Payel Guha

Romance Classics

4  

Payel Guha

Romance Classics

দূরভাষিনী

দূরভাষিনী

28 mins
467


(১)


তোমার নামে লিখবো ভাবি হাজার পাতার কাব্য।

তোমায় দেখে এদিকে যে সব ভুলি, আমার সব শব্দবন্ধ।

পাওয়ার নেশায় বুঁদ হতে চাই, পাই কীভাবে তোমায়?

তোমার প্রেমে মরণ আমার, তুমি জানতেও পারো না।


অবশ্য সে জানবে কীভাবে? জানাতেই তো পারি না। চাইলেও কী কিছু মানুষকে গিয়ে জানানো যায়, বলা যায়, “তুমি জানো না আমি তোমায় কতটা ভালবাসি!” আর বললেও বা সে শুনবে কেন?

কিন্তু তাকে আমি শুনি রোজ। রোজ... মানে রোজ। এই যেমন এখন-ও।


মনে মনে এতগুলো কথা বলতে বলতে মেয়েটি তার হাতে ধরা ফোনটার দিকে তাকালো। ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে ইউটিউব লাইভের সংরক্ষিত ভিডিও। সেখানে দেখা যাচ্ছে একটি রেডিও স্টেশনের স্টুডিও-তে একটি ছেলে বকবক করে চলছে। কখনো মুখে ফুটে উঠছে অনাবিল হাসি‌ আবার কখনো চোখে ফুটে উঠছে দুষ্টুমি। বেশ সুঠাম চেহারা তার। ধারালো মুখের আদল, মাথায় এক গোছা চুলের কিছু অংশ কপালে এসে এলোমেলো ভাবে পড়েছে। ফলে মুখে বেশ একটা সারল্য ফুটে উঠছে। ক্লিন সেভ গালে নীলচে রেখা, মুখে হাসি খেললে গালে হালকা একটা টোল পড়েই মিলিয়ে যায়। কত বয়স হবে? আঠাশ কী ত্রিশ। বেশভুষায় সাধারণ ছাপ। এই মুহূর্তে সেই ছেলেটি একটা গান গাইছে, ভারী কন্ঠস্বরে গাওয়া সুর ভেসে আসছে মেয়েটির হেডফোনের মারফতে, “আর-কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ–”

ধীরে ধীরে মেয়েটিও গলা মেলালো তার সাথে। মেয়েটির চোখ বন্ধ‌। চোখের কোণে অল্প জলের একটা রেখা উঁকি মারছে... মাথাটা অল্প দুলছে। ফোনটা বুকের কাছে শক্ত করে ধরা।

”মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না...”

থামলো মেয়েটি। চোখ বুজেই বন্ধ করল ফোনের ভিডিওটা। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ জানলার রেলিং-এ মাথাটা ঠেকিয়ে বসে রইল। একটা আবেগের ঢেউ বুকটাকে তোলপাড় করে তুলছে।সে ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে বুকের ভেতরটা। কিন্তু ও কিছু করতে পারছে না। হয়তো পারবেও না। আসলে চাইলেও কিছু মানুষকে পাওয়া যায় না। আবার ভালোবাসাও কখনো সীমা-পরিসীমা মানে না।


মেয়েটির কানে বেজে উঠলো ওর বান্ধবীর বলা কথাটা, “ভাই! এই ইনফ্যাচুয়েশন তোর। ভালোবাসা নয়। দু'দিন পর কেঁটে যাবে।”

দু'দিন পর? ঘটনাটি কী আজকের? আজ থেকে পাঁচশো পঞ্চাশ দিন, তেইশ ঘন্টা, বত্রিশ মিনিট। এতোটা সময় ধরে মন ধীরে ধীরে বড়ো যত্নে একটা অনুভূতিকে লালন করছে। যে অনুভূতিটিকে ও নিজেও বহুবার নস্যাৎ করতে চেয়েছে কিন্তু শেষ অবধি পারেনি। সেটা কী শুধুই ইনফ্যাচুয়েশন? নাকি...


(২)


গাড়িতে উঠে অর্ণ হাতের মুঠোয় ধরে রাখা কাগজটিকে খুলল। আর সাথে সাথে মনটা ভরে গেল। কী সুন্দর হাতের লেখাটা! মুক্তোর মতন হাতের লেখায় দু'টো লাইন লেখা।


“কেউ আছে জেনো এই আকাশের নীচে,

তোমার নামে বুকের মাঝে ধ্রুবতারা পোষে।”


অর্ণ পাঠ করে লাইন দুটো। কিছুক্ষণ আনমনে বিড়বিড় করে। তারপরে ধীরে ধীরে এলিয়ে দেয় শরীরটা গাড়ির সিটে। ক্লান্ত চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। গাড়ি এখন ফ্লাইওভারের উপর যাচ্ছে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলছে। আকাশের দিকে চাইলো ও। প্রথমার বড়ো চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। এই মুহুর্তে কোনো বড়ো বিল্ডিং এসে ঢেকে দিচ্ছে না তাকে। চাঁদটাও যেন তাকিয়ে অর্ণর দিকে। অর্ণ একবার মাথাটা বাড়িয়ে আকাশে আরো তারাদের দেখায় চেষ্টা করলো। যতদিন যাচ্ছে আকাশ থেকে তারাগুলো যেন রিটায়ারমেন্ট নিচ্ছে। নাহলে দিনকে দিন আকাশটা এতো কালো হয়ে যাচ্ছে কেন? এই বড়ো কালো আকাশটার মাঝে চাঁদটাকে কী একলা লাগেনা? ঠিক আজকালকার দিনের মানুষ গুলোর মতন। আর তারা গুলো আমাদের পাশে থাকা সেই সব মানুষরা, যাদের থাকার কথা ছিল আজীবন। কিন্তু, হঠাৎ করেই টুপ করে হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। পরিবর্তে একরাশ অন্ধকার-ই তো চিরসঙ্গী হয়ে রয়েছে। তবুও আমরা ধ্রুবতারা খুঁজে বেড়াই। যাকে বুকে নিয়ে এগোতে চাই জীবনের বাকি পথ!


আনমনেই কথাগুলো ভাবছিল। শেষ কথা দু'টো মাথায় আসতেই চমকে উঠল অর্ণ।

“কেউ আছে জেনো এই আকাশের নীচে,

তোমার নামে বুকের মাঝে ধ্রুবতারা পোষে।”


লাইনটা! এটা! এটা কেউ কেন ওকে দিল? ওকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছে? নাকি... বুকের ভেতর একটা মোচড় টের পায় অর্ণ। অদ্ভুত এক অমুলক আশঙ্কার ঘূর্ণি বইতে শুরু করেছে বুকের মধ্যে।


— কীরে অর্ণ? তখন থেকে কী বিড়বিড় করছিস? আর হাতের ওই কাগজটা কী? লাভ লেটার নাকি?

অর্ণর চমক ভাঙলো শৌর্যর কথায়। শৌর্য ওর কলিগ। ওরা একসাথেই রেডিও স্টেশনে কাজ করে। অর্ণ নিজে আর.জে। আজকে একটি সিনেমার প্রোমশনে এসেছিল ওরা দুজনে মিলে চ্যানেলের হয়ে। সেখানে শোয়ের শেষে যখন স্টেজ থেকে দর্শকদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন স্বাভাবিক ভাবেই অনেকগুলো হাত উঠে আসে তার মধ্যে একটা ছোঁয়া অর্ণর পরিস্কার মনে আছে। ওরকম সময়ে, অত এক্সাইটমেন্ট এর মধ্যেও ওর মন টুকে রেখেছিল ছোঁয়াটা। সেই নরম হাতটা পরম আদরে ওর হাতটা ধরেছিল। কিছু একটা ছিল সেই ছোঁয়ার মধ্যে। অর্ণ যখন হাতটা তোলে তখন ওর হাতে এই কাগজটা উঠে আসে। ফেলে দেবে ভেবেছিল। সেই সময়েই ছবি তোলার জন্য ওর হাত ধরে একজন টানলো! তড়িঘড়ি পকেটে পুরে নেয়‌। যদিও ও বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিল, কেউ ইচ্ছে করে কাগজটা ওর হাতে দিয়েছিল। কৌতুহল হচ্ছিল।


পুরো ব্যাপারটা বলতেই শৌর্য বলে ওঠে, “কী ব্যাপার চাঁদু? লাভ লেটার নাকি!!”, তার গলায় স্পষ্ট কৌতুকের আভাষ।

হেসে ফেলে অর্ণ, কিছু না বলে কাগজটা বাড়িয়ে দেয় শৌর্যর দিকে।

— কে রে মেয়েটা?

— চিনি না‌।

— কে দিয়েছে দেখিস নি?

— না! বললাম না, সুযোগ-ই পাইনি। আর তাছাড়া তুই সিওর এটা কোনো মেয়ে দিয়েছে?

— তোর কোনো সন্দেহ আছে নাকি? এত সুন্দর হাতের লেখা কোনো ছেলের হতেই পারে না। কী সুন্দর লিখেছে না লাইনটা? তোর প্রেমে পড়েছে মনে হয়।

অর্ণ হেসে মাথা ঝাকাল দুদিকে। শৌর্য বলে চলে, “তোর-ই তো দিন গুরু। তোর জন্য তো হাজারটা মেল, ডিএম এসেই যাচ্ছে। তারপর কমেন্ট বক্স। তোর ক্রেজ কী আর কম? দেখ তোর তেমন কোনো প্রেমিকার কাজ এটা!

— আহ্ থামবি!, অর্ণ মৃদু ধমকে ওঠে।

শৌর্য ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “এনজয় কর ভাই, এনজয় কর। তুই না কেমন একটা হয়ে গেছিস... তোর লিসেনাররা যদি তোর এই স্বরূপ দেখতো তাহলে আকাশ থেকে পড়তো। ধুস!"

শৌর্য বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় জানলার দিকে। অর্ণ কিছু বলে না, শুধু হাসে। অফিসের সবার একটাই অভিযোগ, “তুই কেমন বদলে গেছিস।" ও নিজেও জানে বদলে গিয়েছে। কখনো কখনো নিজের জীবনটাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। যা হচ্ছে হোক... কী যায় আসে! বেঁচে থাকাও যা, মরে গেলেও ক্ষতি নেই। মরণ তো সহজ নয়, তাই বেঁচে থাকতে হয়‌। তখন ফেম, সাকসেস, প্রেম, ক্রাশ , ভালোবাসা এসব কিচ্ছু অর্থ রাখে না। হ্যাঁ ভালোবাসার-ও অর্থ থাকে না। ভালোবাসার কারণটা যখন জীবন থেকে হারিয়ে যায়, আর কোনো কিছুর কী সত্যি কোনো অর্থ থাকে?


(৩)


ভালোবাসা কখন নিয়ম মেনে চলে না। উচিত-অনুচিত বোঝে না। ভালোবেসে ফেলতে হয়। তাই না?

কিন্তু সব বন্ধুরা ওকে বুঝিয়ে চলছে, “ভাই অর্ণ তোর অবসেশনের জায়গায় চলে গিয়েছে। আর অবসেশন কখনো ভালো না। পাগল হয়ে যাবি তুই।”

অবসেশন! ও নিজেও তো চেয়েছিল পাগলামো থামিয়ে দিতে। কিন্তু, পারছে কোথায়! সন্ধ্যে হতে না হতেই পাগল পাগল লাগে তার কন্ঠস্বরটা না শুনলে। মে বি এটা অবসেশন। এটা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। কিন্তু, অবসেশনের সব কিছুই কী খারাপ নাকি? ও শুনেছিল, ভালোবাসতে হলে নাকি তার নেশার মজতে হয়। তবেই তো ভালোবাসা যায় তাই না?


ফোনের গ্যালারি ভর্তি তার ছবি। তার মধ্যে থেকে এই ছবিটা ওর বড্ড প্রিয়। কারণ এটা যে নিজে তুলেছিল। ব্ল্যাক ব্লেজার, হোয়াইট শার্ট-ব্ল্যাক প্যান্টে ফর্মাল লুকে কি দারুণ লাগছিল! কাল তো শুধু সে আসবে জেনেই ছুটে গিয়েছিল শপিং মলে। একটা সিনেমার প্রমোশনের জন্য এসেছিল সে। অনুষ্ঠানের শেষে যখন সামনের সারির সবার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, ও নিজেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার দিকে। এখনও সেই উষ্ণ স্পর্শটা লেগে রয়েছে মনে।


চাইলে গিয়ে একটা সেলফি তুলে আনতেই পারতো। যদি শুধু একজন ফ্যান হতো তবে নিঃসন্দেহে তাই করতো। কিন্তু, ও যে... না! এভাবে তাকে পেতে চায় না। তাই, সেলফি তোলেনি। তার বদলে তার হাতে ছেড়ে এসেছিল একটা চিরকুট; একটা কবিতা। আশাকরি সে পড়েছে!

ওর চোখ আশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আচ্ছা! লেখাটা দেখার পর সে কী ভেবেছে! তার ঠোঁটে সেই হাসিটা ফুটেছিল?


একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো ভেতর থেকে। এভাবেই নিজের চিহ্ন ছেড়ে আসবে বারবার তার সামনে। আচ্ছা! সে কী খুঁজে নেবে? যদিও এসব ভাবনা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। 

কী সব ভাবছি! আনমনে মাথা ঝাঁকায় ও।


ঠিকই বলেছে পিউ, তবে ও পাগল হয়ে যাবে নয়, পাগল হয়ে গিয়েছে। হোক্! কিছু পাগলামি ভালো। যেখানে প্রত্যাশা নেই, সেখানে পাগলামো থাকলে ক্ষতি কী? নাহয় বারবার তার হাতে নিজের অস্তিত্বের সূত্র ছেড়ে দিয়েই আসলো। যদি সে চিনে নিতে পারে! ভালোবাসার টান বলে একটা কথা আছে তো নাকি!


হেডফোনটা করকর করে উঠলে মেয়েটির সম্বিত ফেরে। হেডফোনে ততক্ষণে ভেসে আসছে ইপ্সিত কন্ঠস্বরটি, “তু মেরি হ্যায় প্রেম কী ভাষা। লিখ তা হু তুঝে রোজ জারা সা!” এই গানটি শুনতে শুনতে ফিরে এলাম আমি অর্ণ, তোমাদের কাছে, উইথ্ ফ্রেন্ডস্ ফর এভার। তো বন্ধুরা তোমরা তোমাদের ভালোবাসা আমাদের জানাতে কখনোই কাপর্ণ্য করো না। ফেসবুক কমেন্টস্ টু হোয়াটসঅ্যাপ। হোয়াটসঅ্যাপে শুধু টপিকের মেসেজ-ই নয়, কখনো তোমরা তোমাদের আনন্দ ভাগ করে নাও আমাদের সাথে। আর আমি দেখি, আনন্দটুকু অনুভব করি। তবে আজ... আজ আমি তোমাদের মধ্যে থেকে একজনের পাঠানো একটি কবিতা পাঠ করে শোনাবো।"


মন দিয়ে শুনছিল সে। হঠাৎ শেষ কথাটা শুনেই চমকে উঠলো। সোজা হয়ে বসল‌। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে... শক্ত করে ধরে ফোনটাকে। কী! কী বলল অর্ণ? কবিতা পাঠ করবে? কার? আ... মা...র কী?


ওদিকে ভেসে আসছে কথা, “ উম্... কে লিখে পাঠিয়েছে তার নাম আমি বলতে পারছি না। কারণ, সে হয়তো চায় না আমি তাকে চিনতে পারি। সে বেশ কয়েকবার কবিতা পাঠিয়েছে কিন্তু কখনো তার নাম লিখে দেয় নি। কোথায় থাকে তাও সে বলে না। যেই পাঠাক না কেন! বড়ো অসাধারণ লেখে সে‌। তাই ভাবলাম, রোজ আমি একা পড়ি, আজ বরং একটু ভাগ করে নিই তোমাদের সাথে...”


(৪)


“ভালোবাসি, তা বলতে বড় ভয় লাগে

 আশার বিষ ছড়িয়ে নীল শরীর।

 তোমার জন্যে চোখের সাগর শূন্য আজ

 তুমি কী জানো, তুমিই মরীচিকা সেই মরুভূমির।


 অপেক্ষা নামক মিথ্যে কথায় ভুলছি আমি

 মন পুড়তে বড়োই আরাম পায়।

 কল্পনাতে তুমি শীতের বনফায়ারের

 লুকিয়ে রাখা উষ্ণতাটির ঠিকানা।


 জানবে না গো তোমার নামে কী লিখি।

 কবিতাদের ছিঁড়ে কাগজের প্লেন বানাই

 তোমার ঠিকানা কবে থেকে ভীনদেশী

 আমি একটা বোকা, বেদুইন একলা-ই।"


কবিতাটি শেষ করে কিছু মুহূর্ত থেমে বলতে শুরু করলো অর্ণ,“তোমাকেই বলছি। হ্যাঁ, তোমাকে। শোনো আজকে যখন কবিতা পাঠাবে নামটা দিও কিন্তু। আর আজকের কবিতা কোথায়? হ্যাঁ? রোজ তোমার কবিতা পড়াটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে যে! আজকেরটা কৈ? আড্ডার শেষ ঘন্টায় তো চলেই এলাম।, আলতো হেসে, “জানো, বড়ো ভালো লেখো তুমি। তুমি কে বলতো? আমার মতন আজকের পর থেকে আরো কত কত মানুষের-ও তো জানতে ইচ্ছে করবে কে লেখে এতো সুন্দর করে! কার মনে এতো ভালোবাসা?”

যারা এই মুহূর্তে অর্ণকে শুনছে তারা জানে এই মুহূর্তে ওর কন্ঠস্বরটা কী ভীষণ রোমান্টিক লাগছে! অর্ণ সেটা নিজেও জানে। আলতো হেসে বলে চলে, “ এই দেখো তুমি আমার মধ্যেও ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছো! ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়া বড়ো দরকার। ভাইরাস নয় ভালোবাসা সংক্রমিত হওয়া দরকার...”

শেষ লাইনটা বলার সময় অর্ণর গলায় অল্প কাঁপুনিটা অর্ণর নিজের কান এড়ায়নি। শ্রোতারা কী বুঝতে পেরেছে? সেটা বলা যায় না। অর্ণ সামলে নেয় নিজেকে। নিজের গহীনে লুকিয়ে রাখা ক্ষতটাকে সবার সামনে আনতে ও চায় না। যারা জানে তারা জানে! কিন্তু, তা বলে বারবার নিজের কষ্টটাকে মুলধন করে মুনাফা আদায় করতে ও পারবে না। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে থাকে, “তবে এখন সময় একটা গানের। পরের গানটা তোমার জন্য ফ্রম চন্দ্রবিন্দু, ‘এইটা তোমার গান’। শুনতে থাকো ফ্রেন্ডস্ ফর এভার উইথ অর্ণ অনলি অন 92.9fm।"


হেডফোনটা নামিয়ে চুপচাপ বসল কিছুক্ষন। এদিকে ফেসবুক লাইভ হচ্ছে। রোজ শো চলাকালীন আধঘন্টা বা একঘন্টা ধরে লাইভ করে। বেশ মজা হয়। আড্ডা দিতে দিতে সময় পার হয়ে যায়। কিন্তু, এই মুহূর্তে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে না।অন এয়ার কথা গুলো বলতে বলতে নিজেই এমন কিছু কথা বলে ফেলেছে যা নিজের অতীতের কিছু স্মৃতিকে উসকে দিয়েছে। এক ঝলক ফোনের দিকে চাইলো। কমেন্ট আসছে... কেউ কবিতাটা নিয়ে লিখেছে। কেউ ওর প্রসঙ্গে বলছে। ওর মধ্যে আবার তেতোভাবটা জেগে উঠেছে। মাঝে মাঝে সব কিছু কেমন যেনো তেতো লাগে। সেই সময়টা নিজের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। শরীরের প্রতিটা ইন্দ্রিয় কেমন যেন বিদ্রোহ করতে থাকে। চোখটা জ্বালা করে। কানে কেমন একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক অনুরণিত হয়। সারা শরীরের যেন কেউ ভাইব্রেশন মোড অন করে দিয়েছে কেউ। অর্ণ বুঝতে পারছে ওর মুখের বদলটা দর্শকদের নজরে পড়ে যাবে। এখুনি কমেন্ট আসলো বলে, “দাদা কী হয়েছে...” ও আর সেই সুযোগ দিল না। হাত নেড়ে, মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলে, “আবার কালকে আড্ডা দেব। আজ এটুকুই থাক্। তোমরা অন এয়ারে আমার সাথে যুক্ত হয়ে যাও। ভালো থেকো, সাবধানে থেকো। টাটা...”

বলেই লাইভটা বন্ধ করে দেয়।


ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। কানে বাজছে একটা কন্ঠস্বর, যে কন্ঠস্বরের অধিকারিনীকে হারিয়ে ফেলেছে দুই বছর আগে।


“চোখে চোখ ছুঁয়ে যায়

কথারা ছুটিতে গিয়েছে কবেই।

নৈশব্দকে বড্ড আপন লাগে

কে বলে “ভালোবাসি ভালোবাসি" মুখে বলতে লাগে?”কবিতাটা বলে সোজা তাকায় মেয়েটি অর্ণর চোখের দিকে। চোখ কথা বলে অর্ণ শুনেছিল, প্রথমবার উপলদ্ধি করল। কারোর চোখে নিজের জন্য প্রেম দেখতে পাওয়ার কপাল সবার থাকে না। তবে ওর আছে। ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসা মেয়েটির হাতে একটা গোলাপ। করিডোরে এই মুহূর্তে কেউ নেই। কিন্তু আসতে কতক্ষণ। অর্ণ চকিতে মেয়েটিকে বলে, “কী করছিস! স্যারদের চোখে পড়লে কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে!”

সে উত্তর দিয়েছিল, “হোক্! আগে তুই বল।”

— কী বলবো?

— তুই জানিস না কী বলবি?

অর্ণ সত্যি বুঝতে পারছিল না কী বলবে। সামনের মেয়েটিকে প্রথমদিন কলেজে দেখার পরেই ভালো লেগেছিল ওর। তবে ঐটুকুই। তার বেশি এগোনোর কথা ভাবেওনি অর্ণ‌। অপরদিকে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব হতেও সময় লাগেনি। তার জন্য আরো বেশি ভাবনা চিন্তা করেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বন্ধুত্বে প্রেম এনে ফেললে প্রেমটাও নষ্ট হয়, আর বন্ধুত্বটাও। আর শেষমেষ সে কিনা প্রোপজ করছে?


— এই আর কতক্ষন বসে থাকবো রে! পা ব্যাথা হয়ে গেল!

— তা বসে আছিস কেন?

— এবার কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে!

— কী বলবো?

— যা জানতে চাইছি!

অর্ণ আলতো হেসে বলে, “নৈশব্দকে বড্ড আপন লাগে

কে বলে “ভালোবাসি ভালোবাসি" মুখে বলতে লাগে?”


মেয়েটির মুখে চওড়া একটা হাসি খেলে যায়। চকিতে অর্ণকে জড়িয়ে ধরে সে। অর্ণর দু'হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে...


আজ দশ বছর পাড় হয়ে গেলেও যেন সেই উষ্ণতাটুকু শরীরে লেগে রয়েছে। অর্ণ ফিরে আসে বর্তমানে। হাতে ধরে থাকা ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে একটা ছবি। হাসি মুখে অর্ণ আর বড়ো আদুরে ভঙ্গিতে ওর গলা জড়িয়ে রয়েছে একটি মেয়ে। ঘন কাজল চোখ, কপালে কালো একটা টিপ, এক পাশে একঢাল চুল উপচে এসে পড়ছে। খুব সুন্দর লাগছে দুজনকে একসাথে। ছবিটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখটা ভিজে এসেছিল অর্ণর। বিড়বিড় করে ওঠে ও, “মিস্ ইউ প্রি... আই অ্যাম মিস্ ইউ সো মাচ্...”


চোখের কোণটা মুছে সামনের দিকে তাকায়। পরের লিংকটা চলেই এলো। ফোনটা অফ করে টেবিলে রেখে একবার কম্পিউটারটির দিকে দেখে। টপিক নিয়ে বেশ ক'টা হোয়াটসঅ্যাপ এসেছে। অনেক সময় টপিকের বাইরের এক্সট্রা ম্যাসেজ-ও আসে। দেখতে থাকে, কোনগুলো এরপর পড়বে। তখনি একটা নতুন ম্যাসেজ ঢোকে; নম্বরটা এতদিনে চিনে গেছে অর্ণ। অর্ণ অনুভব করে ওর মধ্যে উত্তেজনা খেলে গেল। যেন নিজের অজান্তেই অপেক্ষা করছিল এই ম্যাসেজটির। ও খুলল চ্যাট-টা, সেখানে পরপর লাইন সাজিয়ে আবার একটি কবিতা পাঠিয়েছে,

“তোমার চোখে দেখি টলটলে ঝিল।

তাতে সার সার পাথর স্বচ্ছ জলের নীচে। সেই পাথর গুলোকে ধরে ধরে নাম দিলাম আমি। একটা কষ্ট, একটা দুঃখ, একটা যন্ত্রণা, একটির নাম দিলাম বরং বিচ্ছেদ।

সেই সব পাথরকে বুকে আগলে ধরে, তোমার ওই চোখের ঝর্ণা হব আমি।"


হাতের মাউসটাকে শক্ত করে ধরল অর্ণ। বুকের মধ্যে টইটুম্বুর দীঘিটায় যেন সুনামী উঠেছে। কীভাবে! মেয়েটি কীভাবে ওর মনের ভাবটা বুঝতে পারছে! কীভাবে?

কে পাঠাচ্ছে এই লেখা গুলো? না! আজকেও নাম লেখা নেই। আবারও প্রতিদিনের মতন নম্বরটার উপর ট্যাপ করে নামটা দেখলো, আজকেও সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা শব্দ; ‘কুহক’। এটা তো কারোর নাম হতে পারে না। আর ওর সিক্স সেন্স বলছে কবি একজন মহিলা। কে সে? অর্ণ বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “তুমি কে বলতো?"



(৫)


— জীবনে এই প্রথম কাউকে সেলেব্রিটির প্রেমে পাগল হতে দেখলাম।

— না! এমন পাগল অনেক পিস্ পাবি পৃথিবীতে। কিন্তু, চোখের সামনে এমন নমুনা দেখতে পাবো জীবনেও ভাবিনি।


কথাগুলো শুনে আলতো হাসলো সে। পড়ন্ত বিকেলের লালচে আভা তার মুখের আদলটাকে আরো মায়াময় করে তুলেছে। কাজল রাঙা ভাষা ভাষা চোখ তুলে আকাশের দিকে চাইলো। সে তার আরো দুই বন্ধুর সাথে এখন বাড়ি ফিরছে ইউনিভার্সিটি থেকে। প্রথম কথাটি যে বললে তার নাম রিতা। আর সাথে অপর বন্ধুটির নাম দিয়াসা।


দিয়াসা বলে ওঠে, “আমাকে একটা কথা বল! তুই কেন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিস! মানে তুই যেভাবে রোজ কবিতা লিখে পাঠাস। এদিকে ফেসবুক-ইনষ্টা সব জায়গায় সব সময় সিসিটিভির মতন দেখে যাচ্ছিস। এতোদিনে তোকে অর্ণ চিনে যেত ভাই!”


সে আবারও হাসে, “কী হবে বলতো চিনে!”

রিতা বলে ওঠে, “আমার না তোকে পুরো সাইকো মনে হয় বিশ্বাস কর ভাই! তুই কী রে! আর.জে অর্ণর জন্য তুই এতোটা পাগল। অর্ণ কোথাও আসছে শুনলে ছুটে যাস। হাত মিলিয়ে আসিস। কিন্তু, নো সেলফি? আর দিয়া তো ঠিকই বলেছে, এই যে এতো কবিতা পাঠাস, কাল তো পাঠ পর্যন্ত করলো। একবারও নাম লিখে পাঠাস নি। অর্ণ অবধি জানতে চাইছে কে লিখছে কবিতা গুলো। আর এদিকে তুই? কী চাইছিস বল তো?”


সে হেসে বলল, “চাই তো অর্ণকে কিন্তু চাইলেই তো পাবো না। তাই, এটুকুই আমার।”


— মানে?


দিয়ার দিকে চেয়ে বলে, “এই আমাকে জানতে চাওয়ার কৌতুহলটুকু! এটাই শান্তির। ধর সব জায়গায় কমেন্ট করা যদি শুরু করলাম। আই লাভ ইউ বলছি কমেন্টে—কিন্তু তাতে লাভ কী হবে? আরো হাজারটা মেয়ে ওকে হাজারবার আই লাভ ইউ বলে যাচ্ছে! তাদের ভীড়ে আমিও হারিয়ে যাবো। আর কবিতাগুলোর সাথে যদি নাম লিখে দিই, তাতেই বা কী হবে? একজন লিসেনার ভালো কবিতা লিখে পাঠাচ্ছে, তার অমুক নাম! আর সেই নাম ধরে ধন্যবাদ বলবে‌। ব্যাস! তারপর ভুলে যাবে। কিন্তু এই যে আমি কোথাও নেই। কবিতার শেষে আমার নাম নেই। ও আমাকে জানতে চাইছে। দু'দন্ড আমার কথা ভাবছে! এটুকুই তো আমার... এইটুকু শুধু আমার।


দিয়াসা আর রিতা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। চোখের ভাষা বলছে, “এই মেয়ে পেগলেছে পুরো।”এই মনোভাবটা চেপে না রাখে, রিতা বলে ওঠে, “আমাদের সৌভাগ্য জানিস তো! সাক্ষাৎ দেবদাসীকে দেখতে পারছি আমরা।"


— দেবদাসী!


— আরে ফিমেল দেবদাস!


হেসে ফেলে এবার তিনজনেই। হাসতে হাসতেই সে বলে, “ধুস! দেবদাস হবো কোন দুঃখে। অর্ণ কি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে নাকি? উপরন্তু অর্ণকে নিয়ে কোনো দিন আমাকে কষ্ট পেতেই হবে না।”


বাকি দুজন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে চায়। সে হেসে বলে, “ওমন করে তাকানোর কিছু হয়নি। ঠিকই বলেছি। দেখ, এই যেমন দিয়াসা অনুজকে পছন্দ করে। কিন্তু, অনুজের পছন্দ আমাদের জুনিয়র প্রিয়াকে। এই জন্য বেচারির কত কষ্ট! স্বাভাবিক না! যাকে আমরা ভালোবাসি তাকে অন্য কারোর সাথে দেখা বড় কষ্ট দেয়। কিন্তু আমার এসব চাপ নেই। কারণ, আমার কোনো এক্সপেক্টেশন-ই নেই অর্ণকে নিয়ে। কোনো সেলেব্রিটিকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি কিন্তু তাকে নিয়ে তার বেশি কিছু ভাবাটা বোকামো। তাই না? এইটুকু জ্ঞান আমার আছে।”


ক্রাশের কথা তোলায় দিয়াসার মুখটা ভার হয়ে যায়। তেতো গেলার মতন মুখ করে ঝঁঝিয়ে ওঠে, “সেলেব্রিটি না হলেও তোর চাপ হতো না। ওর ওয়াইফ তো মারা গিয়েছে!”


কথাটা শেষ হতে না হতেই তার চোখে- মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। ওর মনে পড়ে যায় গতকালকের অর্ণর চোখটা। ওর সাথে কথা বলতে বলতে... ও থুড়ি, ডাইরেক্ট কথা বলা নয়। রেডিওতে কথা বলে চলছিল সেই কবিতাটি যে লিখেছে তার উদ্দেশ্যে। সেটা এক প্রকারে ওর সাথেই কথা বলা হলো তাই না?


এখনো সেই যে কথাটা কানে বাজছে ওর, অর্ণ বলেছিল, “ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়া বড়ো দরকার। ভাইরাস নয় ভালোবাসা সংক্রমিত হওয়া দরকার...”

আর তারপরেই অর্ণর ছলছলে চোখটা ওর চোখ এড়ায়নি।

প্রতিদিন রেডিওতে অন এয়ার শো চলাকালীন ফেসবুকেও লাইভ করে অর্ণ। স্বাভাবিক ভাবেই ও কখনো লাইভ মিস করে না! কালকেও লাইভে ছিল। মুহুর্তের পার্থক্যটা বুঝতে পেরেছিল। ওই চোখ দুটোর দিকে তো লাইভ চলাকালীন চেয়ে থাকে ও সব সময়। ও বুঝতে পেরেছিল সেই লাইনটার অর্থটাও,

“ভাইরাস নয়, ভালোবাসা সংক্রমিত হওয়া দরকার।"

দিয়াসার দিকে রাগী রাগী চোখে চেয়ে বলে ওঠে, “কারোর কষ্টের জায়গা নিয়ে এভাবে বলতে নেই জানিস না! আমি আসি এখন। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”


আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যায় সে। বেলা পড়ে আসছে। পশ্চিম আকাশে সূর্য আরো একটু ঢলে পড়েছে। শহরে আস্তে আস্তে জোনাকির মতন আলো গুলো জ্বলে উঠছে একটা দু'টো করে। কিছুটা এগিয়েই বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়ায়। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। বাসে জানলার পাশে জায়গাও পেয়ে যায়। রাজপথ বেয়ে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলছে বাসটা। আলতো করে এলিয়ে দেয় মাথাটা জানলায়। মনে মনে ভাবে, গতকাল অর্ণর লাইভটা বন্ধ করে দেবার পর পর একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে ছিল। আচ্ছা, কবিতাটা পড়ে তার কেমন লেগেছিল? তার কষ্টে কী মলম পড়ছিল? বুঝেছিল? তার কষ্টের পাশে কেউ একজন আছে এই পৃথিবীতে। সহব্যাথী হয়ে... এ পৃথিবীতে এমন কেউ আছে, যে তার চোখের ঝর্ণা হতে চায়! সব কষ্ট গুলোকে নিজের বুকে নিয়ে...


মনে আওড়াতে থাকে গতকালকের তাকে পাঠানো কবিতাটা…



(৬)


দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটার উপর অর্ণর প্রতিচ্ছবি পড়ছে। এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে সে। ছবিটা ও এবং ওর স্ত্রী প্রিয়দর্শিনীর। সেই কলেজ থেকে শুরু হওয়া প্রেম। সাত বছর টানা প্রেমের পর, বিয়ে করেছিল ওরা ২০১৯-এ। আর.জে-র চাকরিতে ততদিনে যথেষ্ট নাম করে ফেলেছে। কত ধুমধাম করে বিয়ে হলো ডিসেম্বরে। তারপর ছয় মাসের সংসার। মাত্র ছ'মাস। ২০২০-র বিষের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি প্রিয়দর্শিনীকে। করোনা আক্রান্ত হলো। সেই যে হসপিটালিইজ্ হতে হলো আর ফিরে আসলো না। তারপর কেঁটে গিয়েছে দু'টো বছর। 


অর্ণর ঘরে শুধু প্রিয়দর্শিনীর কোনো ছবি নেই। রাখেনি আসলে। ওই প্রাণবন্ত মুখের উপর মালা ঝুলিয়ে রাখবে! সহ্য করতে পারতো না অর্ণ। সরিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, অর্ণর ঘরটা বিয়ের আগে এসে প্রিয়দর্শিনী আর অর্ণ হাতে হাত লাগিয়ে নতুন করে সাজিয়েছিল। ওদের ছবিতে ঘরটা সাজানো ছিল। বিছানার পিছনের দেওয়ালে একটা বড়ো ফটো ফ্রেম টাঙানো ছিল। সে সব প্রিয়দর্শিনী মারা যাওয়ার পর অর্ণর মা খুলে নিয়েছে। আসলে অর্ণ ঘরটায় থাকতেই পারতো না। এখন আর অর্ণ মনেও করতে চায় না সেই সব দিন গুলো। কীভাবে যে বেড়িয়ে এসেছে সেই ডিপ্রেসড্ ফ্রেজটা থেকে! ওর এক বন্ধু কাউন্সিলর। তার কাছে সেশন নিতে অবধি হয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে কাজে নিজেকে ডুবিয়ে সবটা ভুলে থাকা আর কী! মাঝে মধ্যে এখন ভাবে, সত্যি কী বেড়োতে পেরেছে ডিপ্রেশন থেকে? নাকি মনের জোরটাই ফিরে পেয়েছে শুধু। আর হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। 


কাঁধে হঠাৎ একটা ছোঁয়া পেয়ে চমক ভাঙে অর্ণর। কাঁধে হাতের চাপটা আরো একটু বাড়ে। চোখের কোণে জমে ওঠা জলটাকে মুছে নিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়ায়। ও না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছিল বাবা এসেছে। 

— কীরে! বেড়োবি না কাজে?

অর্ণ আলতো হেসে বলে, “এই তো রেডি আমি। আসলে...”

— প্রিয়-কে এখনও মিস করিস?

কিছু বলল না অর্ণ। এক ঝলক তাকালো ছবিটার দিকে। এখন এই ঘরে একটাই ছবি রাখা আছে। দুজনের একসাথে, কলেজের ফেয়ারওয়েলের দিন তুলেছিল। ওই চনমনে হাসি মুখটা দেখলে সব সময় বুকটা মুষড়ে ওঠে। 

আসলে সবাই ভাবে আউট অফ সাইট হলে আউট অফ মাইন্ড হয়ে যায়। বাস্তবে কিন্তু তা হয় না। মনের ভিতর একবার যাকে জায়গা দেওয়া হয়, তাকে কী অত সহজে বের করে দেওয়া যায়? যায় না। 

প্রিয়দর্শিনী মারা যাওয়ার পর, ও যাতে নিজেকেই নিজে সামলাতে পারে তার জন্য প্রচন্ড সাপোর্ট করেছিল ওর মা-বাবা। একবার কানাঘুষো মা'কে বলতে শুনেছিল, “বাবুর কী আরেকটা বিয়ে দেওয়া যায় না... ছেলেটার কী অবস্থা বল তো? একজন সঙ্গী পেলে মনের ক্ষতটা দ্রুত সাড়তো তাই না?”

ওর মনে আছে বাবার উত্তরটা। বাবা বলেছিল, “ভালোবাসা কখনো ভুলে যাওয়া যায় না রমা! বাবুকে ছেড়ে দাও ওর মতন। ঠিক গুছিয়ে নেবে নিজেকে। সঙ্গী বলে কাউকে সামনে এনে দিলেই সঙ্গী হয়? বোঝা হয়ে যায় সেটা। যদি বাবুর মন কাউকে কোনোদিন খুঁজে নেয়, তবে আবার একটা গল্প শুরু হবে। আমরা চাইলেও হবে, না চাইলেও হবে।"


বাবা, এই মানুষটা সব সময় কোন এক মন্ত্রবলে ওর মনের কথা বুঝে যায়। এই যেমন এখন ওকে ওর মতন ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। অর্ণ এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের দিকে। হাতঘড়িটা হাতে তুলে নিয়ে পরতে পরতে হঠাৎ মনের মধ্যে একজনের কথা জাগে। তাকে যদিও চেনে না‌। কিন্তু, চিনতে চায়। কে সে? এতদিন ধরে রেডিও-তে কাজ করছে। অনেক রকম ফলোয়ারদের ফেস করেছে। প্রচুর ভালোবাসা, প্রেমপত্র, গিফট পেয়েছে। কবিতা, গল্প-ও প্রচুর মানুষ পাঠায়। কিন্তু, সবার মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করার একটা টেনডেন্সি থাকে। কিন্তু, পার্টিকুলার একজনের থেকে অফিসের হোয়াটসঅ্যাপে যে কবিতা আসছে তার সাইকোলজিটা ঠিক বুঝতে পারে না অর্ণ। সে কী চায়! ফেম তো চায় না! চাইলে কাল অন এয়ার তার কবিতা পাঠ করার পর, অতবার করে বলা হলো, তারপর নিশ্চয়ই নাম লিখে পাঠাতো। কবিতা গুলো বেশ কয়েক মাস ধরে আসছে। প্রথম প্রথম পাত্তা দিত না। পড়াও হতো না। তারপর ধীরে ধীরে নজরে আসলো। একে একে কবিতাগুলো পড়ে। আর পড়ার পর একটা জিনিসই ওর মনে হয়, যিনি কবিতাগুলো লিখে পাঠাচ্ছেন সে যেন ওর উদ্দেশ্যেই লিখে পাঠিয়েছে! প্রতিটা কবিতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে প্রেম। কখনো কখনো তো এমন কিছু সময়ে কবিতা গুলো আসে, যেন সে ওর মন পড়তে পেরে সেই মুহূর্তের ইমোশনটাকে ভাগ করে নেওয়ার জন্য লিখে পাঠিয়েছে কবিতাটি। ঠিক যেমন গতকাল হলো। কে? কে আড়ালের মানুষটা?


অর্ণ চমকে যায় নিজের অবস্থা দেখে। আবার নিজের অজান্তে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছে। দেখেছে এই অজ্ঞাত মানুষটির কথা ভাবলেই অদ্ভুত একটা অনুভুতি ঘিরে ধরে। যে অনুভূতিটা শেষ কলেজে টের পেয়েছিল। কী হচ্ছে ওর মনের ভেতরে?



(৭)


“কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/ তোমার চরণে দেবো হৃদয় খুলিয়া


চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি /গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি"


ভরাট কন্ঠে গানটা মনটাকে জুড়িয়ে দিচ্ছিল। অর্ণর গানের গলাটা বড়ো ভালো। অন-এয়ারেও মাঝে মধ্যে গান গেয়ে ওঠে। এই যেমন আজ। গানটা শেষ করেই বলতে শুরু করলো সে, “ভালোবাসার মানুষের কাছে সমপর্ণটা কিন্তু খুব দরকার। যাকে ভালোবাসি তার কাছে নিজের সবটুকু যদি দিতেই না পারলাম তবে কীসের ভালোবাসা তাই না?" আলতো হেসে যোগ করে সে, “কিন্তু এখন ব্যাপার হলো, সব সময় আমরা নিজেদের প্রকাশ করি না। করতে পারি না হয়তো... কী তাই না?" আবার আলতো হাসি, “কী ভাবছো তো এই কথা গুলো কেন বলছি? উম্... একটু সবুর করো। পর পর তিনটে গানের পর আমি ফিরে এসে বাকি কথাগুলো বলছি।", হেসে, “ইয়েস! ফিরে এসে বলবো আজকের কী টপিক। শুনতে থাকো সঙ্গে থাকো, আমার সাথে, নিয়ে ফ্রেন্ডস্ ফর এভার অনলি অন 92.9fm। স্টে টিউনড্..."

মাইক অফ করে হেডফোন নামিয়ে সামনে থাকা কফি কাপটায় চুমুক দিল অর্ণ। এগিয়ে এসেছে তার ফোনের দিকে, দেখছে কারা কারা জয়েন করেছে লাইভে। কী কী কমেন্ট এলো!


***

বাইরে এখন বৃষ্টি পড়ছে। জোলো হাওয়ারা এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার খোলা এলোমেলো চুলগুলোকে। আর সে দেখছে তার ইপ্সিত মানুষটাকে। সেই মানুষটি লাইভের ক্যামেরাতে নিজেকে দেখতে দেখতে চুলে হাত চালাচ্ছে বাড়বাড়। নেভি ব্লু ছিমছাম শার্ট, আর একটা জিন্স, তাতেই কী সুন্দর লাগছে তাকে! বুকের ভেতর যে যন্ত্রটা আছে! সে আরো একটু গতি বাড়াল। অলরেডি বেড়েই ছিল। একটু আগে অর্ণর কথাগুলো ঝড় তুলে দিয়েছে ওর মনে। 

চমক ভাঙলো অর্ণর কথায়। কানে গিয়ে বিঁধলো কথাটা।

অর্ণ বলছে, “তোমাদের মধ্যে কারা কারা কবিতা লেখো? যারা যারা অলরেডি জয়েন করেছো, তোমাদের মধ্যে কেউ না কেউ তো নিশ্চয়ই লেখালেখি করো! কবিতা কারা লেখো?”

প্রশ্নটা করার পর কমেন্ট আসতে শুরু করেছে এক এক করে। অনেকে বলছে “আমি লিখি।", “আমি"। 


হঠাৎ বুকটা দুরুদুরু করে ওঠে। অর্ণর শোয়ের সময়টা যত এগিয়ে আসতে থাকে ওর মনের অস্থিরতা তত বাড়তে থাকে। তার উপর আজ অর্ণর কথা গুলো অন্য রকম। পরিবেশটাই যেন অন্যরকম লাগছে। ওর মন কিছু একটা ঘটার আশঙ্কা করছে। আজ কিছু ঘটবে! কেন যে এমন মনে হচ্ছে জানে না। শুধু একটা কথা বারবার মনটা বলতে চাইছে কিন্তু... সেটা স্বীকার করতে কষ্ট হচ্ছে। বলা ভালো, স্বীকার করাটা হয়তো বোকামো। ও দেখছে আজ হয়তো প্রথমবার অর্ণ সবার কমেন্ট পড়ার চেষ্টা করছে। লাইভে একটার পর একটা কমেন্ট এসে যাচ্ছে, পিছলে যাচ্ছে কমেন্ট গুলো। তবু ধৈর্য্য ধরে পড়ার চেষ্টা করছে সে। অর্ণ কী খুঁজছে কাউকে?


মনটা ছানাকাটা হয়ে যায় মায়ের ডাকে। কানটা খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে মা কী বলছে! 

— বাবাই কিছু খাবি?

উফ্ ভগবান, এদিকে পেট গুড়গুড় করছে, আর মা খাওয়া নিয়ে পড়েছে। তড়িখড়ি উত্তর দেয়, “না মা... একটু ব্যস্ত আছি। ডেকো না।” বলে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার লাইভে মন দেয়। নিজেই বুঝতে পারছে ওর হাত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ও জানে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কখনো ভুল ইঙ্গিত দেয় না। আজ কী হতে চলেছে? শোনে অর্ণ বলছে, “আচ্ছা, তোমরা ছদ্মনামে লেখো? লেখক, কবিদের মধ্যে এই ব্যাপারটা খুব দেখা যায়। তোমাদের মধ্যে কেউ কী ছদ্মনামে লেখো? যেমন: কুহক, আঁধার — ইত্যাদি প্রভৃতি... এজাতীয় নাম ব্যবহার করো নাকি কেউ? তবে জানাও আমায় কমেন্ট করে‌।" বলে চুমুক দিল কফিতে। 


আর ধক্ করে ওঠে ওর বুক‌। হাতটা নিজের অজান্তে উঠে ঠোঁটের উপর চেপে ধরেছে। কুহক! ওর হোয়াটসঅ্যাপে নিজের নামের জায়গায় ‘কুহক’ লিখে রাখা আছে! তবে কী অর্ণ সত্যি সত্যি ও'কে খুঁজছে? উত্তেজনায় হাত কাঁপছে ওর। সারা শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ খেলে যায়!


কড়কড় করে ওঠে কানে থাকা হেডফোনটা, অর্ণ কথা বলছে। কেউ একজন লিখেছে, “কুহক আবার কারোর ছদ্মনাম হতে পারে নাকি!"

অর্ণ উত্তর দেয়, “হতেই পারে!” কয়েকজন লিখেছে তাদের পেন নেম কিন্তু, কুহক নামটা অর্ণ পায়নি। একবার রেডিও স্টেশনের বড়ো কম্পিউটারটির দিকে সে তাকায়, তারপর সম্ভবত কফির লাস্ট সিপটা নিয়ে বলে, “ওকে! সঙ্গে থাকো। অন এয়ার যাচ্ছি...”



(৮)


“আমরা অনেক সময় ভালোবেসে ফেলি। কিন্তু বলতে পারি না। এই প্রকাশ করতে না পারার ব্যাপারটা আমাদের সবারই হয়। স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে আমরা আমাদের ভালোবাসার কথাটা বলে উঠতে পারি না। সেই ভালোবাসার মানুষটি হতে পারে তোমার মা, হতে পারে তোমার বাবা, হতে পারে তোমার ক্রাশ। আবার এমন কেউ যাকে হয়তো হারিয়ে ফেলেছো জীবন থেকে। এমন কেউ যে হয়তো তারা হয়ে গিয়েছে আকাশের। তাদের জন্য না বলা হাজার হাজার কথাগুলো জমতে থাকে। সে সব হাজারটা কথার মধ্যে কিছু কথা হয়তো ডায়রিতে স্থান পায়। কিছু হয়তো স্থান পায় ফেসবুক টাইমলাইনে। কখনো হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাসে। যেটুকু সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করতে পারি, তা থাকে রূপকের মোড়কে। ইনিয়ে বিনিয়ে প্রকাশ করি, আর মনে মনে ভাবি, সে যেন বোঝে...


আজ আমি তোমাদের কাছে একটা সুযোগ করে দিতে চাইছি মনের কথা বলার জন্য। কনফেশন... ভালোবাসার কনফেশন। তোমরা তোমাদের জমানো মনের কথা বলো আমাকে কল করে হোক বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। আজ আমার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক তোমাদের ভালোবাসার কথা তোমাদের ভালবাসার মানুষের কাছে। তবে আর দেরি কীসের! আমি অপেক্ষা করছি তোমার কল বা মেসেজের... আমি অর্ণ রয়েছি তোমাদের বেষ্ট ফ্রেন্ড নিয়ে ফ্রেন্ড ফরএভার।"


এরপর কল করার নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা বলে মাইক অফ করে হেডসেটটা নামিয়ে রাখে। লাইভে দুটো কথা বলে বন্ধ করে দেয়। ভালো লাগছে না। মনটা বড় চঞ্চল হয়ে রয়েছে। আমরা অনেক সময় এমন কিছু কাজ করে ফেলি, যা খুব একটা অঙ্ক কষে করা হয় না। আমরা বুঝতেও পারি না কেন করছি কাজটা। শুধুমাত্র মন থেকে মাথায়, আর মাথা আমাদের যে র্নিদেশটুকু দেয়— সেটুকুই পালন করে চলি। আজ অর্ণর অবস্থাটিও তাই। নিজের অজান্তেই ও একজনকে খোঁজার চেষ্টা করছে। মনে পড়ে যায় আজ শৌর্যর সাথে যে কথা গুলো বলেছিল...


আজ লাঞ্চ টাইমে চুপচাপ টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসেছিল অর্ণ ক্যানটিনে। হঠাৎ কাঁধে হাতের স্পর্শে মাথা তুলে দেখে শৌর্য।

— কী হয়েছে তোর?

— কিছু না। 

শৌর্য উত্তরটা শুনে হাসে, যেন ও জানতো এই উত্তরটাই আসবে। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে, “বুঝলাম। তারপর বল কী হয়েছে?”

অর্ণ কী বলবে বুঝতে না পেরে তাকায় শৌর্যর দিকে। শৌর্য চেয়ার টেনে ওর পাশে বসে, অর্ণর কাঁধটা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে বলে, “প্রিয়দর্শিনীর কথা ভাবছিস? আমার মনে আছে আজকের দিনটা...” 

শৌর্যকে থামিয়ে দিয়ে অর্ণ বলে ওঠে, “না রে! আমি ওই মেয়েটির কথা ভাবছি, যে আমার শো-তে প্রায় প্রতিদিন কবিতা পাঠায়।”

শৌর্য চমকে যায়। এমন উত্তর মোটেও আশা করেনি। ভালো করে তাকায় অর্ণর দিকে। অনেকদিন পর... অনেকদিন পর, অর্ণর চোখটা আজ প্রাণবন্ত লাগছে। আজ অনেকদিন পর যেন ছেলেটার মধ্যে প্রাণ এসেছে। শৌর্য শোনে অর্ণ বলছে, “আমার খুব কৌতুহল হচ্ছে কে সে?”

— মা... নে! তুই একজন আননোন লিসেনারকে খুঁজছিস?

— খুঁজতে চাইছি। যে-ই লিখুক অসাধারণ লেখে। আর কীভাবে বুঝে যায় আমার সিচুয়েশনটা? আর...

— আর?

— জানি না কেন, একটা কথা মনে হচ্ছে লাষ্ট ক'দিন ধরে, যা কিছু লিখে পাঠিয়ে থাকে সে, তার আড়ালে অন্য কোনো বক্তব্য আছে। আমাকে কিছু বলতে চায় সে...


শৌর্য বুঝতে পারে না কী বলবে! হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থেকে অর্ণ বলে ওঠে, “অদ্ভুত লাগছে জানি। কিন্তু, তাকে আমি জানতে চাইছি। কে মেয়েটি?”

— মেয়ে নাও তো হতে পারে! পুরুষ হতে পারে! আমাদের থেকে বড়ো মধ্য বয়স্ক কেউ হতে পারে!

— তাই কী?, অর্ণ অবিশ্বাসের চোখে তাকায় শৌর্যর দিকে। 

— হতে তো পারে তাই না? 


কথার উত্তর দেয়না অর্ণ। শুধু শৌর্যর সাথে কথা বলতে বলতে, ওই কবিতার আড়ালে নিশ্চয়ই সে হয়তো কিছু বলতে চায়— প্রসঙ্গটি উঠতেই বিদ্যুৎ চমকের মতন শো-তে কোন টপিক রাখবে তা মাথায় চলে আসে। আচ্ছা! আজ কী সে কনফেস করবে? আচ্ছা কী শুনতে চাইছে ওর মন? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে। কে কবিতাগুলো লিখেছে তার পরিচয়টুকুই কী জানতে চাইছে? নাকি...


এসব কিছু ভাবতে ভাবতে সময় হয়ে আসে পরের লিংকের। এদিকে ততক্ষণে চলে এসেছে কিছু মেসেজ। আর একজন ফোন লাইনে। 

— ফিরে এসেছি আমি অর্ণ, নিয়ে ফেন্ড ফর এভার‌। আজকের টপিক কনফেশন, ভালোবাসার কনফেশন। অলরেডি ফোনে আমাদের এক বন্ধু চলে এসেছে। চলো শুনে নিই, সে কার প্রতি ভালোবাসার কথা কনফেস করতে চায়!

হ্যালো! কে বলছো?

— আমি... উম... থাক্ না অর্ণদা আজ বরং আমার পরিচয়টা গোপন থাক্। সে যদি শোনে, নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পারবে।

অর্ণর মুখে হাসি খেলে যায়, অল্প শব্দে হেসে বলে, “উম... মনে হচ্ছে প্রোপজ করতে চাইছো?"

অপরদিকের মানুষটি কিঞ্চিৎ লজ্জ্বা পেল হয়তো, “ইয়ে... হ্যাঁ। আসলে... দীপশিখা! আমার বেষ্টফ্রেন্ড। বলবো বলবো করেও বলতে পারিনি। যতবার ও সামনে এসেছে, বলবো ভেবেও চেপে গিয়েছি। মেসেজেও বলবো ভেবেছি, কিন্তু ভয় পেয়েছি যদি কথা বলা বন্ধ করে দেয়!"

— তবে আজ বলছো যে!

— ভালোবাসার কথা যে জানাতে হয়! অ্যাটলিস্ট আপশোস থাকবে না কোনো। উম্ … দীপু আই লাভ ইউ... বেষ্ট ফ্রেন্ডশীপ তো ফর এভার রাখতে চেয়েছিলাম তাই না? ভালোবেসে থাকতে পারি না আমরা? একসাথে...


— ওহো! ওয়াও... কী দারুণ একটা কথা বলল! ওহ্! নাম তো বলেনি সে। কেন বললে না? তোমার দীপু তো তোমাকে চিনতেই পারবে! নাকি সে চায় আজ শুধু ভালোবাসার মানুষটিই তাকে চিনে নিক?, অল্প হেসে বলে, “আমাদের বন্ধুটি একটা কথা কিন্তু দারুণ বলেছে, ‘ভালোবাসার কথা জানাতে হয়!’ তবে আর দেরি কেন? তুমিও জানিও দাও তোমার ভালোবাসার কথা, তোমার প্রিয় মানুষটিকে। আর আজ আমি কিউপিড তোমাদের গল্পের... সঙ্গে থাকো। চলছে ফেন্ড ফরএভার উইথ অর্ণ।"


এরপর গান, ব্রেক আবার অন এয়ার, এভাবে কেঁটে যায় দু'টো ঘন্টা। এসেছে প্রচুর ম্যাসেজ। কেউ তার মা'কে তার মনের কথা জানিয়েছে। কেউ তার ভালোবাসার মানুষকে। কেউ তার বেষ্ট ফ্রেন্ডকে। কেউ তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর উদ্দেশ্যে। একজন আবার তার বাবার উদ্দেশ্যে কনফেশন করেছে, মেয়েটি সদ্য হারিয়েছে তার বাবাকে। অর্ণর মনটা আজ বড় ভালো। আসলে ভালোবাসা জিনিসটা এমন-ই। কখনো কাঁদায় আবার ভালোবাসার কথা মনকে ভিজিয়ে দেয়। অদ্ভুত শান্তি এনে দিতে পারে। হ্যাঁ, অন্যের ভালবাসার কথাও মন জুড়িয়ে দিতে পারে। এত মানুষ যে ভালোবাসে, ভালোবেসে ভালো আছে, মনের কথাগুলো বলতে পারছে— এর মধ্যে যে কী অনাবিল এক শান্তি আছে তা বলে বোঝানো যায় না। এই অনুভুতিটা খুব আরামের।



(৯)



“আমার শহরে বিকেলগুলো লেখা রয়েছে তোমার নামে।

সান্ধ্য মেঘের ভেলায় রোজ প্রেম আসে।

সেই জোয়ারে ভাসতে গিয়ে ভুল করে,

নৌকাডুবি আমার পথের মাঝে।

মরবো বলে পণ করেছি তোমার জন্যে।

যদিও জানি তোমার - আমার রাস্তা দু'টো সমান্তরাল।

পাশাপাশি হাঁটতে চাওয়ার আশারা;

দিন দিন বড়োই বে-লাগাম।


ভালোবাসা কবেই-বা সব নিয়ম মেনেছিল?

মন কবে মেনেছিল বশ নিজের লাগাম?

আজ নির্লজ্জ বরং হলাম তোমার জন্য।

আমি এক দিকভ্রান্ত বোহেমিয়ান।

তোমায় পাবো এতো সাহস আমার কোথায়?

যাযাবরদের কী স্থায়ী আস্তানা হয়? 

তবু মন সঁপতে তো চায় তোমার বুকে।

আর আমি পুষি তোমার নামে ধ্রুবতারা। "


কবিতাটি শেষ হতে যেটুকু সময়, অর্ণর হাত ঠান্ডা হয়ে এসেছে। নিজের অজান্তেই বুকের স্পন্দন গতি বাড়িয়েছে কয়েক ধাপ। শ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। ওর মনের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে উঠেছে। যে কবিতাটি বলল, তাকে চেনে সে কথা অর্ণ বলতে না পারলেও। সম্পূর্ণ অচেনা সে নয়। অর্ণর চকিতে মনে পড়ে গিয়েছে ক'দিন আগে শো-তে যে চিরকুটটা পেয়েছিল তাতে লেখা টুলাইনারটা, “কেউ আছে জেনো এই আকাশের নীচে, 

তোমার নামে বুকের মাঝে ধ্রুবতারা পোষে।”

ওর মন বলছে এই সে! যাকে খোঁজার চেষ্টা করছিল। 

— তুমি?, নিজের অজান্তেই বলে ওঠে অর্ণ। অর্ণ ভুলে যায় অন এয়ার আছে। ভুলে যায় চারপাশটাকে। ওর সামনে অত বড়ো কম্পিউটার, যন্ত্রপাতি, কাঁচ ঘেরা স্টুডিও; সব কিছু ম্লান হয়ে যায়।


অপরদিকের মানুষটি একটু থেমেছিল, অল্প অল্প নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাচ্ছিল। অর্ণ আবার শুনতে পায় মিষ্টি মেয়েলি কন্ঠটা। কিছু মানুষের কন্ঠস্বর বড়ো আদুরে হয়, অদ্ভুত মায়ায় বেঁধে ফেলতে পারে নিমেষে। কন্ঠ নিয়ে কাজ কারবার করা অর্ণর মনে অপরদিকের কন্ঠস্বরটির জায়গা করে নিতে বেশী সময় লাগলো না। অপরদিকের মানুষটির কন্ঠে মায়ার সাথে আরো কিছু আছে! একটু আদর, আবেগ, আকুলতা মেশানো একটা অনুভুতি। সে বলছে, “ভালোবাসি! আ-মি..." একটু থেমে যায়। যেন বলবে নাকি বলবে না সেটা আরেকবার ভেবে নিচ্ছে। 

— আমি... আমি তোমাকে ভালবাসি। আজ যখন ভালোবাসার কনফেশন-এর টপিক রাখলে! সেই সন্ধ্যে থেকে টানা দু'টো ঘন্টা নিজের সাথে লড়াই করে যাচ্ছিলাম। বলবো! হয়তো তোমাকে বিব্রত করে ফেলা হয়ে যাবে! কিন্তু, শুরুতে একটা কথা বলে ছিলে না? ভালোবাসার কথা জানাতে হয়! আমিও এই কথাটায় বিশ্বাস করি। ভালোবাসার কথা জানাতে হয়! তাতে আর যাই হোক সারাজীবন আপশোস থাকে না।”

কিছু মুহূর্তের জন্য থামলো সে। অর্ণর গলার হাড়টা নড়ে উঠলো। কিছু বলবে বলে মুখ খুলতে যাবে তখন সে আবার বলতে শুরু করে, “আমি জানি তোমাকে প্রচুর মানুষ বলে ভালোবাসে। আমি নতুন কেউ নই। তোমার কাছে আমি আরো অন্যান্য ফ্যানদের তালিকায় পড়বো সেটাও আমি জানি। আমি আদৌ ভালোবাসি নাকি স্রেফ একজন ফ্যানের পাগলামি, অবসেশন — এইসবের কোনো প্রমাণ আমি দেওয়ার চেষ্টাই করবো না। আমি আজ শুধু তোমায় আমার মনের কথাটা জানিয়েই দিলাম। ভালোবাসি... ভালোবাসি... উইদাউট এনি টাইপ অফ এক্সপেক্টেশন, আই লাভ ইউ...”


অর্ণ থমকে গিয়েছে। প্রায় দশ বছরের আর.জে জীবনে প্রচুর প্রোপজ পেয়েছে। অন এয়ার কল করে প্রোপজের ঘটনা নতুন নয়। ইনফ্যাক্ট মাঝে মাঝেই লিসেনারদের সাথে মজা করে টুকটাক ফ্লার্ট করেও থাকে। কিন্তু, আজ যে এতগুলো কথা বলল, তার কথাগুলোর মধ্যে এমন একটা ব্যাপার রয়েছে যে... হেসে উড়িয়ে দিতে পারছে না। বাঁধছে কোথাও একটা। অনুভূতিটা অনেকটা এমন, কেউ প্রচন্ড ভালোবাসে জানার পরেও তাকে ফিরিয়ে দিতে যেমন আড়ষ্টতা হয়! 

এসব ভাবনাকে কোনো রকমে সরিয়ে অর্ণ বলে ওঠে, “তুমি! তুমি কে? মা-মানে তোমার নামটা!"

প্রথমবার অপরদিক থেকে একটা হাসি শুনতে পেল অর্ণ। রহস্য করে হেসে সে বলল, “নাম?", আবার হেসে বলে, “কী হবে জেনে? রেডিও লিসনারদের জন্য?"

— না মানে...

অর্ণর কথা শেষ হতে না দিয়ে সে বলে ওঠে, “নাম না বললে তো আমার কথা মনে থাকবে না তোমার! তাই, ধরে নাও তোমার জন্য আমি ...", একটু থামলো সে, 

“দূরভাষিনী"


অর্ণ আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। ফোনটা কেটে যায়। অর্ণ অন -এয়ার কোনো বাক্যব্যয় না করে মাইক অফ করে গান চালিয়ে দেয়। যেটা স্বভাববিরুদ্ধ। হয়তো নিয়মবিরুদ্ধ-ও। সেদিকে ওর কোনো খেয়াল নেই। অর্ণর মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে। সচরাচর এমন হয় না। আসলে যে সকল জিনিস আমরা সহজে পাই না তার প্রতি আকর্ষণটা বেশিই হয়। ’দূরভাষিনী’-কে নিয়ে ওর মধ্যে এই রকম একটা অনুভূতি পাক খাচ্ছে। 


ওর অফিসের সবাই এই কথোপকথনটা শুনেছে। শৌর্য এগিয়ে এসে স্টুডিওর দরজাটা ঠেলে একটু উঁকি মারে, “কী হে! এই কী সেই কুহক? যে মেসেজে কবিতা পাঠায়?” কথা বলতে বলতে ঢুকে আসে শৌর্য। 

— কবিতা গুলো তবে তোর প্রেমে পড়েই লিখেছিল! কী কপাল গুরু তোমার! আমাদের রেডিও স্টেশনের ইতিহাস তৈরী করে দিলি বস্!”


অর্ণ অন্যমনস্ক ভাবে তাকায় শৌর্যর দিকে। একটু বিরক্ত-ও হয়। এখন একটু একা থাকতে পারলে ভালো হত। অদ্ভুত একটা অস্বস্তি ঘিরে রয়েছে মনটাকে। একটা ইচ্ছে ডানা মেলছে ধীরে ধীরে কিন্তু কাজটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। ব্যাপারটা মাথায় এসেছিল আগেই, কিন্তু কাজটা করার হয়ে ওঠেনি। কিছুটা ইগোর জন্যেই হয়নি। শহরের নামজাদা এক রেডিও স্টেশনের আর.জে, তার উপর নিজস্ব পপুলারিটি-ও রয়েছে। কিন্তু এখন! কিছুতেই মনটাকে সামলাতে পারছে না। কী করবে এবার? মনের কথাটাই শুনবে নাকি মাথার? 


— কী হয়েছে বলতো তোর?, শৌর্য জিজ্ঞেস করে ওঠে। অর্ণ যেন ওর অস্তিত্বটা ভুলেই গিয়েছে। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “ইজ এভরিথিং অল রাইট? পরের লিংকটার সময় হয়ে এলো কিন্তু!”

অর্ণ সচকিত হয়ে ওঠে। পাঁচ মিনিট হাতে রয়েছে। কিছু কিছু সময় আসে যখন মনকে শান্ত করার জন্য, কোনো রকম হিসেব না কষেই কোনো একটা কাজ করে ফেলি। আর বাকিটা সঁপে দিই ভবিষ্যতের হাতে। অর্ণ বড়ো করে একটা শ্বাস নিল। খন্ড মুহূর্তের ব্যবধান, সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিল ও।



***

অপরদিকে, তার মনের মধ্যেও ঝড় উঠেছে। যদিও বাইরের প্রকৃতিতে এখন বৃষ্টি শেষের স্নিগ্ধটা। শীতল শান্ত হাওয়ারা ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। তার মধ্যে সে বুকের কাছে ফোনটাকে চেপে ধরে চোখ বুঁজে বসে রয়েছে। বুকের দ্রুত ওঠানামা ইঙ্গিত করছে, দ্রুত শ্বাস পড়ছে তার। আসলে সে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছে নিজের কাজে। মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন তোলপাড় করে চলছে। কাজটা কী ঠিক করল? এরপর? এরপর কী হবে? অবশ্য এ বিষয়ে ভাবার কিছুই নেই। অর্ণর মতন মানুষ কখনোই ওর কাছে এসে ধরা দিত না। প্রোপজ করলে হ্যাঁ বলতো না। প্রশ্ন-ই আসে না। এই ভাবনাটাই শিশুসুলভ। তবে হ্যাঁ, আজ যে সব কথা বলতে পেরেছে। নিজে শান্তি পেয়েছে! 


কানে হেডফোনে রেডিও-তে গান বেজে চলছে, “দূর হতে আমি তাকে সাধিব...” 

ওদিকে ওর কানে এখনো উষ্ণ, ভারী, ধীর কন্ঠস্বরটা অনুরণিত হচ্ছে, কানে বাজছে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করা প্রশ্নটা, “তুমি! তুমি কে? মা-মানে তোমার নামটা!"

হেসে ওঠে সে, একা একাই বলে ওঠে, “দূরভাষিনী! যে দূর থেকে শুধু তোমাকে চেয়ে এসেছে। চাইবেও…, গানের সাথে গলা মিলিয়ে গেয়ে ওঠে, ‘‘মায়াবনবিহারিনী হরিণী গহন স্বপন সঞ্চারিনী…’, তারপর বলে, “তোমার কাছে বরং রহস্য হয়েই আজীবন থেকে গেলাম! যেভাবেই হোক থাকবো তো!"


মাথাটা এলিয়ে দেয় জানলার গরাদে। আলতো প্রশান্তির হাসি ঠোঁটে লেগে থাকে তার।


হঠাৎ, ফোনটা বেজে ওঠে। তার ফর্সা কপালে ভাঁজ পড়ে, ভ্রু জোড়ায় জমে বিরক্তি। হাত দিয়ে মুখের উপর এসে পড়া অবাধ্য চুল গুলোকে কানের পাশে সরিয়ে ফোনটার দিকে চায়। আননোন নম্বর! কে? ধরবে? একটু ইতস্তত করেই ফোনটা ধরলো সে, ভেসে এলো অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার চিরপরিচিত ভারী কন্ঠস্বরটি,

“হ্যালো!”



সমাপ্ত।।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance