The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW
The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW

Sanghamitra Roy

Tragedy Fantasy Others

4.3  

Sanghamitra Roy

Tragedy Fantasy Others

সেও ছিল বীরাঙ্গনা

সেও ছিল বীরাঙ্গনা

13 mins
487



             ( এক)


  শীতের গভীর রাত ! কুয়াশায় ঢাকা লোহিতের চারপাশ জনমানবশূন্য । শুধু একটি নৌকায় বসে আছে দুজন । একজন ধীরে ধীরে নৌকা থেকে নেমে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের বিশাল খেজুরির মাঠের দিকে । 

  এই খেজুরির মাঠ কত ঘটনার নীরব সাক্ষী । এর আগেও কত নিরীহ প্রজাকে সামান্য কারণে এখানে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে । বালক রাজার কাউকে শাস্তি প্রদানের এটাই শ্রেষ্ঠ জায়গা !   আজ দশদিন থেকে খেজুরির মাঠে পালা করে আহোম রাজ্যের প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছে এক বন্দী নারীকে ! এই নারীর উপর সারাদিন চাবুকের আঘাত করা হচ্ছে কোন গোপন সংবাদ পাওয়ার জন্য । সারাদিনে একবার সামান্য কিছু খাবার দেওয়া হয় তাঁকে । কোন দিন কিছু দেওয়া হয় না । কিন্তু এত কিছুর পরও তার মুখ থেকে কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি । রাতে যারা পাহারায় আছে তাদের একটু ও চোখ বুঝার উপায় নেই। বালক রাজা জানতে পারলে গর্দান দেবে !


  একজন এসে ওদের গরম পানীয় দেয় যাতে ওদের কোন ভাবে ঘুম না আসে । কিন্তু একি ! এই পানীয় খাওয়ার পর ওদের চোখে যেন ঘুম নেমে আসছে । অনেক চেষ্টা করছে ওরা চোখ খোলা রাখতে ।

   ধীরে ধীরে এক ছদ্মবেশী এগিয়ে যায় বন্দী নারীর দিকে । একটু আগে ছদ্মবেশী খুব সাবধানে পানীয়ের সাথে নেশা জাতীয় কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল । যার ফলে ওদের চোখে ঘুম নেমে এসেছে ।


   পৌষ মাসের রাতে নারীকে বেঁধে রাখা হয়েছে একটা বড় গাছের সঙ্গে । সারা শরীরে তার চাবুকের আঘাত । নারীর চোখ বন্ধ, ঘাড় একদিকে ঝুঁকে আছে । এই শীতের রাতে ও তার শরীরে হালকা কাপড় । ঠক ঠককরে কাঁপছে । বন্দী নারীর নাম যশোমতী ।


   ছদ্মবেশী গিয়ে যশোমতীর পাশে দাঁড়াল ।একটা চাদর তাঁর গায়ে জড়িয়ে ঠোঁটের কাছে একফোঁটা জল ফেলতেই কোন রকমে চোখ খুলল সে । তাঁকে চারপাশের মৃদু আলোতে চিনতে পেরে অস্ফুটস্বরে কোন রকমে বলল, "যেখানের মানুষ সেখানেই চলে যাও ।"  "না আমি যাব না ! তুমি আমার সঙ্গে চলো।"  " যাও এখান থেকে ।"     এই কথাগুলো পৌছে গেল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধ ঘুমন্ত প্রহরীর কানে । সঙ্গে সঙ্গে ঘুম উড়ে গেল তার ।জোরে জোরে বলতে লাগল, " সর্বনাশ ! কেউ এসেছে এখানে ! কি পাহারা দিচ্ছ । বন্দী করো ! বন্দী করো একে ! কিছুতেই যেন পালাতে না পারে !"


  প্রহরীদের ঘুম মুহূর্তেই উবে গেল । তরবারি নিয়ে এগিয়ে গেল ছদ্মবেশীর দিকে । ছদ্মবেশীও তাঁর তরবারি বের করে অতি সাবধানে প্রহরীদের বাঁধা দিল । যাতে তার শরীরে কোন আঘাত না লাগে । তারপর খুব সাবধানে দৌড়ে পালিয়ে গেল লোহিতপারে রাখা নৌকার দিকে । প্রহরীরা তাঁর উপর তীর নিক্ষেপ করতে থাকে কিন্তু কোন তীর তাকে ছুঁতে পারেনি ।


  খরস্রোতা লোহিতের চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা। তুখোড় মাঝি হলধর মুহূর্তেই নৌকা চালিয়ে সরে যায় প্রহরীদের সীমানা থেকে ।তারপর ধীরে ধীরে পৌছে যায় বিশাল লোহিতের অন্য পাড়ে ।


  তখন ভোরের আলো ফুটেছে । সামনের পাহাড়টায় আদিবাসী লোকেরা নাচ গানে মত্ত। অস্থির মল্লপানি হলধরকে নিয়ে ওখানে যায় ।ছদ্মবেশী মল্লপানিকে কেউ চিনতে পারেনি ।সুরায় মত্ত আদিবাসীদের একজন এসে বাঁশের চোঙায় সুরা এগিয়ে দেয় মল্লপানির দিকে ।এর আগে এ ধরণের সুরা কখনও পান করেনি আহোম রাজ্যের রাজকুমার মল্লপানি । কিন্তু এখন মুহূর্তেই সুরাটুক শেষ করে ফেলল। মনে হচ্ছে একটু ঠান্ডা কমেছে ! 


  মল্লপানি চোঙা হাতে এগিয়ে যায় সামনে রাখা সুরার হাঁড়ির দিকে । হাঁড়ির দিকে তাকাতেই সে দেখতে পায় যশোমতী তার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হেসে বলছে ," তুমি নিজেকে আর আমার সন্তানদের রক্ষা করো রাজকুমার! এই আহোম রাজ্যে তোমাকে প্রয়োজন । আহোম রাজ্যের অরাজকতা, ভয়াবহতা হতে প্রজাদের তোমাকেই রক্ষা করতে হবে রাজকুমার । আমার জন্য চিন্তা করো না । আমি নিজেকে রক্ষা করব । আমাদের আবার দেখা হবে ।কারণ আমরা সাত জনমের সাথী ।"

  মল্লপানি হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে ।তাঁর দুচোখ জল পড়তে আরম্ভ করে । বলতে থাকে, " অবশ্যই যশোমতী আহোম রাজ্যকে আমি বালক রাজার অত্যাচার থেকে মুক্ত করবই।তোমাকে কথা দিলাম ।"

  মল্লপানি আর কিছু বলার আগেই হলধর এগিয়ে এল। ধীরে ধীরে বলল, " কি বলছেন রাজকুমার । চারপাশে হয়তো কত গুপ্তচর ঘুরছে । যদি কেউ আপনাকে চিনে ফেলে তাহলে আঘাত করতে ছাড়বে না । চলুন এখান থেকে ।"

  হলধর মল্লপানিকে টানতে টানতে নিয়ে যায় নৌকার কাছে । দুজনে নৌকায় বসে ।

  তখন সকাল হয়ে গেছে । কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো লোহিতের জলে চিক্ চিক্ করছে । কি সুন্দর সেই অপরূপ দৃশ্য ! কিছু দূরে কয়েকটা নৌকা দেখা যাচ্ছে।   হলধর বলল ," আমাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয় রাজকুমার ! "  " কেন একথা বলছিস হলধর ?"  " কাল রাতে আপনি রাণীমার কাছে গিয়ে চাদর পড়িয়ে এসেছেন একথা তখনই সবাই জেনে গেছে । নইলে আপনাকে আঘাত করার জন্য প্রহরীরা মরিয়া হয়ে উঠত না রাজকুমার। এখন হয়তো বালক রাজা পাগল হয়ে চারপাশে গুপ্তচর পাঠিয়েছে আপনাকে খোঁজার জন্য । আমার মনে হচ্ছে ঔ নৌকাগুলো গুপ্তচরের ।"  মল্লপানি চারপাশে চেয়ে বলল, " ঠিক বলেছিস্ । আমাদের তাড়াতাড়ি নাগাপাহাড়ে পৌছতে হবে । ওখানে আমার সন্তানরা রয়েছে। নইলে আমি যশোমতীর কথা রাখতে পারব না ।"

  "বালক রাজার পতন হবেই রাজকুমার ! ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই মিলে এই প্রার্থনা করব ।"  "তাই করিস তোরা ! এখন তাড়াতাড়ি চল।"

  হলধর তুখোড় ও বিশ্বস্ত মাঝি। তাড়াতাড়ি নৌকা চালিয়ে বাকি নৌকাগুলো থেকে অনেক দূরে চলে যায় ।

             ( দুই)

   আহোম রাজ্যের রাজকুমার মল্লপানির স্ত্রী যশোমতী । দুজনে দুজনকে খুব ভালোবাসে।ওদের চার বছরের জমজ সন্তান আছে ।বড়টির নাম মানসিংহ আর ছোটটির নাম জয়সিংহ । মানসিংহ জয়সিংহ থেকে কিছু সময়ের বড়।

   আহোম রাজ্যের রাজা বজ্রপাণির দুই রানী ছিলেন । বড় রানী দূর্গাবতী খুব ভালো ছিলেন।কিন্তু ছোট রানী ললনাবতী খুব অর্থ ও ক্ষমতা লোভী ছিলেন । সারাক্ষণ দূর্গাবতী ও বাকী সবাইকে কিভাবে দাবিয়ে রাখা যায় সেই চিন্তাতেই থাকতেন।

  ঘটনাচক্রে দুই রানী একসঙ্গে অন্তঃসত্ত্বা হন।প্রসববেদনাও একসঙ্গে শুরু হয় । কিন্তু ললনাবতী দাইকে আগেই বলে রেখেছিলেন, "আমার সন্তানের খবর যেন প্রথমে রাজাকে দেওয়া হয়। নইলে তোর মৃত্যু কেউ আটকাতে পারবে না ।"   "কিন্তু ছোট রানীমা বড় রানীমার সন্তানের জন্ম যদি প্রথম হয়।"  "আতুড় ঘরে তুই আর আমার দাসী ছাড়া কেউ থাকবে না । আমার ছেলের জন্ম পরে হলেও সে যেন বড় রাজকুমার হিসেবে ঘোষিত হয় । এটা তোর দায়িত্ব । কাজটা ঠিক মতো করতে পারলে উপহার পাবি।"  " ঠিক আছে রাণীমা ! আপনি যা বলেছেন তাই হবে ।"



  ষড়যন্ত্রের শুরু সেখান থেকেই ।দূর্গাবতী এসব জানতেন না । কিন্তু প্রথমে দূর্গাবতীর ছেলের জন্ম হয়েছিল তখন দূর্গাবতী অঞ্জান ছিলেন । কিছু সময় পর ললনাবতীর ছেলের জন্ম হয়। কিন্তু দাই আগে ললনাবতীর ছেলের খবর রাজাকে দেওয়ায় তাকেই বড় রাজকুমার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 

   দূর্গাবতীর ছেলের নাম মল্লপানি আর ললনাবতীর ছেলের নাম চক্রপানি রাখা হয় ।দুজনে একসঙ্গে বড় থাকে কিন্তু স্বভাবের দিক থেকে দুজন একেবারে আলাদা । মল্লপানি ধীর, স্থির , শান্ত , দয়ালু স্বভাবের । কারো দুঃখ কষ্ট সে সহ্য করতে পারত না ।


  কিন্তু চক্রপানি ছোট থেকেই খুব নিষ্ঠুর, অত্যাচারী, দাম্ভিক প্রকৃতির ছিল । কারো কষ্ট, যন্ত্রণা দেখলে সে খুব আনন্দ পেত । তার মতে রাজকুমারদের স্বভাব এরকমই হওয়া উচিত। মল্লপানি এরকম নয় বলে সে মল্লপানিকে খুব বিদ্রূপ করে কথা বলত । বলত মল্লপানি নাকি পুরুষই নয়।


   ওদের যখন চৌদ্দ বছর বয়স তখন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বজ্রপাণি। বড় রাজকুমার হিসেবে চৌদ্দ বছর বয়সে সিংহাসনে বসে চক্রপানি । বালক অবস্থায় রাজা হওয়ার জন্য ওকে সবাই 'বালক রাজা ' বলে ডাকত । কিন্তু এরপর থেকেই রাজ্যে শুরু হয় অরাজকতা, নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার ।

  মল্লপানির সঙ্গে যশোমতীর দেখা হয় শিকারে গিয়ে । চক্রপানি প্রায়ই শিকারে যেত । তার মতে যারা পশু শিকার করে না তারা নাকি বীর নয়। সঙ্গে মল্লপানিকে নিয়ে যেত । কিন্তু মল্লপানির পশু শিকার একটুও পছন্দ নয়। শুধু চক্রপানির কথাতেই যেত । এভাবে একদিন চক্রপানি যখন বাঘ শিকারে মত্ত তখন মল্লপানি ঘোড়া নিয়ে আনমনে চলতে চলতে জঙ্গলের বাইরে এক শিবমন্দিরের পাশে পৌছে যায় ।


   তখন মল্লপানির একুশ বছর বয়স । চলতে চলতে সে বেশ ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে ।খাবার দাবার সব চক্রপানির সঙ্গে । মন্দিরটি বেশ উঁচুতে। কিছু দূরে একটা রথ রাখা ।সম্ভবতঃ রাজ পরিবারের কেউ এখানে আছে ।

   একদিকে প্রখর রোদ তার উপর ক্লান্ত মল্লপানি একটা বটগাছের নিচে শুয়ে পড়ে । চোখ লেগে যায় তাঁর ! 


  হঠাৎ একটা মিষ্টি আওয়াজে তার ঘুম ভাঙল । দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা । সূর্যের মতো যার গায়ের রং, চেহারা স্বর্গের দেবীদের মতো , মাথায় মেঘের মতো ঢেউ খেলানো চুল।পিছনে দুজন সহচরী । সুন্দরী তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হেসে কিছু ফল এগিয়ে দিয়ে বলল ," এই নিন এগুলো খান ।মনে হচ্ছে আপনি ক্ষুধার্ত !"


   " আপনি কি করে জানলেন আমি ক্ষুধার্ত ! কে আপনি?"  " ইনি শোনিতপুরের রাজকুমারী যশোমতী ! প্রতি সোমবার এখানে পূজো দিতে আসেন ।ফেরার পথে যাকে পান তাকে ফলাহার করান।"  "মল্লপানি হাত বাড়িয়ে ফলগুলো নিয়ে খেতে খেতে বলল, " রাজকুমারী আপনি এতদূর পূজো দিতে আসেন কেন ? আপনার রাজমহলের আশেপাশে কোন মন্দির নেই !"


  " আমি এক বিশেষ ব্রত পালন করছি এই মন্দিরে এসে । কিন্তু আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমাকে কেউ কোন প্রশ্ন করেনি ! আপনি কে?"  " আমি এক ভিনদেশি যুবক । পথ ভুল করে এখানে এসে পড়েছি ।"  " কিন্তু আপনাকে দেখে , কথা শুনে আর পোষাক দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোন রাজকুমার ।"  "সে রকম কিছু নয় ! ফলগুলো খেয়ে খুব শান্তি পেলাম। আপনি অবশ্যই আপনার মনের মতো কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবেন ।"


 " আপনি কি করে জানলেন আমি মনের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়ার জন্য ব্রত করছি।"  "অবিবাহিত মেয়েরা শিবমন্দিরে এই কারণেই আসে রাজকুমারী । আমি চলি ।ফলগুলো দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ।"

   যশোমতী আর কোন কথা বলতে পারল না। তাঁর কেন যেন মনে হয় এই তাঁর স্বপ্নের পুরুষ ।এর আগে অনেক রাজকুমারকে সে প্রত্যাখান করেছে কারণ ওদের কাউকে তার যোগ্য মনে হয়নি । এরমধ্যে চক্রপানিও একজন ।  মল্লপানি ধীরে ধীরে গিয়ে তার ঘোড়ায় চড়ে। যতদূর দেখা যায় যশোমতী এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে । মল্লপানি ও ঘুরে ঘুরে তাকিয়েছে যশোমতীর দিকে ।


     চক্রপানি এর মধ্যেই দুটো বিয়ে করেছে আরও অনেকের সাথে ওর সম্পর্ক আছে ।কিন্তু মল্লপানির কোথাও পাত্রী পছন্দ হচ্ছিল না । শিকার থেকে এসে সে দূর্গাবতীকে জানায়, "মা শোনিতপুরের রাজকুমারীকে আমার পছন্দ হয়েছে । "  "কি বলছিস বাবা ! এতো খুব খুশির সংবাদ।"  " আমি ওকে বিয়ে করতে চাই ।"  " তাই হবে বাবা । আমরা শোনিতপুর যাবো তোমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ।"


   খুশী হয়ে দূর্গাবতী মল্লপানিকে নিয়ে শোনিতপুরে চলে যান। শোনিতপুরের রাজাকে তার কন্যার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেন ।    যশোমতী আড়াল থেকে মল্লপানিকে দেখেছিল তাই সে এই বিয়েতে অমত করেনি ।তার ধারণাই ঠিক ছিল এ তো রাজকুমার ! শোনিতপুরের রাজা খুব খুশি । এতদিন পর তাঁর মেয়ের কাউকে পছন্দ হল।


   মল্লপানি যশোমতী বিয়ে হয়ে যায় । যশোমতী আহোম রাজ্যে চলে আসে । দুজনের মধ্যে খুব ভালোবাসা । কিছুদিন পর তাদের জমজ সন্তানের জন্ম হয়।


             ( তিন)


  মল্লপানি যশোমতীর বিয়েতে চক্রপানি, ললনাবতী একটু ও খুশী নন। যশোমতী আহোম রাজ্যের রাজাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে সেই রাজ্যের অন্য রাজকুমারকে বিয়ে করে তারই রাজমহল রয়েছে । তার চোখের সামনে ঘোরাফেরা করছে এত সাহস এই রাজকন্যার ! তার উপর আবার জমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছে । একসময় চক্রপানিকে সিংহাসন চ্যুত করে মল্লপানি হয়তো রাজা হবে । অন্যদের নিয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে এরকম চক্রপানির মনে হতে থাকে । কারণ যশোমতী খুব বুদ্ধিমতী ও প্রতিবাদী এটা সে বুঝেছিল।

   আহোম রাজ্যে তখন প্রজাদের উপর খুব অত্যাচার শুরু হয় । সামান্য কারণেই প্রজাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করত চক্রপানি ।ওদের শাস্তি পেতে দেখে তার খুব আনন্দ হত । এছাড়া গরীব প্রজারা পেট ভরে খেতে ও পারত না ।ওদের চাষ করা ফসল, আয়ের এক তৃতীয়াংশ মল্লপানির কোষাগারে চলে যেত ।কেউ কিছু বলার সাহস পেত না ।শুধু যশোমতী, মল্লপানি মাঝে মাঝে এসব ব্যাপারে প্রতিবাদ করত। চক্রপানির ভয়ের এটা ও একটা কারণ ছিল ।সে সামনে যতই বীরত্ব দেখায় মনে মনে কিছু ভীতু ছিল ।

  কেউ কিছু ভাবার আগেই চক্রপানি আর ললনাবতী মিলে এক ভয়ানক চক্রান্ত শুরু করল।এতে চক্রপানির স্ত্রীরাও যুক্ত ছিল ।আহোম রাজ্যের রাজা চক্রপানির পর শুধু তার পুত্র , পৌত্র এরাই হবে । অন্য কেউ নয়।  আহোম রাজ্যের নিয়ম হল কোন বিকলাঙ্গ পুরুষ রাজা হতে পারবে না । চক্রপানি এটাই কাজে লাগাল । যত রাজকুমার আছে তাদের ধরে এনে অঙ্গহানি করতে থাকে । ছোট রাজকুমার এমনকি নবজাতকদের ও ছাড়ল না।

  যশোমতী মল্লপানিকে বলল, " তুমি আমার সন্তানদের নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাও রাজকুমার । তারপর শক্তি সংগ্রহ করে আহোম রাজ্যের এই অরাজকতা, ভয়াবহতা দূর করো । অত্যাচারী চক্রপানির কবল থেকে এই রাজ্যের প্রজাদের বাঁচানোর জন্য তুমি শক্তি সংগ্রহ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি করো ।আমি চাই এই আহোম রাজ্য রাম রাজ্যে পরিণত হোক ।এখানে কারো কোন কষ্ট থাকবে না । "

 " কি বলছ যশোমতী তুমি ! আমি আমার সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাব । ওরা রাজ পরিবারের সন্তান যেখানে সেখানে গিয়ে থাকবে কি করে !

  " এ দেশের অনেক রাজাই পরিস্থিতির চাপে পড়ে বনে জঙ্গলে ও দিন কাটিয়েছেন। স্বয়ং রামচন্দ্র বনে দিন কাটিয়েছিলেন, পান্ডবরাও বনে জঙ্গলে দিন কাটিয়েছেন আর তোমরা এ রাজ্যের মঙ্গলের জন্য কিছু দিন আত্মগোপন করতে পারবে না ।"

  " বেশ আমরা এখান থেকে চলে যাব ! কিন্তু তুমি যাবে না যশোমতী ! এই ছোট শিশুরা মাকে ছাড়া থাকবে কি করে ! আর আমি আমার মাকে ছেড়ে যাব কি করে । আমরা ছাড়া উনার কে আছে !"

  "উনাকে দেখার জন্য আমি রইলাম । উনি যেখানে সেখানে গিয়ে থাকতে পারবেন না ।আর আমার সন্তানদের ভাগ্যে থাকলে মায়ের সঙ্গে আবার দেখা হবে । কতো শিশুদের জন্মের পর মায়ের মৃত্যুর হয় তারাও তো বাঁচে। এরা ও বাঁচবে । আমি এ রাজ্যের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াব। আমাকে নিয়ে ভয় নেই। বালক রাজা আমার অঙ্গহানি করবে না ।কারণ আমি কখনও রাজা হব না । তোমরা আজ রাতেই এখান থেকে পালিয়ে যাও । যখন তখন এখানে আসবে না । আমার দিব্যি রইল ।"   দূর্গাবতী তখনই সেখানে এলেন । ওদের কথা শুনতে পেরে বললেন, " যশোমতী ঠিক বলেছে বাবা ! এই রাজ্যের প্রজাদের তোমাকেই রক্ষা করতে হবে । মহারাজা জীবনে একটা বড় ভুল করেছিলেন চক্রপানির মতো সন্তানের জন্ম দিয়ে । আজ উনি বেচে থাকলে হয়তো এসব বন্ধ করতে পারতেন ।"  "পারতেন না মা। বালক রাজা হয়তো তাঁকে ও বন্দী করে রাখত ।"  "হয়তো তাই হতো মা । চলে গিয়ে তিনি রক্ষা পেয়েছেন রাজ্যের এই দুর্দশা তাকে দেখতে হচ্ছে না । এখন তুমি ওদের নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও বাবা । নইলে তোমাদের ও অঙ্গহানি হবে ।"    " ঠিক আছে মা , আমরা যাচ্ছি ।"

  এরপর মা আর স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছু বিশ্বস্ত মানুষের সহযোগিতায় মল্লপানি রাতের অন্ধকারে দুই সন্তানকে নিয়ে নাগা পাহাড়ে পালিয়ে যায় ।

  মল্লপানিকে আর তাঁর সন্তানদের খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে যায় চক্রপানি । প্রথমে যশোমতীকে ডেকে এনে মিষ্টি করে বলে, " ঔ মল্লপানির মধ্যে কি আছে যে তোমার মতো সুন্দরী ওকে বিয়ে করেছ। ওদের খবর বলে দাও সুন্দরী আমি তোমাকে আমার পাটরাণী করে রাখব। তুমি আহোম রাজ্যের রাণী হবে !"

  " নরাধম ! ছোট ভাইয়ের সহধর্মিণীকে এরকম কথা বলছ তোমার পাপের ভয় নেই ! "  চক্রপানি অট্টহাসি হেসে হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলে , " কে বলেছে ছোট ভাই । মল্লপানি আমার বড় ভাই । বড় ভাইয়ের সহধর্মিণী মানে আমারই সহধর্মিণী ।"  " কি !"  "ওসব ছেড়ে দাও ! তোমার এসব জানার প্রয়োজন নেই । তুমি শুধু আমাকে ওদের খবর বলে দাও !  "কখনও না !"   

   যশোমতী কিছুতেই যখন মল্লপানির খবর বলছিল না তখন চক্রপানির আদেশে তাঁকে বন্দী করে খেজুরির মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় ।দূর্গাবতী চক্রপানির পায়ে ধরে অনুরোধ করেন কিন্তু তাঁর কথা সে শুনেনি।


   বড় একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে তার উপর অনবরত চাবুকের আঘাত করা হয় ।শুধু রাতের বেলা তাকে নিস্তার দেওয়া হচ্ছে । চারপাশে কড়া পাহারা বসিয়েছে চক্রপানি ।

  চক্রপানি প্রতিদিন এসে যশোমতীকে একটাই প্রশ্ন করে ," মল্লপানির খবর বলে দাও তোমাকে আমরা মুক্ত করে দেব । এই ফুলের মতো নরম শরীরে কেন এতো কষ্ট সহ্য করছ সুন্দরী !    "কখনও না ! তুমি ওদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না । ওরা তোমাকে বিনাশ করে আহোম রাজ্যকে রাম রাজ্যে পরিণত করবে ।"

  " দেখ কে কার বিনাশ করে ! "

  কারো যশোমতীর উপর অত্যাচার দেখে খুব কষ্ট হলে ও মুখে উচ্চারণ করার সাহস নেই ।চক্রপানি জানতে পারলে গর্দান দেবে ।    যশোমতীর উপর অত্যাচারের দশ দিনের রাতে মল্লপানি এখানে এসেছিল তা সবাই জেনে গেছে । এরপর চক্রপানির আদেশে যশোমতীর শরীর কুচি কুচি করে কেটে তার উপর বিচুটিপাতা আর লংকা ঘসে এর উপরে গরম জল ঢেলে দেওয়া হয় । এরপর ও আহোম রাজ্যে আর স্বামী, সন্তানদের রক্ষার জন্য যশোমতী মুখ খুলেনি। কিন্তু এই চরম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তেরো দিনের দিন মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়ে যশোমতী ।

  খবরটা শুনে স্থির থাকতে পারেনি মল্লপানি ।খেজুরির মাঠেই যশোমতীকে দাহ করা হয় । মল্লপানি ছদ্মবেশে এসে দূর থেকে দেখে গিয়েছিল যশোমতীর ফুলের মতো নরম শরীরের ছিন্ন ভিন্ন রূপ । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যশোমতীর কথা সে রাখবে ।আহোম রাজ্য আর নিজের স্বামী, সন্তানদের রক্ষার জন্য যশোমতী নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে এটা মল্লপানি তথা রাজ্যবাসীর কাছে খুব বেদনাদায়ক ।

    মল্লপানি কিছু বিশ্বস্ত মানুষ আর নাগা রাজার সহযোগিতায় সৈন্য সংগ্রহ করে কিছুদিন পর চক্রপানি সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় ।সেই যুদ্ধে চক্রপানির মৃত্যু হয় ।

   এরপর আহোম রাজ্যের রাজা মল্লপানি হয়। রাজ্যের প্রজাদের সব দুঃখ কষ্ট দূর করে আহোম রাজ্যকে সত্যিই রাম রাজ্যে পরিণত করে মল্লপানি । কিন্তু একটাই দুঃখ যশোমতী স্বপ্নের রাম রাজ্য সে দেখতে পারেনি।  মল্লপানি বেশ কয়েক বছর রাজত্ব করেছিল।কিন্তু তিনি আর বিয়ে করেনি ।এরপর মানসিংহ, জয়সিংহ বড় হওয়ার পর মানসিংহকে রাজ সিংহাসনে বসিয়ে তিনি অবসর নেন ।

  মানসিংহ আর জয়সিংহ দুই ভাই মল্লপানির মতোই প্রজাবৎসল। মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে খেজুরির মাঠে একটি দিঘি আর একটা স্মৃতি সৌধ নির্মান করেন। দিঘিটির নাম ' যশোসাগর' আর স্মৃতি সৌধের নাম 'যশোদৌল '।

   মল্লপানি তখন সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করতেন। রাজ পরিবারের সব ধরনের ভোগ বিলাস থেকে তিনি নিজেকে বিরত থাকতেন। বেশীরভাগ সময় যশোমতীর স্মৃতি সৌধের পাশে বসে আপন মনে কি সব বিড় বিড় করতেন ।

  মল্লপানি মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে ও যশোমতীর স্মৃতি সৌধের পাশে দাহ করা হয়। মল্লপানি যশোমতী কখনও আলাদা হতে পারে না কারণ ওরা জনম জনমের সাথী । যশোমতী যুদ্ধ করেনি কিন্তু নিজের রাজ্য ও তার প্রজাদের রক্ষার জন্য নিজের জীবন দিয়েছে সেও ছিল বীরাঙ্গনা !

  




Rate this content
Log in

More bengali story from Sanghamitra Roy

Similar bengali story from Tragedy