মেসেজ
মেসেজ
১)
“আজকে আবারও আত্মঘাতী এক যুবতি। বয়স কুড়ি। এই নিয়ে শিলিগুড়িতে একই সপ্তাহে চারজন যুবতীর আত্মঘাতী হবার ঘটনা ঘটল। আর প্রতিটা কেসেই কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া যায় নি..."
ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে শিলিগুড়ির এক ফেসবুক নিউজ পেজের এই নিউজটা পলা পাত্তা না দিয়েই পালটে দেয়। ওর এসব নিউজ নিয়ে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। ওর ইন্টারেস্ট হলো ভূত। ফেসবুকের সব বড়ো বড়ো ভূতের গল্পের গ্ৰুপে সারাদিন বসে বসে ভালো ভালো গল্প গুলো পড়া ওর অন্যতম কাজ। লীলা মজুমদার ওর প্রিয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, হিমাদ্রী কিশোর দাশগুপ্ত এদের গল্প পড়া বা সানডে সাসপেন্স-এ সব শোনা। সারাদিন ওর মাথায় ভূত-ই ঘুরে বেড়ায়। ইদানিং একটা ছেলের হদিশ পেয়েছে। অসম্ভব ভালো লেখে ছেলেটা! ছেলেটার লেখার এতো বড়ো ফ্যান হয়ে গেছে যে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট-ও পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন বসে বসে তার অ্যাকাউন্ট-টাই ষ্টক করছে আর দু-মাস আগের লেখা গল্প পড়ে যাচ্ছে। আর মনে মনে বলছে, “উফ! ছেলেটার প্রেমেই পড়ে গেলাম লেখার জন্য...”
২)
মেসেঞ্জারে মেসেজটা দেখে ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ওই ছেলেটার থেকে মেসেজ এসেছে। পলা-ই মেসেজ করেছিল, “তুমি কিন্তু দারুন লেখো। একেকটা গল্পের বুনন ভয় পাওয়াতেই বাধ্য। আর অভিনবত্ব ... ইত্যাদি... প্রভৃতি নানান স্তুতিবাক্য।
তার উত্তরে ছেলেটা ধন্যবাদ জানিয়েছে। পলা আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। পাল্টা দু'একটা কথা বলে ছেড়ে দিয়েছে। পলার ছেলেটাকেও খু-উ-ব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। প্রোফাইলে একটা ছাড়া কোনো ছবি নেই... প্রোফাইলের নাম ‘অশরীরি'; যদিও পলা জানে এই নামটা আসলে ছেলেটার ছদ্মনাম, প্রতিটা লেখার শেষে ওই নাম থাকে। প্রোফাইল পিকটা কী আসল? মনে তো হয়...
আর কথা বাড়ায়নি পলা। গল্প পড়া কাজ অতো জেনে কী হবে!
৩)
আজ হঠাৎ ওই ছেলেটা মেসেজ পাঠিয়েছে, "তুমি খুব ভালো"
পলার মনে হয়েছে, ওর সব লেখার পড়ে বলে, ফিডব্যাক দেয় বলেই হয়তো কথাটা বলেছে। যত-ই হোক, লেখকরা তার রেগুলার পাঠকদের নজরে রাখে। তাদের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা থাকে...
৪)
আজ তিন নম্বর দিন, এই এক মেসেজ এলো ছেলেটার থেকে। কী আশ্চর্য! পলা জানে না ছেলেটা কোথায় থাকে। ও নিজেও কখনো বলেনি ও কোথায় থাকে। ছেলেটা আদৌ শিলিগুড়ি-তে থাকে? নাকি বাইরে কে জানে! প্রোফাইলে-ও লেখা নেই। পরপর তিনদিন রাত বারোটা নাগাদ একটা মেসেজ করছে সে, “আজ রাতে তোমার বাড়ির নীচে দাঁড়াবো। ডাকবো... আমার কাছে এসো...”
পলা রাত দু'টো অবধি জাগে। কিন্তু পরীক্ষা চলছে বলে তা তিনটায় গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু ও কোনো কিছু টের পায়নি। কিন্তু এই মেসেজটা ওর মনের মধ্যে কেমন একটা অস্
বত্বির তৈরি করছে! ও প্রথমদিন পালটা কত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো, “ মানে? তুমি কী চেনো আমার বাড়ি? তুমি কোথায় থাকো? এর মানে কী?”
কিন্তু কোনো উত্তর নেই। শুধু ঠিক রাত বারোটায় ওই মেসেজ! গতকালকেও বলেছিল পলা, “কী বলছো? তুমি কী মজা করছো আমার সাথে? কিন্তু, আমার সাথে তোমার কোনো পরিচিতি নেই, অচেনা মানুষের কাছ থেকে এমন মজা মোটেও আমি পছন্দ করি না..."
নো রিপ্লাই।
৫)
“পলা..."
তিনটে বাজে ঘড়িতে। সবে মাত্র লেখা শেষ করে শুয়েছে পলা। হঠাৎ নিজের নামটা শুনে চমকে ওঠে। একটা শীতল কিন্তু ভারী পুরুষালি স্বরে ওর নামটা উচ্চারিত হয়েছে। কে? কে ডাকলো?
মা-বাবা ঘুমিয়েছে তো অনেক ক্ষন তবে? কান খাঁড়া করে রাখলো পলা।
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান, আবার ডাক...
পলা...
হঠাৎ ওর মনে হলো, ডাকটা বারান্দার দিক থেকে আসছে মানে কেউ ওকে... রাস্তা থেকে...
শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। কিছু মুহূর্ত চুপচাপ।
আবার...
পলা...
পলা উঠেই দাঁড়িয়েছিল। এবার মন্থর গতিতে দুরুদুরু বুকে বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। তিনতলায় ওদের ফ্ল্যাট। তিনতলার নীচে একটি সাইকেল দাঁড়ানো। সওয়ারির মুখ দেখা যাচ্ছে না। নীচ থেকে কেউ ওমন শান্ত শীতল স্বরে ডাকলে এভাবে শোনা যায়? কোথায় মা-বাবা কী শুনতে পেল না?
নিস্তব্দ কিছু মুহূর্ত পার হয়ে যাচ্ছে... রাস্তায় কিছু কুকুর কেমন কান্না জুড়েছে। পলার গা কাঁটা দিয়ে উঠলো ডাকটা শুনে। ও সকৌতুহলে তাকিয়ে আছে সাইকেল সওয়ালির দিকে।
হঠাৎ সে উপরের দিকে তাকালো। ধক্! করে উঠলো পলার বুকটা!
এতো উপর থেকেও স্পষ্ট দেখলো সওয়ারির চোখ লাল। সেই লাল চোখে যেন শূন্যতা। সওয়ারির ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল। সেই এক শীতল কন্ঠস্বর পলার কানে ভেসে এলো,
“তুমি খুব ভালো, আমার কাছে এসো...”
৬)
“আবার শিলিগুড়ির বুকে আত্মঘাতী এক তরুনী। পাওয়া যায়নি কোনো সুইসাইড নোট। তার মা-বাবা জানাচ্ছেন, তাদের কন্যা কোনোভাবেই এমন কাজ করতে পারে না... ঠিক যে কথাটা আগের চার জনের মা-বাবারাও বলেছিলেন। কী ঘটছে আমাদের এই শিলিগুড়ির বুকে?”
পুলিশ এসে পলার ফোনটা সিজ্ করলো। ফোন খুলে চেক করে কোনো রকম সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কী না! কিন্তু, পুলিশ জানতেই পায়নি সেই বিশেষ অ্যাকাউন্টটির সাথে পলার কথোপকথন।
পলার ফেসবুক থেকে সেই অ্যাকাউন্টটি ভ্যানিস! এমনকি সেই মেসেজটাও, “আজ রাতে তোমার বাড়ির নীচে দাঁড়াবো। ডাকবো... আমার কাছে এসো...”
যেন সত্যি ওই অ্যাকাউন্টটি ‘অশরীরি’।