জাতক
জাতক
আপনারা জানেন, সবাই জানেন------পঞ্চভূতে গঠিত এই দেহ,পঞ্চভূতেই বিলীন হয়। আত্মার আধার এই "দেহ "। আত্মার কর্মস্থল এই "মন"। কিন্তু এদের প্রকৃত স্বরূপ কি ? জীবনের উদ্দেশ্য কি শুধুই বেঁচে থাকা ? আর ধীরে ধীরে বার্ধক্যকে বরণ করে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়া ? পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ শুধুই উপভোগের জন্য ? যতদিন শরীরের সুস্থতা, ততদিনই পৃথিবী সুন্দর ? নাকি এই উপকরণ গুলোই তৈরি করে উপভোগের ইচ্ছে ? আবার একসময় প্রকৃতিক ভাবেই এই ইচ্ছেগুলো চলে যায় বা বিকৃত হয়, এসব নিয়ন্ত্রণের কি কোনো উপায় নেই ?
এই প্রশ্ন গুলোই একসময় ভাবিয়েছিল তাঁকে---------
**********এক*********
------কৃশকায় মুন্ডিত মস্তক, গৈরিক বসন, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, হাতে একটা মোটা গাছের ডাল লাঠির মতো ধরা। চোখদুটি যেন কোন সুদুরের এক আনন্দময় জগতের দৃশ্যে বিভোর ! যেতে যেতে
হেসে বলছেন,
---------- জাতকের গল্প মনে আছে, বিষ্ণুপদ ? শেষ হয়নি, এখনও শেষ হয়নি। অনাদি অনন্ত পৃথিবীর রহস্য বুঝতে হলে, জীবন মৃত্যুর রহস্য বুঝতে হলে আবার -----আবার জাতক হতে হবে--- বার বার ফিরে আসতে হবে------বহু রূপে----বহু ভাবে-----
ওর দিকে হাত বাড়িয়ে মায়া ভরা কণ্ঠে বললেন,
-------হয়তো তোমার মধ্যেই !!
ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়েন বিষ্ণুপদ, ঘামে ভিজে গেছে গা। দক্ষিণের বড়ো বড়ো জানলা ঘরে । হাওয়ার অভাব নেই। তবু যে কদিন ধরে কি হচ্ছে !! রোজ ভোর রাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্নে ঘুম ভেঙে ঘেমে নেয়ে যাচ্ছেন বিষ্ণুপদ। রোজ রোজ একই স্বপ্ন,
*************দুই**************
পর পর কয়েকদিন স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই বিষ্ণুপদর মনে হচ্ছে, এই বনবন্ ঘুরন্ত পৃথিবীতে সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত, ওর চোখের সামনে সব বদলে যাচ্ছে, ও স্থবির, কিচ্ছু করছেনা---করতে পারছে না----সামনে খাদ, পৃথিবীটা গড়িয়ে গড়িয়ে খাদের দিকে চলছে ঝাঁপ দেবে বলে-----
উঠে পড়েন বিষ্ণুপদ। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। মুখ চোখে জল দিয়ে বারান্দায় এলেন।এখান থেকে সামনেটা অনেকটা খালি মাঠ পড়ে আছে। ছেলেরা ফুটবল খেলে। পূর্বদিক,তাই প্রথম সূর্যটা বেশ দেখা যায়। কদিন ধরে কিছু লোকজন আনাগোনা করছে মাঠে, অচেনা মনে হচ্ছে। কিছু মাপ-জোকও করছে।
একটা একেবারে নিজস্ব জায়গা আছে এ বাড়িতে তার। সেটা লাইব্রেরি। অর্থনীতির এই প্রাক্তন অধ্যাপকের কাছে, এখনও ছাত্র-ছাত্রীরা, বেলা একটু বাড়তেই ভীড় করে। এখনও মাঝে মাঝে কলেজ থেকে ডাক আসে তার। লেকচার দিতে হয়।
সেদিনও লেকচার দিতে যেতে হবে, তৈরি হতে হবে। বই খুলে বহুপঠিত অধ্যায়টি আরোও একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। কোনো খুঁত তার পছন্দ নয়।
****************
কলেজের গেটে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে বিনয় বললো,
-------বিষ্ণুদা,মনে হচ্ছে, আবার ঝামেলা---
বিষ্ণুপদও বুঝলেন, কিছু একটা হয়েছে। ওর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলে,
------এরকম তো হয়ই------
গাড়ি থেকে নামতেই, একটি ছেলে বললো,
------ফিরে যান স্যার, আজ ক্লাস হবে না----ভেতরে টেম্পো হট্ আছে-----
ছেলেটিকে ঠিক চিনতে পারেন না বিষ্ণুপদ। জিনসের প্যান্ট আর প্রিন্টেড সার্ট, হাতে ব্যান্ড। কোনোদিন তার ছাত্র ছিল কি ? হয়তো ছিল।
বিষ্ণুপদ কোনো উত্তর না দিয়ে, গেটের দিকে এগিয়ে যান। এবার এগিয়ে এলো একটি মেয়ে, চোখের চশমা মাথার ওপর তোলা, হাতে একটা রুমাল,সেটা ঘোরাতে ঘোরাতে ভীড় সামলাচ্ছিল সে। বললো,
------বুঝে শুনে যান স্যার ! নিজের দায়িত্বে যান ! পরে কিন্তু আমরা আর কিছু করতে পারবো না।
বিষ্ণুপদর রুচি হলো না ওদের সাথে কথা বলার। এগিয়ে গেলেন ভীড় ঠেলে। একটা আমলকি গাছের তলায় বেদির কাছে খুব ভীড়। বেশ চেঁচামেচিও।
ছেলেমেয়েরা সবাই প্রায় অচেনা, আর খুব উত্তেজিত। একটু দূরে বেশ কয়েকজন অধ্যাপককে দেখা গেল, বিপন্নমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
বিষ্ণুপদ ভীড়ের মধ্যে, ঢুকে দেখতে পেলেন, কেউ একজন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন, পাকাচুল বেয়ে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে, মাথা থেকে ঘাড় বেয়ে পিঠে। তিনি আতঙ্কিত স্বরে বললেন,
-------কি ! কি হয়েছে এখানে ?
-------কিছুনা স্যার আপনি যান---
কোনো উত্তর না দিয়ে, বিষ্ণুপদ বসে থাকা মানুষটির কাঁধে হাত রাখতেই, বোঝা গেল উনি অলকেন্দু, বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ।
অলকেন্দু বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
---------আমি শুধু ওদের বেরিয়ে যেতে বলেছিলাম। ওরা জোর করছিলো, নতুন ছেলেমেয়েদের।
কঠিন মুখে বিষ্ণুপদ বললেন,
------ উঠুন----
ছেলেমেয়েরা বাধা দিতে এলে ওদের হাত তুলে থামতে বলেন। একটি মেয়ে অত্যন্ত উদ্ধতভাবে বললো,
--------আমাদের ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না স্যার---ফল ভালো হবে না।
বিষ্ণুপদর মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো, তবুও সংযত হয়ে, অলকেন্দুকে তুলে ভীড়ের বাইরে নিয়ে এলেন। ততক্ষণে পুলিশ এসে গেছে।
********
টিচার্স রুমে তখন ঝড় ----
-----কলেজে পড়ানো এখন যেন ঝকমারি হয়ে গেছে---গর্জে উঠলেন পুলকেশ রক্ষিত।
-------এতো বাইরের ছেলে কেন আসে ?
রমাপদ স্যারের প্রশ্ন---
-------কে বাধা দেবে ! দেখলেন তো অবস্থা----
অজয় ভৌমিক অসহায় রাগে টেবিলে ঘুসি মারেন।
--------সত্যি চাকরি করাই দায়-----
বললেন রাধাকান্ত স্যার, তাঁর আর এক বছর বাকি অবসরের।
বিষ্ণুপদ এইসব কথায় যোগ দিলেননা, উঠে পড়লেন। একবার অলকেন্দুকে দেখতে যাবেন নার্সিং হোমে। মাথায় দুটো সেলাই দিতে হয়েছে, তার। সৎ সাহস কে দেখাবে এখন ? গাড়িতে উঠে বললেন,
------একবার কেয়ার হোমে চলো তো !
কেয়ার হোমে অলকেন্দু মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে শুয়ে আছেন। মিডিয়া ফিডিয়া এসব দেখিয়ে তাদের কর্তব্য সেরে ফেলেছে। বিষ্ণুপদ গিয়ে দাঁড়ালেন মাথার কাছে। প্রচুর রক্তপাতে ক্লান্ত তিনি। চোখ খুলে বললেন,
------ ছেলেমেয়েদের কিচ্ছু শেখাতে পারিনি, জানেন !!
বিষ্ণুপদ তাঁর মাথায় হাত রেখে বেরিয়ে এলেন। "জাতক"-----"জাতক"
----শব্দটা-----দুবার উচ্চারণ করলেন অস্ফুটে।
আজ সারা সন্ধ্যে কাজে মন এলোনা তার। একটা বিরাট অবক্ষয়ের পথে যেতে চলেছে একাংশ। আজ আবার তাঁকে দেখতে পাবেন, খুব আশা বিষ্ণুপদর। সেই সৌম্য কান্তি, অনিন্দ্য ব্যক্তিত্ব কৃশকায় সন্ন্যাসী। ভোর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, এই যা !!
বিষ্ণুপদ আজ একটা সরোদের সুর বাজিয়ে শুয়ে পড়লেন একটু আগেভাগেই। সুরটা বেজে বেজে তার দক্ষিণের ঘরটাকে স্বর্গপুরী করে তুলছে, বিষ্ণুপদ চোখ বুজলেন।
**************তিন*************
হিমালয় পর্বতের কোলে রোহিনী বয়ে চলেছে তার নিজস্ব গতিতে নিজস্ব ছন্দে। তার কোলে কপিলাবস্তু। অপূর্ব নৈস্বর্গিক শোভা, মেঘেরা এখানে রোজ দ্বিপ্রহরে ছায়া ফেলে যায়। প্রকৃতি সেজে ওঠে অপরূপ সাজে।
কিছুদিন ধরে কিছুই ভালো লাগছেনা সিদ্ধার্থের, সেদিন একটা ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে ছন্দক রথ নিয়ে যাচ্ছিল। একটা সমবেত কান্নার রব যেন সিদ্ধার্থের কান থেকে মাথা পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে তুলছিল। ঠিক যেমন হয়েছিল দেবদত্ত যেদিন রাজহাঁসটাকে তীর মেরেছিল। ছটফট করেন সিদ্ধার্থ। প্রতিক্ষণে জীবের মৃত্যু, চারিদিকে এত আর্তনাদ এর মধ্যে এতো বিলাসিতায় মানুষ থাকে কি করে !
জীবনের পরিনতিকে সহজভাবে মনে নেওয়ার একটা সহজ পথ ভীষণ প্রয়োজন......শুধু কিছুকালব্যাপী আরাম কখনও জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে ? কি ভাবে দেহগত এই কষ্ট নিবারণ সম্ভব ! জানতে হবে তাকে জানতেই হবে, তার জন্য পরিচিত সাধারণ গৃহস্থ জীবন থেকে মুক্তি পেতে হবে। ছিঁড়ে ফেলতে হবে বন্ধন।
গোপা আর রাহুল নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক ওরা। সিদ্ধার্থ উঠলেন, তাঁর সিদ্ধান্ত অটল। একবার ছুঁলেন তিনি শিশুপুত্র রাহুলের কপাল।
-----তোমার এই ফুলের মতো দেহ একদিন ব্যাধি, জরা তারপর..... এর হাত থেকে রেহাই দিতেই আমাকে কঠিন হতে হবে,
-------গোপার এই সুন্দর দেহটাও একদিন...... তোমাদের জন্যই, আমাকে ত্যাগ করতে হলো তোমাদের। তবে, আমি ফিরবো আবার, ফিরবো। তোমাদের জাগতিক মায়া কাটিয়ে নিয়ে যাব এক আনন্দময় জগতে।
নিজের রেশমের আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নিলেন। ছন্দক নিশ্চয়ই এসে গেছে এতক্ষণে। তিনি নিঃশব্দে বেরোলেন। রাজপুরী ঘুমে অচেতন, ধীর সাবধানী পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন, তাঁর মন এখন সম্পূর্ণ নিস্তরঙ্গ-----
রাজপ্রাসাদের পশ্চাৎ দ্বারে রথ সাজিয়ে প্রস্তুত ছন্দক। তার মুখে গভীর দুঃখের ছায়া কালো হয়ে আছে।
দুচোখে বাষ্প জমে ধোঁয়াটে দৃষ্টি। সে অপেক্ষা করছে সিদ্ধার্থের। আদেশ পালনে আবদ্ধ ছন্দক।
প্রাসাদের রক্ষীদলকে নির্দেশ দেওয়া আছে। ঐ যে ধীর শান্ত পদক্ষেপে আসছেন সিদ্ধার্থ। গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী, কলোচুল থাকে থাকে নেমে এসেছে পিঠ পর্যন্ত। গায়ের আলোয়ানটা ঝুলছে অবহেলায়।
কাছে এসে বললেন,
-----চলো ছন্দক------
রথ চললো, ভবিষ্যতের পথে। অণোমা নদীর তীরে রচিত হবে ইতিহাস।
*********চার********
বিষ্ণুপদ আবার ঘেমে গেছেন, সরোদ কখন বেজে বেজে থেমে গেছে যেন। নিস্তব্ধ ঘর। ভোর হতে এখনও অনেক দেরি। ঘরটা ভালোভাবে দেখলেন তাকিয়ে, একলা ঘর। বিষ্ণুপদর গার্হস্থ্য আশ্রম। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন, এবার কি বাণপ্রস্থের পালা ? কিন্তু করা হলোনা কিছুই "চলো ছন্দক"---কথাটা কানে বাজতে থাকে।
কেন ? এমন হচ্ছে কেন ? ভাবতে ভাবতে বারান্দায় এসে দেখলেন, পূর্বদিকের মাঠে অনেক মানুষ, অনেক যন্ত্রপাতি, বোঝা যাচ্ছে, মাঠের আয়ু আর বেশিদিন নেই। চারিদিকে বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো গাছ। কাটবে নাকি ? কি যেন হয়ে গেল মাথার মধ্যে, গমগম্ করতে লাগলো, একটা কণ্ঠস্বর ,
----"বার বার ফিরে আসতে হবে, নানা রূপে"
বিষ্ণুপদ চটিটা পায়ে গলিয়ে, যেমন ছিলেন বেরিয়ে গেলেন, দাঁড়ালেন গিয়ে মাঠে লোকেদের মাঝে। কিছু স্থানীয় মানুষ ভীড় করেছে। দেখছে সবাই। বিষ্ণুপদ একটু জোরেই বললেন,
--------কি ব্যাপার ! কি হচ্ছে এখানে ?
এই এলাকায় ওর একটু আধটু নামডাক আছে। দু একজন এসে দাঁড়ালেন পাশে। একজন কেওকেটা টাইপের লোক এগিয়ে এলো, ঠান্ডা চোখে তাকালো, হাসলো একটু,
--------আপনি কে ?
বিষ্ণুপদ দুইহাতে বুক বেঁধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন। বললেন,
---------বিষ্ণুপদ , ভারতসন্তান।
লোকটা হয়তো এরকম কথা আশা করেনি। থমকালো একটু। বললো,
--------আমি বলাই সেন। সবাই "বুল দা" বলেই জানে। এ জমির মালিক আমাকে জমি বিক্রি করে দিয়েছে। আমি ফ্ল্যাট করবো। এনি অবজেক্সন ?
এপাড়ার সবচেয়ে বর্ষীয়ান কমলবাবু, এগিয়ে এসে বললেন,
---------এ জমিটা কিন্তু বিপ্লব সামন্তের বাবা ফুটবল ক্লাবকে দান করেছিলেন। উনি খুব ফুটবল ভালোবাসতেন। আমি জানি।
বিষ্ণুপদ বলাইকে বললেন,
--------একটু কাগজ-পত্র দেখতে চাই। ক্লাবের সদস্যেদর সাথেও কথা বলতে হবে। আপনি কাল সন্ধ্যায় আসুন। এখন যান।
সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
------একটু আসুন তো আমার বাড়িতে---
বুল দা-র লোকেরা পাত্তারি গোটাতে লাগলো। পাড়ার সবাই চললো বিষ্ণুপদর বাড়ি। সবার মুখ গম্ভীর। কল্যাণ বয়সে একটু ছোটো, বললো,
-------ক্লাবের নামে দানপত্র ছিলো। তখনকার কমিটি নিয়েছিলো। এখন তো তারা কেউ নেই। জটিল অবস্থা।
--------এখনকার সেক্রেটারি বিক্রি করে দিচ্ছে। ঘোষবাবু খবর দিলেন।
--------ক্লাবের ছেলেরা রাজি ? বিষ্ণুর প্রশ্ন।
কমলবাবু বললেন,
--------হতে হয়েছে ----প্রোমোটারের সাথে কে লড়াই করবে ?
আরো কিছু আইনী তথ্য জেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ান বিষ্ণুপদ। বলেন,
-------আমি দেখছি , ছেলেদের পাঠাবেন তো একবার !
পরেরদিন বিকেলে মাঠে জড়ো সবাই , বেশ বড়োসড়ো একটা লাল গাড়ি থেকে নামলেন একজন। চেহারা বেশ অভিজাত। সঙ্গে গতকালের লোকটা। অভিজাত চেহারার লোকটা বললো,
--------নমস্কার ! নমস্কার ! বলুন কি বলতে চান।
বিষ্ণুপদ বুঝলো ওদের লড়াইটা এর সঙ্গে। অতএব টাকা নয়, ক্ষমতা নয়, যুক্তি নয়, হাতিয়ার হতে হবে ঐক্যবদ্ধ জনমত----
বিষ্ণুপদ বুকে হাত বেঁধে মাথা উঁচু করে নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। ওর পাশে কমলবাবু, তারপাশে
কল্যান---সজল---অভিক---আরোও---আরোও----
কলেজ যাবে বলে বেরিয়ে ছিলো কয়েকটি মেয়ে তারাও ব্যাপার শুনে মোবাইলে ডাক দিলো সবাইকে, দেখতে দেখতে গড়ে উঠলো মানব শৃঙ্খল, চারিদিকের গাছগুলোও যোগ দিলো নিশ্চয়ই -------সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো, শান্তিপূর্ণ-অগ্নিগর্ভ পরিবেশ।
প্রোমোটার অর্থপূর্ণ হেসে গাড়িতে উঠে কাচ তুলে দিলো, সবার উল্লাসে ভরে উঠলো বাতাস।
বেশ ঝরঝরে লাগছে আজ। সন্ধ্যায় কয়েকজন এসে বলে গেলেন, পুলিশকে জানানো হয়েছে। তবে জনমত অটুট রাখতে হবে। বিষ্ণুপদ আজ বেশ খুশি, কর্তব্য করতে পারার আনন্দ আর কি ! রাতের আকাশ দেখতে দেখতে কর্মসূচী একবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল মনে মনে------ আজ বিনা চেষ্টায় ঘুম এসে গেল-----
***********পাঁচ***********
রথটা এসে দাঁড়িয়ে গেল অনোমা নদীর তীরে, নামলেন সিদ্ধার্থ। মুখে অজানাকে জানার পথে পা রাখার আনন্দ। দুহাত বাড়িয়ে যেন বিশ্বকে আপন করে নিলেন তিনি । রাতের তারারা অভিনন্দন জানালো তাঁকে। বন্ধন মুক্তির আস্বাদ যে এতো তীব্র, এর আগে তিনি অনুভব করননি, খোলা বাতায়ন পথে যে বাতাসের আনাগোনায় তিনি অভ্যস্ত, সে বাতাসের যে এতো সুবাস, তিনি আগে বোঝেননি। বিশ্বমাতা যেন তাঁর আদরের পুত্রকে আবার টেনে নিলেন আপন ক্রোড়ে-------
সিদ্ধার্থ তরবারি উন্মুক্ত করলেন , নিজের যত্নলালিত কেশ ছিন্ন করলেন, ছুড়ে ফেলে দিলেন রাজবস্ত্র। ছন্দকের দেওয়া সাধারণ বস্ত্র জড়িয়ে নিলেন গায়ে। একবার আলিঙ্গন করলেন ছন্দককে, মৃদু কণ্ঠে বললেন,
-------তুমি আমার মুক্তিপথের সাথী , আমি আবার ফিরব, অপেক্ষা কোরো---
ছন্দকের চোখের জল আর বাঁধ মানে না, সে বসে পড়ে হাঁটুর ওপর ভর করে, বন্ধ হয়ে আসে গলা। জড়িয়ে ধরে পা দুখানি,
---------জানি তুমি মুক্তিকামী, মানব উদ্ধারে তোমার জন্ম, শুধু ফিরে এসো রাজপুত্র------কপিলাবস্তু তোমার অপেক্ষায় থাকবে-----
ছন্দককে তুললেন হাত ধরে,
--------ফিরে যাও ছন্দক, ফিরে যাও, আমার সময় হলো-----
আর একবারও ফিরে তাকাননি তিনি। নদীতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল
খেয়াতরীর মাঝি-----
**********ছয়***********
বিষ্ণুপদ চোখ খুললেন, মনে পড়লো রাতের স্বপ্ন। আজ আর ঘেমে ওঠেননি, হাসি ফুটে উঠলো মুখে। ভোর হয়ে গেছে। যাত্রা শুরু হয়ে গেছে মুক্তির পথে। অনেক কাজ তার। আজ একবার কলেজে যেতে হবে। দুটো ক্লাস আছে। অলকেন্দুকে দেখতে যেতে হবে একবার। বারান্দায় গিয়ে দেখলেন, মাঠ ফাঁকা। নিশ্চিন্ত মনে তৈরি হলেন কলেজের জন্য।
কলেজের গেটে আজ সব স্বাভাবিক। ছেলেমেয়েরা হাসিখুশি। টিচার্সরুমের আবহাওয়াও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বিষ্ণুপদ তাঁর চেয়ার গিয়ে বসলেন। একটু পরেই ক্লাস। দুজন মেয়ে বাইরে থেকে ডাকলো ।
---------স্যার ! আসবো ?
বিষ্ণুপদ হাতের ইশারায় ঢুকতে বললেন। ওরা উচ্ছ্বসিত,
-----------জানেন স্যার, সেদিনের পর আর ওরা কলেজে ঝামেলা করেনি। স্যার আপনাদের পাড়ার ঐ প্রোমোটারের ব্যাপারটা অনেকেই জানি স্যার। আমাদের ফোন নম্বর দেওয়া আছে। কিছু হলেই আমরা যাব স্যার---
বেশ লাগে ঐ ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সারল্য, ওদের ভালো রাখা, তো বড়োদের কর্তব্য। ওর সময় হলো, ক্লাসে যেতে হবে।
দুটো ক্লাস সেরে বেরিয়ে দেখলেন, ওর গাড়িটা নেই। আশ্চর্য, বিনয় তো ফোন না করে কোথাও যায় না। ফোন করলেন বিষ্ণুপদ। ধরছেনা তো !! একটা কালো বেশ বড়ো গাড়ি এসে দাঁড়ালো। দরজাটা খুলে একজন বললো, উঠে আসুন স্যার। বিষ্ণুর কেমন চেনা চেনা লাগলো ছেলেটিকে। বললেন,
-------না, আমার গাড়ি আছে।
--------আরে আসুন স্যার !
একটি ছেলে নেমে এলো। ওর পাশে দাঁড়ালো। কোমরে একটা ধাতব স্পর্শ। ছেলেটার মুখে হাসি, নম্রতা ঝরে পড়লো, মাথাটা নামিয়ে একমুখ হেসে বলল,
------- চলুন স্যার !
বিষ্ণুপদর মনে পড়ে গেল, সেদিনের সেই "জিনসের প্যান্ট আর প্রিন্টেড সার্ট" ছেলেটি। উঠতে হলো গাড়িতে। কিছুটা গিয়ে ওরা একটা নির্জন রাস্তায় ঢুকলো। এরকমই কিছু একটা ভেবেছিলেন বিষ্ণুপদ। মনে মনে প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য। "চলো ছন্দক"------কানে ভেসে এলো কথাটা যেন------
হঠাৎ ওরা মুখটা টিপে ধরলো, একটা ধাতুর পাত সোজা ঢুকে গেল পাঁজরে।
------প্রোমোটারের সঙ্গে লাগতে আসা ?
একটা পিঠে ঢুকলো।
-------সবাই তোমার ছাত্র ? আমাদের শাসন করা ? পেটে পর পর দুবার ধাতব অনুভূতি। যন্ত্রণা পাওয়ারও সময় দিলোনা ওরা, সঙ্গে অশ্রাব্য গালি। গলায় ঠেকালো একটা ধারালো পাত----
*********
বিনয় জ্ঞান ফিরে দেখলো, গাড়ি সমেত ও একটা অচেনা রাস্তায়। বিষ্ণুদা কোথায় ? মনে পড়লো চা খাওয়ার পরই ওর মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল।বিদ্যুদ্বেগে গাড়ি ছুটিয়ে কলেজের গেটে এসে শুনলো বিষ্ণুদা চলে গেছে। বাড়িতে গিয়ে না দেখতে পেয়ে, পুলিশ। আর সন্ধ্যা বেলায় পুলিশের গাড়িতে বিষ্ণুপদ হাসপাতালে। তখনও নাড়ি ধিকি ধিকি চলছে।
বিষ্ণুপদর বন্ধ চোখের সামনে তখন পাঁচজন সন্ন্যাসীর পদব্রাজনের ছবি , হাসি মুখে বলছেন,
--------আবার জাতক হতে হবে------ফিরে আসতে হবে বার বার -------
****************
বিষ্ণুপদর মৃত্যুসংবাদটা এলো ভোরবেলায়। এলাকার মানুষ মর্মাহত, কমলবাবু একচোখ জল নিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,
------ওর শহীদের সম্মান প্রাপ্য। কিছুতেই বিষ্ণুর মৃত্যু বিফলে যাবেনা। আমরা পিকেটিং করবো। মাঠ ছাড়বো না।
------হ্যাঁ, সবাই থাকবো, দেখি কি করে মাঠ নেয়,
অপরাধী মুখে ক্লাব সেক্রেটারী,
------আমি টাকা ফেরত দেব, সবার সামনে।
সামনের রাস্তায় ভীড় , কলেজের ছেলেমেয়ে আর অধ্যাপকরাও এসছেন।
অলকেন্দু স্যার চেঁচিয়ে বললেন,
------ আমরা আছি বিষ্ণুপদ, নিশ্চিন্ত থাকো----
******************
বিষ্ণুপদ নিশ্চিন্ত ! যাত্রা করেছেন, মহাপ্রস্থানের পথে, ----আবার জাতক হতে হবে, ----ফিরে আসতে হবে বার বার