Ananya Podder

Romance Classics Others

3  

Ananya Podder

Romance Classics Others

ক্ষত

ক্ষত

6 mins
304


ঘাটকাজের সব সেরে উঠে বিকেলে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে শাশ্বতীর চোখে পরে উজানকে | আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের গালের গভীর ক্ষতটাকে দেখে চলেছে | এই ক্ষতচিহ্ন রোজ দেখা যায় না, কারণ ট্রিম করা দাঁড়ির আড়ালে সেই ক্ষতকে সযত্নে লালন করে উজান | প্রসাধনী বা সাজের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে শরীরে আর মনে বয়ে বেড়ায় সে | হয়তো বা শাশ্বতীর চোখকে আড়াল করতেও এই সাজের সাহায্য নেওয়া | কিন্তু আজ আর তাকে আড়াল করে রাখা যায়নি | উজানের বাবা মারা যাবার পরে শ্রাদ্ধাদির যে নিয়মকানুনগুলো করতে হয়, সেই নিয়মগুলো মানতে গিয়েই বিসর্জন দিতে হয়েছে চুল, দাঁড়ি আর নখ | আর তাতেই বেরিয়ে এসেছে পুরোনো স্মৃতি |


উজানকে শাশ্বতী আজ থেকে চেনে না | চেনে সেই ছোটবেলা থেকেই | শাশ্বতীর বড়ো মামী উজানের মেজো পিসি হন | সেই সূত্রেই একে অপরকে জীবনের অনেক শুরুর থেকেই জানা | আর জানা জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকেও |


উজান ভালো বাসতো কলেজের তার থেকে দু বছরের জুনিয়র মুসকানকে | আর সেটাই ছিল উজানের জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল | দুটি আলাদা ধর্মের মানুষের প্রয়োজনে রক্ত আদানপ্রদান হতে পারে, কিন্তু মন বিনিময় নিষিদ্ধ !! তাই কোনো পরিবারেই গ্রহণ হয়নি উজান - মুসকানের ভালোবাসা | কলেজে পড়তেই শুরু হয় অশান্তি | তবুও সবার অলক্ষ্যে নিজেদের প্রেমটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো ওরা | মাস্টার্স শেষ করে উজান চাকরি পাওয়ার পরে দুজনেই ঠিক করে, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে |


কিন্তু শেষমেশ আর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি | মুসকানের বাবা, জ্যাঠা, দাদারা খবরটা জানতে পেরে ধাওয়া করে ওদেরকে | অন্য জাতের ছেলে ঘরের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, এটা মানতে পেরেছিলো না মুসকানের দাদারা | মাঝপথেই মেরে ফেলতে চেয়েছিলো ওদের দুজনকেই | তাই গাড়ির ধাক্কায় পিষে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া দুটো মানুষকে | তাতেই গভীরভাবে আহত হয় দুজন | সেই ঘটনারই চিহ্ন হিসেবে গভীর ক্ষত তৈরী হয়েছিল উজানের গালে | হেলমেটের কাঁচ ভেঙে ঢুকে গিয়েছিলো গালের বেশ কিছু জায়গায় | তার মধ্যেই একটি ক্ষত চিরকালের জন্য রয়ে গেল উজানের জীবনে |


সেদিন এক্সিডেন্টের অজুহাতে যখন ওদেরকে মেরে ফেলতে পারলো না, তখন পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশ কাস্টডিতে মেরে ফেলার প্ল্যান করে মুসকানের বাড়ির লোক | সেই সময় উজানের মৃত্যুর সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে ছিল মুসকান, বলেছিল, "উজানকে ছেড়ে দাও তোমরা | আমি তোমাদের সাথে ফিরে যাচ্ছি তোমাদের ঘরে | "


তারপর উজান বহু চেষ্টা করেও আর দেখা করতে পারেনি মুসকানের সঙ্গে | মুসকান উজানের প্রাণ বাঁচাতে নিজের থেকে দূরে রেখেছিলো তার প্রাণপ্রিয়কে | কিন্তু তবুও সে ভালোবাসা তখনও কবর চাপা পড়েনি, তুষের আগুনের মতো জ্বলছিল দুজনের বুকেই |


শেষপর্যন্ত অবশ্য সেই প্রেমকাহিনীর ইতি টানলো মুসকান নিজেই | তার বাড়ির লোকেরা তার বিয়ে ঠিক করলে মুসকান আত্মহত্যা করে বাড়ির লোককে বুঝিয়ে দিয়ে যায়, তার কাছে জীবনের আরেক নাম উজান | যে জীবনে উজান নেই, সেই জীবন থাকার চেয়ে মৃত্যু অনেক প্ৰিয় তার কাছে |


উজানের জীবনের এত নিষ্ঠুর ঘটনার সাক্ষী ছিল শাশ্বতী | উজান হয়তো নিজেও মরে যেত যদি না তখন উজানের মায়ের স্ট্রোকটা হোতো | মাকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের মনটাকে মেরে নিজের শরীরটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো উজান | বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিলো, "আমাকে কোনোদিন বিয়ের জন্য জোর করবে না তোমরা | "


তবুও শাশ্বতী, উজানের বিয়ে হয় | বলা যায়, এই বিয়েটাও একটা দুর্ঘটনা |


শাশ্বতীর সাথে ওর বাবা মা যে ছেলেটির সম্বন্ধ করেছিলেন , সেই ছেলেটি আবার নাকি একটি মেয়ের সাথে প্রেম টেম করে শেষে তাকে ল্যাং মেরে বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে আসছে | বিয়ের দিন শাশ্বতীর কাছে সেই মেয়েটি একেবারে সশরীরে হাজির তার আর শাশ্বতীর হবু বরের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি আর কিছু প্রেমপত্র নিয়ে | মেয়েটি কান্না ভেজা গলায় অনুরোধ করে শাশ্বতীকে , "প্লিজ, এ বিয়ে আপনি করবেন না | "


সবকিছু জেনে শুনে আর সেই পাত্রকে বিয়ে করা যায় না ভেবে বিয়ে থেকে সরে আসার মনস্থির করে শাশ্বতী | বাবাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সে , "যে ছেলে পাঁচ ছ' বছরের প্রেমকে অমর্যাদা করে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, সে যে ভবিষ্যতে আমার সাথেও প্রতারণা করবে না, তার কি মানে আছে | অতএব, এই পাত্রকে বিয়ে করা সম্ভব নয় | "


সেই প্রতারক পাত্রটিকে বিদায় করার পরেও একটা সমস্যা থেকে যায় | তাহলে বিয়ের লগ্নে শাশ্বতীকে বিয়ে করবে কে ??


শাশ্বতী খুব আধুনিক চিন্তাধারার মেয়ে | সে জানালো, "বিয়ে না হলেও কিছু যায় আসে না আমার | আজকের যুগে লগ্নভ্রষ্টা কনসেপ্টটা খুব ব্যাকডেটেড | ওটাকে নিয়ে কেউ আজকাল মাথা ঘামায় না | "


তবুও শাশ্বতীর ঠাকুমা বললেন, "না, এই লগ্নেই তোমার বিয়ে হবে | "


এখন, লগ্নভ্রষ্টা না হবার জন্য যে কোনো ছেলেকে তো আর শাশ্বতীর জীবনসঙ্গী করে দেওয়া যায় না | তাই, সেই দুর্ভাবনার দিনে এগিয়ে এসেছিলো উজান | নিজের পিসির কাছে গিয়ে বলেছিল, "তোমাদের সবার আপত্তি না থাকলে শাশ্বতীকে আমি বিয়ে করতে পারি | "


শাশ্বতীদের গোটা পরিবার উজান - মুসকানের বিষয়টা জানার পরেও উজানের সাথে শাশ্বতীর বিয়ে দিতে অস্বীকার করেননি | কারণ, উজান কতটা পরিবার ও সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়, সেটা সবার জানা ছিল |


তাই দুর্ঘটনার অছিলায় বিয়ে হয়ে গেল উজান আর শাশ্বতীর |


বিয়ের পরে একে অপরের কাছে আসতে বহু সময় লেগে গিয়েছিলো দুজনের | কিন্তু শাশ্বতী জানে, মুসকান আজও উজানের মন জুড়ে রয়ে গেছে | জীবনের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও উজান অবচেতনায় শাশ্বতীকে মুসকান বলে ডেকে উঠেছে বেশ কয়েকবার | সেই ডাক শাশ্বতীর মনকে ক্ষতও করে গেছে গভীরভাবে, কিন্তু মুখের হাসি আর মনের ভালোবাসার ছোঁয়ায় সেই ক্ষতকে মেকআপ করার চেষ্টাও করেছে সে | নিজেকে বুঝিয়েছে, উজানের মনের ক্ষত তার ক্ষতের চেয়ে আরও অনেক বেশি বেদনাদায়ক |


সময়ের প্রলেপে উজানের জীবনের ক্ষত প্রায় সেরে গেলেও সেই ক্ষতের দাগকে সযত্নে নিজের চেহারায় সাজিয়ে রেখেছিলো উজান | প্রসাধনী, আর সাজ হিসেবে অবলম্বন করেছিল ট্রিম করা দাঁড়ির | তার পিছনেই লুকিয়ে থাকতো উজান - মুসকানের ভালোবাসার কাহিনী |


আজ প্রায় সতেরো আঠেরো বছর বাদে সেই ক্ষত নতুন করে উন্মোচন হোলো দাঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে | গালের সেই ক্ষতটার উপর হাত বুলিয়ে উজান হয়তো কিছুক্ষনের জন্য খুঁজে পেতে চাইছে হারিয়ে যাওয়া মুসকানকে | শাশ্বতী আর ঘরে ঢুকলো না | দরজার বাইরে থেকেই ফিরে গেল | কিছুটা সময় দিয়ে গেল উজানকে তার অতীত জীবনের মাঝে ডুবে থাকতে |


উজান স্বামী হিসেবে যেমন ভালো, তেমনি বন্ধু হিসেবেও তার দান অস্বীকার্য | সময়ের স্রোতে সে এখন শাশ্বতীর প্রেমিকও বটে | শাশ্বতীকে মন প্রাণ দিয়েই ভালোবাসে সে | হয়তো মুখে বলে না, কিন্তু শাশ্বতী অনুভব করে সেই ভালোবাসাকে | ভালোবাসা না থাকলে শুধু দায়িত্বের নামে একটা মানুষ আরেকটা মানুষের জন্য এতটা করতে পারে না |শাশ্বতী সম্ভ্রম করে উজানের ভালোবাসাকে | যে মানুষটা তার প্রথম ভালোবাসাকে যত্ন করে মনে লালন করতে পারে, সেই মানুষটা আর যাই হোক, প্রতারক নয় | আজকের যুগে তো স্ত্রী থাকতেও কত পুরুষ অন্য নারীতে আসক্ত হয় | অথচ উজান মনের মধ্যে থাকা মুসকানকে ভালোবেসেও শাশ্বতীর মুখে হাসি ফুটিয়ে চলেছে | হয়তো শাশ্বতীর মুখের ওই তৃপ্ত হাসিটার মধ্যেই জাগতিক মুসকানকে খুঁজে পায় উজান !!


তাই শাশ্বতী আর বিরক্ত করল না উজানকে | যে কারণে ঘরে এসেছিলো সে, সেই কাজ কিছুক্ষন বাদে সারলেও হবে | আজ এই মুহূর্তটুকু সে উজানকে তার ক্ষতের স্মৃতির সাথে থাকতে দিতে চায় | উজান তো তারই রয়ে যাবে চিরকাল | মুসকানের ভালোবাসার এই ক্ষতস্মৃতি আর ক্ষণকাল পরেই তো লুকিয়ে যাবে ট্রিম করা দাঁড়ির আড়ালে | তাই আজ ভালো থাক উজান, ভালো থাক তার ভালোবাসার ক্ষতটুকু নিয়ে |


সমাপ্ত

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance