Ananya Podder

Abstract Drama Others

3  

Ananya Podder

Abstract Drama Others

একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট

একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট

13 mins
265


ল্যাবরেটরি থেকে সুতনুর টেস্ট রিপোর্টটা নিয়ে ওখানেই চুপচাপ বসে পড়ে জয়শ্রী | ডক্টর সান্যালকে আজ পাওয়া যাবে না চেম্বারে, উনি দুদিনের জন্য দিল্লী গেছেন, একটা নাকি কনফারেন্স আছে উনার |


কদিন ধরেই সুতনুর শরীরটা খারাপ যাচ্ছিলো | মাঝে মধ্যেই পেটে একটা ব্যথা হচ্ছিলো, সাথে গায়ে হাল্কা হাল্কা জ্বর আসে | বহুকালের পরিচিত ডক্টর সান্যালকে দেখাতেই উনি কতগুলো টেস্ট লিখে দিয়ে বলেন, "টেস্টগুলো করিয়ে রাখুন | আমি দিল্লী থেকে ফিরে আসলে রিপোর্ট দেখে প্রপার ট্রিটমেন্ট শুরু করবো | আপাতত কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সেগুলো খেতে শুরু করে দিন | "


ডক্টর সান্যালের দেওয়া সেই রিপোর্টটাই নিতে এসে জয়শ্রী রিপোর্টে দেখেছে লেখা আছে, সুতনুর যে রোগ হয়েছে তার নাম "হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা" |


রোগটা আসলে কি জানার জন্য গুগল সার্চ করতেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো | আজও সকালবেলায় অফিস বেরোনোর আগে ভীষণরকমের মানসিক চাপ দিয়ে এসেছে সে সুতনুকে | অথচ মানুষটা ভিতরে ভিতরে এতটা ভেঙে গেছে, বুঝতেই পারেনি জয়শ্রী | দোষটা যে সম্পূর্ণ জয়শ্রীর তাও নয়, এর পিছনে সুতনুর মা মালতীর হাতও কিছু কম নয় |


আসলে সুতনুর সাথে জয়শ্রীর বিয়ে প্রায় অর্ধেক যুগ পেরিয়ে গেছে | তিন বছরের সৃজনকে নিয়ে স্বামীস্ত্রীর দাম্পত্য জীবন মোটামুটি সুখের | কিন্তু জয়শ্রীর জীবনে যত অশান্তি হোলো ওর শাশুড়ি | উনি যেন এখনো মনে করেন, যে, তার ছেলেটি এখনো তার কোলের ছেলেই রয়ে গেছে | জয়শ্রী আর সুতনুর যে একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে, সেটা উনি মানতেই চাননা |


এই তো সেদিন, সুতনুর জন্মদিনে জয়শ্রী ঠিক করলো, বাড়ির সবাইকে হায়াতে নিয়ে গিয়ে বরের জন্য বেশ একটা সারপ্রাইস পার্টি দেবে | প্রতি বছর সুতনুর অফিসের কারণে ওর জন্মদিনটা সেভাবে সেলিব্রেটই করা হয়না | এবার রবিবার পড়াতে জয়শ্রী সব প্ল্যানিং ঠিক করে ফেললো | কিন্তু বাধ সাধলেন সুতনুর মা | তিনি বললেন, "না, না, ওসব হবে না | আমার ছেলের এবার যখন জন্মদিনটা রবিবারে পড়েছে, তখন আমি এবার বেশ আমার মতো করে পালন করবো তনুর জন্মদিন | ইলিশভাপা, ডাবচিংড়ি, কচি পাঁঠার ঝোল, খেজুর - টমেটোর প্লাস্টিক চাটনি, নলেন গুড়ের পায়েস এসব রান্না হবে বাড়িতে | তনুর মামা মাসি আর পিসিদেরদেরও আসতে বলবো | সবাই মিলে জমিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া করা হবে | "


জয়শ্রী একটু সংকোচের সাথে বলেছিলো, "এতো রান্নার আয়োজন কে করবে মা?? "


"কেন, তুমি আর আমিই করবো | আবার কে করবে ?? "


জয়শ্রীর মেজাজটা গেলো বিগড়ে | বরের জন্মদিনটা কোথায় বরের সাথে একটু বাইরে বেরোবে, ঘুরবে, একটু রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করবে, তা নয়, এই বুড়ির সাথে সারাদিন রান্নাঘরে গলদঘর্ম হয়ে উনার বাপের বাড়ির আর শ্বশুরবাড়ির গুষ্ঠির জন্য রান্না করো | ছেলের জন্মদিন তো বাহানা মাত্র!! উদ্দেশ্য তো ওই রাবনের গুষ্ঠিকে গেলানো !!


এই জন্যই শাশুড়িকে সহ্য হয় না জয়শ্রীর | মানুষটার কি যে এতো ছেলের উপরে আধিপত্য কে জানে !! যখন যা ইচ্ছে হোলো, তখন সেটাই ছেলেকে করতে হবে | না করলেই সব দোষ বৌমার | যেন বৌমাই সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে ছেলেকে | আর জয়শ্রীই কি সুতনুর কেউ হয় না !! এতোই যদি ছেলের উপরে দাবী থেকে যাবে উনার, তাহলে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন কেন কে জানে !!


সুতনুর কাছে ছুটে গিয়ে নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে জয়শ্রী বলেছিল, "তুমি মাকে বলে দাও, তোমার জন্মদিনে যেন কাউকে না ডাকে বাড়িতে | আমি সারাদিন রান্নাঘরে সময় কাটালে তোমার সঙ্গে থাকবো কিভাবে ?? অতএব, আমি যা ভেবেছি, তাই হবে | "


সুতনু জানে, মাকে এমন কথা বলতে গেলেই মা বলবেন," এখন তো তোর বউই সব, তাই না তনু ?? আমি তো তোর কেউ হই না !! "


মাকেই বা বুঝায় কি করে সুতনু, আজকালকার মেয়ে জয়শ্রী এসব পছন্দ করে না | সুতনুর বাবা মাকে নিয়ে সময় কাটাতে জয়শ্রীর আপত্তি নেই | কিন্তু বিশেষ কিছু দিনে আরও আত্মীয়স্বজনদেরকে নিয়ে বাড়িতে হইহুল্লোড় করা, একদম পছন্দ নয় জয়শ্রীর | এদিকে মাও নিজের জেদে অনড় থাকবে | তাই জয়শ্রীকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছিল সুতনু," মা, যা করছে করতে দাও শ্রী | আমরা বরং পরের একটা রবিবারে যাবো বাইরে |"


একরাশ অভিমান নিয়ে জয়শ্রী বলেছিল, "ঠিক আছে, তোমার জন্মদিন, তোমার ইচ্ছেমতোই হোক | সেলিব্রেটে করো তোমার মায়ের ইচ্ছেমতো | আমি তো তোমার কেউ নই | "


সুতনুর খারাপ লাগে, কিন্তু সেও বা কি করে | সে বৌ আর মায়ের মাঝে পিষে যাচ্ছে সেই বিয়ের পর থেকেই | প্রেমের বিয়ে ছিল বলে, মায়ের কাছে চিরকালই চক্ষুশূল থেকে গেছে জয়শ্রী | প্রথম প্রথম শাশুড়ির সাথে এডজাস্ট করার চেষ্টা করলেও ছেলে হওয়ার পরে জয়শ্রীও শাশুড়ির বিরুদ্ধে বলতে শুরু করলো | মায়ের কাছে বৌয়ের নামে নিন্দে আর বৌয়ের কাছে মায়ের নামে অভিযোগ শুনতে শুনতে সুতনু হাঁপিয়ে উঠেছিল | দুজনের কেউই বুঝতে পারছিলো না, একে অপরের সাথে একটা অসুস্থ সম্পর্ক তৈরী করে তারা সুতনুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে |


শেষ পর্যন্ত অশান্তি চূড়ান্ত বাঁধলো, যখন জয়শ্রী ড্রয়িং রুমে একটা পঞ্চান্ন ইঞ্চির এল.ই.ডি. লাগাবে বলে ঠিক করলো | সাথে ড্রয়িং রুমের একটা দেওয়াল জুড়ে বুক সেলফ তৈরী করবে বলেও ঠিক করলো জয়শ্রী | কিন্তু বাধ সাধলেন মালতী | এইভাবে ড্রয়িংরুমটা নিজের মতো করে জয়শ্রী যদি সাজিয়ে নেয়, তাহলে বাড়িতে লোকজন এলে, উৎসব অনুষ্ঠান হলে যে ড্রয়িংরুমে ঢালাও বিছানা করা হয়, সেটা আর করা যাবে না | তাই তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, "এসব বানানো চলবে না আমার বাড়িতে |"


এর আগেও নিজের পছন্দ মতো ওয়াশিং মেশিন কিনতে চেয়ে কিনতে পারেনি জয়শ্রী | "অত টাকা নষ্ট করে দরকার নেই " বলে একটা সাধারণ অটোমেটিক ওয়াশিং মেশিন কিনিয়েছিলেন ছেলেকে দিয়ে | রাগে বরের সাথে দোকান অব্দিও আর যায়নি জয়শ্রী | একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেছিল, "তোমাদের বাড়ি, তোমরাই যা ভালো বুঝবে করো | আমি বাইরের মেয়ে, আমাকে এর মধ্যে টেনে এনে কি হবে | "


বৌকে তখন সান্ত্বনা দিয়েছিলো সুতনু, "আচ্ছা শ্রী, এরপরে টিভিটা তোমার পছন্দ মতো কিনবো |"


কিন্তু টিভির বেলাতেও শাশুড়ি তার জেদ দেখালে জয়শ্রী বেঁকে গিয়ে বলে, " সুতনু, তুমি আলাদা ফ্ল্যাট কেনো বা ভাড়া নাও | এ বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে | এই বাড়ির সবটাই যখন তোমার মায়ের অধিকারে, তখন এই বাড়ি আর এই সংসার নিয়ে তোমার মা থাকুন | আমরা আলাদা হয়ে যাই | "


আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা শুনে কেমন মুষড়ে পড়ে সুতনু | সুতনুর দাদা অতনু চাকরির অজুহাতে সেই যে ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে সেটল হয়েছে, আর ফিরে আসার নাম করেনি | জয়শ্রী বড়ো জাকে বলেছিল, "তুমিও তো মাঝেমধ্যে বাবা মাকে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারো দিদিভাই | আমি একটু প্রাণখুলে বাঁচি তাহলে |"


অতনুর বৌ রঞ্জনা বলেছিল, "পাগল নাকি রে !! ওই মহিলাকে নিয়ে কেউ ঘর করে | ওই মহিলা আমার সংসারে এসে আমার ওপরেই খবরদারী করবে | যদি উনাদেরকে আমার কাছে পাঠাবি ভাবিস, তাহলে তোর দাদাভাইকে নিয়ে সোজা লন্ডন উড়ে যাবো | ওই মহিলার সাথে থাকতে পারবো না আমি | "


জয়শ্রী সুতনুর কাছে জায়ের কথা বলে বলেছিল, "তুমি কি একটু দাদাভাইয়ের মতো চালাক হতে পারো না ?? যত বোকামি কি তোমাকেই করতে হবে!! তোমার মায়ের সাথে আর যে সমঝোতা করে চলা যায় না !! আর কবে বুঝবে তুমি !! "


সুতনু শুধু বলেছিল, "সবাই তো সমান হয় না শ্রী | আমি জানি, আমার মায়ের সংসারে আধিপত্য সবসময়ই বেশি | আমার বাবাও কখনো মায়ের সামনে মুখ খোলার চেষ্টা করেনি | আমার মা মানুষটাই এইরকম | কিন্তু তাই বলে তাকে ছেড়ে চলে যাবো, এতটা নিচ মানসিকতা কি করে দেখাই, বলো | শত হলেও সে তো আমার মা | ছোটবেলায় কত ভুল তো আমরাও করেছি | তাই বলে কি আমাদের বাবা মায়েরা আমাদের ছেড়ে দিয়েছেন?? "


"তাহলে আর কি , আমাকেই বিষ এনে দাও, সুতনু, খেয়ে মরে যাই | তোমাকে ভালোবেসে নিজেকে তোমার কাছে সমর্পন করেছি মানে তো এই নয়, যে, তোমার মায়ের অন্যায় আর মিথ্যে আবদারের সাথে সবসময় সমঝোতা করে চলতে হবে আমাকে ?? "


"সমঝোতা কি আমিও করছি না শ্রী !! তোমার আর মায়ের কাছে আমি তো সমান অপরাধী | তোমাদের দুজনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না, তোমরা দুজনেই আমার কাছে সমান ভাবে প্রিয় | তোমাদের দুজনের গুরুত্বই আমার কাছে সমান | তোমরা যখন একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করো, তখন আমিই ময়লা হই বেশি | একটু কি মিলে মিশে থাকা যায় না ?? "


"না, যায় না | আমাকে নিয়ে ঘর করতে হলে তোমাকে আলাদা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করতেই হবে সুতনু | আমারও তো ইচ্ছে করে, আমার নিজের একটা সংসার হোক | "


সকালে বরকে অতগুলো কথা শোনানোর পরে জয়শ্রী দেখেছিলো সুতনু তার মায়ের কাছে গিয়ে বলেছিল, " মা, কি হয়েছে, জয়শ্রী যদি নিজের ইচ্ছেমতো ড্রয়িংরুমটা সাজাতে চায় | তোমার কাছে তোমার ছেলেবৌ বেশি, নাকি দুদিনের জন্য আসা আত্মীয়স্বজন বেশি ?? দাদা বৌদি এখানে থাকে না | তোমাদেরও তো বয়স হচ্ছে | এবার সংসারের কিছু সিদ্ধান্ত জয়শ্রীকে নিতে দাও মা | নাহলে, এই সংসারটাকে শ্রী ভালোবাসবে কি করে বলো !! "


সব শুনে মালতী বলেছিলেন, "বৌ শিখিয়ে পাঠিয়েছে বুঝি??.. যা, আলাদা সংসার পাত গিয়ে | আমি আর তোর বাবা এই বাড়িতে ভালোই থাকবো | আমাদেরকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না | তুই তোর বৌয়ের কথা ভাব | "


ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুতনু মাকে বলল, "আমার কথাটা একবারও ভেবে দেখলে না মা | আমি দাদার মতো পালিয়ে যেতে চাইনি | তাই, কলকাতার বাইরে ভালো চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যাইনি, শুধু তোমাদের সবাইকে নিয়ে থাকবো বলে | তোমাদের সবার প্রতি আমার ভালোবাসার সমর্পনের এই দাম দিলে তোমরা !! আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি মা, তুমি আমাকে ভালোবাসো না | যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতে তাহলে আমার ভালোবাসার মানুষটাকেও আপন করে নিতে পারতে তুমি | কিন্তু সেটা তুমি করোনি মা | তোমরা কেউ আমার ইচ্ছের দাম দিলে না | কি আর বলবো তোমাদের ?? "


রিপোর্টটা হাতে নিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল জয়শ্রী | "হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা" মানে যে লিভার ক্যান্সার সেটা তো গুগল বলে দিলো তাকে | কিন্তু এমন মারণ রোগ কেন হোলো সুতনুর !! কোনোদিন মদ না ছোঁয়া, সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষটার জীবন এমন একটা রোগে তছনছ হয়ে যাবে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে জয়শ্রীর | সুতনুর জীবনটা এতো স্বল্প পরিসর বলেই কি সে সবাইকে একসাথে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল !!


ল্যাবরেটরিতেই ডুকরে কেঁদে উঠল জয়শ্রী | সুতনু বাড়ি ঢোকার আগেই তাকে বাড়িতে ঢুকতে হবে | শাশুড়িকে বোঝাতে হবে, এবার অন্ততঃ কয়েকটা দিন সুতনুকে ভালো রাখার জন্য তাদেরকে একে অপরের সাথে সমঝোতা করে চলতে হবে | সুতনুর শরীরের অস্বস্তি ডাক্তার লাঘব করতে পারবেন কিনা জানা নেই জয়শ্রীর, কিন্তু তার মনের অস্বস্তি তো দূর করা যেতেই পারে | যদি বিধাতার নিষ্ঠুর লিখনে সুতনুকে সময়ের আগে চলে যেতেই হয়, তবে চলে যাওয়ার আগে সুতনু মনে এটুকু শান্তি নিয়ে যাক, যে, তার প্রিয় দুটো মানুষ একে অপরের সাথে থাকতে শিখে গেছে কোনো মিথ্যে সমঝোতা ছাড়াই |


তাই বাড়িতে ঢুকেই শাশুড়িকে সবটুকু জানিয়ে জয়শ্রী বলল, "আমি জানি মা, আমি তোমার পছন্দের মানুষ নই | তবুও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু আমাকে মেনে নাও | সুতনু আমাকে আর তোমাকে যেভাবে দেখতে চায়, চলো না, কটা দিন না হয়, সেভাবেই চলি আমরা | অভিনয়ই না হয় করলাম দুজন, তবুও মানুষটা তো ভালো থাকবে | "


মালতী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "তুমি কি মানুষ জয়শ্রী !! মায়ের কাছে ছেলের সুখের জন্য বলছো, অভিনয় করতে !! আমার দুই ছেলের মধ্যে তনুই আমার বুক আগলে থেকেছে চিরকাল | আর সেই ছেলের জন্য আমি কিছুই করবো না !! নিয়ে নাও এই সংসার তুমি | সংসার কে চায়?? আমার ছেলে না থাকলে আমিও থাকবো না আর এই সংসারে |"


সেদিন রাত্রে বাড়িতে ফিরে সুতনু বাড়ির পরিবেশটার আমূল পরিবর্তন দেখতে পেল | রান্নাঘরে শাশুড়ি-বৌমা রান্না করার সাথে সাথে হেসে হেসে গল্প করছে | এ দৃশ্য জয়শ্রী এবাড়িতে আসার পরে এই প্রথম দেখছে সুতনু |


সুতনু ফ্রেস হয়ে নেবার পরে জয়শ্রী চা এনে দিতেই সুতনু বলল, "মেডিক্যাল রিপোর্টটা নিয়ে এসেছো শ্রী?? "


জয়শ্রী বলল, "না গো, সময় পাইনি | ভাবছি, এখন আর আনবো না | ডক্টর সান্যালকে যেদিন দেখাতে যাবে, সেদিনই একবারে রিপোর্টটা তুলে নিয়ে ডক্টরের কাছে চলে যাবো | "


সুতনু আর কথা না বাড়িয়ে বলল, "তোমার কাজ হয়ে গেলে একটু এসো শ্রী | কয়েকটা ভাড়া বাড়ির খোঁজ পেয়েছি | ছবিগুলো দেখে রেখো | তার মধ্যে যেগুলো তোমার পছন্দ হবে, তোমাকে নিয়ে যাবো দেখাতে এই রবিবারে | "


সুতনুর মুখের কথা শেষ হতে পারে না, তার আগেই মালতী ঢুকে পড়েন ওদের কথার মাঝখানে, "কোথাও কিচ্ছু দেখতে যেতে হবে না কাউকে | জয়শ্রী বানাক বুকসেল্ফ ড্রয়িংরুমে, আমার কোনো আপত্তি নেই | কবে কোন লোকজন আসবে, তার জন্য ওর শখকে নষ্ট করে কি লাভ?? "


সুতনু বলল, "কিন্তু লোকজন এলে কোথায় শুতে দেবে তুমি ?? "


"তোদের ঘরে পাঠিয়ে দেবো | তখন জয়শ্রী বুঝে নেবে কোথায় কাকে শুতে দেবে | আর দেখ বাবা, অনেক বছর এই সংসার আঁকড়ে পড়ে থাকলাম, এবার ভাবছি সবটুকু দায়িত্ব জয়শ্রীর হাতে তুলে দিয়ে একটু আরাম করবো | এই মেয়েটা এতদিন ধরে গায়ে অনেক হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে | এবার একটু সংসার সামলাক | "


জয়শ্রী শাশুড়ির কথায় একটু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সুতনু মাকে জিজ্ঞেস করলো, "কি ব্যাপার বলো তো মা ?? সকালেও বললে, আলাদা হয়ে যেতে !! আর এখন বলছো, সংসারের সব দায়িত্ব শ্রীকে দিয়ে দেবে !! এই একবেলাতেই এতো পরিবর্তন এল কি করে মনের ?? "


ছেলের পাশে বসে ছেলের হাত দুটো ধরে মালতী বললেন, "আজ তোর জোৎস্না মাসির সাথে কথা হচ্ছিলো ফোনে | জয় বাড়ি থেকে চলে যাবার পরে সত্যিই কেমন একা হয়ে গেছে ওরা | আমিও তাই ভাবলাম, সংসার মানে তো তোরাই | তোরাই যদি না থাকিস, তাহলে আর এই সংসার থেকে কি হবে | জয়শ্রীকে সত্যিই এতদিন ভরসা না করে ভুল করেছি আমি | সত্যিই তো, মেয়েটাকেও তো অনুভব করতে দিতে হবে, যে, এই বাড়িটা, এই সংসারটা ওর নিজেরও | তাহলেই তো ভালোবাসতে পারবে ও এই বাড়ির সব কিছুকে | আর সত্যিই তো, আমরা শাশুড়ি - বৌ ঝগড়া করে গেলে তোরই সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়, এটা বুঝিনি রে বাবা | আসলে তোর ঠাকুমা যখন আমাকে জ্বালাতন করতো, তোর বাবা তো কখনো একটা কথাও খরচ করেনি আমার হয়ে | তাই তুই জয়শ্রীর হয়ে কথা বলতে এলে খুব রাগ হয়ে যেত আমার | কিন্তু আজ তোর কথাগুলো শোনার পরে আর জোৎস্নার সাথে কথা বলে মনে হোলো, জীবনটা তো ক্ষনিকের, তাই যতদিন মিলে মিশে থাকা যায় একে অপরের সাথে | "


এই ছয় বছরে এই প্রথম শান্তির ঘুম দিলো সুতনু | রাত্রে শুতে যাবার আগে শ্রীও বলেছে, "ভাড়াবাড়ির দরকার নেই, এই বাড়িতেই থাকবো আমরা | আর ভাবছি, এই মুহূর্তে টিভি, বুকসেল্ফ কিছুই বানাবো না | তোমার মা যখন এতটা মানিয়ে নিলেন, তখন আমারও তো কর্তব্য তার দিকটাও বিবেচনা করে দেখা | "


সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারেনি জয়শ্রী | সুতনুর পাশে শুয়ে তার তৃপ্তির ঘুমটাকে দেখছিলো সে | সত্যিই মানুষটা এই ছয় বছর ধরে কতটা মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেটা কেউ উপলব্ধিই করতে পারেনি | একটা সংসারে একজন পুরুষই বোধহয় সবচেয়ে পিষে মরে বেশি | যাকে বিয়ে করে হাত পেতে যার দায়িত্ব নিয়ে এসে তাকে ভালো রাখতে পারে না, তখনও যেমন তার কষ্ট হয়, তেমনি কষ্ট হয় সেই বাবা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের দিকে আঙুল তুলে কথা বলতে | কারণ, কি করে ভুলে যাবে যে, এই বাবা মায়ের জন্যই সে পৃথিবীতে এসেছে, বড়ো হয়েছে, সংসার করার মতো সক্ষম হয়েছে | তাই স্ত্রী, মা দুজনের কাছেই নির্বাক থেকে সে কখনো বৌয়ের গোলাম আখ্যা পায়, আবার স্ত্রীয়ের কাছে পায়, মায়ের কোলের ছেলে বলে অপবাদ | কিন্তু সে যে এই দুটোর কোনোটাই নয়, সেটা মা - বৌ কেউই বোঝে না |


পরেরদিন অফিসে লাঞ্চের সময়ে জয়শ্রীর কাছে একটা ফোন আসে, "মিসেস চৌধুরী বলছেন?? "


"হ্যাঁ, বলছি | "


"আমি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে ফোন করছি | আপনি কি একবার স্যারের রিপোর্টটা নিয়ে আমাদের এখানে আসতে পারবেন প্লিজ ?? "


"কেন বলুন তো ?? " উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করে জয়শ্রী |


"আপনি আসুন, এলেই সব জানতে পারবেন | "


সন্ধ্যে অবদি আর অপেক্ষা করতে পারে না জয়শ্রী | সুতনুর রিপোর্টটা নিজের ব্যাগের মধ্যে নিয়েই ঘুরছিলো জয়শ্রী, যাতে সুতনুর হাতে কোনোভাবে না পড়ে রিপোর্টটা | তাই ব্যাগটা বগলে চাপিয়েই অফিসে জানিয়ে সে বেরিয়ে গেলো ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের উদ্দেশ্যে |


সেখানে পৌঁছতেই রিপোর্ট ডিপার্টমেন্টের মেয়েটি আমতা আমতা করে বলল, "আসলে ম্যাম, একটা ভুল হয়ে গেছে আমাদের তরফ থেকে | অন্য একজনের রিপোর্ট আপনাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে | সেই পেসেন্টের নামও সুতনু চৌধুরী, আর উনাকেও রেফার করেছিলেন ডক্টর সান্যাল | যিনি কাল আপনাকে রিপোর্টটা দিয়েছিলো সে পেসেন্ট নেম দেখেই দিয়ে দিয়েছিলো, পেসেন্ট আই. ডি টা আর চেক করেনি | আজ সেই রিপোর্টের আসল মানুষ এসে পড়াতে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আমাদের কাছে | "


সুতনুর আসল রিপোর্টটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো জয়শ্রী, সব ঠিকঠাক আছে | কান্নায় ভেঙে পড়লো সে | রিপোর্ট দিচ্ছিল যে মেয়েটি, সে জয়শ্রীর কাছে ছুটে এসে বলল, "কি হয়েছে ম্যাম, কিছু খারাপ বেরিয়েছে কি রিপোর্টে ?? আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন ?? "


চোখের জল মুছে জয়শ্রী বলল, "না ম্যাম, খারাপটার হাত থেকে হঠাৎ করে মুক্তি পেয়ে গেছি, তাই কান্না সামলাতে পারিনি | "


ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকেই জয়শ্রী শাশুড়িকে ফোন করে সুখবরটা দিতেই মালতী বললেন, "জয়শ্রী, আজ সবাই মিলে চলো না, রেস্টুরেন্টে যাই | তোমার তো খুব ইচ্ছে ছিল তনুর জন্মদিনটা একটু অন্যরকম করে পালন করার | এটাও তো তনুর নতুন জন্মই বলো | তবে কি আজ পালন করা যায় না, তনুর আরেকটা জন্মদিন ?? দেখো না, তনুও যদি একটু আগে বেরিয়ে আসতে পারে অফিস থেকে | "


সবাই মিলে সেই রাতে রেস্টুরেন্টে একসাথে সময় কাটালো | একটা ছোট্ট কেকের ব্যবস্থা করালেন মালতী জয়শ্রীকে বলে | সুতনু জিজ্ঞেস করলো, "এসব আবার কেন?? "


মালতী হেসে বললেন, "এখন থেকে যে সবাই মিলে মিশে থাকবো, তার জন্য এই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখছি | কে কদিন এ পৃথিবীতে আছি, কেই বা জানে | তাই যে কটা দিন বাঁচবো, তোর মুখের হাসিটা দেখে বাঁচতে চাই রে বাবা | "


সুতনুর কাছে তবুও সব ধোঁয়াশা | কিন্তু বিধাতা অলক্ষ্যে হাসছেন | একটা ভুল মেডিক্যাল রিপোর্ট যে সুতনুর মনের সব আশাকে এভাবে পূরণ করে দিয়ে গেলো, সে কথা সুতনু কোনোদিন জানতে পারবে না | শুধু তার সদিচ্ছা তার জীবনকে এক নতুন রঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেলো |


সমাপ্ত






Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract