Debabrata Mukhopadhyay

Inspirational

3  

Debabrata Mukhopadhyay

Inspirational

মুরশীদ মারা গেছে

মুরশীদ মারা গেছে

9 mins
687



(১)

মুরশীদ মারা গেছে। সে খবর আজকের নাকি! মারা যাবার আগে মুরশীদ সব খবরের কাগজের বেশ খানিকটা করে জায়গা নিয়েছিল। সেই খবরের কাগজ তারপর পরিত্যক্ত কাগজ হয়েছিল। বারো টাকা কেজি। পুরোনো খবরের কাগজে কী কী হয়? ঠোঙা হয় এটা আমি জানি। তবে আমি সুনিশ্চিত মুরশীদের মৃত্যুর খবর আর ঠোঙাতেও নেই। সেই ঠোঙা ব্যবহৃত হয়ে ময়লার গাড়িতে চড়ে ডাঁই ডাঁই আর্বজনার ভেতরে থেকে থেকে মাটি হয়ে গেছে। শহরের দুটো রাস্তা থেকে বিরোধী দলের ছেলেমেয়েরা মোমবাতি মিছিল করেছিল। আমাদের প্রশান্তদা মানে প্রশান্ত মাইতির মেয়ে ঈশিতাও সেই মিছিলে ছিল। ডান হাতে মোমবাতি ধরে বাঁহাতে সেলফি তুলেছিল। ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। একশো বত্রিশটা লাইক, পঁয়তাল্লিশটা কমেন্ট, নটা শেয়ার হয়েছিল। সেসবও অনেকদিন হল।মোমবাতি নিভে গেছে। এখন আর কোথাও কোন ক্ষোভ বিক্ষোভ নেই তা নয়, আছে। ২০১৯ সাল তো! এখন অনেক বড় বড় ভাবনা। বড় বড় মিছিল। তবে ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রশমিত হয় উৎসবের আবহে। এখন উৎসব চলছে। খাদ্যমেলা থেকে একশোটা মাইক চেঁচাচ্ছেঃ এই রসগোল্লা দৌড়চ্ছে ল্যাংচার দিকে, সিঙাড়া হা হা করে হাসছে, ফুচকা ফুলে উঠছে,  এই দেখুন তেঁতুলজলে লাফিয়ে পড়ল একটা ফুচকা.....। আমি জানলা বন্ধ করলাম। তাতেও পরিবেশটা অ-মাইক হল না। এখনও শুনতে পাচ্ছি। তবে শব্দের দাপট একটু কমেছে। আমার মুরশীদকে মনে পড়ল। ওকে নিয়ে এই গল্পটা লিখব। কথা দিচ্ছি গল্পটা লেখার পরই ওকে ভুলে যাব- ইয়ে অত্যন্ত সৎভাবে চেষ্টা করব বেমালুম ভুলে যেতে। তাহলে গল্পটা বলি।

(২)

আমিরাকে সবাই ঠকিয়েছে। এইরকম একটা বর ওর প্রাপ্য ছিল নাকি! ও ক্লাশ ফাইভ পাশ। অশিক্ষিতা বলা যাবে না। তারপর ওর রঙ ফরসা, কোমর সরু, বুকটা দেখলে আপনার লোভ হবে (মাপ করবেন, আপনার নয় কিছু কিছু পুরুষমানুষের)। তাহলে কি দাঁড়াল? আমিরা একটা সুন্দরী মেয়ে। ওর বাবা নুরউদ্দিন কি ভেবে ওকে একটা বেকার , আধপাগল ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিল?অবশ্য আমিরার বয়েস এখন ষোল হয়েছে। ষোল মানে যথেষ্ট বিবাহযোগ্যা। আর মুরশীদের বাবা মুরশীদুলের একমাত্র সন্তান মুরশীদ। স্বাস্থ্য ভালো, অর্থাৎ বিবাহযোগ্য। মুরশীদুলের রাস্তার ধারে একটা চাকাওয়ালা দোকান আছে।ওখানে মুরশীদুল চা, ঘুঘনি, পাঁউরুটি, সিগারেট, দেশলাই এসব বিক্রি করে।তাতে মুরশীদুলের সংসার চলে না তা নয়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। এই একটা দোকান আর লাইনের ধারে রেলের জমিতে একটুকরো টালির বাড়ি-এটাই নুরউদ্দিনের কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছিল?

বিয়ে করেই আমিরার মনে হল এ ছেলের বোধবুদ্ধি বলে কিছুই নেই। বেড়ার ফাঁকে দশটা চোখের সামনে আমিরাকে উন্মুক্ত করেছিল মুরশীদ। বাঁধা মানে নি। এই খিদেটা ওর কখনও শেষ হয় না। সকাল থেকে রাত্রির যে কোনো সময়ই ওর সময়। আমিরা বছর ঘুরতে না ঘুরতে মা হয়েছে। ওর মেয়ের নাম দিয়েছে দানিন। মায়ের মত সুন্দরী হয়েছে দানিন। এই পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল। শোনা গেল রাস্তাটা হাইওয়ে হবে। রাস্তার ধারের গাছগুলো ছাড়া সবাই খুব চিন্তায় পড়ল। কারুর দোকান, কারুর বাড়ি সবই ভাঙা পড়বে। ঘন ঘন মিটিং হল। সবাই মিলে গেল নেতার বাড়িতে। নেতা বললেন, ‘উন্নয়নে বাঁধা দেওয়া যায়? এই রাস্তাটা কত চওড়া হবে, কত গাড়ি যাবে, কত কোটি টাকা খরচ হবে জানো?পাশের জমিগুলো সোনা হয়ে গেল। দশ লাখ টাকা কাটা হয়ে যাবে’। ব্যাস, সবাইয়ের কী আনন্দ! দুদশজন মুরশীদুলের মত হাভাতে লোক তাকিয়ে দেখল উন্নয়নের খুশি ইতিমধ্যেই সবাইকে ছুঁয়েছে। একটা গরম হাওয়া মুরশীদুলের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিল। মুরশীদুলের দোকানটাও রাস্তার ধারের গাছের মত অপেক্ষা করতে লাগল ওর মৃত্যুর জন্যে।

একমাসের মধ্যেই বড় বড় দাঁত বের করা আর্থমুভার, গোঁয়ারমার্কা বুলডোজার এসে রাস্তা চওড়া করতে লাগল। গাছগুলো কাটা হল। প্রথমে ডালপালা, তারপরে গুঁড়ি। ওদের চিৎকার কেউ শুনতে পেল না। শুধু অনেকটা ছায়া পথ ছেড়ে দিয়ে রৌদ্রের আকাশে চিরকালের মত মিলিয়ে গেল। মুরশীদুল ওর দোকান থেকে সব জিনিস বাড়িতে নিয়ে এসেছে দুদিন হল। কিন্তু বারো চোদ্দো বছর না চলে চলে দোকানটার চলার শক্তি আর নেই। চাকাগুলো মাটির ভেতর নিজেদের কবর দিয়ে দিয়েছে। মুরশিদুল ভাঙতে আরাম্ভ করল ওর দোকান। একটা দয়ালু আর্থমুভার ওকে সাহায্য করল। দোকানটাকে মুঠোয় তুলে পাশের ক্ষেতে ফেলে দিল।

(৩)

মুরশীদ বাবার দোকানের টুকরোগুলো বয়ে নিয়ে আনতে আনতে একটু যেন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে। চারপাশটায় থিকহিক করছে লোক। অথচ মনে হচ্ছে মরুভূমি। মানুষ নেই। শুধু ধুলো উড়ছে। দোকানটা টুকরো করে দিল যে মাটিকাটা মেশিনটা তার মতনই সবাই। কারুর চোখে জল নেই, সবাই ভাঙছে, খাবলাচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে নিজের দিকে। এদিকে ওর বাবার কোমর যেন ভেঙে গেছে। আমিরা বলছে,’তোমরা বাড়িতে বসে থাকলে আমরা খাবো কী?’ মুরশীদও তাই ভাবছে। মুরশীদুল দরজার বাইরে বসে বিড়ির ধোঁওয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবছে। ভাবছে তো ভাবছেই। রাস্তা চওড়া করতে কত লোক কাজ করছে, এই সময় দোকানটা থাকলে চা, বিস্কুট, পাঁউরুটি, ঘুঘনি কত কি বিক্রি করা যেত। দোকানের পুঁজিটাও শেষ করে ফেলছে মুরশীদুল।

-চল , বড় রাস্তায় চল। ওদের বলি। কিছু কাজ পাবো। মুরশীদুল ছেলেকে বলে।ছেলে অবাধ্য নয়। মুরশীদ চলল বাবার সঙ্গে। সবাইকে বলতে থাকে, ‘লোক লাগবে না? এত কাজ! আমাদের বাপ বেটাকে একটা কাজ দাওনাগো!’

সবাই বলছে, ‘ বাগচী বাবুকে বল’

-কে বাগচী বাবু ?

-আসবে, বাইকে করে আসবে। বসে থাকো।

মুরশীদুল আর মুরশীদ বসেই থেকেছে। সেই দুপুর পেরিয়ে ধুলো উড়িয়ে বাগচীবাবু এল।বাইক থেকে নামলই না । মুরশীদ দৌড়ে গেছে।

-আপনি বাগচীবাবু? মুরশীদ ওর বাইকের সামনে দুহাত জোর করেছে।

-হ্যা, কী হয়েছে। বাগচীবাবু কালো চশমার ভেতর দিয়ে ওকে মাপে। কালো চশমার ভেতর দিয়ে লোককে ভালো করে মাপা যায়। ছেলেটার পেছনে একটা আধবুড়ো লোক দাঁড়িয়ে আছে। ভিখিরি ভিখিরি দেখতে।

- বাবু কাজ দেবেন আমাদের? যে কোনো কাজ। আমরা বাবা ছেলে দুজনে আছি। মুরশীদ বলে।

- কোনো কাজ নেই ভাই, কোনো কাজ নেই। মাথা খারাপ করে দিও না। সব মেশিনে কাজ করছে। সময় নষ্ট কোরো না। যাও যাও, এখান থেকে যাও।

নিজের ছেলের জন্যে মুরশীদুলের হটাৎ কষ্ট হয়। বলে, ‘চলে আয়, মুর চলে আয়’। 

সারাদিন বাদে ওরা ফিরে এসেছে। মুরশীদুল এক বোতল জল ঢক ঢক করে খেয়েছে। দেখাদেখি মুরশীদও। খানিকটা খাবার আমিরা ওদের সবার জন্যে রেখে দিয়েছে। মুরশীদের খিদে কমে গিয়েছে। আমিরা তবু সবাইকে জোর করে খাওয়ায়। অনেক রাত্রি অবধি ওরা কথা বলে! কী করবে ওরা! ওরাতো কিছুই জানে না। কাঠের কাজ, কলের কাজ সবই তো শিখতে হয়। রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগারে হলে খারাপ কী হয়? ওর জন্যে কাজ শিখতে হয় নাকি? বিশু মিস্ত্রির কাছে কাল সকালবেলাই যেতে হবে। অনেক রাত্রি হলেও খানিকটা আশা ওদের ঘুম পারিয়ে দেয়।

                                

(৪)

বিশু মিস্ত্রির সঙ্গে মুরশীদ কাজ করতে আসছে আজ পাঁচ ছ দিন। হাসপাতালের হোস্টেলে কাজ হচ্ছে।বিশুর কম পয়সার লেবার মুরশীদ।মুরশীদ কিছুই জানে না। ইঁট, সিমেন্ট, স্টোন চিপ বইতে পারে। হোস্টেলের তিনতলার ছাদে মাটি থেকে এগুলো টেনে নিয়ে যাচ্ছে মুরশীদ, অজয়, রামবলি আর গোলাম। অজয় , রামবলি, গোলাম তিনজনেই অনেকদিনের পুরোন লেবার। ওদের দেখে দেখে কাজ শিখছে মুরশীদ। বিশু বড় মিস্ত্রি। ওর সাথে রয়েছে আরো দুজন মিস্ত্রি, লক্ষন আর কমল। হাসপাতালের তিনতলার ওপরে একটা হলঘর তৈরি হচ্ছে। হয়ত ওটা একটা ক্যান্টিন হবে। সিঁড়ি দিয়ে যাবতীয় জিনিস ওপরে উঠছে। হোস্টেলের ছেলেরা ভীষণ বিরক্ত। নোংরা হচ্ছে সারা পথ। প্রতিদিন কাজ শেষ হলে মুরশীদের দায়িত্ব থাকে সিঁড়ি পরিষ্কারের। সিঁড়ি দিয়ে যেতে আসতে শুধু মাঝে মাঝে মুরশীদের চোখ ঘরগুলোর মধ্যে চলে যায়। এরাই সব ডাক্তার হবে। কত জানে এরা। কেমন একটা ভয় ভয় চোখে মুরশীদ তাকায় ওদের দিকে। ওরা চিৎকার করে, হাসে, কানে ফোন নিয়ে ইংরাজীতে কথা বলে। সবটাই অন্যরকম। সিনেমার মত। সাদা সাদা অ্যাপ্রোন পরে, কাঁধে স্টেথো নিয়ে যখন হবু ডাক্তাররা ঘোরে তখন মুরশীদ খুব সাবধানে ওপর নিচ করে। ওদের ঘরে কখন কখন মেয়েরাও ঢোকে। মাটি থেকে চারতলা অবধি বাঁশের ভারা করতে করতে ও আজ দেখেছে একটা সুন্দর ছেলে একটা সুন্দর মেয়েকে চুমু খাচ্ছে। ঠিক সিনেমার মত। ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল দেখে। ও যে ইচ্ছে করে দেখেনি, অকস্মাতই দেখে ফেলেছে এটা ও বোঝাবে কেমন করে! আমিরাকে ও ওদের কথা বলে। যেন একটা মনখারাপ মিশে থাকে মুরশীদের কথায়। অনেক স্বপ্ন, অনেক না পাওয়া ও যেন আবিস্কার করেছে। আমিরা বলে দানিনকে ও পড়াশুনা শেখাবে। স্কুলে পড়াবে। আজকের ঘটনাটাও আমিরাকে বলছিল মুরশীদ। ঠিক সেই সময় দরজায় শব্দ হল।

-কে? মুরশীদুল বলে। ঘরটাকে মাঝখানে বেড়া দিয়ে আধখানা করেছে মুরশীদুল। নাহলে নিজেরই লজ্জায় পড়তে হবে।

- আমি গোলাম।

মুরশীদ তাড়াতাড়ি ওঠে। বিশু পাঠিয়েছে গোলামকে।

-কি হয়েছে? মুরশীদ দরজাটা খুলে প্রশ্ন করে।

- চল একবার হোস্টেলে যাব। বিশুদার টাকার ব্যাগটা ছাদে ফেলে এসেছে। চার হাজার টাকা আছে। সকাল সকাল কেউ ঝেড়ে দিলেই গেল।

- এখন কটা বাজে? যাবো কি করে? মুরশীদ বলে।

- বাইক নিয়ে এসেছি বিশুদার। চল।

-চল। মুরশীদ জামা গায়ে দেয়।

বাইকে স্টার্ট দেয় গোলাম। আধঘণ্টাতেই হাসপাতালে পৌঁছে যায় ওরা। হোস্টেলের দরজা খোলা। ছোট একটা টর্চ দিয়ে দিয়েছে গোলাম। গোলাম বলেছে, ‘আমি ওপরে যাব না। বাইকটা বন্ধ করলে আবার স্টার্ট নিতে পারবে না। সোজা চারতলায় উঠে দক্ষিণদিকে যেখানে ঢালাই-এর কাঠ জড়ো করা আছে, তার ওপরেই দেখবি একটা কালো ব্যাগ। মুরশীদ ভয়ে ভয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ দরজাই খোলা। হবু ডাক্তাররা পড়াশুনা করছে। এখন ওদের সন্ধে। তিনতলার ছাদে উঠে চমকে যায় মুরশীদ।একটা আলো ঘিরে ন দশজন গোল হয়ে বসে আছে। ওই আলোতেই দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো গ্লাস, বোতল। ওরা নেশা করছে। ওদের দিকে আর তাকায় না মুরশীদ। নিজেকে একটু আড়াল করে নির্দিষ্ট জায়গার দিকে গিয়ে টর্চটা জ্বালায়। হ্যা, ব্যাগটা আছে। হটাৎ মাথায় জোরে একটা আঘাত পায়। তারপর আবার, তারপর আবার। হইচই হতে থাকে। চোর চোর চিৎকার করতে থাকে সবাই। মুরশীদ যন্ত্রনায় চিৎকার করে। ওর মাথায় একজন ইঁট দিয়ে আঘাত করে। আস্তে আস্তে ওর চোখে অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে যায়। ছাদের মাঝখানের আলোটা ঝাপসা হতে থাকে। ছাদের মাঝখানে একটা মিথ্যে আকাশ যেন ভেঙে পড়ে। দেহটাকে সবাই মিলে তুলে ধরে। ছাদ থেকে একটা গম্ভীর শব্দ করে মুরশীদের দেহটা মাটিতে আছড়ে পড়ে। মুরশীদের চোখ বন্ধ হয়ে যায়।

(৫)

-অত রাত্রে কী করতে গিয়েছল ওখানে?

-চুরি করতে যায় নি, ও চোর নয়। আমিরা চোখের জলটা ডানহাতে মোছে। বাঁহাতে ও দানিনকে ধরে আছে। ছোট্ট দানিন তার কচি কচি হাত দিয়ে মায়ের বুকটা খুঁজছে।

-কিছু করতেতো গিয়েছিল । রাত সাড়ে দশটায় হোস্টেলের ছাদে গেল কেন?নেতা বললেন।

নেতা মানে আমাদের অতি পরিচিত নেতা, বিশিষ্ট সমাজসেবী, আপনাদের রাজনৈতিক অভিভাবক ঘনশ্যাম যাদব। আমিরাকে ভালো করে দেখলেন। মেয়েটা দেখতে বেশ ভালো। কেঁদে কেঁদে চোখটা লাল। তাই আরো সুন্দর লাগছে।রোগা রোগা, ফরসা। যাদব স্যারের ডানদিকে, বাঁদিকে অনেকলোক। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে।

-ওকে গোলাম বলে একটা ছেলে...মুরশীদুল বলার চেষ্টা করে। যাদব স্যার বাঁহাতটা উঁচু করে মুরশীদুলকে থামিয়ে দেন।

-সেদিনও শুনেছি গোলাম বাইক নিয়ে এসেছিল। ওই নামের কোনো ছেলে বিশুর সাথে কাজ করে না। আর বিশুর কোনো টাকার ব্যাগ ছাদের ওপর ছিল না। তাছাড়া বিশুর কোনো বাইকও নেই। ওসব গল্প। ওসব ছেড়ে দাও মুরশীদুল। তোমার ছেলে আমাদের দলের ছেলে।আমাদের খুব কষ্ট হয়েছে- খুব। কিন্তু হোস্টেল থেকে নটা ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। আর দুমাস বাদে ওদের পরীক্ষা। ওদের প্রত্যেকের বাবা সবাই এখানে এসেছে। আমার কাছে এখন প্রশ্ন তোমরা কী করে খাবে, কীভাবে বাঁচবে? তোমার বৌমা আমিরা কী করে মানুষ করবে বাচ্ছাটাকে? এটাই তো? সবাইকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন যাদব স্যার। সবাই সরব হয়ে সমর্থন করে যাদব স্যারকে।

আমিরার দিকে তাকান যাদব স্যার।

-আমিরা, মুরশীদ মারা গেছে। কেউ ওকে মেরে ফেলে নি। চারতলার ভারা থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। খুব দুঃখের। তুমি এত অল্প বয়েসে....একটু থামলেন যাদব। পকেট থেকে একটা সাদা ধবধবে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন কিংবা মুখের ঘাম ...তুমি চিন্তা কোরো না। শুধু তুমি বলবে ও উঁচুভারা থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছে। কেউ ওকে মেরে ফেলেনি।

-কিন্তু ও ফিরে এসেছিল কাজ থেকে।

-আবার গিয়েছিল তো। যাদব স্যারের গলার স্বর একটু রুক্ষ হল। আবার বললেন, ‘যাদের অকারনে পুলিশ ধরে রেখেছে তাদের কথা একটু শোনো।’

একজন ফরসা লোক চেয়ার টেনে আমিরার কাছে এগিয়ে এল।

-আমার ছেলে বিভাস। ও ডাক্তারি পড়ছে। ওর বন্ধুরাও। কিচ্ছু জানেনা ওরা। আমরা বুঝতে পারছি তোমার, তোমার বাবার ,সবার কষ্টটা। আমরা সবাই মিলে তোমাদের দেখব। সেদিন ওরা হোস্টেলে ছিল না। নাইট শোতে সিনেমায় গিয়েছিল। সেই সিনেমার টিকিটও ওদের কাছে আছে।

-আঃ আসল কথাটা বলুন না। যাদব স্যার বিরক্ত হলেন।

আমিরা তাকিয়ে আছে যাদব স্যারের দিকে। আসল কথাটা ও-ও বুঝতে চাইছে।

-এরা সবাই মিলে তোমায় মিলে তোমায় ন লাখ টাকা দেবে, যার ইন্টারেস্টে মানে সুদে তোমার চলে যাবে। যাদব স্যার শান্ত গলায় বললেন ।

- না না, সবাই মিলে নাহয় দশ লাখই দেব। বিভাসের বাবা বলেন। আমিরার মেয়ে দানিন কেঁদে ওঠে। কিছুতেই ও ওর মায়ের বুকটা পাচ্ছে না। আমিরা তাকায় ওর বাবার দিকে তারপর শ্বশুরের দিকে। ওর বাবা নুরউদ্দিন কেঁদেই চলেছে। মুরশীদুল নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে আর বিড়বিড় করে, ’আমাদের ক্ষমা করিস মুর’। মাথা নাড়ায় আমিরা। ঠিক আছে। ভারা থেকেই পড়ে গেছে মুরশীদ।

                            (৬)

তারপর কী হয়েছে তাতো আপনারা জানেন। আমিরা ভালো আছে। রেল লাইনের ধার থেকে মুরশীদুল, আমিরা, দানিন স্থানান্তরিত হয়েছে। সরকারি আবাস যোজনায় জায়গা পেয়েছে। মুরশীদুল বড় রাস্তার ধারে একটা চাকালাগানো চায়ের দোকান করেছে। শুধু মুরশীদ নেই। তবে তার জন্যে কারুর কোনো অসুবিধা হয় না। আমারও না। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational