Ananya Podder

Tragedy Classics

4  

Ananya Podder

Tragedy Classics

অন্যরকম মাতৃত্ব

অন্যরকম মাতৃত্ব

7 mins
543


ডেডবডি নিয়ে যেতে এখনও কিছুটা সময় বাকি | বাড়ি ভর্তি লোক,, সবাই আসছে ঘোষাল বাড়ির একমাত্র ছেলে সঞ্জয়ের মৃত্যুর খবরে মৃন্ময়ীকে সান্ত্বনা দিতে | কিন্তু মৃন্ময়ীর চোখে জল নেই | আজ দুপুরের পর থেকেই বড়ো ধকল যাচ্ছে তার | সঠিক সময় বলতে গেলে বলতে হয়, ঠিক আজ দুপুর থেকে নয়, শরীরটা ধকল সইছে আগের রাত থেকেই | ভয়ে সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেননি মৃন্ময়ী | সঞ্জয়ের ঘর থেকে রঞ্জনা আর পালকের বিরক্তিমাখা শব্দ শুনে আরও কান খাঁড়া করে রাখতে হয়েছে তাকে | একটাই আতঙ্ক,.... এই বুঝি সঞ্জয় ওদের গায়ে হাত তুলে বসলো !!

' সঞ্জয় '-- মৃন্ময়ীর সর্বশেষ সন্তান ও ঘোষাল বাড়ির একমাত্র ছেলে | দুই মেয়ের পরে মৃন্ময়ীর কোলে সঞ্জয় আসাতে বাড়ির সবার মুখে হাসি ফুটেছিলো | দুই মেয়ে হবার পরে মন্দিরে মন্দিরে মাথা ঠোকার ফল নাকি সঞ্জয় | তাই বাড়ির ভালোবাসার কেন্দ্রই ছিল সেই বংশের প্রদীপ |

লেখাপড়ায় বেশ ভালো থাকাতে কস্টিং পাশ করে একটি নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে ঢোকে সঞ্জয় | বাড়ির সবার চোখের মণি সে | চাকরির সাথে সাথে অর্থ, প্রতিপত্তি, সামাজিক সম্মান এনে দেওয়ায় সঞ্জয়ের দাম যেন আরও বেড়ে গেলো পরিবারে | তার সিদ্ধান্ত, তার দাবীর উপরে কোনো কথাই চলে না সেখানে |

সঞ্জয়ের দুই দিদি, নীতা আর রীতাও ছোটভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে কাতর | মাঝমধ্যেই মূর্ছা যাচ্ছে বড়ো বোন নীতা | ছোটবোন রীতা কেঁদে চলেছে, "সামনের ভাইফোঁটায় আর কাকে ফোঁটা দেবো রে ভাই ?? কেন এভাবে চলে গেলি ?? কার অভিশাপে এমনভাবে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লি তুই ?? "

রীতার আকুল আর্তনাদের শেষ লাইনটা বুক কাঁপিয়ে দিলো মৃন্ময়ীর | কার অভিশাপে তার আদরের ছেলের এমন অকালে চলে যাওয়া ??

মনে পড়লো, তার সঞ্জয় স্বাভাবিক মানুষ ছিল না | বিভিন্ন ধরণের নেশার কবলে পড়ে নিজের ও স্ত্রী সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করছিলো একটু একটু করে | সঞ্জয় যে মানসিক ভাবে রোগগ্রস্ত, সেটা উপলব্ধি করতেন মৃন্ময়ী | একেবারে সাদামাটা বাড়ির মেয়ে রঞ্জনা বৌ হয়ে এসেছিলো বলেই বোধহয় সঞ্জয়ের সাথে এতগুলো বছর ঘর করে গেলো নিঃশব্দে | স্বামীকে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মৃন্ময়ী, " একবার কি ছেলেটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া যায় না ?? "

কিন্তু মৃন্ময়ীর স্বামী সনাতন ঘোষালের একটাই কথা," যে ছেলেটা এতো বড়ো কোম্পানিতে কাজ করে যাচ্ছে, তাকে তুমি পাগল বলো কি করে ?? সব স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই সমস্যা থাকে | ওদের ব্যাপারে নাক গলিও না তো তুমি | আর যদি পারো, তবে তোমার আদরের বৌমাকে বলো, একটু স্বামীকে যেন মেনে চলে | এতো নারীবাদী না রঞ্জনা, কি বলবো !! সবসময় নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার চেষ্টা !!.... এই জন্যই বলেছিলাম, চাকরি করা মেয়েকে ঘরের বৌ করে এনো না | তা, তুমি শুনলে তো সেসব কথা!!.... সংসার করতে গেলে যে একটু আধটু অ্যাডজাস্টমেন্টও দেখাতে হয়, সেটাই তো জানেনা তোমার আদরের বৌমা !! "

অ্যাডজাস্টমেন্ট কাকে বলে ?? নিজের আত্মসম্মানকে একজনের হাতে পিষে মেরে ফেলা ?? প্রতি রাতে স্বামীর মদের গ্লাস সাজিয়ে দেওয়া, স্বামীর সব হুকুম চুপ করে মেনে নেওয়া সে যতই শরীর খারাপ থাকুক না কেন ?? এসব অ্যাডজাস্টমেন্ট তো রঞ্জনা করেছে,, মুখ বুজেই করেছে |

মৃন্ময়ী জানেন, তার ছেলের মধ্যে প্রচন্ড দাম্ভীকতা ছিল, ছিল নিজের পছন্দমতো সবকিছু আদায় করে নেবার জেদ | স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেরটুকু বুঝে নেওয়ার অভিলাষায় সে ভুলে যেত যে, সে কারোর স্বামী, কারোর বাবা |

নেশায় চুর হয়ে ঘরের মধ্যেই চলতো রঞ্জনার সাথে মানসিক অত্যাচার, সাথে কখনো কখনো বা গায়েও হাত তোলা, মুখে অজস্র গালিগালাজ | ভদ্রবাড়ির বৌ অনেক রাত্রেই নিঃশব্দে নির্যাতিত হতো | সকালে উঠে ফোলা চোখ আর একগাল হাসি নিয়ে সবাইকে জানান দিতো, "আমি খুব ভালো আছি | "

কিন্তু গতরাত্রে ঘটে গেলো ভয়ঙ্কর রকমের ঘটনা | মায়ের উপরে বাবার অযাচিত দাবীকে প্রশয় দেয়নি কৈশোরে পা রাখা পালক | প্রতিবাদের ভাষায় গর্জে উঠেছিল মায়ের প্রতি তার ভালোবাসা | সেখানেই বড্ড ঠুনকো হয়ে যায় সঞ্জয়ের পৌরুষ | বাবা হিসেবে সন্তানের কাছে দাম কম পাওয়াতে সঞ্জয় পালককে বলেছিল, "তুই মরে যাস না কেন ?? মরে গেলেই তো পারিস তুই !! "

বুক কেঁপে উঠেছিল রঞ্জনার | রেগে গিয়ে স্বামীকে বলেছিল, "আর কত নিচে নামবে তুমি ?? "

বাবার এমন তীক্ষ্ণ বাক্যবানে পালক তখন বাক্যহারা | নিঃশব্দে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে তার | রঞ্জনা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, " তুই ঘুমো, কারোর কোনো কথা কানে নিবি না তুই | তোকে এখনও জীবনের অনেকটা পথ চলতে হবে | পৌঁছতে হবে তোর দেখা স্বপ্নের ভূমিতে | "

পরেরদিন সকালে উঠে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে ঠাকুঘরে বসে কাঁদতে কাঁদতে রঞ্জনা বলেছিল, "ভগবান , এ অত্যাচার আর যে সহ্য হয় না | যতদিন আমার উপরে অত্যাচার হয়েছে, আমি সহ্য করেছি, কিন্তু আজ আমার মেয়েটা কাঁদছে | তুমি কি এর কোনো বিহিত করবে না ভগবান?? আমি যে মেয়ের চোখের জল আর দেখতে পারি না | আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ফেলো | হয় আজ আমাকে মারো, নয়তো ওকে মারো | এভাবে আর একসঙ্গে বেঁচে থাকা যায় না !! " .... তারপরেই মুখে একটাও ভাতের দানা না তুলে অফিসের পথে পা বাড়িয়েছিল রঞ্জনা |

মৃন্ময়ী রঞ্জনার হাত দুটো ধরে বলেছিলেন , "খালি মুখে ঘরের লক্ষ্মী বেরোয় না রঞ্জনা | একটু কিছু মুখে দিয়ে যাও, নাহলে সংসারের অমঙ্গল হবে | "

অভিমানী রঞ্জনা শাশুড়ির হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে বলেছিল, " এ সংসারে অমঙ্গল হতে আর কি বাকি আছে মা ?? "

মৃন্ময়ীর বুক কেঁপে উঠেছিল | ঠাকুর ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রঞ্জনার মনের ব্যথা তিনি শুনেছিলেন | সত্যিই যদি ঈশ্বর রঞ্জনার কথা শুনে ফেলেন, তাহলে কি হবে আজ ??

দুপুরবেলার একটু আগে ছেলের ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢোকেন মৃন্ময়ী | আগের দিন আকণ্ঠ পান করেছে সঞ্জয় | আজ আর অফিস যাবে না সকালে | ইভনিং শিফ্টে হয়তো অফিস যাবে আজ | তাই দুপুরের একটু আগে ছেলেকে ডাকতে গেলেন তিনি দুপুরের খাবার দেবেন কিনা জিজ্ঞেস করতে | দেখলেন, সঞ্জয়ের গা-টা মারাত্মক রকমের ঠান্ডা | সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে ডাকলেন | সঞ্জয় কি কি ওষুধ খায়, জানা নেই দুজনের কারোরই |

রঞ্জনাকে ফোন লাগালেন মৃন্ময়ী, 'নট রিচেবল' বলছে ফোনটা | আজ যেন রঞ্জনার সাথে সাথে সমস্ত প্রকৃতিও চাইছে, সঞ্জয়ের সব দায়িত্ব থেকে রঞ্জনাকে অব্যাহতি দিতে |

সনাতন বাবু পাশের বাড়ির কাজলকে ডাকলেন | কাজল আসার পরে সনাতন বাবু কাজলকে বললেন, "একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা কর তো কাজল, সঞ্জয়কে নার্সিংহোমে নিয়ে যাবো |"

কাজল সঞ্জয়কে দেখে কি বুঝলো কে জানে, বলল, "কাকু, আমার মনে হয়, বাড়িতেই ডাক্তার ডাকা ভালো | দাঁড়ান, পল্লবকে ফোন করি, অতনুডাক্তারকে যদি একবার বাড়ি নিয়ে আসতে পারে | অতনু ডাক্তার এখন চেম্বারেই আছে | "

ক্লাবের বেশ নামকরা লোক ছিল সঞ্জয় | তাই, তার জন্য ক্লাবে চ্যারিটি করা অতনু ডাক্তার পল্লবের সাথে মিনিট দশেকের মধ্যেই সঞ্জয়কে দেখতে এলেন | এসে পরীক্ষা করে বললেন, "সব শেষ | প্রায় ঘন্টা খানেক আগেই কার্ডিয়াক আরেস্ট এর ধাক্কায় সঞ্জয়ের মৃত্যু হয়েছে | অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে অস্বাভাবিক প্রেসারের জন্য এমন দুর্ঘটনা | "

অতনু ডাক্তার বললেন, "চার ঘন্টা হয়ে গেলে আমি আরেকবার এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে যাবো |"

সব শেষ হয়ে যাবার খবরটা রঞ্জনাকে দেওয়ার জন্য আরেকবার ফোন করলেন সনাতনবাবু, কিন্তু এবারেও সেই একই উত্তর -- "নট রিচেবল" |

মৃন্ময়ী বললেন, "সঞ্জয়ের ফোনে রঞ্জনার অফিসের নাম্বার আছে, আমি জানি | সেখানে একবার চেষ্টা করে দেখছি আমি | "

পল্লব বলল, "আমি ফোন করে দিচ্ছি কাকিমা | "

মৃন্ময়ী বললেন, "না থাক, আমিই ফোন করছি |"

রঞ্জনার অফিসে ফোন করে মৃন্ময়ী রঞ্জনাকে বললেন, "পালককে নিয়ে বাড়ি চলে আসো রঞ্জনা | আজ কিছুক্ষন আগে ঘোষাল বাড়ি অশান্তি থেকে মুক্ত হয়ে গেলো | "

ফোনের ওপার থেকে রঞ্জনার গলাটা একবার ডুকরে উঠেই আবার মিলিয়ে গেলো যেন | শোনা গেলো নিঃশব্দে রেখে দেওয়া রিসিভারের আওয়াজ |

পালককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ঢুকে একফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি রঞ্জনা | পালকও যেন মাকে সঙ্গ দিতে সব দুঃখ, সব কান্নাটুকুকে নিঃশব্দে পান করে যাচ্ছে | উফ, এইটুকু মেয়ের কি অসীম ক্ষমতা বেদনা লুকোনোর | শত হলেও বাবা তো !! তবুও আজ যেন ভেঙে না পড়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে পালক |

রঞ্জনার মুখের দিকে তাকিয়ে তার শুকনো স্থির চোখ দেখে মৃন্ময়ী বুঝেছেন, ভিতর থেকে কতটা ভেঙে চলেছে রঞ্জনা !! তবুও যেন রোজকার অপমান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার মুহুর্তটাকে সে কেঁদে আর অপমানিত করতে চাইছে না | তাই আজ, মৃন্ময়ীর নিজেরও বুক ফেটে গেলেও চোখ ফেটে একফোঁটা জলও বার হতে দেবেননা তিনি |

আজই যে তার মাতৃত্ব দেখানোর সময় | ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে রোজগার করার জন্য উপযুক্ত বানিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু বিয়ে করে কি করে ভালো স্বামী, ভালো বাবা হতে হয়, সে পাঠ তিনি দিতে পারেননি তার ছেলেকে | ছেলেকে শেখাতে পারেননি, বিয়ে করে নিয়ে আসা বৌ কোনো সম্পত্তি নয়, সেও একটা রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ!! শেখাতে পারেননি, দাম্পত্য জীবনটা একটা ধর্ম -- সেটাও যত্নের সাথে, নিষ্ঠার সাথে নিঃস্বার্থ ভাবে পালন করতে হয় |

তাই এতোগুলো না শেখাতে পারার ব্যর্থতা আজ মৃন্ময়ীকে এভাবেই ভোগ করতে হবে | সঞ্জয়কে সুস্থ জীবনের শিক্ষা দিয়ে নিজের মাতৃত্ব দেখাতে না পারলেও আজ রঞ্জনার পাশে দাঁড়িয়ে অন্যরকম মাতৃত্বের পরিচয় রাখবেন তিনি | মেয়েটা এই সংসারে এসে যত কষ্ট পেয়েছে, তার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে ফেরত দেওয়ার জন্য আজ রঞ্জনার নিষ্ঠুর চোখের সাথে মৃন্ময়ীর চোখকেও নিষ্ঠুর হতে হবে | যাতে কেউ এসে বলতে না পারে, "বউটা কি নিষ্ঠুর !! স্বামীর মৃত্যুতে চোখের জলটাও ফেললো না এতটুকু !! "

হলোও তাই, পাশের বাড়ির কাজলের বৌকে মৃন্ময়ী বলতে শুনলেন, "এইভাবে সঞ্জয়দার আকস্মিক চলে যাওয়া মানা গেলো না কিছুতেই | দেখো সঞ্জয়দার চলে যাওয়ায় শোকে কেমন পাথর হয়ে গেছে কাকিমা আর বৌদি | শাশুড়ি - বৌ দুজনেই সব কান্নার বিষ যেন একসাথে ভিতরে ভিতরে গিলে চলেছে |"

মৃন্ময়ী শুনতে পেলেন পল্লবের মা কাকে যেন ডেকে বললেন, "ওদের শাশুড়ি-বৌকে একটু কাঁদাও তোমরা | শোকে তো পাথর হয়ে গেছে মানুষ দুটো!! "

মৃন্ময়ী জানেন, রঞ্জনা আর কাঁদবে না | বিগত অনেকগুলো বছর নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে তার চোখে জল শুকিয়ে গেছে | তাই ছেলেবৌয়ের পাথর হয়ে যাওয়া অনুভূতির সাথে আজ তাকেও সমান তালে তাল মেলাতে হবে | হোক না রঞ্জনা পরের ঘরের মেয়ে, তবুও তো সে তাকে এতো বছর মা বলেই ডেকে এসেছে, মেয়ের মতোই ভালোবাসা দিয়ে এসেছে তাকে |

তাই আজ মৃন্ময়ীরও মা হওয়ার সময় | হোক না সে, অন্যরকম মাতৃত্ব !! রঞ্জনাও তার কাছে সন্তানের চাইতে তো কিছু কম নয় !!

------------------------------------------------------------

সমাপ্ত

©অনুভূতির আঙিনায় ~ কলমে অনন্যা


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy