সেই বুড়ো লোকটা
সেই বুড়ো লোকটা


আমি দীপঙ্কর সেন। আমি ঘোষপাড়ার ভেতর দিকটায় থাকি। একেবারে ভেতরে। যেখানে খোলা নর্দমাগুলো বর্ষাকালে উপচে গিয়ে কর্দমাক্ত করে। বিনা বাঁধায় ফড়িঙের মত বড় বড় মশা বংশবিস্তার করে। রাস্তায় বুক থেকে খাবলা খাবলা পিচ উঠে গিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য বাড়ায় আর খরচা কমানোর জন্যে মাঝে মাঝে লাইটপোস্টগুলো ছুটি নেয়। ওরা তখন শুধু পোস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, লাইট জ্বালায় না। অবশ্য এতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয় না।
আমি ঠিক সাড়ে আটটায় ইয়ে টিয়ে করে, চান করে, গরম ভাত, আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ আর নুন ছাড়া পটল,সিম,বিন,গাজর আরো সব সবুজ শাক সবজি সেদ্ধ খেয়ে অফিস যাই। আমি নুন খাই না, শুনেছি হাই প্রেসার হয়, খুব অল্প ভাত খাই, আলুও কম যাতে সুগার না হয়। যারা এগরোল, তেলে ভাজা এইসব ভয়ঙ্কর জিনিস খায় আমি দূর থেকে তাদের আত্মহত্যা দেখি আর মনে মনে বলি “ঈশ্বর এদের ক্ষমা করে দিন, এরা জানে না এরা কী অপরাধ করছে”।
আমি চারপাশটাকে ভয় করি। মৃত্যু বিভিন্ন পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে। ফুচকা, তেলেভাজা,ধুলো, ধোঁওয়া, বাসের চাকা , রোদ্দুর, কাশিসর্দি, ভাঙাবাড়ি, খোলা ম্যানহোল সবাই আমায় ভয় দেখায়। এখন আমি চল্লিশ। আমি আমার স্ত্রীর সাথে সপ্তাহে তিনদিন দাম্পত্যকর্ম করি। গুনে তিনদিন। সর্বজনীন যোগাসন। শরীরটা ভালো থাকে। অন্যান্য যোগাভ্যাস যেমন অনুলোম বিলোম, কপালভাতি এসবও করি। এগুলো সকালে। যখন সূর্য হাসিমুখে থাকে।
মোটকথা আমি মৃত্যুকে ভীষণ ভয় করি। এই লোকলস্কর, বাড়ি, জমি, টাকা, ব্যাঙ্কের পাশ বইয়ে লেখা মনোরম সংখ্যাগুলো, আমার আলমারি, আমার অদম্য যোগাভ্যাস সব ছেড়ে হঠাৎ নির্দয় আগুনের মধ্যে হাত লম্বা করে ঢুকে যেতে হবে, সেটা মোটেই পছন্দ হয় না। আমি তাই শরীর ঠিক রাখার জন্যে হাঁটা পছন্দ করি। বাড়ি থেকে চৌরাস্তা তা দুকিলোমিটার হবে। আমি হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে ব্রীজের তলায় পৌঁছে যাই। হাঁটাও হল আর নিজের আর পকেটের স্বাস্থ্য ভালো থাকল। নাহলে তো অটো। অটো মানেই ঘনিষ্টতা, কে সুস্থ, কে অসুস্থ কিচ্ছু নির্ধারণ না করেই একটা তিনচাকার উদ্ধতবাহনে বসে পড়া আর বাহনটা সারা রাস্তা সার্কাস দেখাতে দেখাতে যাবে, ভেতরটা ‘এই গেলাম’ ‘এই গেলাম’ করবে আর আমি উপবিষ্ট যাত্রীদের দ্বারা পিষ্ট হতে থাকব। আর পরিশেষে দশটা টাকাও যাবে। তার বদলে আমি হাঁটি। হেঁটে ব্রীজের তলায় এসে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বুড়ো লোককে আমি দুটাকা দি। আমার বুকের ভেতর করুণা আর কার্পণ্যের লড়াইয়ে দুটাকাই অনুমিত হয়েছে। যাহোক ভালোকাজের অ্যাকাউন্টে রোজ দুটাকাতো জমা পড়ে।
বুড়ো লোকটার কোনো নাম নেই। পথে যারা থাকে তাদের নাম ধুলোয় ঢেকে যায়। যেমন পথশিশু, রাস্তার মেয়ে, পথের ভিখিরি। বুড়ো লোকাটা ওখানেই থাকে। আমি দেখেছি একটা নীল প্লাস্টিকের ছাউনি, একটা শতরঞ্চি আরো কীসব হাজিবাজি জিনিস ওকে ঘিরে আছে। ও একটা দুঃখু, দুঃখু মুখে বলে, ‘ দশটা টাকা দেবে বাবা, বাবা দশটা টাকা দেবে!’ সবাইকে ও বাবা বলে। আমি দুটাকা দিতে দিতে একটা প্রোবাবিলিটির অঙ্ক কষি। একঘণ্টায় ওকে কমপক্ষে দুহাজার লোক অতিক্রম করে। তার শতকরা পাঁচভাগ মানে একশোটা লোক যদি ওকে দুটাকা করেও দেয় তাহলে প্রতি ঘণ্টায় ও দুশো টাকা করে পায়, তাহলে সারাদিনে, সারা মাসে..। আমি ভাবতে থাকি। ওকে একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে! বলবে কি? দরকার হলে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ওর খানিকটা দূরে গিয়ে আমিও দাঁড়াব। ওর সঙ্গে ভাব করতে আজ আমি ওকে পাঁচটাকা দিয়েছি। ও আমার মনের কথাটা বলল, ‘একশো বছর বাঁচো বাবা’।
-আপনার নাম কী? প্রত্যেকদিন কত রোজগার হয়? কত? দশ হাজার, পাঁচ, দুইতো হবেই? ইত্যাদি প্রশ্ন ওকে করব ইতিমধ্যে আমার বাস এসে গেল। সারা গায়ে ধুলো, ভেতরে অনেক যাত্রী। উঠে পড়লাম। গরম, পা রাখার জায়গা নেই,সবাই রেগে আছে, সবাই অসুস্থ। আর কন্ডাকটর ছেলেটা ক্রমান্বয় বলে যাচ্ছে, ‘ভেতরে ঢুকে যান, পেছনে অনেক জায়গা আছে, অনেক জায়গা’। এত বিষাক্ত পরিবেশ অতিক্রম করতে করতে কী করে যে পঞ্চাশ পেরোবো। একশো বছরের মধ্যে পাঁচটা বিশ্বযুদ্ধ হতে পারে। আরশোলা ছাড়া কিছুই বাঁচবে না। এই ভয়টাই আমার মাথা, মেধা, বুক,সুখ সব দখল করে নিচ্ছে। আমি বুড়ো লোকটার কথা ভাবছিলাম। ওই লোকটার ভয় করে না? ওর বাড়ি ঘর নেই, হয়ত আছে। হয়ত বেশ বড় বাড়ি। হয়ত ব্যাঙ্কে অনেক টাকা, বউ, ছেলে মেয়ে। মুখে দুঃখ মেখে ও রোজগার করছে। দুঃখের অভিনয় করে সুখে আছে।
অফিস থেকে ফিরতে আজ খুব দেরি হল। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একটা বেনিয়ম বেশ মর্যাদা পায়। অফিস কখন বন্ধ হবে তা বলা যাবে না। আমার চাকরি জীবনের প্রথমদিনই অফিস ম্যানেজার অনুপ শর্মাজী বলে দিয়েছেন এখানে ছুটি ভেবে ছুটে বেরিয়ে যাবেন না যেন, তাহলেই ঘ্যাচাং ফুঃ। চেয়ারটায় আটা লাগিয়ে বসে থাকুন, অফিস ফাঁকা হবে, যখন দেখবেন আপনি বেশ একা তখন ভাব্বেন ছুটি। রাত সাড়ে নটায় চৌরাস্তায় নামলাম। মুখের কাছে ভিড়। কিছু একটা হয়েছে। নতুন তৈরি করা ব্রীজের ফাঁক দিয়ে একটা সিমেন্টের চাঙড় খসে পড়ে একটা লোকের মাথায় পড়েছে।
-স্পটেই মারা গেছে লোকটা। একজন আর একজনকে বলল।
-খুব ভালো লোক ছিল। ভিক্ষে করে বাচ্ছাদের খাওয়াতো।
এইটুকু শুনে আমি ভিড়ের ভেতর ঢুকে গেলাম। সেই বুড়ো লোকটা।
ওর চারপাশে অনেকগুলো বাচ্ছাছেলে। ওদের চোখে জল।
-লোকটা ভিক্ষে করে রাস্তার ছেলেপিলেদের খাওয়াতো ।
-লোকটা ওদের জামা কাপড় কিনে দিত।
-রাত্রে পড়াতো ওদের।
-ওদের সঙ্গেই থাকতো।
সবাই ওকে নিয়ে কথা বলছে। মৃত্যুর পরও লোকটা খানিকক্ষণ বেঁচে আছে। পুলিশ এসেছে। আমি সরে এলাম। চিরকাল আমি সরে এসেছি। কষ্টের সামনে দাঁড়াইনি। কিন্তু বুকের মধ্যে একটা দমবন্ধ কষ্ট হচ্ছে এখন। কি জানি বাতাসে বড্ড ধুলো বলে? বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছি আমি ওর মত খানিকটা বাঁচতে পারবোতো? মৃত্যুর পরেও?