Debabrata Mukhopadhyay

Classics Inspirational

1.3  

Debabrata Mukhopadhyay

Classics Inspirational

সত্যপীর

সত্যপীর

16 mins
972


দুটো হাত কার্যত শূণ্য ।অভাব যেন ভাব করে ফেলেছে কমলেশের সঙ্গে ।মুখের দাঁড়ি, গায়ের পোশাক,পায়ের চটি সব কিছুর ওপর অভাবের ছাপ ।নিজের বাড়িটাও জরাজীর্ণ । ঠিক নিজের নয়, আট শরিকের বাড়ি । সেইসব শরিকেরও ডালপালা অনেক । কেউই থাকে না এ বাড়িতে । কমলেশকে থাকতেই হয় যাবার জায়গা নেই বলে।বাড়িটা প্রতিদিনই ভয় দেখায় । এপাশ ওপাশ থেকে চাঙড় খসে পড়ে । সর্বত্য জঙ্গলে ভরে গেছে। একটা বেয়াদপ অশত্থ গাছ কার্নিশ থেকে হাতরে হাতরে পশ্চিমে ছাদের মাথায় উঠে পড়েছে । কমলেশ দেখেও দেখে না ।পূবদিকের একটা বড় ঘর , একটা মলিন বাথরুম, আর একটা ছোটো ঘর তার ভাগে । এইটুকুতেই সে সব সাজিয়ে নিয়েছে। এরমধ্যেই একটা রান্নাঘর আর দুটো তাকে নির্বাক ঈশ্বরেরা থাকেন । কমলেশের হিসেব অনুযায়ী এ বাড়িতে বসবাসকারীর সংখ্যা তিন। ও, ওর মেয়ে মিলি আর সদা জাগ্রত শালগ্রাম শিলা । মিলি এম.এ পড়ছে । অনেক খরচ ।ওর পোশাক, রোজের গাড়িভাড়া,হাত খরচা, খাওয়া, বইপত্র , খাতা , পেন ... খরচার তালিকাটা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। প্রত্যেকটা দিন ভীষণ শক্ত হয়ে পড়ছে।শুধু এ দেশে অনেক দেবদেবী আছেন বলেই ও টাকা রোজগারের একটা পথ খুঁজে পেয়েছে ।পূজোর দক্ষিণা নিয়ে এতদিন ধরে কি ভাবে সংসার চালাচ্ছে কমলেশ তা শুধু নারায়ণই জানেন । কিন্তু নারায়ণ কেন তাকে এত হতদরিদ্র করে রেখেছেন তার যথেষ্ট যুক্তি কমলেশের কাছে নেই ।দক্ষিণা নিয়ে দরাদরি করলে ব্রাহ্মণের শুদ্ধতা নষ্ট হয় ।যেন ঈশ্বরকে সাধনা করার অবকাশে থালার ওপর পূস্পার্ঘ,চন্দন,চিল, আতপ চাল ইত্যাদির পাশে রক্ষিত দক্ষিনাটি পূজারী উপেক্ষা করেন, তবেই বোঝা যায় তিনি ঈশ্বরনিষ্ঠ ,নির্লোভ সাধক ।অতএব দক্ষিনা গৃহকর্তার ইচ্ছানুসারে যৎসামান্য হলেও ব্রাহ্মণকে মেনে নিতে হয় । কিন্তু কমলেশ উপেক্ষা না করে অপেক্ষা করে ।দারিদ্র মানুষকে অর্থকাতর করে তোলে।বিশেষতঃ যাদের নারায়ণ অকাতর দিয়েছেন তারা যে কেন এত অনুদার হয় কমলেশ বুঝতে পারে না ।কমলেশ সপ্তাহে একদিন একটা সিগারেট খায় ।অন্যদিন মুখ উশখুশ করলে একেবারে স্বদেশী বিড়ি ।তাও বিড়ির দামটা কি নির্দয়ভাবে বেড়ে চলেছে ।আসলে পৃথিবীটা কমলেশের মত হতভাগ্য ফুটো পকেটের জন্য তৈরি হয়নি । এটা বিত্তবানের পৃথিবী ।বিত্তবানেদের রক্ষার জন্য কিছু পেশীশক্তি সকর্মক ।আর ওদের উভয়কে রক্ষা করার জন্য পুলিশ নামক এক সুসভ্য প্রশিক্ষিত যন্ত্র আছে , যারা পোশাক পরে আইন রক্ষা করে ।কমলেশ দেখেছে পয়সা থাকলে আইন বস্তুটি উপভোগ্য । না থাকলে আইন তার দিকে ফিরেও তাকায় না ।এই যে কমলেশ এত কম খায় ,ওর পোশাক এত দীর্ণ ,ওর সাতপুরুষের শরিকি বাড়িটা যে কোনোদিন ওর মাথাতেই ভেঙ্গে পড়তে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নিশ্চয় আইনে কোনো অক্ষর অপচিত হয়নি অর্থাৎ আইনের কোন মাথা ব্যাথা নেই ।কিন্তু পাশেই সুপ্রভাত দুকাটা জমির ওপর কিভাবে ছতলা ফ্ল্যাট তৈরি করতে পারবে, কিভাবে রাস্তার ওপর বারান্দাগুলো নির্দ্বিধায় তিনফুট করে এগিয়ে আসতে পারবে তার সুস্পষ্ট নির্দেশ নিশ্চয় আইনের বইয়ে ছোটো ছোটো করে লেখা আছে। কমলেশ বুঝতে পেরেছে আইন ব্যাপারটা ক্রয়যোগ্য , শুধুমাত্র মেধা ও অর্থের প্রয়োজন ।কমলেশ আইনরক্ষক পুলিশকে ভীষণ ভয় পায় কারন ও বুঝতে পেরেছে আইনরক্ষকরা আইনভঙ্গকারীদের থেকেও দরিদ্র ও মূর্খ লোকেদের ভীষণ অপছন্দ কর । আর কমলেশ উভয় দোষেই দোষী ।কিছু লোক সাধারণ হয়,কিছু লোক অতি সাধারণ হয় আর কিছুলোক সমাজের তুচ্ছাতিতুচ্ছ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয় ।কমলেশ নিজেকে একেবারে তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত ভিখারি মনে করে ।অতএব পুলিশের গাড়ি দেখলে কমলেশ সভয়ে ময়লার গাড়ি দেখার মত তিনহাত দূরে চলে যায় ।

বজু মাইতির বাড়িতে মাঝে মাঝেই পূজো হয় । আজ সত্যনারায়ণ পুজো ।অনেকক্ষণের পুজো । নারায়ণ পুজোর আগে গনেশ,সূর্য্য, বিষ্ণু,নারায়ণ, শিব, দূর্গা সবার পুজো শেষ করে তবে আবার সত্যনারায়ণ পুজো । নারায়ণ এক ফকিরের বেশ ধরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণকে দেখা দিয়েছিলেন ।সেই ফকিরের পুজো ।পুজো করতে করতে যেন কমলেশের নিজেকে সেই গরীব ব্রাহ্মণের মত লাগে । নারায়ণ কবে তাকে ফকিরের বেশে দেখা দেবেন? দিতে পারেন না ?পুজোর পর আরতি, তারপর পুষ্পাঞ্জলি, তারপর ব্রতকথা ।কমলেশ মাথা দোলাতে দোলাতে পাঠ করে, ‘পীর বলে আজই হৈতে দুঃখ গেল দূর/অতুল সম্পদ হৈল, যাও নিজ পুর//নিশ্চয় তোমারে কহি , আমি সত্যপীর / কলিযুগে পৃথিবীতে হয়েছি জাহির...’ । মন দিয়ে শোনার কথা সকলের । কেউ শোনে না । বজু মাইতির বৌ চন্দনা এরই মধ্যে কাজের মাসীকে বলে, ‘পুজো হচ্ছে, তুমি যেন ঝাঁটা বের কোরো না, সিন্নি খেয়ে যেও’ । মেয়েকে বলে ‘ব্রতকথার সময় কথা বলতে নেই ,ইত্যাদি , ইত্যাদি’ । কমলেশ পড়ে যেতে থাকে , ‘...মাথায় বেষ্টিত মালা দিব্য দীপ্ত পাক/ছাগলের ছড়া ,ছড়ি ,গুধড়ি পোশাক//হাতেতে জৈতুন মালা জপিতে জপিতে/সাত শত আউল্যে যোগান তাঁর সাথে...’।দীর্ঘ ব্রতকথা শেষ হয় ।এরপর শান্তিজল । এই সময়টায় সবাই হৈই হৈই করে ছুটে এসে পা ঢাকা দিয়ে বসে পড়ে ।যেন এই শান্তিজল নিলেই এতক্ষনের অমনযোগের অন্যায় ধুয়ে গেল এবং ঈশ্বরের করুনা পাওয়া গেল । এবার শেষ । থালার পাশে উপেক্ষিত টাকাগুলো কমলেশ সযত্নে নিয়ে তার ওপর একটা ফুল চাপিয়ে পড়তে থাকে ‘ ... সত্যনারায়ণ পূজনকর্ম্মন সাঙ্গতার্থং দক্ষিনামিদং কাঞ্চনমূল্যং...’ ।এই মন্ত্রগুলো বলতে কমলেশের খুব ভালো লাগে ।নারায়ণের দয়ায় এটাই তার একমাত্র রুজি। কিন্তু মন্ত্র পড়াই সার ।দক্ষিণা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে ।দুবছর ধরে সত্যনারায়ন পুজোয় একশো এক টাকা দক্ষিণা পাচ্ছে কমলেশ ।কিছুতেই বাড়ছে না ।দক্ষিণার সঙ্গে কিছু কাটা ফল, কিছু গোটা ফল, আর কেজি খানেক আতপ চাল । মাইতি গিন্নিকে কমলেশ খুব নরম গলায় বলে, ‘একটা কথা আছে’ ।কমলেশের মন্ত্রোচ্চারণের জোর আছে কিন্তু আবেদন নিবেদনের জোর বড় কম ।আর সেইসময়ই মাইতি গিন্নির নাতনি অকারনে শাঁখে ফুঁ দেয় । মোটেই কথাটা শোনা যায় না ।মাইতি গিন্নি বড্ড ব্যস্ত মহিলা । তাড়াতাড়ি বলেন, ‘ঠাকুরমশাই , ‘একটু সিন্নি খেয়ে যাবেন তো?’ কমলেশ হ্যা বলতে গিয়ে না বলে ফেলে।

-ও! পুজো আছে বুঝি আরো বাড়িতে?

  

-হ্যা, হ্যা বৌদি । একটা কথা আছে । এবার গোলমালের ফাঁক দিয়ে সফলভাবে কমলেশ আবেদনের উপক্রমণিকাটা করতে পারে ।

-যাই , হঠাত মাইতি গিন্নির তীব্র কম্পাঙ্কযুক্ত একটা চিৎকারে আবেদনের সারবস্তুটাই অকথিত রয়ে যায়।

-আপনার দাদা ডাকছে। এক্ষুনি বেরোবে। সেই গড়িয়া যাবে । একটা বড় কাজ পাবার কথা আছে ।একটু কথা পাকা হলেই জোড়া সিন্নি দেব ।মাইতি গিন্নি ঘোষনা করেন ।করেই সিঁড়ি দিয়ে ভারি পা নিয়ে ছুটতে লাগেন ওপরে । বেশ একটা দাম্ভিক ধপ ধপ শব্দ উচ্চতায় উঠে যায়। কি কথা পাকা হলে জোড়া সিন্নি হবে তা কমলেশ অনুমান করতে পারে না ।শুধু দুটো মোকাম, দুগুন দক্ষিনা ইত্যাদি পাওয়া যেতে পারে সেই সম্ভাবনায় ভেতরটা পুলকিত হয়ে ওঠে ।ঠাকুর ঘর ফাঁকা করে সবাই চলে গেছে ।প্রসাদ ছড়িয়ে আছে চারপাশে ।একটা নৈবদ্যের চূড়ায় একটা স্বাস্থ্যবান সন্দেশ শোভা পাচ্ছে ।মনে হল টুপ করে বস্তুটাকে তুলে মেয়েটার জন্যে নিয়ে গেলে ভালো হয় ।দেয়াল ঘড়িতে দশটা পঁচিশ ।হয়ত মিলি দরজায় চাবি দিয়ে বেরিয়ে গেছে।কি খেয়ে গেল কে জানে ! হয়ত একগাল মুড়ি আর কালকের তরকারি খেয়ে বেরিয়েছে ।ব্যাগের মধ্যে মাইতি গিন্নির দেওয়া ফল , মিষ্টি সব গুছিয়ে নেয় কমলেশ ।ফতুয়ার বুক পকেটে একশো এক টাকা পুরতে পুরতে ভাবে যে সত্যনারায়ণের পুজো করে গৃহকর্ত্তার এত বারবৃদ্ধি, তার পুরোহিতের এমন হতশ্রী অবস্থা কি নারায়ণ দেখতে পান না? নিজের শালগ্রাম শিলাকে অতি যত্নের সঙ্গে ব্যাগের মধ্যে নিতে নিতে মন বলে, ‘এতটা পাথর কেন তুমি ঈশ্বর ?’ ঈশ্বরকে পাথর বলায় যে অপরাধ হল তা মোচন করতে মনে মনে আবার বলে, ‘নারায়ণ, নারায়ণ’ । 

(২)

মিলির একটা আকাশ আছে । সেটা আকাশের মত উদার নয়, জানলার মতই সীমাবদ্ধ । সেখানে ওর বাবা, ও , ওর মামা আর কুয়াশার মত ওর মার একটা আবছা স্মৃতি ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারে না ।ছোটো থেকে মিলি জানে পৃথিবীতে এত লোক থাকলেও ওদের পৃথিবীতে বাবা, মা আর অনেক দূরে থাকা একজন মামা। ওর বাবার কাছে ও শুনেছে ওর মা ঠিকমত চিকিৎসা পায়নি ।কি হয়েছিল জানা যায় নি। সমস্ত শরীরটা ধীরে ধীরে অচল হয়ে গিয়েছিল ।গরীবের দৈব সহায় । দেবতা ওদের সহায় হন নি। মিলি তাই দেবতাকে তাকে তুলে দিয়েছে । ওখানেই বাবাকে দেখিয়ে রোজ একবার প্রণাম করে । এতে কমলেশ খুব খুশি হয়ে ওঠে। বলে , ‘ঈশ্বর সতত আমাদের কাছে থাকেন,তাঁর মত নিকট আত্মীয় কেউ নেই’ ।

ওর বাবা কি করেন দশজনকে বলতে পারে না মিলি। লজ্জা করে বলতে বাবা পুরোহিত । লোকে পুরোহিত বলে না, বলে পুরুত। এই সংক্ষিপ্ত শব্দটার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য লুকিয়ে আছে। চারটে টিউশনি করে মিলি ।ওতে নিজের কিছু খরচা চলে যায় । কোনোদিন পারলারে যায়নি মিলি। দুটাকার শ্যাম্পু কিনে মাথাটাকে পরিষ্কার করে। নোখে নেলপালিশ দেয় না। ঠোঁটে রঙ না মাখলেও মিলির ঠোঁট হালকা গোলাপি হয়ে থাকে। চোখের পাতাগুলো যেন জন্ম থেকেই কাজল পরে আছে । ফরসা হবার জন্যে ফেসওয়াশ লাগেনা মিলির । ভিজে আলোর মত স্নিগ্ধ হয়ে থাকে মুখ ।এ মাসে টিউশনির পয়সায় বাবাকে একটা জামা, একটা চটি কিনে দিয়েছে মিলি। কমলেশ ওর দিকে তাকিয়েছিল একরাশ তৃপ্তি নিয়ে। চোখে জল চলে এসেছিল ।জামাটায় পরম আদরে চুমু খেয়েছিল । এতটা আশা করেনি মিলি। আবেগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘আর কিছু দিন বাবা, একটা চাকরি পাবোই। তোমাকে তখন আর পূজো করতে বেরোতে হবে না’।

‘না না , তা কি হয় , নারায়ণ পূজো ছাড়বো কি করে। তিনিই তো সব । তাঁর ইচ্ছেতে রাজদন্ড, তাঁর ইচ্ছেয় লন্ডভন্ড’।

-তুমি বাড়িতে পূজো কোরো। আমি তোমায় উজার করে দক্ষিণা দেব।

কমলেশ হাসে। মনে মনে বলে , ‘পাগল মেয়ে’ । মিলি সেই দিনটার জন্যে প্রতীক্ষা করছে। কমলেশও ।কখন কখন একটা চিন্তা কমলেশকে ভাবিয়ে তোলে । মিলিকে কি ভাবে বিয়ে দেবে । মিলিকে ছেড়ে দিয়ে কি করে বাঁচবে ও!

মিলিরও ভয় করে। চারপাশে অনেক হাতছানি।প্রলুব্ধ হবার মত মজা, সান্নিধ্য সব ডাকছে । ছেলেদের বেশির ভাগই কয়েকদিন বন্ধুত্বের পরই অন্যকিছু আশা করে । বন্ধুত্বের স্তর অতিক্রম করতে চায় ।মিলি এ পর্যন্ত মুখের ওপর ‘না’ বলেছে। গত সপ্তাহে লাইব্রেরির নির্জনতার সুযোগ নিয়ে অপূর্ব ওই একই কথা বলতে এসেছিল । মিলি আবার ‘না’ বলেছে । অপূর্ব সুদর্শন, বিত্তবান, অনেক মেয়ের কাছেই আগ্রহের বস্তু।

-কেন? আমি কি অযোগ্য ? অপূর্ব বলেছিল।

-আমি এসব নিয়ে ভাবছি না । আমাকে ভেবে সময় নষ্ট করিস না, প্লিজ। এ নিয়ে আর কথা নয়।

এইকথাগুলো মিলির নিজের রচনা। তৈরি করেই মুখস্ত করে ফেলেছে। মাঝে মাঝেই ব্যবহার করতে হচ্ছে।

-ঠিক আছে, ঠিক আছে । প্রত্যাখাত হয়ে অপূর্ব বিষ্মিত হয়েছে। একবার মিলির দিকে তাকিয়েছে । নীরবে একটা বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছে মিলি। যেন কিছুই হয় নি।ফাঁকা লাইব্রেরিটা একটু বেশিরকম ফাঁকা লাগছে। লাইব্রেরিয়ান অমলবাবু দূর থেকে তাকিয়ে রয়েছেন ওদের দিকে। শুনতে পাননি নিশ্চই। এমনিতেই লোকটা কানে কম শোনেন। মিলির কানের কাছে ফিসফিস করেছে অপূর্ব , ‘সত্যিই সময় নষ্ট করলাম’ । মিলি কথা বলেনি।


ইতিমধ্যে কমলেশ একদিন রায়বাড়ি থেকে ডাক পেয়েছিল । রায়বাড়ির ছোট ছেলেটা খুব ভালো । বিদেশে থাকে।কোন দেশে কখন থাকে বলা যায় না। আজ আমেরিকা, চার মাস বাদে শোনা যায় মাদাগাস্কারে আছে । জাহাজের চাকরি । বছরে তিনমাস দেশে থাকে । এই এসেছে। রাস্তায় মিলিকে দেখে খুব পছন্দ হয়ে গেছে। এ মাসেই বিয়ে করে চলে যাবে । কমলেশ রায়বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।প্রস্তাবটা ভালো না মন্দ বুঝতে পারছে না। জয়দেব রায় হাসছেন।জয়দেব রায়ের পাশে বাড়ির সবাই।

-আমি তো একদম প্রস্তুত নই । কমলেশ কোনক্রমে বলতে পারে।

-আপনাকে আমরাই প্রস্তুত করে দেব । সব খরচ আমাদের । এখন আপনিতো আমাদের বাড়ির লোক । বিজয় ওকে পছন্দ করেছে মানে আপনার মেয়ে আমাদের বাড়ির বৌমা হয়ে গেছে । জয়দেবের চারপাশে সবাই তাকিয়ে আছেন কমলেশের দিকে। যেন কমলেশ একটা লটারি জিতেছে ।

কিন্তু ওই যে আগে বললাম, মিলির খুব খারাপ স্বভাব ।মুখের ওপর না বলে। এবারও বলল । কেন? আমাকে বিয়ে করবে কেন? আমাকে চেনে না , আমার সঙ্গে কোন কথা বলল না, আমকে জানল না, দেখল আর পছন্দ হয়ে গেল? আমার থেকে সুন্দর মেয়ে নেই দেশে? না। একদম না।জাহাজে নমাস থাকবে আর এখানে তিনমাস ।এমন ছেলে আমার মোটেই পছন্দ নয়। তারপর আবার সেই পুরনো কথাটা একই সুরে বলল মিলি।

- সময় নষ্ট করতে বারণ কর। আমি এসব নিয়ে ভাবছি না।

কমলেশ এবার বুঝতে পারল প্রস্তাবটা মোটেই ভালো ছিল না। জয়দেববাবুকে বলতেই হল । মিলির খটখটে ‘না’-টাকে কমলেশ যথাসম্ভব নরম করে বলল, তাতেই জয়দেব রায়ের নাকের ওপরটা জ্বলতে লাগল, যেন কেউ ঝামা ঘষে দিয়েছে। জয়দেব রায়ের ঠাকুরঘরের সমস্ত দেবদেবীরা একসঙ্গে কুপিত হয়ে কমলেশকে বরখাস্ত করল।

(৩)

বিষয় রবীন্দ্রনাথ। এম.এস-এর ক্লাস । এর আগে পি.জি-র ক্লাস হয়ে গেছে।পি.জি-র ক্লাসকে ছাত্ররা পাগলা গারদ বলে । পি.জি-র আর একটা পূর্ণাঙ্গ রুপ চালু হয়েছে ক্লাসে। পাগলা গরু। বোর্ডের ওপর ইংরাজি হরফে পাগলা গরু লিখে পি আর জি অক্ষরগুলো গোল করে দেওয়া হয় যাতে করে কারুর বুঝতে অসুবিধা না হয়। কখনও কখনও বোর্ডের ওপর একটা ক্ষিপ্ত গরুর ছবি আঁকা থাকে পঙ্কজ ঘোষ ক্লাসে ঢুকবার আগে। রেগে গিয়ে দুদিন ক্লাস ছেড়ে চলে গেছেন পঙ্কজবাবু। অথচ এম.এসের ক্লাস একেবারে ঠান্ডা থাকে। মিলি বাইরে গিয়েছিল । এম.এসের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হল মিলিকে। এম.এস পড়াচ্ছেন কিন্তু দরজার দিকে তাকাচ্ছেন না।

......দশই ডিসেম্বর উনিশশো তেরো। স্বাধীনতার চৌত্রিশ বছর আগে সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে নোবেল কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান হ্যারাল্ড গ্যাব্রিয়েল হিয়ার্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার দিতে গিয়ে বললেন....


মিলি ঢুকে পড়েছে ক্লাসে। চোখের ইশারায় এম.এস ওকে ভেতরে আসতে বলেছেন ।

-আর একবার নামটা বলবেন স্যার ? মিলি বলে।

-হ্যারাল্ড গ্যাব্রিয়েল হিয়ার্ন । সুইডিশ পলিটিসিয়ান ।রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বললেন, এই আংলোইন্ডিয়ান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার দিতে গিয়ে আমরা ভাবিনি তিনি ইউরোপে যথেষ্ট সুপরিচিত কিনা , কেননা সেটা বিবেচ্য নয়। আমরা এটাও ভাবিনি তিনি কোন দেশের নাগরিক, কেননা সেটাও বিবেচ্য তালিকার মধ্যে পড়ে না। সঙ অফারিংস অর্থাৎ গীতাঞ্জলি-র ভাব গভীরতা, অধ্যাত্মবোধ,সৌন্দর্য্য ইতিমধ্যেই ইউরোপ, আমেরিকার মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছে.......

মিলি মুগ্ধ হয়ে শোনে এম.এসের ক্লাস ।প্রত্যেকদিন রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনান এম.এস। ক্লাসের শেষে মিলি এম.এস এর কাছে আসে।

-রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে লেখা কিছু বইয়ের নাম বলুন না স্যার।

-অনেক বই আছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রজীবন কথা’, প্রশান্ত কুমার পালের ‘রবীজীবনী’। তুমি আবু সৈয়দ আইয়ুবের ‘পান্থজনের সখা’ পড়েছ ? খুব ভালো।আমার কাছে এই মুহুর্তে ‘পান্থজনের সখা’ আছে। পড়তে দিচ্ছি। দশদিন বাদে ফেরত দিয়ো কিন্তু। একটু ধরে পড়। একটু বুঝে।

ব্যাগের মধ্যে অনেক খাতা বই। ট্রেনে বসার জায়গা পেয়ে যায় মিলি।ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে এম.এস এর দেওয়া বইটা বার করে নিয়ে আসে।অন্য বইগুলোর থেকে এই বইটা যেন একটু বেশি উষ্ণ। বইটা খুলতেই প্রথম পাতায় সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা, ‘মহিউদ্দিন সরকার’।একটা সুন্দর জ্ঞানী মানুষ। এম.এসের বয়েস কম । একটা নম্র ব্যক্তিত্ব আছে মানুষটার। সব সময় মুখে হাসি আর হাতে বই। মেয়েরা চর্চা করত এম.এস বিবাহিত কিনা! ফেসবুকে প্রোফাইল ঘেঁটে পাওয়া গেছে , ‘সিংগল’, আর কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে লোকটা সাড়া দেয় না। ছেলেরা বলেছে লোকটার হাত ভর্তি, ব্যাগ ভর্তি, মাথা ভর্তি বই । বৌকে কোথায় জায়গা দেবে? বেশ খানিকক্ষণ বাদে মিলি আবিস্কার করে ও বইটার প্রথম পাতাতে চোখ রেখে হারিয়ে গেছে।‘মহিউদ্দিন’ নামটার দিকে তাকিয়ে আছে।নামটার সঙ্গে কথা বলে চলেছে মিলি। নামটা ক্রমশ ওর নম্র কোনো জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে।


(৪)

তিনদিন হল শরীরটা ভালো নেই কমলেশের ।রায়বাড়ির কাজটা গিয়ে মনটাও খুব খারাপ। সময়ে অসময়ে জয়দেববাবু কমলেশকে সাহায্য করেছেন । একটা ছাতা মাথার ওপর থেকে যেন সরে গেল।রোদ্দুরটা আরো তীব্র হল ।দুর্বল লোকেরা বিনামূল্যে চারপাশের পরামর্শ পেয়ে থাকে। কমলেশের বন্ধুরাও ইদানিং কমলেশকে নানান উপদেশ দিচ্ছে।

-মেয়েটার কথা ভাব।ঠিক সময়ে বাবা মা কে বিয়ের কথা ভাবতে হয়, নাহলে কি হবে জানিস – হঠাত দেখবি তোর মেয়ে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নিয়েছে।সেটা ভালো নাও হতে পারে।

- থামতো, দীনবন্ধুকে থামিয়ে দেয় কমলেশ। মিলি ওরকম মেয়ে নয়।ও চাকরি করবে, তারপর বিয়ের কথা ভাববে।

দীনবন্ধু থেমে যায় ।একটা কথা না বললেই যেন নয়, তাই বলে, ‘নন্দন চত্ত্বরে তোর মেয়েকে কালকে দেখেছি একটা লোকের সঙ্গে।‘

-লোক! কমলেশ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দীনুর দিকে।

দীনবন্ধু কথাটা আর ভাঙে না।যেন যা বলার বলা হয়ে গেছে।

দীনু চলে যাবার পর কমলশের মনে হয়, রায়বাড়ির প্রস্তাবটা খুব একটা খারাপ ছিল না। মিলি বড় হয়েছে। এটা যেন সবাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। কী জানি কী করছে মেয়েটা! ‘লোক’? শব্দটার মধ্যে একটা ভয় লুকিয়ে আছে। ফাঁকা ঘরের নীরবতায় ক্রমশ সেটা যেন প্রকাশ্যে আস্তে থাকে। শরীরটা আরো খারাপ করতে থাকে।

-না! অসম্ভব। মিলিকে নিয়ে চিন্তা করা যায় কিন্তু দুঃশ্চিন্তা করা অন্যায্য। কমলেশ নিজেকে বলে। মিলির আজকাল এত দেরি হয় কেন? প্রশ্নটা একটা দুর্ভাবনার হাত ধরে কমলেশের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ল।প্রশ্নটা নিরুচ্চারে বুকের মধ্যে ঘুরছে।এক কাপ চা নিজের জন্যে তৈরি করে কমলেশ।চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবে ও ছাড়াতো মিলির কেউ নেই। হঠাত যদি ও মরে যায় মিলি একা একা বাঁচতে পারবেতো? নিজের সঙ্গে কথা হতে থাকে।

- ঠাকুরমাশাই আছেন? কে যেন ডাকছে!

কমলেশ চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে।

-কে? কমলেশ বিছানা থেকে উঠে দরজা খোলে।তারপরই সারা শরীরটা দুলতে থাকে।যেন মাটি দুলে উঠেছে। আকাশের আলো নিভে যাচ্ছে।বাতাস ফুরিয়ে যাচ্ছে।কমলেশ দরজার পাল্লাটা ধরবার চেষ্টা করে।দুটো পাল্লা যেন পাখির মত উড়ে যাচ্ছে।কমলেশ পড়ে যায়।

একটা গোলমাল ওকে ঘিরে ধরেছে কমলেশ বুঝতে পারে।অনেক অর্থহীন কথা, অনেক অস্পষ্ট ছবি ওর চারপাশে কুয়াশার মত জমা হতে থাকে।কমলেশের মিলির মুখ মনে পড়ে।

-মিলি... কমলেশ বলার চেষ্টা করে।ঠোঁট দুঠো শুধু নড়ে।


(৫)


-তোমাকে আমি একটা কথা বলব। সাতদিন আগে মহিউদ্দিন বলেছিল মিলিকে।

‘পান্থজনের সখা’ ফেরত দিতে গিয়েছিল মিলি।মিলি যেন অপেক্ষা করছে সেই কথাটা শোনার জন্যে। খানিকক্ষণ চুপচাপ।

-কি হোলো, বলুন! মিলি বলে।

মহিউদ্দিন মিলির দিকে তাকিয়ে হাসে। যেন খানিকটা বলা হয়ে গেল। গলাটা একটু নামিয়ে নিয়েছিল মহিউদ্দিন।

-আবু সৈয়দ আইয়ুবের জীবন , সাহিত্য সবটা জানো ।আবু সৈয়দ গৌরী দত্তকে বিয়ে করেছিলেন। গৌরী আইয়ুবের কিছু লেখা তোমায় পড়াব। মানুষকে আমরা কিভাবে চিনতে চাই? ধর্ম দিয়ে, জাত দিয়ে, গায়ের রঙ দিয়ে, অর্থের ক্ষমতা দিয়ে?

মিলি ভাবে এইগুলোই কি কথা? নাকি মহিউদ্দিন প্রস্তুত হচ্ছে ওর ‘একটা কথা’ বলার জন্যে।মিলি উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে মহিউদ্দিনের দিকে।এই সময় প্রফেসরস রুমে অজিতবাবু ঢুকে পড়লেন।অজিতবাবু মহিউদ্দিনের ওপর যে কোনো কারনেই হোক প্রসন্ন নন। কিছুদিন আগে হিন্দু মুসলিম প্রসঙ্গ তুলে মহিউদ্দিনকে বিব্রত করেছিলেন অজিত ভট্টাচার্য । মহিউদ্দিন অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিল। কথাটা তাই না বলা রয়ে গিয়েছিল ।

-কথাটা বলতেই হবে। মহিউদ্দিন ভাবতে ভাবতে ইউনিভার্সিটির দোতলা থেকে নেমে আসে।চোখ পড়ে যায় বাগানের বেঞ্চের ওপর মিলি বসে আছে।দুতিনজন মিলিকে ঘিরে।সবাই কিছু একটা বোঝাচ্ছে। দুচোখ ঢাকা দিয়ে মিলি ফোঁপাচ্ছে ।

- কি হয়েছে মিলির? মহিউদ্দিন পা চালিয়ে মিলির সামনে আসে।

-কি হয়েছে তোমার ?

মিলি মুখ তোলে। কান্নার আবেগ আটকানোর জন্যে ঠোঁট ঠিপে ধরে।

-ওর বাবা অঞ্জান হয়ে গেছে। যে ফোন করেছে সে বলেছে ওর বাবাকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মিলিকে ঘিরে থাকা একটা ছেলে তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়।

- কোন নার্সিং হোমে?

- লাইফ নার্সিং হোম। মিলি কোনক্রমে বলে।

-চল আমার সাথে।তোমরা বাড়ি যাও, আমি দেখছি। চল দেরি কোরো না , আমি আছি।

মিলি উঠে পড়ে।মহিউদ্দিন দৌড়তে থাকে। গেটের মুখে ট্যাক্সি থেকে কে একজন নামছে। মহিউদ্দিন দৌড়ে গিয়ে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করায় ।

-লাইফ নার্সিং হোমে চল। মিলি ওঠ তাড়াতাড়ি ।

মিলি উঠে পড়ে।এই প্রথম আধো চেনা আধো অচেনা কারুর সঙ্গে ও ট্যাক্সিতে চেপেছে।গিয়ে বাবাকে ঠিক দেখবে তো?শহরের বুকে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। মহিউদ্দিন কথা বলে।

‘ভয় পেও না , আমি পাশে থাকবো। তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?’

-কেউ না।

-মা?

-মারা গেছেন অনেকদিন আগে।

মহিউদ্দিন থমকে যায়। মিলির দিকে তাকায়। যেন ঝড় বৃষ্টির মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।

-আত্মীয়? মহিউদ্দিন আবার প্রশ্ন করে।

-একজন মামা, অনেক দূরে থাকে । ভূপালে।

-বাবা কী করেন?

থেমে যায় মিলি।সিগন্যালে দাঁড়িয়ে গেছে গাড়িটা।মহিউদ্দিন তাকায় মিলির দিকে। মিলি মাথা নিচু করে সিগন্যালের লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে আছে ।

-বললে নাতো , বাবা কী করেন? 

-পুরোহিত। পূজো করেন বাড়ি বাড়ি ।আমাকে বাঁচানোর জন্যে... মিলি একটু থামে। তারপর বলে...বাবা মনে করেন বাড়িতে আমরা তিন জনে আছি, আমি, বাবা আর নারায়ণ।

- কে নারায়ণ?

-আমাদের ঈশ্বর , যাকে আমি খুব একটা জানি না।

-ও! নারায়ণ? নারায়ণ কি শুধু তোমাদের?

-এসে গেছি। ট্যাক্সি ড্রাইভার বলে। নার্সিং হোমের বড় গেটটার সামনে ওরা নেমে পড়ে ।

মহিউদ্দিন নেমেই ট্যাক্সির টাকা মিটিয়ে দেয়।মিলি দেখে পাড়ার দুজন দাঁড়িয়ে আছে সামনে। অঞ্জনদা আর দীনুকাকা।মিলি দৌড়ে যায়।

-ঞ্জান ফিরেছে । মনে হচ্ছে সুগার ফল করেছিল। ডাক্তাররা বলছে ভয়ের কিছু নেই। ই সি জি হয়েছে। অঞ্জন বলতে থাকে।

মহিউদ্দিন সামনে এগিয়ে যায়।

-আপনি কি ওদের আত্মীয়? দীনবন্ধু মহিউদ্দিনকে বলে।

-হ্যা, আত্মীয়, নিকট আত্মীয় ।

মহিউদ্দিনের কথায় মিলি একটু অবাক হয়ে যায়। মহিউদ্দিন মিলির দিকে গাছের ছায়ার মত তাকায়।

-পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। একটু অ্যাকাউন্টসে যান-আমরা ঝপ করে নিয়ে চলে এসেছি, হয়ত দিন দুয়েক থাকতে হবে মিলির বাবাকে।

-মহিউদ্দিন এগিয়ে যায় অ্যাকাউন্টসের দিকে, মিলির লজ্জা করে।একজন প্রায় অচেনা মানুষের ওপর এ যেন জুলুম।কি ভাবছে মহিউদ্দিন।

-স্যার আমি টাকাটা...

-ভাবোনা তোমার বাড়িতে সত্যিই তিনজন থাকে। যাও বাবার কাছে যাও মিলি । তোমায় দেখলে ওনার ভালো লাগবে।

মিলি আবার একবার ঠোঁট ঠিপে ধরে। কৃতঞ্জ চোখে মহিউদ্দিনের দিকে তাকায়।


(৬)


কমলেশ চোখ খুলেই দেখতে পায় অপরিচিত একটা জায়গা, অচেনা লোকজন। একজন মহিলা নিচু হয়ে বলে, ‘কী কেমন লাগছে?’

কমলেশ অচেনা মহিলাকে কিছু বলার চেষ্টা করে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

-আমি কোথায় ? কোনক্রমে বলে।

মহিলা উত্তর দেয় না। একটা ঝুলন্ত বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকে । হাতের শিরায় একটা নিডিল ঢুকে যায় । কমলেশ আঃ করে ওঠে।

-আমি কোথায় ? আবার প্রশ্ন করে কমলেশ ।একটা অল্প বয়েসের ডাক্তার এগিয়ে আসে ।ওর চোখটা টেনে ধরে । চোখের ওপরটা টিপে ধরে ছেলেটা । কমলেশ আবার আঃ করে ওঠে।

- কটা আঙুল? ছেলেটা দুটো আঙুল দেখায়।

-দুটো। এতক্ষনে কমলেশ নিজের গলার আওয়াজ শুনতে পায়।

- আমি কোথায় ? কমলেশ আবার বলে।

-নার্সিং হোমে। ডাক্তার বলে।

ঝুলন্ত বোতলের ভেতর একটা ওষুধ ঢুকিয়ে দেয়।নার্সিং হোম শুনে কমলেশ চমকে ওঠে।চোখ দুটো বুঁজে আসছে।বৃষ্টি পড়ছে নাকি? এত ঝাপসা লাগছে কেন?কমলেশের মিলির কথা মনে পড়ে। দুর্ভাবনাকে অতিক্রম করে একটা ঘুম আসছে নরম পায়ে।কমলেশ আর ভাবতে পারে না।

মিলির সাথে ডাক্তারের দেখা হয়ে যায় ওয়ার্ডের সামনে।

-কমলেশ চক্রবর্তী? মিলি প্রশ্ন করে ।

- কে আপনি? মেয়ে?

-হ্যা। ডাক্তারের দিকে সভয়ে তাকায় মিলি।

- যান, কথা বলবেন না । যদি ঘুমোয় জাগাবেন না । ভয়ের কিছু নেই, হাইপোগ্লাইসেমিয়া। ওনার হার্ট ল্যাঙ সব ঠিক আছে ।আমরা দেখে নিয়েছি।

-হাইপোগ্লাইসেমিয়া! মিলি উচ্চারণ করে।

-সুগারটা ফল করেছে, প্রেশারও। একটা কম্বাইন্ড এফেক্ট। কাল বা পরশু ছেড়ে দেব। ই সি জি ঠিক আছে। মানে প্রায় ঠিক আছে । ডাক্তার এইটুকু বলে মিলিকে অতিক্রম করে চলে যায়।

মিলি ওয়ার্ডে ঢোকে। রিসেপশনে বলেছে উনিশ নম্বর বেড।মিলি খুঁজে পেয়ে যায়।বাবা ঘুমোচ্ছে। মিলি খুব সাবধানে একটা টুল টেনে নেয়, যাতে শব্দ না হয়। বাবার পাশে বসে।বাবার বিছানার পাশে একটা মনিটারে কিছু আলোকিত রেখা ভয় দেখাতে দেখাতে চলে যাচ্ছে । স্যালাইনের বোতলের ভেতর টুপটাপ করে জীবনের আশ্বাস নেমে আসছে।

‘ভয়ের কিছু নেই’ কথাটা মিলিকে ভীষন তৃপ্তি দিয়েছে।মিলি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।কমলেশের চোখ দুটো নড়ে ওঠে।কি একটা কথা বলতে চাইছে।মিলি উৎকর্ণ হয়ে ঝুঁকে পড়ে বাবার কাছে। কমলেশ বিড়বিড় করে,’মিলি’।মাথায় হালকা করে নরম হাত বুলিয়ে মিলি বলে , ‘এই তো আমি।’ কমলেশ আস্তে আস্তে চোখ খোলে।মিলির ছবি ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হতে থাকে।মিলির পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।কে ও? কোথায় দেখেছে ওকে? অকস্মাৎ কেঁপে ওঠে ভেতরটা। সারা চোখে বিস্ময় নিয়ে কমলেশ বলে ,’ও এসেছে’? মহিউদ্দিন এগিয়ে আসে। মিলি বলে ,’আমাদের বন্ধু, আমার খুব কাছের মানুষ। মহিউদ্দিন সরকার’।

-আমি মহিউদ্দিন, আপনি ভালো হয়ে যাবেন । আমি এসে গেছি।

-আমি জানতাম তুমি আসবে। তুমি সত্যপীর। কমলেশ থেমে থেমে বলে। চোখ দিয়ে জলধারা নেমে আসে। মিলি চোখের জল মুছিয়ে দেয়।ফুঁপিয়ে ওঠে মিলি।

অপার প্রশান্তিতে কমলেশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।ঘুম আসছে।

মহিউদ   

   

্দিন মিলির দিকে তাকায়।মিলি বুঝতে পারে এতক্ষনে মহিউদ্দিনের না বলা কথা বলা হয়ে গেছে।

মিলির কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু স্বরে মহিউদ্দিন প্রশ্ন করে, ‘সত্যপীর কে?’

-আমাদের ঘরের লোক। বলিনি আমাদের ঘরে তিন জন থাকে। তৃতীয়জন সত্যপীর। নারায়ণের আর এক রুপ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics