Ananya Podder

Romance Classics Others

3.6  

Ananya Podder

Romance Classics Others

গরম সিঙ্গারা

গরম সিঙ্গারা

8 mins
293


গরম সিঙ্গারায় কামড় দিয়েই চোখটা বন্ধ করলো শ্যামলী | আজ কত বছর বাদে যে এমন গরম গরম সিঙ্গারা খেলো সে !! মুখের ভিতরের তৃপ্তিটা গলা ভেদ করে বুকের মধ্যে যখন পৌঁছে যাচ্ছে, তখন হৃদয়টাও গরম নোনা জলের বাতাসে ভেসে যাচ্ছে যেন !!


আজ থেকে কত বছর আগেকার কথা !! গৌতম আর সে তখন কলেজে পড়ে | তার চেয়ে দুবছরের সিনিয়র গৌতম তখন কলেজে সদ্য সেক্রেটারি হয়েছে | মেয়েদের ভোটেই একতরফা জিতে গিয়েছিলো সে |


ওদের কলেজের সামনেই কিছু ছেলেদের আড্ডা বসতো চায়ের রকে | পার্টির নেতার ছাতার তলে ছিল বলে কেমন যেন নিজেদের হনু মনে করতো তারা | কলেজে যাওয়া আসার পথে কলেজের মেয়েগুলোকে খুব উক্তক্ত করতো সর্বক্ষণ | তাদের মধ্যেই একটি ছেলে ছিল, নাম বাচ্চু | শ্যামলীরই ক্লাসের আরেক পড়ুয়া ঝর্ণার উপরে তার লোলুপ দৃষ্টি ছিল | ঝর্ণা গরীব হলে কি হবে, দেখতে ছিল অপরূপ সুন্দরী !!


সেই ঝর্ণাকে আসতে যেতে পথ আটকে দাঁড়াতো বাচ্চু | রোজই এক কথা ছিল, "বিয়ে কবে করবে আমায়?? "


ঝর্ণা কোনো উত্তর দিতো না | একদিন ঝর্ণার হাত ধরে টেনে তাকে শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে বাচ্চু | সেই সময়ে গৌতম ভাগ্যক্রমে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল | ঝর্ণাকে বাচ্চুর হাত থেকে বাঁচিয়ে বলেছিল, "কলেজের মেয়েরা তোর ঘরের পোষা কুকুর - বিড়াল নয়, যে যখন খুশি মন চাইলেই তাদের গায়ে হাত দিতে পারিস তুই | "


স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিল না বাচ্চু | ব্যাপারটা কথা থেকে হাত অব্দি ছড়ায় | হাতাহাতি, মারামারি হয়ে যাওয়ার পরে বাচ্চু বুঝে গিয়েছিলো, ভালো জামাকাপড় পরা, ভালো আচরণ দেখানো ভদ্র সভ্য গৌতম তার চেয়েও বড়ো গুন্ডা | লড়তে গেলে যে গৌতমের কাছে বারবার হারতে হবে সেটা বুঝেই চুপচাপ সরে গিয়েছিলো সে |


তারপর কলেজের মেয়েরাই গৌতমকে চেপে ধরে কলেজ ইলেকশনে দাঁড়াতে | কলেজের বাকি ছেলেরাও সাপোর্ট করলো মেয়েদের এই ইচ্ছেকে | ফলে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছিলো গৌতম |


সেই গৌতম একদিন বৃষ্টির দিনে রমেনদার ক্যান্টিনে এসে বসলো | সেই সময় ক্যান্টিনে বসেছিল শ্যামলী, ঝর্ণা, প্রতিভা আর কাবেরী | তাদের চারজনের মাঝে এসে হঠাৎ বসে পড়লো গৌতম | সেই বিশ্রী ঘটনার পরে ঝর্ণা গৌতমের মুখতুতো বোন হয়ে উঠেছিল | ঝর্ণা যেখানে থাকে, সেখানে গৌতম বিনা দ্বিধায় পৌঁছে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায় | কলেজের মেয়েরাও গৌতমকে ভরসা করতো চোখ বন্ধ করে | গৌতম ছিলই এতটা নির্ভরযোগ্য !!


সেই গৌতম বৃষ্টির সেই পড়ন্ত দুপুরে ওদের চারটে মেয়ের মাঝে এসে ঝর্ণাকে বলেছিল, "ঝর্ণা, এই টেবিল থেকে যা তো তোরা | শ্যামলীর সাথে আমার কিছু কথা আছে | "


শ্যামলী বেশ কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিলো, গৌতম তাকে আড়চোখে দেখে বেড়ায় | ঝর্ণা একদিন বলেছিল, "বুঝলি শ্যামলী, তুই বোধহয় আর আমার বন্ধু থাকতে পারবি না রে !! "


"কেন?? বন্ধু থাকবো না কেন?? " অবাকের সুরে প্রশ্ন ছুঁড়ে ছিল শ্যামলী |


"কি করে থাকবি ?? আমার গৌতমদার যে তোকে ভালো লেগে গেছে রে | মাঝেমধ্যেই তোর সম্বন্ধে টুকটাক প্রশ্ন আসছে ওই তরফ থেকে | কলেজ ফাঙ্কশনে তোমার সেই গান "ইয়ে মুলাকাত এক বাহানা হ্যায় " ঝড় তুলে দিয়েছে যে তার বুকে | সাথে সেদিন যখন অফ পিরিয়ডে ক্লাসে বসে "কভি কভি মেরে দিল মে খায়াল আতা হ্যায় ". গাইছিলি .. লক্ষ্য করেছিলি কি, আমার দাদা ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে তোর গান শুনছিলো | অতএব প্রেম জমে ক্ষীর হতে আর বাকি কোথায় আছে বল !! "


তারপর থেকে গৌতমকে আড়চোখে দেখা শুরু করেছিল শ্যামলীও | গৌতমের মতো মানুষকে ভালো না বেসে থাকা যায় না | কিন্তু নিজের মনের কথা কাউকে বলেনি সে | পাছে গৌতম তার কাছে ধরা না দিলে তার ভালোবাসা সবার সামনে খেলো হয়ে যেতে পারে, এই ভেবে | তাই মনের টানটুকুকে সে মনের মধ্যেই বেঁধে রেখেছিলো |


কিন্তু সেদিন সবার সামনে ওভাবে গৌতমের শ্যামলীর সাথে একা কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করায় বুকের মধ্যে একশোটা ড্রাম একসাথে বাজতে শুরু করে দিয়েছিলো শ্যামলীর |


ঝর্ণা টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়ার সময় একটা চিমটি কেটে গেল শ্যামলীকে | টেবিলে উপস্থিত সবাই বুঝতে পারছিলো, আর কিছুক্ষন বাদে কি হতে চলেছে |


গৌতম খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ছুঁড়লো শ্যামলীর দিকে, " সিঙ্গারা খেতে ভালো বাসো তো ?? "


শ্যামলী কিছু বলার আগেই সে আবারও বলে উঠল, "আমি জানি, সিঙ্গারা খেতে ভালোবাসো তুমি | ক্যান্টিনে এলেই তো সিঙ্গারা আর চা ছাড়া কিছু খাও না !! খুব ভালোবাসো সিঙ্গারা, তাই না ?? "


শ্যামলী সিঙ্গারার প্রতি নিজের টানটাকে লুকোনোর জন্য বলল, "ক্যান্টিনে আর কি খাবো ?? অল্প পয়সায় এটাই পেট ভরায় যে | "


"আই, মিথ্যে বলবে না | শুধু রমেনদার ক্যান্টিন কেন, তুমি তো তোমাদের পাড়ার বিশু শীলের দোকান থেকে সিঙ্গারাই খাও, চপ তো খাওয়া না কখনো | "


শ্যামলী অবাক হয় | তার মানে গৌতম তার পাড়া অব্দি ধাওয়া দিয়েছে !!


সে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই গৌতম বলল, "জানো, আমারও না, সিঙ্গারা খুব প্রিয় !! গরম গরম ধোঁয়া ওঠা সিঙ্গারা মুখে পুরে দেওয়ার যে আনন্দ, তা ওই চপ ঠপে নেই, তাই না ?? "


শ্যামলী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে | গৌতম কি তার সাথে সিঙ্গারার গল্প করতে এসেছে !!


ঠিক এমন সময় গৌতম হাঁক ছাড়লো, "ও রমেনদা, দুটো করে সিঙ্গারা দু জায়গায় পাঠাও তো এই টেবিলে | আর ওই ঝর্ণাদের টেবিলেও দিও | "


গৌতমের হাঁক দেওয়ার মিনিট দু তিনেকের মধ্যেই ক্যান্টিনের বয় মানিক নিয়ে এল সিঙ্গারার প্লেট | শ্যামলী চুপ করে বসে রইল | গৌতম না বললে বা না খাওয়া শুরু করলে সিঙ্গারায় মুখ দেওয়া যায় না | সিঙ্গারার গন্ধে ক্ষিদে পাচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু রাগও হচ্ছিলো গৌতমের উপরে | কি ভাবলো শ্যামলী, আর গৌতম কি সব করে যাচ্ছে!!


এমন সময় গৌতম বলে উঠল, "আমার মা বলেন, "তোমার পছন্দ, অপছন্দ, রুচি, অরুচি যার সাথে মেলে, জানবে সে তোমার সুহৃদ | তার সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে হলে তাকে কিছু উপহার দাও, সেটা দামী না হলেও চলবে, কিন্তু সেটা তার খুব প্ৰিয় আর পছন্দের হতে হবে | ".... তাই এই রাস্তাটা ধরেছি | চার পাঁচটা টিউশনি করে যে রোজগার করি তাতে তোমায় তোমার দামী পছন্দের জিনিস দিতে পারবো না | তাই সস্তার পছন্দটা বেছে নিলাম | সিঙ্গারা তোমারও প্রিয়, আমারও | তাই সিঙ্গারা খাইয়ে প্রপোজ করছি তোমায়, " কলেজ পাশ করে চাকরি পেলে বিয়ে করবে আমায় ?? যতদিন না চাকরি পাই, ততদিন এই সিঙ্গারা খেয়েই প্রেমটা চালিয়ে যাবো আমরা | রাজী আছো কি, সারাজীবন আমার সাথে এমন বৃষ্টিমুখর দিনে সিঙ্গারা খাওয়ার সঙ্গী হতে ?? "


শ্যামলী বুঝতে পারছিলো না, গৌতম তাকে প্রপোজ করছে, নাকি একসাথে সিঙ্গারা খাওয়ার চুক্তি করছে | কিন্তু ভালো লাগছে, এমন বৃষ্টিমুখর দিনে এমন একজন দিলখোলা মানুষের সাথে নিজেকে বেঁধে নিতে |


সে হেসে বলল, "তোমায় কে বলল, আমি সিঙ্গারা খেতে ভালোবাসি ?? "


গৌতম ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে বলল, "এক বছর ধরে লক্ষ্য করছি তোমায়, সিঙ্গারা ছাড়া আর কোনো তেলেভাজা তো খাওয়া না তুমি | "


তারপর একটু থেমে বলল, "আর এটাও লক্ষ্য করেছি, শুধু আমি না, তুমিও আমাকে আড়চোখে দেখো | জানি, মেয়েরা প্রেম নিবেদন করতে পারে না | তাদের হয়তো সম্ভ্রমে বাধে | তাই আমিই এগিয়ে এলাম | কলেজের সেক্রেটারি আমি, তাও নিজের ইমেজ সরিয়ে নিজে থেকেই ধরা দিতে এসেছি তোমার কাছে | এবার অন্ততঃ হাঁটু মুড়ে বসতে বলো না আমায় | সেটা করতে গেলে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে | "


শ্যামলীর মনে হতে লাগলো, মুহুর্ত দেরী না করেই গৌতমের কাছে ধরা দেয় সে | তবুও মজা করার ইচ্ছেয় সে বলল, "আমার একজন আছে | তাই তোমায় "হ্যাঁ" বলতে পারলাম না | "


"মিথ্যে কথা একদমই নয় শ্যামলী | তোমার সবটুকু জেনেই তোমার কাছে এসেছি | আমি তোমার মনের খবর জানি | তোমার চোখের ভাষাও পড়তে পারি | ছেলেরা বিয়ে করার সময় মায়ের অনুমতি নিয়ে বিয়ে করতে যায় | আমি আজ মাকে বলে এসেছি, খুব শিগগির মায়ের সাথে তোমাকে দেখা করাবো | অতএব যদি চালাকি করো, তাহলে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো তোমাকে | "


আর নিজেকে বেঁধে রাখেনি শ্যামলী | চোখের ভাষা দিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল গৌতমের ভালোবাসাকে | ওদের প্রেম শুরু হওয়ার উপলক্ষ্যে গৌতম সবাইকে সেদিন রমেনদার সিঙ্গারা ট্রিট দিয়েছিলো |


সেই থেকে গরম সিঙ্গারা ওদের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেল | দুজনে ঘুরতে বেরোলে চপ, রোল বাদ দিয়ে সিঙ্গারা খেত | শ্যামলী গৌতমের বাড়ি গেলে বা গৌতম শ্যামলীর বাড়িতে গেলে সঙ্গী থাকতো এক ঠোঙা গরম সিঙ্গারা | এমনকি যেদিন গৌতম পুলিশের চাকরি পেয়েছিলো, বা যেদিন গৌরবের অস্তিত্বের খবর জানতে পেরেছিলো গৌতম, সেদিনটিও সেলিব্রেট করা হয়েছিল গরম সিঙ্গারা দিয়ে | দুটো মানুষের একই পছন্দ দুজনের ভালোলাগা, ভালোবাসাকে আরও একাত্ম করে তুলেছিল |


তাই দুষ্কৃতীদের হাতে যখন খুন হয়ে গেল গৌতম, যখন গৌতমের মা তার অন্তসত্ত্বা বৌমাকে বলেছিলেন, "গৌতম চলে গেলেও তোকে রেখে গেল আমার কাছে | তুই আমার কাছে বৌমা হয়ে নয়, মেয়ে হয়ে থাকবি | তাই কোনো বৈধব্য নিয়ম তুই মানবি না | "


শাশুড়ির কথা শুনে সব কিছুকে নিজের জীবনে বহাল রেখেছিলো শ্যামলী, এমনকি লাল রঙটাকেও | শুধু ত্যাগ দিয়েছিলো গরম বা ঠান্ডা সিঙ্গারাকে | অতি প্রিয় ওই খাদ্যটাকে ভালোবাসার নামে ভালোবাসার মানুষটাকে উৎসর্গ করেছিল সে | গৌতমের প্রতি তার আজীবন ভালোবাসার এটাই ছিল অর্ঘ্য |


গৌরব হওয়ার পরেই শ্বশুর শাশুড়ি জোর করেছিলেন শ্যামলীকে নতুন করে জীবন শুরু করতে | কিন্তু শ্যামলী নিজে থেকেই আর সেই পথে হাঁটেনি | গৌতমের ভালোবাসা পাওয়ার পরে দ্বিতীয় কাউকে শরীর কেন, মন দেওয়াও বড়ো কঠিন হয়ে যেত তার পক্ষে!!


আজ কত বছর বাদে নাতি সৌমাল্যর কনভোকেশনে এসেছে শ্যামলী | বয়স হয়ে গেছে বলে আসতে চেয়েছিলো না সে | কিন্তু সৌমাল্য তার ঠাম্মিকে বলেছে, "এটা তো হবে না গার্লফ্রেন্ড | বয়ফ্রেন্ডের এই স্পেশাল দিনে তুমি থাকবে না, তা কি করে হয় !! "


হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকে সৌমাল্য নিজের ঠাকুমাকে গার্লফ্রেন্ড বলেই ডাকে | শ্যামলীও তার আদরের নাতিকে ডাকে বয়ফ্রেন্ড বলে | সেই নাতি বর্তমানে তার প্রেমিকার সাথে শ্যামলীর আলাপ করিয়ে দেবে বলে জোর করে নিয়ে এসেছে কলেজের সমাবর্তনে | অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে কলেজের ক্যান্টিনে এনে ঠাকুমাকে গরম সিঙ্গারা জোর করে হাতে দিয়ে বলেছে, "একদিন দাদু তোমায় সিঙ্গারা খাইয়ে প্রপোজ করেছিল | আজ আমিও তোমায় সিঙ্গারা খাওয়াতে চাই গার্লফ্রেন্ড | দাদু তোমার বয়ফ্রেন্ড ছিল | আমিও কি তোমার বয়ফ্রেন্ড নই ?? দাদুকে ভালোবেসেই কি তোমার পরম পছন্দের খাবারটাকে আবার ফিরিয়ে আনা যায় না গার্লফ্রেন্ড ?? অন্ততঃ আমার জন্য ?? "


আর না করেনি শ্যামলী | দীর্ঘ পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের বিচ্ছেদের পরে নতুন বয়ফ্রেন্ডের আবদারে আবার গরম সিঙ্গারা আস্বাদন করছেন তিনি | সিঙ্গারার সাথে গৌতমও যেন কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে শ্যামলীর সমস্ত অন্তরে !! এরই নাম বোধহয় ভালোবাসা, যা জেদ বা নিয়মে না,, বাঁধা থাকে শুধু আবেগে !


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance