দীনময়ীর রান্নাঘর
দীনময়ীর রান্নাঘর
" সংসারের এতো বিপদ ! যদি কিছু করতে পারতাম ! "
" তুমি কি করবে দীনু ! মেয়েরা ঘরের কাজ করতে পারো কিন্তু রোজগার করতে পারো না । সব কষ্ট ছেলেদের ! বাইরের জগতের সঙ্গে লড়াই করে রোজগার করতে হয়। এখন কিভাবে পরিবারের আটজন লোকের খাবার জোগাড় করব ভেবে কুল পাচ্ছি না । "
" ঠিক বলেছ আমাদের তো ঘরের ভিতরেই কাজ । তবে তুমি চিন্তা করো না গো ! ভগবান ঠিক কোন উপায় বের করবেন । আমরা না খেয়ে মরব না। "
" কি উপায় বের হবে ! দোকান ভিটে পড়ে আছে কিন্তু ওখানে কি করে দোকান হবে বুঝতে পারছি না । কোন কাজ ও পাচ্ছি না । বাবার মুখের দিকে তাকানো যায় না। রাতে আমার ঘুম আসে না দীনু । বিপদ যখন আসে সবদিক দিয়েই আসে ! "
" আমিও খুব ভাবছি কিভাবে আমরা বাঁচব ।"
" তুমি কি করবে যা করার আমাকেই করতে হবে ।"
উত্তর কলকাতার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ দীনময়ী । যাকে সবাই দীনু বলে ডাকে । দীনময়ী মেদিনীপুরের পলাশপুর গ্রামের গরীব পরিবারের মেয়ে । ওখানে প্রাইমারী স্কুল অবধি পড়েছে সে । এরপর অভাবের কারণে আর পড়া হয়নি । কিন্তু দীনময়ী দেখতে বেশ সুন্দরী আর সবচেয়ে বড় কথা হল ও খুব সুন্দর গুছিয়ে ঘরের কাজ করতে পারে । ওর রান্নার হাত চমৎকার। ওর মা, ঠাকুমা দুজনেই খুব ভালো রান্না করতেন । ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে দীনময়ী অল্প বয়সেই রান্নায় বেশ পটু হয়ে গিয়েছিল । তাছাড়া ওর নানা ধরনের পিঠে পুলি বানাতে ওর খুব ভালো লাগে । সবাইকে খাওয়াতেও খুব ভালোবাসে । কিন্তু গরীব পরিবারের মেয়ে হাতের কাছে সবসময় সব জিনিস পায় না তাই মনের মতো রান্না করতে পারে না । কিন্তু সামান্য কিছু দিয়েই অনেক ভালো রান্না করতে পারে দীনময়ী।
পরিতোষ কুন্ডু দীনময়ীর বাবা দয়াময় হাজরার ছেলেবেলার বন্ধু । পরিতোষবাবুর মূল বাড়ি পলাশপুরে । পরে উনারা কলকাতায় চলে আসেন।
পরিতোষবাবু একদিন কোন কাজে পলাশপুরে গিয়েছিলেন । কাজ শেষ হলে পুরানো বন্ধুর বাড়িতে গেছেন দেখা করতে ।গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেছে । দয়াময়বাবু বন্ধুকে ছাড়লেন না রাতে ।
দীনময়ীর মা সেদিন বাড়ি ছিলেন না । ঠাকুমার শরীরটা ভালো নেই । দীনময়ী পুকুর থেকে ভাইকে নিয়ে বিকেলবেলা মাছ ধরেছে । রাতে চুনোপুঁটি দিয়ে পাতুরি আরও কয়েকপদ রান্না করেছে । খুব যত্ন করে পরিবেশন করেছে পরিতোষ কাকুকে ।
খাওয়ার পর দুই বন্ধু উঠোনে এসে বসলেন। গরমকাল বেশ ফুরফুরে বাতাস বইছে । পরিতোষ বাবু গল্প করতে করতে হঠাৎ বলে উঠলেন " দীনুকে তুই আমায় দিয়ে দে দয়াময়।"
"তোর বাড়িতে বেড়াতে যাবে ! বেশ তো নিয়ে যা । দীনুর কলকাতা শহর দেখা হয়ে যাবে ।"
" সে যেতেই পারে । কিন্তু তুই কি ওর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছিস না।মেয়েটার বয়স কত হলো।"
" পনেরো । কিন্তু ভালো পাত্র না পেলে বিয়ে দিই কি করে । তোর কাছে কোন পাত্র আছে ! "
" আছে । সেইজন্যই তো বললাম আমার বড় ছেলে প্রবীরের সঙ্গে দীনু মায়ের বিয়ে দিতে চাই। যদি তোর কোন আপত্তি না থাকে ।"
দীনময়ীর ঠাকুমা গিরিবালাদেবী ঘর থেকে কথাগুলো শুনে বেরিয়ে এলেন । দয়াময় বাবু কিছু বলার আগেই বললেন, " আপত্তি থাকবে কেন রে পরিতোষ ! কিন্তু আমরা গরীব মানুষ বিয়েতে কিছু দিতে পারব না বাবা । তুই তো সব জানিস।"
" কিছু লাগবে না কাকিমা । আমার ছেলে কারখানায় চাকরি করে । আমার বাড়ির সামনে একটা মুদির দোকান আছে । আপনাদের আশীর্বাদে ভালোই চলছে ।শুধু ঘরে একজন লক্ষ্মীমন্ত বৌমা চাই।"
" কিন্তু তোর বাড়ির লোকেরা কি এই বিয়েতে রাজি হবে ।"
" আমার বাড়িতে আমার কথাই শেষ কথা ।"
" তাহলে আমি ও নাতনির বিয়ের পাকা কথা দিলাম ।"
এরপর কোন যৌতুক ছাড়া দীনময়ীর বিয়ে হয়ে গেল । দীনময়ী কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে চলে এল।
( দুই)
সত্যি দীনময়ীর বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সবার প্রিয় হয়ে উঠল। শান্তশিষ্ট স্বভাবের দীনময়ী সবার মন জুগিয়ে চলে । সবচেয়ে বড় কথা হলAdvertisementওর হাতের রান্না খেয়ে পরিবারের সবাই এমনকি আত্মীয় স্বজনেরা খুব খুশি । পরিবারে ওর দুই দেবর , ননদ, শ্বশুর -শাশুড়ি, দিদি শাশুড়ি আছেন। এরপর দীনময়ী এক সন্তানের মা হল। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেছে । দীনময়ী পাকা গিন্নি হয়ে গেছে । খুব দক্ষতার সঙ্গে সব দিক সামলাচ্ছে। ওর শাশুড়ি প্রতিমাদেবী দীনময়ীর উপর সংসারের ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত । পরিতোষ বাবু গর্ব করে বলেন, " ভাগ্যিস পলাশপুরের মেয়েকে প্রবীরের বউ করে এনেছিলান নইলে এমন মেয়ে কি কলকাতায় পেতে মা।"
"ঠিক বলেছিস্ পরি । নাতবৌ আমার লাখে একজন ।"
কিন্তু হঠাৎ দীনময়ীর সংসারে দুর্যোগ নেমে এল। এক শীতের রাতে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় পরিতোষবাবুর দোকান । এর মধ্যে প্রবীর যে কারখানায় কাজ করত সেটা ও বন্ধ হয়ে যায় । একমাস আগে দীনময়ীর ননদের বিয়ে হয়েছে সুতরাং ওদের হাতে একদম টাকা নেই ।
সবাই মিলে খেতে বসেছে । শুধু ডাল আর ধনেপাতা বড়া রেঁধেছে আজ দীনময়ী। ক্ষিদের জ্বালায় সবাই তাই খাচ্ছে। কিন্তু পরিতোষবাবু , প্রবীর দুজনেই ভাতের উপর হাত নাড়ছেন ।
দীনময়ীর এসব দেখে চোখে জল এসে গেল। আস্তে আস্তে বলল ," কোন রকমে খেয়ে নিন বাবা । না খেলে শরীর খারাপ করবে যে !"
"ভেবে পাচ্ছি না রে মা কি করব ।"
দীনময়ী একটু চুপ করে থেকে বলল, " বাবা আপনার যে ভিটে আছে ওখানে যদি একটা হোটেল খুলি।"
" কি বলছিস মা ! সেটা কি করে সম্ভব ! "
" আমাদের বাড়ির সামনে একটা ব্যাঙ্ক হয়েছে সেটা আমরা সবাই জানি । কিন্তু এখানে খাবারের কোন ব্যবস্থা নেই । সেজন্য ওদের খুব কষ্ট হয় । ওখানে বেশ কিছু কর্মী আছেন আমরা যদি ওদের খাবারের ব্যবস্থা করি ! "
" কি বলছ এসব ! হোটেলের ব্যবসা আমরা কখনও করিনি । তাছাড়া টাকা কোথায় পাব।"- প্রবীর বলল ।
" দাঁড়া প্রবীর বৌমা কথাটা মন্দ বলেনি ! কিন্তু দীনু মা হোটেলের রান্না কে করবে ! লোক রাখার ক্ষমতা আমাদের নেই ।"
"আমি সব রান্না করে দেব । আমার, মায়ের যা গয়না আছে তা বিক্রি করে সেই টাকায় হোটেল ব্যবসা শুরু করে দেখি না আমরা ।"
"কথাটা নাতবৌ মন্দ বলেনি । ওর রান্নার হাত খুব ভালো । ঘরে বসে রান্না করে দেবে আর তোরা সবাই মিলে পরিবেশন করবি।"
"আমি বলেছিলাম না দীনু মা আমার ঘরের লক্ষ্মী । দেখলে কি করে সমস্যার সমাধান করে দিল। এমন কথা আমাদের মাথাতেও আসেনি।"
" আমি বৌমাকে রান্নাবান্নায় সাহায্য করব ।- প্রতিমা দেবী বললেন ।
দীনময়ীর কথায় সবাই যেন শক্তি পেল। ওদের যা সামান্য গয়না ছিল সেগুলো বিক্রি করে হোটেল ব্যবসা শুরু হল।
প্রথম দিনের রান্না খেয়েই ব্যাঙ্ক কর্মীরা খুব খুশী। খুব অল্প সময়েই এই হোটেলের রান্নার প্রশংসা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল । আস্তে আস্তে হোটেলের ভিড় বাড়তে লাগল । প্রবীর, পরিতোষবাবু , উনার ছোট দুই ছেলে সবাই হোটেলে কাজ করতে লাগল ।
প্রায় একবছর কেটে যায় । পরিতোষবাবুর সংসারের অভাব দূর হয়েছে । ব্যবসা খুব ভালো চলছে । ব্যাঙ্ক ম্যানেজার অভিরূপ সরকার একদিন পরিতোষবাবুকে বললেন, "আপনার হোটেলের রান্না চমৎকার। মনে হয় যেন মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি। এই রান্নার গুণেই হোটেল এতো ভালো চলছে । একটা সুন্দর নাম দিন না হোটেলের ।"
" এই হোটেল শুরু হয়েছে আমার বৌমা দীনময়ীর কথাতেই । আর এতো রান্না রোজ বৌমাই করে । কি নাম দেব ভেবে পাচ্ছি না ।"
" বেশ তো তাহলে হোটেলের নাম 'দীনময়ীর রান্নাঘর ' দিন না। এই গৃহবধূদের সবাই অবহেলার চোখে দেখে । কিন্তু ভালো রান্না করা এটাও একটা প্রতিভা। সবার মধ্যেই কোন না কোন প্রতিভা আছে । কিন্তু সবাই তা কাজে লাগাতে পারে না । আপনার বৌমা তা কাজে লাগিয়েছে ।"
"ঠিক বলেছেন । 'দীনময়ীর রান্নাঘর' চমৎকার নাম । এটাই থাক হোটেলের নাম ।
' দীনময়ীর রান্নাঘর ' আস্তে আস্তে খুব উন্নতি করতে থাকে । কলকাতায় ওদের এখন পাঁচটা হোটেল আছে । আর সব হোটেলে শুধু বাঙালি রান্না হয়। পৌষ মাসে পিঠেপুলির সময় নানা ধরনের পিঠেপুলি তৈরী হয় এইসব হোটেলে ।এখন অবশ্য অন্য রাঁধুনিরা রান্না করে । কিন্তু সবকিছু হয় দীনময়ীর রেসিপি অনুয়াযী । কর্মব্যস্ত বাঙালি দম্পতিদের মনের মতো খাবারের একমাত্র ভরসা 'দীনময়ীর রান্নাঘর'।
দীনময়ীদেবীর বয়স এখন সত্তর বছর । তাঁর পরিবার এখন কোটিপতি। স্বামী, ছেলে , বউমা, নাতি, নাতনিকে নিয়ে তার ভরা সংসার । প্রতি বছর অনাথ আশ্রম , বৃদ্ধাশ্রমে অনেক টাকা দান করেন কুন্ড পরিবার।