Debabrata Mukhopadhyay

Children Stories Horror Classics

4.0  

Debabrata Mukhopadhyay

Children Stories Horror Classics

রঙ্গাইপুরের ঘর

রঙ্গাইপুরের ঘর

11 mins
411



 

-এই আপনার ঘর । লাগোয়া বাথরুম। সারাক্ষণ জল পাবেন ।দক্ষিনের জানলা খুললে রাত্রে আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে ।একটাই প্রবলেম ওপরে আপনি ছাড়া কেউ নেই ।

-কেউ নেই? সমীরণ অবাক হয়ে বলল ।

-না কেউ নেই। দুটো ঘর নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে । দেখবেন তালা দেওয়া । একটা ঘর মালিকের নিজের । তিন বছরে একবার হয়ত আসেন । আপাততঃ ওটাও তালা দেওয়া ।

-নিচে?

-নিচে একটা মুদির দোকান আছে। ওটা সকাল সন্ধে খোলে। তখন তো আপনি অফিসে থাকবেন । নিচে একটা গোডাউনও আছে । চাল, ডাল স্টোর করে। মধ্যরাত্রে মাল ঢোকে আর হয়ত দুপুরে বেরিয়ে যায় । সবই হয়ত বলছি । সবটা আমি দেখিনি । রাত্রে আপনার একটু একা লাগবে ।তবে আপনি আসবেন তো ঘুমোতে ।

-প্রায় তাই, তারপর শনি, রবি বাড়ি চলে যাবো।

- তবে আবার কী । কাল তাহলে মালপত্র নিয়ে চলে আসুন । এই নিন চাবি।

অজিত বীরবংশী সমীরণকে চাবি দেয় ।


-কত ভাড়া দিতে হবে, সেসব কথা হল না, একটু বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা হল না।

- তাহলে তো বছর খানেক অপেক্ষা করতে হবে, উনি জার্ম্মানীতে আছেন ছেলের কাছে, কবে আসবেন কেউ জানে না । ভাড়া দিতে হবে না , কাকে দেবেন । তাছাড়া আপনার চারশো ছশো টাকায় ওদের কিছু যায় আসে না । বীরবংশী হাসে ।


- তাহলে ? সমীরণ কী করবে বুঝতে পারে না ।

-চলে আসুন কাল । অত ভাববার কী আছে? আরে বাবা চারপাশে তো লোক আছে । বাড়ির তলাতেই মুদির দোকান । সিগারেট থেকে আরাম্ভ করে বাসমতী চাল সবই পাবেন ।


-এটা একটা প্লাস পয়েন্ট । সমীরণ বলে । ঠিক আছে কাল সকালে সব মাল নিয়ে চলে আসছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনি আমার জন্যে একটা বাসস্থান জোগাড় করে দিলেন ।


অজিত বীরবংশী একেবারে খোলা মনের মানুষ । বলে , ‘আরে বাড়িওয়ালা আপনাকে ধন্যবাদ দেবে । এই বাড়িটায় থাকার একজন লোক পাওয়া গেল ।গত পনের কুড়ি বছর এখানে টিকটিকি , আড়শুলা ছাড়া কিছু থাকেনি ।সুরমান তিন দিন ধরে পরিষ্কার করেছে আপনার ঘর , বারান্দা , সিড়ি। ও আবার এই বাড়িটায় আসতে ভয় পায় । বলে ভূত আছে। সঙ্গে ওর ভাই ফরমান কে নিয়ে এসেছিল’

সমীরণ বলে , ‘তাহলে তো ভালোই, একেবারে কেউ নেই তা নয়।’

অজিত হাসে , বলে ‘ কিছু বদমাইশ লোক আছে যারা এসব রটায় । আপনি ভয় পাবেন না কিন্তু’

-ধ্যা, বাচ্ছা ছেলে নাকি? সমীরণ বলে । 


*******************************************************


সিউড়ি থেকে সাঁইথিয়া যাবার পথে রঙ্গাইপুর গ্রামের কাছে এই বাড়িটা । দোতলা বাড়ি । একদা এর গায়ে সাদা একটা রঙ ছিল । এখন পথের ধুলোয় ওটা প্রায় কালো হয়ে গেছে। নিচের তলায় মুদির দোকানটা খুব সকালেই সচল হয়ে ওঠে । সকাল সাতটাতেই খাট, বিছানা, ছোট একটা আলমারি, একটা অতি পুরনো এক পা নড়বড়ে ছোট টেবিল, একটা চেয়ার, ফাইল, বইপত্র, স্টোভ, বাসনপত্র ইত্যাদি নিয়ে সমীরণ চলে এলো বাড়িটায় । কিছুক্ষণ বাদেই বীরবংশী হাজির । এক ঘণ্টার মধ্যে ঘর সাজানো হয়ে যায় ।

-চলুন আমার বাড়ি হয়ে যাবেন । বীরবংশী বলে । 

-কেন, অফিস যেতে হবে না?

- আরে এখন তো সবে আটটা। আমার বাড়িতে গিয়ে চান, খাওয়া করে আসবেন । প্রথম দিন আপনাকে কিছু জোগাড় করতে হবে না ।কাল থেকে সকালে একটা কিছু করে নেবেন । অফিসেতো ভাত কান্টিন আছেই ।

স্কুটারের পেছনে চেপে বসল সমীরণ । মনে মনে ভাবল, নতুন জায়গায় একজন ভালো বন্ধু ভাগ্য প্রসন্ন হলেই পাওয়া যায় ।

ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সমীরণ । ছোট ব্রাঞ্চ । অজিত বীরবংশী ব্যাঙ্কেরই চিফ ক্যাশিয়ার । খুব মিশুকে অজিত । সমীরণের প্রায় সমবয়েসি । সেদিন কাজ করতে করতে অজিত প্রশ্ন করে,  ‘আপনার একা থাকতে সত্যিই অসুবিধে হবে নাতো?’

সমীরণ হাসে,

- যে ঘরেই থাকি না কেন , একাই তো থাকতে হবে ।

-না তা বলছি না, পাশে লোকজন থাকলে একটু সুবিধে হয় ।

-তেমন তেমন লোক থাকলে অসুবিধেও হতে পারে ।এক্ষেত্রে সুবিধে না হোক , অসুবিধে হবে না ।

- আর আপনি তো গল্পের বই পড়েন ,গান গান , গান শোনেন।

- হ্যা, তবে যা লোডশেডিং এখানে কতটা পড়তে পারবো কে জানে !

-সেক্ষেত্রে ভূতের সঙ্গে কথা বলবেন ।গান গাইবেন । দক্ষিনের বারান্দা খুলে চেয়ারে বসে রেডিও চালিয়ে দেবেন ।সময় কেটে যাবে ।

সমীরণ আবার হাসে।

*******************************************************

রাত নটা । সিউড়ি শহর ক্রমশ নীরব হচ্ছে ।

-চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি ।বীরবংশী বলল ।সিউড়ির এস.পি মোড়ে বীরবংশীর বাড়ি ছেলের জন্মদিন বলে সন্ধেতে সমীরণকে একরকম জোর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল ।

-ওভার ইটিং হয়ে গেল ।

- তাতে কী হয়েছে ? আপনার ওজন ষাট কেজিরও কম । এক আধদিন বেশি খেলে ক্ষতি হবে না ।বীরবংশী বলে ।

- প্রত্যেকদিন এত আদর যত্ন করলে একশো কুড়ি কেজি হয়ে যাবে ।

বীরবংশী স্কুটারে স্টার্ট দিল । রঙ্গাইপুরে সমীরণ পৌঁছলো প্রায় সাড়ে নটায় ।চারপাশ একেবারে নিস্তব্ধ ।একটা মনমরা অনুজ্জ্বল বাড়ি শুধু ওর জন্যে অপেক্ষা করছে ।শীত পড়েছে । বীরবংশীকে আবার এতটা পথ ফিরে যেতে হবে ।

-আপনি সাবধানে যাবেন । সমীরণ বলে ।

-হ্যা, হ্যা ।

-সিগারেট আছেতো? দেশলাই? টর্চ? ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করুন ।

-সব আছেরে বাবা ।ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে সমীরণ ।এবার আপনি যান ।অনেকটা পথ যেতে হবে ।

-আরে বাবা ! এটা আমার এলাকা ।এখানকার সব লোক, এমনকি রাস্তার কুকুরগুলোও আমায় চেনে । আপনি ওপরে যান, দরজা খুলুন, লাইট জ্বালান –তারপর আমি যাচ্ছি ।


-আপনি কি আমায় সত্যি সত্যি বাচ্ছা ছেলে পেয়েছেন নাকি? আরে আমি খয়রাশোলের অন্ধকারে একা দুবছর কাটিয়ে এসেছি । যান আপনি । সমীরন ধমক দেয় ।বীরবংশী হেসে স্কুটারে চালু করে । স্কুটারের ইঞ্জিনের শব্দ নিস্তব্ধতা ভাঙতে ভাঙতে দূরে চলে যায় । আবার নীরবতা ফিরে আসে। চারপাশে কুয়াশা । শীত করতে থাকে সমীরণের ।


******************************************************** 


টর্চটা খুব কাজে লাগছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবে সমীরণ । আশ্চর্য টর্চের আলোটা কমে যেতে থাকে । মনে মনে ভাবে প্রশংসা করলে মানুষ কেন প্রাণহীন বস্তুও বিগড়ে যায় । সিড়ির তলায় কেউ হেসে ওঠে । টর্চটা দ্রুত ঘোরায় সমীরণ হাসির উৎসের দিকে । টর্চটা নিভে যায় । কেমন একটা লাগে । গা ভারি হয়ে ওঠে । অন্ধকারের মধ্যে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ও । আকাশের একফালি চাঁদ আর মুঠো মুঠো নক্ষত্রের আলোর করুনায় ক্রমশ সিঁড়িটা দৃশ্যমান হয় ।আস্তে আস্তে পা ফেলে ঘরের দরজা অবধি চলে আসে । তালা খোলে ।পকেট থেকে দেশলাইটা বের করে ।বীরবংশী সব প্রস্তুতি আগে থেকেই করে গেছে ।টেবিলের ওপর মোমবাতির স্ট্যান্ড । তাতে মোটা মোমবাতি লাগানো । মোমবাতির স্ট্যান্ডটার অবস্থানটা সমীরণ জানে । ফস করে দেশলাইটা জ্বালায় ।সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন ফুঁ দেয় ।নিভিয়ে দেয় শিখা সমেত দেশলাই এর কাটিটা । অদ্ভুত একটা অনুভব। যেন ঘরে কেউ আছে ।

-কে? হালকা গলায় ও প্রশ্ন করে । 


কেউ উত্তর দেয় না ।দক্ষিনের জানলাটা নিজে নিজেই খুলে যায় । ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে ।নিজের বোকামিতে সমীরণের হাসি পায় ।আশ্চর্য একটু অন্ধকার হলেই ভয় পায় কেন মানুষ ।মনে মনে বলে, ‘জানতাম নাতো আমি এত ভীতু’! অথচ ভয়টা যেন পেছনেই অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়টা কাটানোর জন্যে গাইতে থাকে, “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরান সখা বন্ধু হে আমার..” । আবার দেশলাইটা জ্বালায় ।নির্বিঘ্নে মোমবাতি ধরায় । দক্ষিনের দরজাটাও খুলে দেয় সমীরণ । চেয়ারটা বারান্দায় নিয়ে আসে । সাঁইথিয়া থেকে একটা বাস সিউড়ির দিকে চলে গেল ।পারিসর গ্রামের মুখে থামল বাসটা । কয়েকজন লোক নামল । গ্রামের ভেতর চলে গেল ।ঘরের ভেতর মোমবাতিটা দপদপ করছে হাওয়ায় ।একটু কোনের দিকে রেখে দিলে হাওয়া লাগবে না । সমীরণ ভেতরে এসে মোমবাতিটা সেইভাবে রেখে দেয় । শিখা অকম্পিত, স্থির হয় ।যদিও বারান্দায় বসে থাকলে ঘরের ভেতর আলোর প্রয়োজন হয় না , তবুও মোমবাতিটা জ্বেলে রাখলে অন্ধকারটা আর ভয়ঙ্কর লাগছে না । বারান্দায় বেশিক্ষণ বসা যাবে না । ঠান্ডা লাগছে । কোথা থেকে ডুম ডুম ডুম করে একটা ঢোলের শব্দ আসছে ।সম্ভবত পারিসর গ্রামের সাঁওতাল পরিবারে বিয়ে হচ্ছে । পারিসর হিন্দু গ্রাম । রঙ্গাইপুর মুসলিম প্রধান গ্রাম ।বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে আসে সমীরণ । কটা বাজে এখন ? চোখের পাতা ভারি হচ্ছে। ঘুম পাচ্ছে ।টেবিলের ওপর হাত ঘড়িটা পড়ে আছে । ঘড়িটা তুলে দেখে।

-দশটা দশ । কেউ যেন ধরা গলায় বলল ।

- কে? আতঙ্কে গলা দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে । চারপাশে তাকায় সমীরণ । এটাতো বিভ্রম নয় । একটা সুস্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ স্বকর্নে শুনেছে । কার গলা? কেউ একজন ঘরে আছে ।কেউ একজন ঘরে হাঁটছে । তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে । মোমবাতিটা তুলে চারপাশ দেখতে থাকে সমীরণ । পারিসর গ্রাম থেকে ঢোলের আওয়াজটা এখনও আসছে । মাঝে মাঝে একটা সমস্বরে চিৎকার ।রেডিওটা কোথায় ? মোমবাতির আলয় রেডিওটাকে আবিস্কার করে ।রেডিওটা চালিয়ে দেয় । এফ এম এ গান হচ্ছে । খুব কম ভ্যলুমে গান চলতে থাকে । শুয়ে পড়ে সমীরণ । ঘুম আসছে ।বাঁহাতটা তুলে রেডিওটা বন্ধ করার চেষ্টা করে । কেউ একজন বন্ধ করে দেয় । হয়ত খুব ভয় পেয়ে যেত সমীরণ, কিন্তু ঘুম তার আগে অন্ধকারে ওকে ডুবিয়ে দিয়েছে ।


******************************************************

এসব কিছু বলা যাবে না অজিত বীরবংশীকে । ও ভগবান ভূত কিচ্ছু মানে না । হাসাহাসি করবে । ম্যানেজার চেম্বারের আলো ফ্যান কিছুই চলছে না । ইলেক্ট্রিসিয়ান সামসুল এসেছে দেখতে ।ওর নামটা সবাই ছোট করে দিয়েছে । সবাই ওকে সামু বলে ডাকে । সামু দেখছে সব । নতুন ফ্যান, না চলার তো কোনো কারণ নেই ।

- সমস্ত লাইনটা দেখ । ভূতুরে ব্যাপার হয়েছে । সমীরণ বলে ।

সামসুল বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘দেখছি স্যার’ ।

কাজ করতে করতে বলে, ‘স্যার আপনি গোডাউন বাড়িতে আছেন ?’

-কী বাড়ি ?

- ওটাকে লোকে গোডাউন বাড়ি বলে । স্যার, আপনি কি একা থাকেন ওখানে ?

- হ্যা । কেনরে ?

- না , সামু তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গে আসে ।বলে, ‘ওই বাড়িটায় ইলেক্ট্রিসিটির টোটাল কাজ আমি করেছি । পুরো কনসিল কাজ আছে। এখানে কেউ আগে এসব কাজ জানতো না’ ।

-তাই? সমীরণ হাসে ।নিজের কথা সামু খুব জোরের সঙ্গে বলে ।

-ও বাড়িতে লাইন দিতে খুব ঝামেলা হয়েছিল ।খালি লাইট কেটে যায় ।ফিউজ উড়ে যায় ।

-কেন ? সমীরণ অবাক হয়ে জানতে চায় । চুপ করে যায় সামু  

-ঝামেলাটা কী রে ? সমীরণ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে । সামু হটাৎ কাজে খুব মন দিয়ে ফেলে । ভয়ে ভয়ে একবার তাকায় বীরবংশীর দিকে ।

-যেখানেই তুই যাস সেখানেই ঝামেলা তোর সঙ্গে সঙ্গে যায়,তাই না? বীরবংশী বলে

সামু হাসে । পুরো ব্যাপারটা মেনে নেয় । কি একটা কথা না বলা রয়ে যায় ।  

‘তাহলে ঝামেলা একটা আছে’ মনে মনে বলে সমীরণ ।যাই হোক বাড়িটা ব্যাঙ্কের খুব কাছে ।ব্রাঞ্চ থেকে হেঁটে গেলে বড় জোর কুড়ি মিনিট ।কাজ করতে করতে অনেক রাত্রি হয়ে গেলেও হেঁটে বাড়ি পৌঁছোনো যাবে । কিন্তু এই যে সামু বলল ঝামেলা আছে , সেটা খুব বেশি ঝামেলা করবে নাতো? গতকাল ‘দশটা দশ’ বলে কেউ যেন সময় বলে দিল সেটা কি মনের ভুল? কেউ মোমবাতি নিভিয়ে দিয়েছিল । সেটাও কি মনের ভুল ?

- আজ কিন্তু বাস নেই ।ব্যাঙ্কের পিওন তাপস কথাটা বলতে বলতে ঢোকে ।

- সকালে চলছিল তো ? সমীরণ সন্দেহ প্রকাশ করে ।

- স্ট্রাইক হয়েছে । সকালে একটা বাস আস্যক্সিডেন্ট করেছিল ।তাতে বাসের ড্রাইভারকে খুব মেরেছে পাবলিক । ড্রাইভাররা স্ট্রাইক করে দিয়েছে ।ট্রেকার চলছে ।ভীষণ ভিড় । লোকে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে ।

তার মানে আজ সবাই আগে আগে বাড়ি চলে যাবে ।গোকুল , তাপস , অরবিন্দ সবাই তৈরি হতে থাকে । যাহোক করে ঝুলে ঝুলে যাবে । সবাই সন্ত্রস্ত । কাজ কর্মের তেরোটা বাজল । ব্যাঙ্ক সাড়ে চারটেতেই বন্ধ হয়ে যাবে । সামু কাজ করতে করতে বলল , স্যার আর্থিংএ ভূতটা ঢুকেছিল । ধরেছি । এই দেখুন আলো, ফ্যান সব চলছে ।

কিছুক্ষণ বাদেই বীরবংশী হাঁকে , ‘আমার সঙ্গে কে যাবে? স্যার , তাপস বলছে মাঠপলশার ওদিকে ঝামেলা হচ্ছে । ব্রাঞ্চ খুলে রাখবেন না। তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিন ।’ সমীরণ একটু অসন্তুষ্ট হয়ে ভাবে , ‘কাজগুলো কী করে হবে কে ভাববে?’

 সামু বেরিয়ে যাবার আগে একটু দাঁড়ায় ।

- একটা কথা বলি স্যার । ও বাড়িটা ভালো নয় । আজ পর্যন্ত কেউ ও বাড়িতে থাকতে পারেনি । আপনি যেন বলবেন না আমি বলেছি । বীরবংশীদা আমায় মারবে তাহলে ।

-কিসে ভালো নয়? কী ঝামেলা আছে বলছিলি , খুলে বল না ।

-সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যে দুটো ঘর আছে দেখেছেন? তালা দেওয়া । ওখানে কিছু একটা হয়েছিল । খুন অথবা আত্মহত্যা । তারপর থেকে ওখানে লোকে অনেক কিছু দেখতে পায় ।

-তুই দেখেছিস ?

- লোকে বলে ।তখন আমি খুব ছোটো ছিলাম। এর আগের ম্যানেজার ওখানে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ।  

সমীরণ হাসে । সামু ম্যানেজারের হাসি দেখে বলে , ‘আপনার সাহস আছে। আপনার কিছু হবে না । আসলে কি জানেন ভূত তাদের কাছে আসে যারা ভয় পায়’ । কথাটা বলে সামসুল বেরিয়ে যায় । সমীরণ ভাবে ঠিক বলেছে সামু । ভয়কেই লোকে ভয় পায় । আপন মনে কাজ করতে থাকে সমীরণ । কোথায় একটা হই হই হচ্ছে । সমীরণ সচেতন হয় । বড্ড ফাঁকা জায়গায় ব্রাঞ্চটা । অন্ধকার হয়ে এসেছে । বন্ধ করে দেওয়াই ভালো । ব্রাঞ্চ বন্ধ করে দেয় সমীরণ ।

********************************************************

শীতকালের বিকেল চড়ুই পাখির মত পালিয়ে যায় ।সাড়ে পাঁচটাতেই সন্ধে নেমে এল ।গোলমালের গন্ধ পেয়ে এলাকা ফাঁকা হয়ে গেছে । ফাঁকা রাস্তায় জুতোর শব্দটাও শোনা যাচ্ছে । সমীরণ শুনতে পায় পেছন থেকে কেউ আসছে । একটা পায়ের শব্দ যেন ওকে অনুসরণ করছে । পেছনে তাকায় , কই কেউ তো নেই! অথচ পায়ের শব্দটা ওর দিকে এগিয়ে এসে ওকে অতিক্রম করে চলে যায় । বুকটা ধকধক করে ওঠে ।মুখ থেকে একটা আর্তনাদ অজান্তে বেরিয়ে আসে । সামনে মহসীনের চায়ের দোকান । একটা লোক ওখান থেকে বেরিয়ে আসে । লোকটা বেশ লম্বা । লোকটা কাছে আসে । লোকটাকে আর একটু লম্বা লাগে । লোকটা হেসে বলে, ‘ভয় করছে বুঝি?’, তারপর হাসতে হাসতে ওর সামনে দিয়ে চলে যায় ।লোকটার দিকে সমীরণ তাকিয়ে থাকে । কুয়াশা আর অন্ধকারে কেমন যেন হারিয়ে যায় লোকটা । সমীরণ পা চালায় । গোডাউন বাড়িটার তলায় তখনও দোকানটা খোলা । দোকানটায় ঢোকে সমীরণ । দোকানের মালিকের নাম সন্যাসী ।

-কি নিবেন স্যার। দোকান বন্ধ করব । খুব মারামারি হছে শুনেছেন তো?

- কেন , কি হয়েছে ? 

- লেগেই আছে । কিছু লোক গোলমাল পাকাতেই জানে । ওই দেখুন শুনছেন ?

একটা গোলমাল এদিকেই আসছে মনে হয় । সন্যাসী দোকানের সাটার টানে । দোকান বন্ধ ক’রে রাস্তার উল্টোদিকে পারিসর গ্রামের ভেতর ঢুকে যায় । সমীরণ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে । পাশ দিয়ে সিঁড়ি চলে গেছে ওপরে । সমীরণ সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের দরজা খোলে । ঘরে সিগারেটের গন্ধ কেন? অবাক হয়ে যায় সমীরণ । আলো জ্বালায় ।

‘আঃ!’ কেউ যেন আপত্তি করে । আলোটা নিভিয়ে দেয় কেউ ।

-কে? কে বললে কথাটা ? আলো আমি জ্বালাব , অবশ্যই জ্বালাব । সমীরণ চিৎকার করে ওঠে ।কেউ হাসতে থাকে ।সমীরণ আতঙ্কে বিছানায় বসে পড়ে ।

- তবে জ্বালান , আমার চোখে খুব কষ্ট হয় । বেশ, আমি বারান্দায় যাচ্ছি ।

একটা ভারি গলা , যেন মাইকে কেউ নিচু গলায় কথা বলছে ।

দক্ষিনের জানলা দরজা আপনি আপনি খুলতে থাকে । আবার একটা পায়ের শব্দ বারান্দায় চলে যায় ।চেয়ার টানার শব্দ হয় । ওখানে রাখা একটা চেয়ারে কেউ বসে । বিছানা থেকে সমীরণ দেখে অন্ধকারে এক অস্পষ্ট অবয়ব নিয়ে বারান্দায় বসে আছে একটা লম্বা লোক যাকে এইমাত্র রাস্তায় দেখেছে । গলা দিয়ে আর কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না সমীরণের । সারা পৃথিবী দুলে ওঠে । বিছানায় অজ্ঞান হয়ে যায় সমীরণ ।



  


Rate this content
Log in