Ranu Sil

Abstract Inspirational Others

3  

Ranu Sil

Abstract Inspirational Others

চন্দ্রাবতী

চন্দ্রাবতী

9 mins
275



এগল্পের কোনো চরিত্র ঐতিহাসিক সত্যতা দাবি করেনা। তবে সেইসব চরিত্রের আলোকিত পথেই হেঁটেছে কাল্পনিক চরিত্রেরা, যাদের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্থান না পেলেও, চিরস্মরণীয়। তেমনই এক মানুষ ছিলেন, চন্দ্রাবতী দেবী চৌধুরী।

***************

আবার ! -ঐ-- আবার !! " বন্দে মাতরম্" ধ্বনিতে কেঁপে উঠলো এই শহরতলির গলিটা। গলিটা কানা গলি, তাই এখানে বিপ্লবীরা সরাচর ঢোকেনা,গলির মুখে দাঁড়িয়ে দুবার আওয়াজ তুলে ওরা বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেল। বড়ো রাস্তা থেকে একটা মোটামুটি চওড়া গলি ঢুকে গেছে পূর্বদিকে। সেই গলিটাকে তেরছা ভাবে কেটেছে আরোও একটা সরু গলি। ঐ গলির একটা মুখ অন্য একটি বড়ো রাস্তায়, মিশেছে। আর একটা গেছে এ গল্পের মানদা সুন্দরীর বাড়ির দরজায়।

এ বাড়ির অন্দর মহলের একটা সুরঙ্গ-পথ সো-ও-জা গিয়ে মিশেছে জমিদার বরদা চরণ চৌধুরীর বাড়ির অন্দরের উঠোনে। এ পথেই যাওয়া আসা করে মানদা। সে বড়ো রাণীমার খাস পরিচারিকা। চৌধুরী বাড়িতে বড়ো রাণীমার কথাই শেষ কথা। তাই মানদা সুন্দরীরও বেশ দাপট আছে।

*********************

বরদা চরণ চৌধুরী সাত বছর হলো গত হয়েছেন। এদের পারিবারিক কাঠের ব্যবসা। তাঁর দুই ছেলে। বড়ো অনঙ্গ চৌধুরী ও ছোটো অম্বর চৌধুরী।

অনঙ্গ চৌধুরী ব্যবসার কাজে উত্তরে থাকেন।তার একমাত্র ছেলে, কুমুদারঞ্জন। ওকে নিয়ে খুব অশান্তি। দেশের কাজে নিবেদিত প্রাণ, জমিদারিতে মন নেই।

ছোটোভাই অম্বর চৌধুরী অকাল প্রয়াত। তার স্ত্রী আছেন, চন্দ্রাবতী। বয়সে তিনি কুমুদারঞ্জনেরই সমান। খুড়িমা আর ভাসুরপোর মধ্যে

আন্তরিক সখ্যতা।

বর্তমানে অনঙ্গ চৌধুরীর স্ত্রী,বড়ো রাণীমা এ সংসারের কর্ত্রী। ছেলে কুমুদারঞ্জনকে "শাসন" করার অনেক চেষ্টা করেও পারেননি। মাষ্টারমশায়ের পাল্লায় পড়ে সে একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। সম্প্রতি শুনতে পান সে যেন কোথায় বোমা বাঁধা শিখছে, ইংরেজ মারবে।

তার ওপর আবার জুটেছে ঐ ছোটগিন্নী চন্দ্রাবতী।

মানদা পানের ডিবে নিয়ে রড়ো রাণীমার ঘরে ঢুকলো, আজকের খবরটা শুনে, রাণীমা নিশ্চয়ই তাকে অনেক উপহার দেবেন। সে পালঙ্কের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালো, হাসিমুখে। রাণীমা একমনে কি যেন ভাবছিলেন। মুখে অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট।

মানদা ছোট্টো একটা 'খুক্' করে কাশির শব্দ করলো, বড়ো রাণীমা চমকে উঠে, হাত পাখাটা তুলে নিলেন,

---কিছু বলবি ?

মানদা বেশ গুছিয়ে বসলো মেঝেতে, বললো,

---আর তোমার ছেলেকে ফেরাতে পারবেনা গো !! আর পারবেনা! মাথাটা খেয়ে দিলে গা !! তাই বলি, ঐ ছেলে এতো সাহস পায় কোথা ?

রাণীমা বিরক্ত হন,

---আঃ মানদা, তোর নাকে কান্না বন্ধ কর....... কি হয়েছে বল.....

মানদা চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,

---তোমার ছেলেকে ওর খুড়িমা কতো গুলো গয়না দিলে গো মা, কাল আমি স্বচোক্ষে দেখনু! সারাক্ষণ ভাসুরপোর সাথে ফিসফাস্ করছে, একদিন আড়িপেতে শুনি মা...আ...তারা কোথায় যেন কি লুট করবে, যুদ্দু হবে ইংরিজিদের সঙ্গে....আরো কতো কী......সব কী আর আমি বুঝি ছাই!

রাণীমা উঠে বসলেন, তাঁর বিষয় বুদ্ধি জমিদারবাবুকেও হার মানায়। তিনি কী ভেবে মানদাকে বললেন,

--- তুই আজ থেকে এখানেই থাক কটা দিন। কাজ আছে। চন্দ্রার গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখবি। আর কালুকে একবার খবর দিস তো !! এখন যা......

মানদা বিরস বদনে বেরিয়ে গেল।

রাণীমা ঘরের মধ্যে পায়েচারী শুরু করলেন, তার মাথায় এখন অনেকগুলো চিন্তা একসাথে জট পাকিয়ে গেছে। তার একমাত্র ছেলে কুমুদ। তার মাথায় দেশোদ্ধারের ভূত চেপেছে। এতো বুদ্ধি করে ডামাডোলকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করা,কার জন্যে ? তাকে আবার মদত দিচ্ছে ঐ চন্দ্রা। সম্পত্তিতে তারও অধিকার। সব যদি গরীব দুঃখীদের কবলে দেয় !! শিউরে উঠলেন রাণীমা, না না উদ্ধার করতেই হবে ছেলেকে, উদ্ধার করতেই হবে!

এমন সময় কালু এসে দাঁড়ালো। তাদের অনেকদিনের বিশ্বস্ত লাঠিয়াল।নিজের বলতে সাতকুলে কেউ নেই। সে অম্বর চৌধুরীকে বড্ডো ভালোবাসতো। এখন ছোটমাকেও সবসময় বড়ো রাণীমার রোষের হাত থেকে রক্ষা করে। অন্দরমহলের রক্ষী সে।কুমুদ তার কাছে লাঠি খেলা, কুস্তির প্যাঁচ, এসব শিখেছে গোপনে। সেও কালুর স্নেহের পাত্র।

রাণীমা বসলেন শান্ত হয়ে, কালু চৌকাঠের ওপারে দাঁড়িয়ে রইলো।

---আয় বোস কালু। তুই তো চাস! এই জমিদারি টিকে থাক ? দেখছিস তো দেশের অবস্থা ! কার ওপর যে কখন কোপ পড়ে ঠিক কী ? এর মধ্যে আবার তোর কুমুদ দাদাবাবু দেশোদ্ধারে নেমেছে। শোন, ও কখন কোথায় যায় একটু নজর রাখিস, আমাকে সব খবর দিবি। বুঝলি?

কালু মাথা নাড়ে,

একটু চুপ করে থেকে রাণীমা কালুর মুখটা পড়ার চেষ্টা করেন।

---হ্যাঁ রে কালু ! তুই তো এবাড়িতেই বুড়ো হলি, চন্দ্রাকে তো মেয়ের মতো দেখিস, ওর সংসারের কাজে মন নেই তা তো দেখতেই পাস। কাকে আর বলি বল !! ওর মতিগতি ঠিক বুঝিনা। একটু পুজোআর্চায় মন নেই, রান্নাবান্নায় মন নেই ! কী-ঈ-যে করে সারাদিন !

বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে থাকেন কালুকে।

---আমি আসি মা ?

বলে কালু উঠে পড়ে, বিপদ একটা ঘনাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। বড়ো রাণীমা নিশ্চয়ই কিছু জেনেছেন। সে চন্দ্রাবতীর ঘরের সামনে এসে ডাকলো,

---ছোটোমা! ছোটোমা !

সাড়া না পেয়ে অপেক্ষা করবে বলে দালানের কোনায় বসলো।

*****************

চন্দ্রাবতী ঘরে ছিল না। ও এখন কুমুদের ঘরে।ঘরের দালানের দিকের জানলা দরজাগুলো বন্ধ। একটা দিকে খোলা, সেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়, লক্ষ্য রাখার সুবিধা। বিশাল ঘরের এক দিকটা প্রায় অন্ধকার। ঘরের মেঝেতে গোল হয়ে বসে আছে, কুমুদ, তার বন্ধু সঞ্জয় আর পরিতোষ ও একজন কৃশকায় মাঝবয়সী মানুষ, চন্দ্রবতী একটু দূরে একটা আরাম চেয়ারে বসে আছে। মধ্যিখানে একটা হারিকেন জ্বলছে, ওদের হাতে একটা হাতে-লেখা ইস্তাহার। ব্রিটিশ সরকারের ভাষায় নিষিদ্ধ ইস্তাহার। মধ্যবয়সী মানুষটির চশমা পড়া চোখদুটিতে উত্তেজনা।

তিনি বলছিলেন,

---মানিকতলা থেকে বোমা বার করে এ পাড়ার অখিলের চায়ের দোকান অবধি পৌঁছে দেবে পঞ্চানন। সেখানে পরিতোষ থাকবে, সে ওটা ছোটোমার দায়িত্বে রেখে ফিরে যাবে। পঞ্চাননের এ বাড়িতে না আসাই ভালো।

ঐ বড়ো রাস্তা দিয়ে ভোর তিনটে পাঁচ থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে যাবে বন্দুকভর্তি তিনটে ঘোড়ার গাড়ি। শেষ গাড়িটা হবে টার্গেট। অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কোচোয়ানের ওপর! কথা বলতে না দিয়েই মারা হবে তাকে। যদি কিছু গন্ডগোল হয়, বোমা ফাটাতে হবে আসেপাশে, যাতে অন্যেরা আসতে না পারে, ধোঁয়ার আড়ালে পালানোর সুবিধে।

এই লুঠ হবে শুক্রবার। মঙ্গলবার বিকেল থেকে কুমুদ আর সঞ্জয় গা ঢাকা দেবে। বুধবার ভোর রাতে বিহারে কার্তুজ লুঠ হবে। পুলিশ ঐ দিন সতর্ক থাকবে। বোমা এখানে পৌঁছে যাবে বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে।বলে, একটু জল খেলেন তিনি।

চন্দ্রাবতী আচ্ছন্নের মতো বসেছিলো, ওর শুভ্র বসন, মুখখানিকে ঘিরে রেখেছে, চোখদুটি কিসের আশায় উজ্জ্বল, যেন সুদূর কোনো নক্ষত্রলোক থেকে ভেসে আসছে, স্বাধীনতার সুর! মনের মধ্যে তুফান!

মধ্যবয়সী মানুষটা আবার বললেন,

---এখন প্রশ্ন হলো, ছোটোমার কাছ থেকে বোমা নিয়ে গিয়ে কুমুদদের দেবে কে ?

চন্দ্রাবতী বললেন,

---চিন্তা নেই, আমি দেব ওদের। বোমা আমি হাতছাড়া করবো না।

ঘরের মধ্যেই যেন বোমা ফাটলো,

---না না তা হয়না ছোটমা ! তোমাকে এই বিপদে ফেলতে পারিনা।

কুমুদের তীব্র প্রতিবাদ উড়িয়ে দিলো চন্দ্রা,

--- কেন ? বড্ডো বীরপুরুষ হয়েছো তোমরা না ? দেশ তোমাদের একার মা ? আমাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হোক!

মধ্যবয়স্ক মানুষটির চোখ চকচক্ করছে, হাত তুলে থামিয়ে দিলেন। বললেন,

---বেশ তাই হবে। তবে ছদ্মবেশে। যদিও প্রাণের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে, তবুও যদি প্রাণ থাকে, মানটাও থাকা ভালো। তাই পুরুষের ছদ্মবেশ দরকার। আজ এই পর্যন্ত।

ওরা চলে গেল। চন্দ্রা ঘরে আসতে গিয়ে দেখলো, কালু দালানে ঘুমিয়ে পড়েছে। বয়স হয়েছে ওর। ডাকলেন,

--কালু --

ধড়মড় করে উঠে বসলো কালু,

---হ্যাঁ, বলো, ছোটোমা !

চন্দ্রাবতী নিচু গলায় বললেন, আমাকে কয়েকটা জিনিস এনে দিতে হবে।

******************

মানদা লক্ষ্য করলো, কুমুদারঞ্জন আজ দুদিন হলো বাড়িতে নেই। পরিতোষ নামের ছেলেটা একবার এসেছিল, কালুকে কথা বলতে দেখেছিল। তার মানে,চন্দ্রা জানে, কুমুদ কোথায় ! আজ দুদিন ধরে বড়ই অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে। কালুর মতিগতিও সুবিধের নয়। ব্যাপারটা বড়ো রাণীমাকে জানাতে হবে!

*******************

বড়ো রাণীমার ঘরে ডাক পড়েছে চন্দ্রার, সে পায়ে পায়ে গিয়ে পালঙ্কের পাশে দাঁড়ালো যেন শ্বেত পাথরের মূর্তি। রাণীমা কোনো ভনিতা না করেই তীব্র গলায় বললেন,

---কুমুদ কোথায় ?

---জানিনা তো !

---দ্যাখ্ ছোটো ! আমার ঐ একটিই ছেলে ! ওকে বিপথে দিসনি, মহাপাতক হবি তুই! মহা পাতক হবি। ভোগ করছিস না পাপের ফল ??

চন্দ্রাবতী হাসলো, আজ আর ধমকে ভয় পেলো না। বললো,

--- ছেলে আপনার পুণ্যি করছে দিদি, আপনাকে যদি কেউ অপমান করে, কষ্ট দেয়, ছেলে রুখে দাঁড়াবে না ? সে উপযুক্ত পুত্র। আমার তো সাতকুলে কেউ নেই, তাই যা বলেন,শুনি! কিন্তু নির্বিচারে সহ্য করার দিন বুঝি ফুরোলো। দেখছেন না! সূর্য ওঠার আভাষ পাচ্ছেন না ? পুব আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে রক্তে, ওখান থেকেই তো স্বাধীন সূর্য উঠবে! মানুষ বুক ভরে বাতাস নেবে! আবার ভারত হাসবে! প্রাণ খোলা হাসি। আর দেরি নেই ! আর দেরি নেই!

বড়ো রাণী স্তব্ধ হয়ে যান, কি যেন আছে কথাগুলোয়,পরক্ষণেই মনে ভাবেন,-ও-ও-এই সব বুলিই বোধ হয় শেখানো হয়! তিনি চন্দ্রাকে জব্দ করার জন্য চেঁচিয়ে ওঠেন,

--- কাল শুক্রবার ! একাদশী ! আজ রাতে শুধু একটা সন্দেশ গালে ফেলো। বুঝলে ?

চন্দ্রা ঘাড় নাড়ে, দ্রুত নিজের ঘরে চলে আসে, কালই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ওর কিছু না খেলেও চলবে। তবে দীর্ঘদিনের অত্যাচারে, উপবাসে ক্লিষ্ট শরীর, মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে মাঝে মাঝে। কাল আবার সারাদিন নির্জলা উপোস। চন্দ্রা পালঙ্কের তলা থেকে একটা তোরঙ্গ টেনে বার করে। জামাকাপড়ের তলায় হাত চালিয়ে বার করে দুটি বোমা। চোখদুটো চকচক্ করে। "স্বাধীনতা" সে কেমন জানে না চন্দ্রা, দেশ স্বাধীন হলে তার কী ভালো হবে তাও সে জানেনা, তবু সে চায় দেশ স্বাধীন হোক, ইংরেজের অত্যাচার থেকে রেহাই পাক দেশের মানুষ।

********************

সারাদিন উপোস করে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দে ঘুম ভাঙলো চন্দ্রার। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো, কটা বাজে ?

দরজাটা ফাঁক করে দেখলো কালু।

---এই নাও ছোটো মা !! আর সময় নেই,

বলে একটা পুঁটুলি দিলো।

চন্দ্রা ওটা নিয়ে বললো,

--- বাইরে দাঁড়াও আসছি।

পুঁটুলি খুলে, চন্দ্রা দ্রুত হাতে কাজ সারছিলো।তার চুল ঢাকলো পাগড়িতে, গায়ে ঢিলে আলখাল্লা, কোমরে বেঁধে নিলো বোমাদুটো। ধুতির মতো করে পড়লো শাড়িটা। হাতে একটা লাঠি। দরজা খুলে বেরোলো যখন, তখন একজন কিশোর লাঠিয়াল ছাড়া তাকে আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। কালুর সাথে রওনা হলো বড়ো রাস্তার দিকে।

রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছে কুমুদ। চন্দ্রা অবাক হলো। একা কেন ?

---সঞ্জয়ের বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, ওর খোঁজ পাওয়ার জন্য। অত্যচার সহ্য করতে না পেরে মারা গেছেন উনি, ও তাই গেছে একবার শেষ দেখা দেখতে, বোধহয় ধরাও পড়বে। যাক! এনেছো ? দাও।

চন্দ্রার কণ্ঠস্বর দৃঢ়,

---তুমি তো কোচোয়ানকে মারবে, গাড়ি নিয়ে পালাবে, ওটা আমার কাছেই থাক। কিভাবে ছুড়তে হয় দেখাও।

আর সময় নেই! কুমুদ দেখিয়ে দিলো।

চন্দ্রা কালুকে বললো,

---বাড়ি যাও।

---না ছোটো মা, তোমাকে ফেলে...

---আ-আঃ যাও...

কালু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

সাড়ে তিনটে বেজে গেল, খবর ঠিক ছিলো তো ! বেশ চিন্তা হচ্ছে এবার।একটা শব্দ যেন ?

ঠিক তিনটে তেত্রিশ মিনিটে প্রথম গাড়িটা দেখা গেলো। গাছের আড়ালে কুমুদ জায়গা বেছে নিলো, চন্দ্রা বোমাটা বার করে নিলো, দাঁড়ালো অন্ধকারে।

প্রথম গাড়িটা পেরিয়ে গেল!

দ্বিতীয়টা এলো প্রায় দেড় মিনিট পর।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তৃতীয় গাড়িটা দেখা গেল।

ওরাও প্রস্তুত!

কুমুদ টোটা ভর্তি বন্দুকটা কোমরে গুঁজে একটু নিচু হয়ে আঙুলগুলো একবার মটকে নিলো, চোখদুটো যেন বাঘের চোখ, সামনে শিকার!

গাছের কাছ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো কুমুদ, এক মোক্ষম প্যাঁচে ঘাড়টা ভেঙে দিলো কোচোয়ানের। টুঁ শব্দ হলোনা। শুধু ঘোড়া দুটো থমক গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই আগের গাড়িটা থেমে গেল। একটা লোক নেমে এলো। তৃতীয়টার পেছনেও যে ঘোড়া নিয়ে কেউ থাকবে, তা ওদের জানা ছিল না। ঘোড়ার ওপর থেকে বন্দুক উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো লোকটা,

--"হল্ট !"--

চন্দ্রা বিহ্বলতা কাটিয়ে, দ্রুত বেরিয়ে এসে গায়ে যতো জোর ছিলো নিঃশেষ করে বোমাটা আছড়ে ফেললো মাটিতে! বিস্ফোরণ আর ধোঁয়ার কুন্ডলি! এর মধ্যেই একটা ফটাস করে তীব্র আওয়াজের সাথে সাথে একটা গরম সিসার টুকরো ঢুকে গেল ওর পাঁজর ভেদ করে, চোখদুটো অন্ধকার হয়ে এলো, ও বোধহয় মরে যাচ্ছে, পড়ে যেতে যেতে শুনলো,

একটা ঘোড়ার গাড়ির শব্দ দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে! আরোও দূরে! ওরা পেরেছে! ওরা সফল হয়েছে!

ওর অনাহার ক্লিষ্ট, রক্তাক্ত শরীরটা এলিয়ে পড়লো রাস্তায়।

ঘোড়ায় চড়া ইংরেজটা গাড়ি চুরি যেতে মরিয়া হয়ে আরো দুটো গুলি গেঁথে দিলো চন্দ্রার শরীরে। কালু আর পারলোনা, এগিয়ে এসে ইংরেজটার মাথা লক্ষ্য করে লাঠি চালালো, এলোপাথাড়ি লাঠির ঘায়ে ইংরেজটা রাস্তায় পড়ে কাতরাতে লাগলো। ততক্ষণে অন্য গাড়িদুটো পালিয়ে গেছে। কালু চন্দ্রাবতীর দেহটা তুলতে তুলতে কপালে হাত ঠেকালো,

--- কোথায় পেলে মা এতো সাহস ? কোথায় পেলে ??

চন্দ্রাবতী শেষবারের মতো তাকালো আকাশে....

পুব আকাশে লালের ছোপ লেগেছে, সূর্য উঠবে ! এবার সূর্য উঠবে!

শেষ শক্তি দিয়ে উচ্চারণ করলো,

--বন্দেমাতরম্--




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract