যখন বাঁধন আলগা হয়
যখন বাঁধন আলগা হয়
ভাতের থালাটা তেমনি আঢাকা পড়ে রয়েছে, আর ঝিমলি ডুব দিয়েছে সুদূর অতীতে। ভাইয়ের সাথে ওর বয়সের ফারাক প্রায় আট বছরের। তাই দিদি হলেও ছোট থেকে ভাইকে আগলে রাখত মায়ের মত। সেই দিদি যখন বিয়ের পর বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি যাবে ভাই জয়ন্তের সে কী কান্না। দিদি আর ভাই ছাপিয়ে যাচ্ছে একে অপরকে। ভাইকে ফেলে রেখেই ঝিমলি গিয়েছিল সংসার করতে।
সে সংসার স্থায়ী হয়নি। পাঁচ মাসের মেয়াদে শরীর মিলেছে বহুবার — প্রকৃতির নিয়মে, কিন্তু ঝিমলি মন মেলাতে পারেনি। সে বুঝেছে যার হাতটাকে ভরসা করেছে তার মন বাঁধা আছে অন্যখানে। তবু ঝিমলি চেষ্টা করেছে —মনের গভীরে ডুব দিতে, বিনিময়ে জুটেছে শাষণের ছড়ি। যখন অযহ্য হয়ে গেছে শরীর আর মন একসাথে কাতরে উঠেছে, টিকতে পারেনি ছুটে এসেছে বাবা-মায়ের কাছে চিরতরে। কোন খোঁজ নেয়নি বর নামক বর্বর মানুষটাও।
বাবা সায় দিয়েছে ঝিমলির সিদ্ধান্তকে। বলেছে— খেটে খাওয়া মানুষ তবু তিনজনের খাবার না হয় চারজনে ভাগ করে খাবে তবু... মা বোঝাতে চেষ্টা করেছে, বলেছে — বারমুখী পুরুষকে ঘরমুখী তোকেই করতে হবে। একদিনে হবে না, তবে একদিন ঠিক পারবি। ঘরের নিভু নিভু লন্ঠনের আলোয় পিঠের কাপড়টা সরিয়ে মায়ের সামনে দেখিয়েছে কত কালসিটে আর ফেটে লাল হয়ে থাকা ক্ষত! আঁতকে উঠেছে মা। ডুকরে কেঁদে উঠেছে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ভাই। সেই দশ বছরের ভাই ছুটে এসে দিদিকে জড়িয়ে ধরেছে। বলেছে – দিদি তুই কোথাও যাবি না। তুই বাড়িতেই থাকবি।
ঝিমলি বাবা-মা আর ভাইয়ের সাথে রয়ে গেল। সে এই কটা মাসে অনেকটা বড় হয়ে গেছে। মায়ের না বলা কথার মানে বুঝেছে, বাবার ক্ষমতা বুঝেছে, আর চেয়েছে ভাইটাকে মানুষ করার মাঝে যন্ত্রণাকে ভুলে থাকতে। কাজ করতে শুরু করেছে সে। সব কাজ — জমিতে চাষের কাজ, রাজমিস্ত্রির জোগারের কাজ যখন যা পায় তাই। সেই সাথে দ
ু-চারটে ছাগলও কিনে রেখেছে। এভাবেই সে নতুন করে যুদ্ধ নেমেছে— যুদ্ধ নিজের ভাগ্যের সাথে।
জয়ের মুখ সে দেখেছে। ভাই স্কুল পাশ করেছে কলেজে গেছে। একটা সরকারী কাজও জুটিয়েছে। এরই মধ্যে একে একে বিদায় নিয়েছে বাবা-মা। ওরা ছেলের সুদিনটা দেখে যেতে পারেনি। মেয়ের লড়াইটা দেখলেও জয়টা দেখা হয়নি। ভাই যখন তার প্রথম মাইনের টাকায় শাড়ি এনে দিদিকে দিয়ে প্রণাম করলো দিদির দু'চোখে আনন্দের বন্যা বইলো — জীবনে প্রথমবার!
সময়ের চাহিদা মেনে ভাইয়ের বৌ মহুয়া এল ঘরে। ঝিমলি তার শেষ সম্বল ছাগলদুটো বিক্রি করে ভাইয়ের বৌয়ের মুখ দেখতে গয়না গড়ালো। নতুন বৌকে সংসার বোঝাতে লাগল ঝিমলি। কিন্তু বুঝতে পারছে সব বুঝে আসা মেয়ে নিয়ে এসেছে তার ভাই, তাকে বেশি বোঝাতে গেলে ঠেক খেতে হবে পদে পদে। বরং মহুয়া প্রতি পদে বুঝিয়ে দিচ্ছে এ সংসারে ঝিমলির ভিতটা বড্ড নড়বড়ে। তাই সংসারে চুপ থাকতে শিখে নিয়েছে সে। আর গোপনে চোখের জল মুছতে — যা তার চিরসঙ্গী হয়ে আছে!
কদিন হল জ্বর বাধিয়েছে ঝিমলি। সারাদিন শুয়েই থাকে। কোন খাবার মুখে রুচি হয়না। আজ অনেকটা ভাল। তাই দুটো ভাত খাবে ভেবেছে। ভাতের থালাটা মহুয়া ধরে দিয়ে গেছে। আজ ভাইয়ের ছুটি। ভাইকে বৌ বোঝাচ্ছে ঝিমলি সব শুনতে পাচ্ছে। ভাইটা কতটা বোকা অকাট্য তথ্য প্রমাণ দিয়ে বোঝাচ্ছে তার বৌ। দিদিকে যে এভাবে কেউ বয়ে বেড়ায় তার নজির বৌয়ের কাছে নেই। একটা মানুষকে শুধু শুধু বসিয়ে সেবা নেওয়ার খরচটা হিসাব করতে পরামর্শ দিচ্ছে বৌ। তাছাড়া কতকাল এই বোঝা বইতে হবে তার ঠিক নেই! এত কথার মাঝে ভাইয়ের মুখে একটা কথাও নেই! তাহলে ভাইয়ের কি কিছুই বলার নেই! নাকি বৌয়ের কথাগুলোই ওর কথা!
ভাতের উপর মাছি বসে কালো হয়ে গেছে ঝিমলি ভাবতে ভাবতে উদাস চোখে ঘরের কোণে ঝুলতে থাকা কাজ হারানো ছাগলের দড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে।