফুলানো মুখটা পাগল করেই ছাড়ল। শেষমেষ রণদীপ লাহিড়ী নিজের ষ্টুডেন্টের কাছেই কাবু হল!


পাশ থেকে একটা কন্ঠস্বরে চমক ভাঙল।

— কী ভাবছিস!

ওর কলিগ শুভময়। ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়াল। 

— উঁহু! কিছু তো হয়েছে তোর! আর কেন জানি মনে হচ্ছে কেসটা যেটাই হয়েছে সেটা পুরো জন্ডিস কেস! কলেজের হার্টথ্রবের হার্ট কার কাছে গেল শুনি? ব্রেকিং নিউজ করতে হবে তো! তারপর কলেজে ছুটির একটা ব্যবস্থাও তো করতে হবে! কারন, এই খবর পেলে যে পরিমাণ ফিমেল ষ্টুডেন্টদের ভাঙবে, তাদের জন্য নীরাবতা পালন করতে হবে না?, এতটা বলে নিজেই সজোরে হেসে ওঠে।

রণদীপ-ও হেসে ফেলে।

— আরে পরে হাসবি, বল কেস কী?

একটু ইতস্তত করে বলে, “ইয়ে... মানে... মানে তুই না ঠিকই আন্দাজ করেছিস।"

হাতে একটা তালি মেরে বলে ওঠে শুভময়, “আরে বাঃ! তা মেয়েটি কে? রঞ্জিনী নয় তো!”

চমকে ওঠে রণদীপ। ও কি এতটাই হ্যাঙলামো করে ফেলেছে যে সবার চোখে পরেছে?

— তুই... মানে কী করে...

বিজ্ঞের মতন বলে উঠল, “হু...হু! সাইকোলজি পড়াই মশাই। মনের কথা বুঝব না তা কী হয়? তা সমস্যা কোথায়? বলেছিস? নাকি বলাটাই আসল সমস্যা?"


এটাও বুঝে গিয়েছে দেখে রণদীপ ফোঁস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ যুগে যুগে সব প্রেমিকদের তো এই একটাই সমস্যা ফেস করে আসতে হচ্ছে ব্রো! তার উপর...”

ও'কে থামিয়ে শুভময় বলে ওঠে, “তার উপর যদি প্রেমিকা প্রেমিকের কলেজের ষ্টুডেন্ট হয় আর তার থেকে দশ বছরের ছোট হয় বলতে ইতঃস্তত হয় তাই তো! দেখ ভাই, প্রেমে না বয়স দেখলে চলে না। বল তো!"

— বলবো বলেই তো ভাবছি!

— বলে ফেল! বেষ্ট অব লাক!


আর বলা! দুই সপ্তাহ ধরে বলবে বলেই প্ল্যান করে চলছে। একটা করে প্ল্যান করছে আর ক্যানসেল করছে। একবার ভাবছে মেসেজে বলবে, আবার ভাবছে সামনে বলবে। বলবে! বললে যদি না করে দেয়! তখন! বাকি আড়াইটা বছর তাইলে আড়ষ্টতায় কাটবে... 


তবে আশঙ্কার চোখ রাঙানি কবেইবা প্রেম শুনেছে। প্রেমে পড়লে যে সবার আগে জানিয়ে দেওয়ার জন্য-ই মনটা ছটফট করে ওঠে। অবশ্য জানানোটা ভালো, সারাজীবন অ্যাটলিষ্ট আপশোস থাকবে না।  তাই রণদীপ এঁটেছে এই প্ল্যান...



(৮)


“যদি বল হ্যাঁ বিসিএসে বসে যাবো আমি

যদি বল না আওড়াবো জয় গোস্বামী

যদি কর দোনামনা,

কোল্ড কফি নিয়ে নেবো দুটো..."


ক্যাফেতে লো ভলিউমে গানটি বেজে চলছে। আর রণদীপ আপাতত এই দোনামনাতেই দু'টো কোল্ড কফি-ই অর্ডার দিয়ে দিল। একজনকে দু'টো কফি অর্ডার দিতে দেখে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকাতে তাকাতে গেল ওয়েটারটি। সেদিকে হুশ নেই, টেবিলে বসে হাত কচলাচ্ছে রণদীপ। পেট গুড়গুড় করছে ওর। ওর মাথায় এখন চন্দ্রবিন্দুই ঘুরছে। যদি বলে না, জয় গোস্বামী পড়া ছাড়া কোনো গতি নেই। তবে যদি হ্যাঁ বলে! হ্যাঁ কী বলবে! তার থেকেও বড়ো কথা, কথাটা বলবে কীভাবে?


কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকল রঞ্জিনী। বুকটা ওর-ও দুরুদুরু করছে। মনে মনে সেই একটাই প্রশ্ন ঘুরছে। বাইরে দীপাকে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছে। ঢুকে রণদীপকে দেখতে পেয়ে ওর টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। 

— বসো!, রণদীপ সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল।

রঞ্জিনী বসে ব্যাগ থেকে খাতাটা বের করে রণদীপকে দিল, “স্যার আরো পাঁচ নম্বর আপনি কাউন্ট করেননি। টোটাল নম্বর বাড়বে আমার।"


রণদীপ লক্ষ্য করে রঞ্জিনী আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। ও রঞ্জিনীর হাত থেকে খাতাটা নিয়ে পকেট থেকে লাল পেনটা বের করে, খাতার উপরে টোটাল এর জায়গাটায় প্লাস ফাইভ করে দিল। তারপর খাতাটা ওকে ফেরত দেওয়ার সময় ওয়েটার দু'টো কফি দিয়ে যায়। রণদীপ একটা ও'কে এগিয়ে দিয়ে বলে, “নে...”

— না স্যার, বাড়ি যাবো... 

— এটা খেয়ে অ্যাটলিষ্ট যা

— বাইরে দীপা দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমি উঠি।, বলেই উঠে দাঁড়ায় ও। 

ঘুরে এগোতে গিয়েও থেমে গেল একটা কথা মনে পড়তে, “স্যার আপনি মনে করে মার্ক্সের শিটটায় অ্যাড করে দেবেন কিন্তু নম্বরটা। আমি কী বাড়ি ফিরে একবার পিং করবো?"

— লাগবে না, নম্বর লেখা আছে।

— মানে?, রঞ্জিনী বিস্মিত।

— মানে তুই যে সতেরো পেয়েছিস তা আমি জানি। লিখেই রেখেছি ওটা চিন্তা করিস না। তুই একটু বস না একটা কথা ছি...

ওর কথা শেষ হবার আগে রঞ্জিনী ব্লার্ষ্ট করে, “মানে? আচ্ছা আপনি কী আমার সাথে ইয়ার্কি করেন? সব সময় আমাকে হ্যারাজ করার মানে কী স্যার আজ আমি সিরিয়াসলি জানতে চাই!"


এই রে! ভাগ্যিস এই মুহূর্তে ক্যাফেটা ফাঁকা! তাও ওয়েটার দু'জন ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। 


— রঞ্জিনী একটু আস্তে, সবাই তাকাচ্ছে!, কাকুতির স্বরে বলল, তারপর বলে চলে, “আমি আসলে তোকে এখানে আনার জন্য এটা করেছি। তোকে একটা কথা বলতে চাই!”

রাগে গজগজ করতে করতে বলে রঞ্জিনী, “ কী এমন কথা স্যার!”

কিছু মুহূর্ত ইতঃস্তত করে, বলেই দেয় রণদীপ, “অ্যাকচুয়ালি আই ফল ইন লাভ উইথ ইয়োর আইজ্, আই... আই লাভ ইউ! বিশ্বাস কর লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটে বিশ্বাস করতাম না যদি না তোকে দেখতাম। এতোগুলো মাস শুধু পুষে রেখেছি কথাটা মনের মধ্যে। কিন্তু আর পারলাম না... আর পারছিলাম না... আমি সত্যি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি র্নিলজ্জ্বের মতন...

 শশাঙ্ক আর ঔরঙ্গজেবের দিব্যি আমি তোকে চাই!... আচ্ছা তুই কী আমার হবি?”


থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রঞ্জিনী। 

একি কান্ড! সব পন্ড! এ ব্রহ্মান্ড! সব কাঁপছে কেন চারপাশের! রঞ্জিনী টের পেল ওর বুকটাও কাঁপছে! কী সব বলল রণদীপ স্যার!

আর এক মুহূর্ত নয়। পিছন ফিরে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল রঞ্জিনী। 


পরে রইল দু'টো কোল্ড কফি আর রণদীপ। 



(৯)


কখনো কখনো জীবনে কিছু কাজ করার পর কাজটার ফলাফল বোঝা যায় না। এইজন্যই মনে হয় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিল, ‘কর্ম করে যাও ফলের আশা করো না।’ কিন্তু, মন যে ফল জানতেই চায়! এই মনটাই যত নষ্টের গোড়া!

কিন্তু কী আর করার... সময় বয়ে যায় স্রোতের ন্যায়...


সময় এগিয়েছে একটা বছর। দু'টো সেমিষ্টার কমপ্লিট। থার্ড সেমিস্টারের লম্বা সিলেবাস। পড়ার আর পড়ানোর দু'টোরই  চাপ বেড়েছে। 

আজ সেকেন্ড প্রফেসর আসেননি দেখে, প্রথম দু'টো ঘন্টায় নিজের দু'টো ক্লাস পরপর নিয়ে নিয়েছে রণদীপ। এই মাঝের কয়েকমাস খুব স্বাভাবিক ভাবেই কেটেছে। ওই দিনের পর রণদীপ আর কোনো হঠকারিতা করেনি। কিন্তু, সব কিছুরই তো একটা ফলাফল জানতে চায় মানুষ। ও নিজেও জানতে চায় ওর উত্তরটা। রোজ ক্লাসে ঢুকে রঞ্জিনীকে দেখলেই এই কথাগুলো মনে পরে। 


ঘড়িতে এখন পাঁচটা বাজে। দিনের শেষের ক্লাস করার পর ষ্টুডেন্টরা যেমন ক্লান্ত থাকে, প্রফেসররাও থাকে। তার উপর দু'ঘন্টার ক্লাস। আরো বেশি ক্লান্তি ঘিরে ধরছে।  কমনরুম থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে সেই কফিশপটায় ঢুকল ও। 

আজ-ও ঢিমে সুরে বাজছে চন্দ্রবিন্দু, “এইটা তোমার গান”।

কফি অর্ডার দিয়ে ফোনটা খুলে বসল ও।


কিছুক্ষন পর, ওয়েটার এসে কফিটা দিয়ে যায়। কফিটায় চুমুক দিতে যাবে, থমকে যায়। কফিটার উপর লেখা “ইয়েস" পাশে তিনটে লাভ। ক্রিম দিয়ে লেখা‌।

কেমন একটা খটকা লাগে। মাথা তুলে ওয়েটারটিকে আবার ডাকে, “এটা কী?"

— কেন স্যার আমাদের এখানে তো কফির উপর ডিজাইন করেই দেওয়া হয়!

— সে জানি কিন্তু এরকম তো থাকে না... এর মানে...


একজন এগিয়ে এল। রণদীপ তাকে চেনে, এ তো এই ক্যাফের মালিক। এর আরো একটা পরিচয় আছে, কী রকম দাদা জানি রঞ্জিনীর হয়।

— আসলে আমার বোন এটা করেছে। ওই ওই দেখুন পালালো... ওর কথা বলতে এলাম বলে...


রণদীপ দরজার দিকে তাকাতে, ও নিজে তরাক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, রঞ্জিনী!

ও ছুটে যায়।


— এই দাঁড়া! ওটার মানে কি রঞ্জিনী?, রঞ্জিনীর হাত টেনে ধরেছে। 

— কেন? তোমার উত্তরটা! দেওয়া উচিত হয়নি বুঝি!, ঠোঁটে মুচকি হাসি।

— স...সত্যি! তুই...

— এহেম! কলেজটা কিন্তু সামনে...


হাতটা ছেড়ে সরে দাঁড়ায় রণদীপ। তা দেখে হেসে রঞ্জিনী বলে, “এবার ক্যাফেটা বদলান স্যার! তাহলে একটু আমিও কোল্ড কফি খেতে পারি..." 

এরই মধ্যে হাত দেখিয়ে টোটো থামিয়েছে, কথাটা বলেই উঠে বসে তাতে।

— চলুন দাদা,কালীবাড়ি রোড।

রণদীপকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় ও। মনের মধ্যে ভেসে উঠতে থাকে বিগত এক বছরের ঘটনা পরম্পরা।

সেই প্রথমদিন ক্লাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যখন ওই মানুষটাকে দেখেছিল, সেদিনই বুকে একটা ধাক্কা টের পেয়েছিল। গোটা ক্লাসের সবাই যেখানে তার অ্যাটেশনের জন্য হাপিত্যেশ করতো, সেখানে ফোকটে নিজে তার থেকে অ্যাটেনশন পেতে ভালো লাগতো বৈকি। একটা সময়ের পর একটা অদ্ভুত অধিকারবোধ কাজ করতো মনের মধ্যে। রণদীপ যা কিছু বলুক, তা সবটাই যেন অলিখিত অধিকারের মধ্যেই পড়তো। আর রণদীপের উপর রাগ দেখানোটাও যেন ওর অধিকার-ই ছিল…

কবে যে মনে মনে রণদীপ স্যারটা শুধু রণদীপ হয়ে গেল বুঝতেও পারেনি। চায়-ও নি… বুঝল সেদিন…

তবু এতোদিন পর উত্তর দিল রণদীপকে। 

রণদীপকে তো কবেই উত্তর দিতে ও চেয়েছিল। তবে এই মাঝের সময়টুকু ছিল শাস্তি! ওই অকারণ হেনস্থাগুলোর। বলেছিল না! শোধ নেবোই…


নিজের মনেই হেসে উঠলো ও।


অপরদিকে, রণদীপ ফিরে এসে কফিটার উপর লেখাটার দিকে চেয়ে রয়েছে। এ'সব সত্যি! রঞ্জিনী সত্যিই...


ক্যাফেতে আবার এই মুহূর্তটাতেই  বাজছে সেই গান, 


“যদি বল হ্যাঁ বিসিএসে বসে যাবো আমি

যদি বল না আওড়াবো জয় গোস্বামী

যদি কর দোনামনা,

কোল্ড কফি নিয়ে নেবো দুটো..."


© পায়েল




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance