রং ছোওয়া তুলি
রং ছোওয়া তুলি
মাটির বাসনগুলো রোদে শুকাতে দিয়ে বিলাসী বলল , " কি হইব এইসব বানাইয়া ।কেউ এসব আর কিনব না। কদিন পর না খাইয়া মরতে হইব ।" " আমরা যে মাটির কাজ ছাড়া কিছু জানি না বিলাসী । "- ব্রজবাসী বলল । " এতো কষ্ট কইরা বানাই মাটির বাসনগুলো কেউ কিনতেই চায় না । আগে সারা গেরামের মাইনষে কিনত।" " আমাগোর কপাল ভালা মাইয়াডার ভালো ঘরে বিয়া হইছে । ওরে আর এসব কাম করতে হইতাছে না । জামাই চাকরি করে তাই ওগোর ভাতের অভাব নাই । " " ঠিক কইছ ।" ব্রজবাসী পাল আর বিলাসী পাল দুজনে কুমার । ওরা দুধপুকুর গ্রামে থাকে । এই দুটো মানুষ লেখাপড়া জানে না , মাটির বাসন তৈরী করেই ওদের চলে । কিন্তু এখন ওদের খুব কষ্টে চলে । কারণ ওদের গ্রাম এখন অনেক উন্নত হয়েছে । এখন কেউ বাড়িতে মাটির বাসন খুব একটা ব্যবহার করে না। মাঝে মাঝে কারো বাড়িতে পুজো বা কেউ মারা গেলে মাটির বাসনের প্রয়োজন হয় । ওদের একমাত্র মেয়ে বেলীকে অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছে । বেলী খুব ভালো আছে ।
বেলীর মেয়ে বনিতা উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে । পরীক্ষার পর দাদু- দিদার বাড়িতে বেড়াতে এল বনিতা । বনিতা পড়াশোনায় খুব ভালো, বুদ্ধিমতী আর বেশ চটপটে । ওদের বাড়ি বহরমপুরে ।
বনিতা দাদুর বাড়িতে এসেই বুঝল অনেক কষ্টে চলছে দাদু - দিদার সংসার । সে সবকিছু ভালোভাবে লক্ষ্য করতে লাগল আর ভাবতে লাগল কিভাবে ওদের অভাব দূর করা যায় । দুজনেই হাতের কাজ সুন্দর করেন । বিলাসী খুব সুন্দর আল্পনা দেয়। প্রতি দিন ঠাকুরঘরে নূতন নূতন আল্পনা আঁকে বিলাসী। এসব সে কোথাও শেখেনি নিজের মন থেকেই আঁকে ।
বিলাসী, ব্রজবাসী দুজনে কাজ করছে। বনিতা পাশে গিয়ে বসল। ওদের কাজ দেখতে দেখতে বলল ," দাদুভাই শুধু কলস , গামলা, হাঁড়ি, প্রদীপ এসব বানাও কেন অন্যকিছু ও তো বানাতে পার।" " কি আর বানামু দিদিভাই ! মাটির জিনিস কেউ আর এখন আর কিনে না । শুধু পেটের তাগিদে বানাই । মানুষ কিছুদিন পর মাটির জিনিসের কথা ভুইলা যাইব । মাঝে মাঝে বিক্রি হয় কিন্তু কেউ বেশী টাকা দেয় না । এগুলা বানাইতেও খরচ লাগে । মনে হয় এসব ছাইড়া কোন জায়গায় কাজে লাইগা পড়ি।" " কেন ভুলে যাবে দাদুভাই । তোমরা কি চাও আমাদের দেশের প্রাচীন মৃৎ শিল্প , যা তোমাদের পূর্ব পুরুষেরা করে এসেছেন সেটি বন্ধ হয়ে যাক। আর কেন তোমরা অন্য কোথাও কাজে যাবে ।" " তাইলে কি করমু দিদিভাই ! এই মাটির কাম যে আমাগোর বুকে গাইথা আছে । আমরা কখনও চাই কাজ বন্ধ হোক । কিন্তু কিছু করার নাই। না খাইয়া মরতে পারুম না। "- বিলাসী বলল । " এভাবে ভাবছ কেন দিদন ! সময় বদলাচ্ছে সেই সঙ্গে তোমাদের শিল্পকে ও আধুনিক করে তুলতে হবে । তোমরা যে ধরনের জিনিস তৈরী করো তার চেয়ে অন্য ধরনের জিনিস তোমাদের তৈরী করতে হবে । মানুষের চাহিদা মতো জিনিস হলে অবশ্যই কিনবে ।"
" কিনব লোকে মাটির জিনিসপত্র ! ঠিক কইতাছস দিদিভাই ! আর কি কি বানামু আমরা যে আর কিছু জানি না । কি চাহিদা আছে মানুষের।" - ব্রজবাসী বলল । " অবশ্যই জানো ! কি সুন্দর তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতিভা আছে কিন্তু তোমরা তার ব্যবহার জানো না । তাই হতাশ হয়ে গেছ । তোমরা মাটির টব , খেলনা, পুতুল, নানা ধরনের সব্জি, ফল , পাখি, পশু, মূর্তি , ঘর সাজানোর নানা জিনিস বানাবে । দিদুন তুমি খুব সুন্দর আল্পনা আঁকো। তুমি রং তুলি দিয়ে সেগুলোতে সুন্দর করে রং করবে । তোমাদের শিল্পকে নূতন রপে তুলে ধরতে হবে । শিল্প কখনও হারিয়ে যায় না সময়ের সাথে সাথে শিল্পের রূপান্তর হয়। এখনও বড় বড় শহরে ও লোকে ঘর সাজানোর জন্য অনেক দাম দিয়ে মাটির তৈরী জিনিসপত্র কিনে।" " সুন্দর কথা কইছস দিদিভাই । কিন্তু আমরা কি ওসব পারুম। আর ওগুলোন কই বিক্রি করুম ।" " অবশ্যই পারবে । তোমরা বিভিন্ন মেলায় যাবে , কলকাতায় মাটির জিনিসপত্র বিক্রির জায়গা আছে ওখানে যাবে । তোমরা তৈরী করা শুরু করো আমি বাবাকে বলে সব ব্যবস্থা করে দেব। " বনিতা মোবাইল বের করে ওদের মাটির তৈরী নানা জিনিসের ছবি দেখাতে থাকে ।
বনিতার কথায় দুজনে যেন আশার আলো দেখতে পান। মোবাইলে বিভিন্ন জিনিস দেখে ওদের মনে হয় এসব ওরাও বানাতে পারবে ।দুজনে কাজ ভালো জানেন শুধু চেনা জিনিসগুলো ছাড়া এতদিন অন্য কিছুর কথা ওরা ভাবেনি । কারণ ওদের সীমানা দুধপুকুর গ্রামেই । বাইরের জগত সম্পর্কে ওদের বিশেষ ধারণা নেই । ব্রজবাসী -বিলাসী দুজনে মন দিয়ে কাজ করতে আরম্ভ করে । ওরা পুতুল, খেলনা , ফুলের টব বিভিন্ন ধরনের , মূর্তি, পশু, পাখি, ফল , ঘর সাজানোর বিভিন্ন জিনিস বানাতে থাকে । ব্রজবাসী অনেক ধরনের ডাইস তৈরী করেছে নিজে নিজে । বনিতা ওদের নানা আইডিয়া দিতে থাকে ।
ওদের তৈরী জিনিসগুলো বিলাসীর হাতের রং তুলির ছোঁয়ায় অসাধারণ হয়ে উঠে । রথযাত্রা উপলক্ষে সাতদিনের মেলা হয় বিষ্ণুপুরে । ওরা মেলায় যায় ওদের তৈরী জিনিসগুলো নিয়ে । বেশ ভালো বিক্রি হয় ওদের তৈরী মাটির জিনিসগুলো । এরপর থেকে দুজনে চেনা জিনিসপত্র গুলো ছাড়া নানা ধরনের জিনিসপত্র তৈরী করতে থাকে । এরপর আস্তে আস্তে ওদের মাথায় নূতন নূতন আইডিয়া আসতে থাকে । দুজনের পক্ষে সম্ভব হয় না এতো কিছু বানানো বিভিন্ন দুঃস্থ অসহায় মহিলাকে কাজে আনে ওরা আস্তে আস্তে ওদের তৈরীর জিনিসের চাহিদা বাড়তে থাকে । সময়ের সাথে সাথে ওদের হাত আরও পাকা হয়ে যায় ।ওরা বিভিন্ন মেলায় যায় , কলকাতায় মাটির তৈরী জিনিসের বাজারেও ওদের তৈরী জিনিসগুলো ভালো দামে বিক্রি হয়।
বনিতার দৌলতে সোসাল মিডিয়া ও ওদের তৈরী জিনিসের প্রচার হয়। ওদের শিল্পকলা সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে থাকে । জিনিসগুলো বেশী আকর্ষণীয় হয়েছে বিলাসীর হাতের রং তুলির ছোঁয়াতে। সংসারের অভাব জুটেছে সেইসঙ্গে ওদের সঙ্গে কাজ করে অনেক অসহায় মহিলারাও স্বাবলম্বী হয়েছে । হস্তশিল্পের উপর ওরা বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও পেয়েছে । ব্রজবাসী ও বিলাসীর মতো অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষের সম্মান ও পরিচিতি মিলেছে । তবে এতে বনিতার ভূমিকা অনেক । ওদের দেখে এখন অনেকে অনুপ্রাণিত হন যে কান কাজ ছোট নয় শুধু সময়ের সাথে তার সঠিক ব্যবহার করতে হয়। ওদের তৈরী জিনিস কিছুদিন পর বিদেশে ও পাড়ি দেবে।
