পেপসি
পেপসি


হরেন দলুই। এই নামে ওকে আর কেউ চেনে না। এখন হরেন ভিখিরি। ভিখিরিদের নাম থাকার তেমন প্রচলন নেই। বউ বাচ্ছা নিয়ে দুর্গাপুর স্টেশন চত্ত্বরে একটা গাছের নিচে হরেন পড়েছিল। ছিল বলছি কেন এখনো আছে। শুধু সংসারের তিনজন কমে দুজন হয়েছে। পাঁচদিন আগে জম্মু তাওয়াই এর ইঞ্জিনটা ওর বউকে পিষে দিয়ে গেছে। কালো কালো রক্ত এখনও লাইনের পাথরে জমাট হয়ে আছে। ছেলেটা সেই থেকে কাঁদছে। তিন বছরের ছেলে সব দেখেছে - দেখেছে বাঁশের খুঁটিতে ওর মাকে বেঁধে থলে জড়িয়ে নিয়ে গেল কয়েকজন লোক- দেখেও খুব একটা কিছু বোঝেনি ছেলেটা। কিন্তু সেই থেকে বিভিন্ন বায়না ধরছে।
আজ বায়না করছে ও পেপসি খাবে। স্টেশন চত্ত্বরে একটা লোক একটা বাক্স নিয়ে ঘুরছে আর ভাঙা গলায় হাঁকছে,' পেপসি পাঁচ টাকা , পাঁচ টাকায় পেপসি'।পাঁচ টাকা হরেনের কাছে অনেক। পাঁচ টাকা রোজগার করতে দু'ঘন্টা লাগতেও পারে। মানুষের চোখে্র জল বড় কম৷ আর ভিখিরি কি একটা। হরেনের তো মনে হয় সারা দুনিয়ায় ভিখিরির সংখ্যা এত বেড়ে গেছে এর পরে ভিখিরির কাছ থেকেই ভিক্ষে চাইতে হবে। হরেনের সাহস বড় কম,ও একটাকার বেশি চাইতে পারে না। ওর বউ ভালো বলতে পারতো। বাবু আমার বরের বড্ড অসুখ, ও হাসপাতালে আছে, কিডনি খারাপ হয়ে গেছে, দশটা টাকা দিন না বাবু। আপনারা সবাই দিলে ওকে বাঁচিয়ে আনবো। ও একাই দুশো টাকা তুলে ফেলতো সারাদিনে। হরেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ছেলেটা এখনও কেঁদে চলেছে। রোদের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মুখ দিয়ে নাল বেরুচ্ছে। খালি গায়ের ঘামে স্টেশনের ধুলো আটকে যাচ্ছে। হরেন অনেকবার ডেকেছে, এদিকে আয়, আয় এদিকে। বাবা বাছা নয়, নিরাসক্ত গলায়। ছেলেটা আসেনি। প্রতিটি ডাকের সাথে আরো পা দাপিয়ে, শুয়ে,গড়িয়ে, মুখ দিয়ে নাল বের করে তারস্বরে কাঁদছে। রোদে মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মরেই যাবে।
-মর, মরলে আমিও মরি। বিড়বিড় করছে হরেন।
-কি হয়েছে ওর, এতো কাঁদছে কেন?
হরেন তাকায়। সুন্দর জামাপ্যান্ট পরা একজন স্বাস্থ্যহীন লোক। পাশে অল্প বয়েসের একটা ছেলে।
- পেপসি চাইছে। পাঁচ টাকা দিয়ে একটা পেপসি কী করে কিনে দি বলুন। খাবার হয় না!
লোকটা হরেনের ছেলেকে দেখে। চোখে সহানুভূতি। হরেনের কাছে এগিয়ে আসে লোকটা। পাঁঁচ টাকার একটা কয়েন লোকটা হরেনের হাতে দেয়। বলে, ' কিনে দাও ওকে একটা '।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অল্প বয়েসি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে,' কত ছোট বাচ্ছা, কত অনাদরে আছে দেখছো? অথচ ওর তো সব কিছু পাওয়ার কথা, কি?'
হরেন নিজের ছেলের কাছে এগিয়ে আসে।
-ওঠ বাবা, এইতো বাবু টাকা দিয়েছে, পেপসি কিনে দেবো৷ ওঠ,বাবা ওঠ।'
ছেলেটা হরেনকে বিশ্বাস করে না। ও কাঁদতে থাকে।
তুফান এক্সপ্রেস ঢুকেছে। লোকটা উঠে যায় ছেলেটাকে নিয়ে। হরেন ছেলেটাকে তুলতে গিয়ে কি একটা ভাবে। নিজের ছেলের দিকে তাকায় হরেন। ছেলেটার মুখ লাল। কাঁদতে কাঁদতে হাঁপাচ্ছে ছেলেটা। চারপাশে তাকায় হরেন। ট্রেনটা চলে গেছে। এখনও কাঁদছে ছেলেটা। কিছুর একটা প্রতীক্ষা করছে হরেন। হ্যা আসছে। একটা চকচকে কালো বুট ছেলেটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-ছেলেটা কার?
-আমার বাবু।
- কাঁদছে কেন ছেলেটা।
- বায়না,পেপসি খাবে।
লোকটা পকেটে হাত দেয়।