Ranu Sil

Classics Fantasy

3  

Ranu Sil

Classics Fantasy

সম্ভবামি

সম্ভবামি

8 mins
233



প্রিয় পাঠক, আপনি কি পুরানের ভক্ত ?


কথাটা জিগ্যেস করামাত্রই আপনি রেগে উঠবেন। বলবেন,

----- আচ্ছা বোকা তো আপনি, এই বুদ্ধি নিয়ে লোককে গল্প শুনিয়ে বেড়ান ? মিথ হলো মানসিক চাপ কমানোর বেশ জনপ্রিয় একটা উপায়। তাই বেশির ভাগ মানুষই এর ভক্ত। কিন্তু কি ব্যাপারটা কি ? আপনি আবার মাইথোলজি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছেন নাকি ? 


না পাঠক ! আমি শুধু বলতে চাই, আমরা যে বিজ্ঞান বিজ্ঞান করে এতো যে মাতামাতি করি! আর ভাবি যে , কতোই না অবাক আবিষ্কার করে ফেলেছি ! কে বলতে পারে  ! এসব আরও বড়ো কোনোও বৈজ্ঞানিকের খেলা নয় ? হয়তো আমাদের অজান্তেই অন্যকোনো গ্রহের অতিউন্নত কোনোও জীব, আমাদের নিয়ে খেলে চলেছে, কৌতুকে ? ভাঙছে-গড়ছে , ছিঁড়ছে-জুড়ছে যেমন খুশি !

########


নীরধারা কাজ সারতে সারতে একটা সংকেত পাচ্ছিল। সংকেতটা আসছে, সম্বর্তকের কাছ থেকে। সম্বর্তক ডাকলেই ও বোঝে কোনো বিশেষ কাজ আছে। কঠিন কাজ। প্রায় এক মহার্ষ পরে, ডাক এলো। নীরধারা দ্রুত খোলশের মধ্যে ঢুকে গিয়ে, বাতাস কেটে পৌঁছে গেল মৃগশিরায় । এখানে হাওয়ার জ্বালাতন নেই । কথা শুনতে পাবেনা কেউ। গিয়ে কিন্তু দেখতে পেলনা সম্বর্তককে। অপেক্ষা করতে হবে। ও খোলশের ভেতর থেকে একটা গাছের ফাঁপা ডাল বের করে, ফুঁ দিল তাতে । একটা মিহি সুর জেগে উঠলো , সুরটা শুনতে পাবে একমাত্র সে, যার জন্য বাজানো হচ্ছে ! সূর্যটা জ্বলছে সেই আদিকাল থেকে, আজ একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে যেন ? ওকে রসদ জোগাতে হবে । আসুক সম্বর্তক, একা হবেনা ওটা । ঐ চাঁদটার একটা দিক যেন একটু বসে গেছে ঠিক না করলে কক্ষপথ পাল্টে যেতে পারে।


সম্বর্তক আসছে দেখতে পেল ধারা। বললো,

------- এতো দেরি কেন সম্বর্তক ? তোর সবতাতেই দেরি। ঐ করে....যাক্ গে ! বল কি বলবি।


সম্বর্তক হাপাচ্ছিলো । বললো ,

------ আর বলিস না ! আমাদের ওখানে হাওয়ায় চাপ বড্ডো বেড়ে গেছে । তাই আসতে দেরি হলো। তুই আজকাল খুব অল্পে রেগে যাস ! শোন না, তোর মনে আছে ? আমরা নিকেল-ম্যাঙ্গানিজ-লোহা-বালি দিয়ে একটা গোল্লা বানিয়ে সূর্যের কাছে ছুড়ে দিলাম ! আর সূর্য সেটা লুফে নিয়ে বসিয়ে দিলো নিজের তৃতীয় বৃত্তে, কি নাকি, ম্যাজিক করবে !


------ মনে আছে , বলে যা !


----- তো সেই ম্যাজিকটা তো হয়েছে ! শুনেছিস নিশ্চয়ই।


------ শুনেছিলাম। তুই সেখানে গিয়েছিলিস। মানুষ বানিয়েছিস । এবং মাঝে মাঝেই গিয়ে চারটি ঝামেলা পাকিয়ে আসিস। তারপর আমার কাছেই বাঁশি টাঁশি শিখে দিব্যি নিজের বলে..... 

একবার আমাকেও নিয়ে গিয়ে ভক্তি টক্তি ছড়িয়ে দিলি । এখন বেচারা মানুষ না পারে গিলতে না পারে উগরাতে। 


------- আমি স্বাতীতে গিয়ে শুনলাম, আবার সেই ম্যাজিক গোল্লাটার প্রাণী, বেশ কিছুটা এগিয়েছে, বিজ্ঞানে, কিন্তু তারা ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছে। সবটাই, কার্যকারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। মানুষে মানুষে বিভেদ করছে। ধ্বংস আসন্ন। তাই ভাবছি , যদি ওদের মধ্যে একটু ভালোবাসার রসায়নটা পুরে দেওয়া যায় ! কেমন হয় ?


নীরধারা একটু হেসে বললো, 

------ বিভেদ ? ওটা তো তুমিই পাকিয়েছো ! বর্ণ-ফর্ণ বলে। তখন বোঝোনি , ওরা নিজেরাই সর্বজ্ঞ ভাবতে  শুরু করবে নিজেদের , এখন তো তোর নামেও …. যা...তা..


------ আরে ! আমি তো সেভাবে বলতে চাইনি ! আজেবাজে মানে না হয়, কোনোও ঝামেলা না হয়, তাই কাজ ভাগাভাগির কথা, --- সেটা ভেবেই তো ! পরে ব্যাপারটা সামলে দেব ! ঠিক করাইছিল... কিন্তু তা আর... 

বলে হাত ওল্টালো সম্বর্তক.... 


---- সেই ! তারপর দিলি যোগনিদ্রা। ব্যাস্ সব গেল বিগড়ে .... 


মাথা নাড়ে সম্বর্তক। 

---- ঠিকই বলেছিস ধারা---- 


ধারা হাসলো ,বড়ো বড়ো চুল ঘেঁটে দিয়ে বললো, ---- তুই বরাবরের পাকা ! আবার ঐ গোল্লাটায় ঝামেলা পাকাবি দেখছি। তা তুই যখন চাস...! করতে তো হবেই । বল কি করতে চাস !


---- চল আমি আর তুই সেখানে যাই !


---- তারপর ?


----- একজন উপযুক্ত প্রাণী দেখে, তুই তোর ঐ অস্ত্র নিক্ষেপ করবি ! 


----- এবার আবার কি অস্ত্র ? 


---- ভক্তি ! ভক্তি ! 


----- দূর ! ওটা ভোঁতা হয়ে গেছে , অন্যকিছু ভাব। 


সম্বর্তক ভেবে বললো, 

----- আচ্ছা, তবে বুদ্ধি !


----- কু ? না, সু ?


------ উঃ ! যাতে বেশি কাজ হয় ! অতো প্রশ্ন করিস কেন ? বুদ্ধি আবার কু — সু কি ? দ্যাখ, বুদ্ধি যেমনই হোক , উদ্দেশ্যেটা শুভ হওয়া চাই । 


----- অ, তা শুনি , শুভ উদ্দেশ্যটা কি ?


----- আরে বলে ফেলেছি তো ! ----- "ধর্মসংস্থাপনার্থায়"

ইয়ে মানে, আসবো ।


------ ও কারোর মনে নেই ! 


----- না নেই আবার ! এমন এমন এক একটা ব্যাখ্যা দেয় না ! নিজের কথাই গুলিয়ে যায়। আর কেউ মানবে ? না গেলে ? 


----- ওঃ , পুজো করবে নাকি ? সে গুড়ে বালি ! এখন ধর্ম - টর্ম নিয়ে খিল্লি করতে যাস না ! তোমার সে যুগ আর নেই —


----- কিন্তু সময় যে এসে গেল !


------ বেশ চল ! তবে শুনেছি, যা অবস্থা সেখানে, দেখ কি হয় ! 


------ আমার একটা ছোট্টো কাজ আছে। সেরেই আসছি ।


ধারা জানে, ওর "ছোট্টো কাজ" টা নেহাতই ছোটো হবে না। তাই একটু অপেক্ষা করে, রওনা দেয়। 

দূর থেকে কি সুন্দর দেখায় গোল্লাটা ! নীল-সাদা ঝকঝকে গোল্লাটা ঘুরছে তো ঘুরছেই । ধারা আসছিলো বেশ । হঠাৎই একটা আঘাতে থামতে হলো ! মনে পড়লো, হাওয়ার জগতে ঢুকে পড়েছে ও। আর একটু যেতেই কেমন ঘোলাটে হয়ে গেলো চারিদিক আর কি যেন একটা তীব্র টান আকৃষ্ট করতে লাগলো, আগেও এ টান পেয়েছে এ গ্রহে, ইচ্ছে করলে ও আটকাতে পারতো কিন্তু কৌতুহল হলো।


একটা কঠিন কিছুর ওপর আছড়ে পরেই স্প্রিং এর মতো উঠে দাঁড়ালো। হিসেব করে দেখলো , আরোও সামান্য সময় পরে নামার কথা ছিলো !

জায়গাটাতে মাটি নেই তো ? একটু এগিয়ে দেখলো, অনেক নিচে পথ। চোখ বন্ধ করে বুঝলো, অবস্থাটা। গুনে দেখলো সপ্তবিংশতি স্তরে রয়েছে সে, প্রতিটা স্তরে মানুষ। 

------ ও বাবা ! এরা এতোটা উঠে এসেছে ? হ্যাঁ, সময় হয়েছে সম্বর্তকের আসার। তবে ওর প্রতিশ্রুতি অনুসারে কালো ঘোড়া চাই তো ? উঃ এতো দেরি করে ! 


------ এই তো এসে গেছি ! 


------ যাক ! একেই তো তোর দেরির জন্য তোর থেকে বেশ খানিকটা বড়ো হয়ে গেছি সেই দাপরেই। সেই থেকে বেশ কিছু এঁড়েপাকারা বড়ো মেয়েদের ওপর নজর দেয়। জানিস এখানে বয়স তাড়াতাড়ি বাড়ে...তবুও.....দেরি করিস...


----- হা হা হা হা— এখন দৃশ্য হওয়ার সুইচ দিস না যেন —


----- ঈসস্ আরো কালো হয়ে গেলি। বলেছিলাম , ভালো করে জামাকাপড় পরে আয় ! হাওয়ায় ঘষা খেয়ে কালো হয়ে যাবি । তা নয়, পিত বসন । দেখাচ্ছে বেশ কিন্তু তোকে ! 


------ নে এবার চল ! মন্দির টন্দির বন্ধ দেখছি ! কোথাও কেউ নেই ! দাঁড়া, একটা কালো বাহন নিই ! কিছু লোক যেন উত্তেজিত ? তুই ওদের বুদ্ধি দে —


ধারা একটু হেসে চোখ বন্ধ করলো , দুহাত ওপরে তুলে ছড়িয়ে দিলো তরঙ্গ । মন্ত্র চালিতের মতো কিছু মানুষ বেরিয়ে এলো। অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে একটা কালো গাড়িতে উঠলো তারা । সম্বর্তক অবাক হয়ে বললো, 

---- কি বুদ্ধি দিলি?

ধারা হেসে বলল,

---- কু !


হাসতে হাসতে ওরাও চলল ।

শহরের শেষ প্রান্তে, একটা প্রায় গ্রাম্য অঞ্চলে এসে দাঁড়ালো ওরা। ওদিকেও প্রস্তুত ছোটো একটা দল । ওরাও অস্ত্রধারী। আরে আবার কুরুক্ষেত্র হবে নাকি ?


সম্বর্তক বললো, 

-----এখন আর কুরুক্ষেত্র থামে না। শুধু দলগুলো বদলে যায়। চল, থামাই.... 

########


মানুষগুলো এসেছিলো , এলাকার দখল নিতে। এখানে একটা প্রাইভেট স্কুল আছে । সেটা ভাঙার

অর্ডার আছে। পড়াশোনার জন্য আর ওসবের দরকার নেই। বাড়ি বসে পরীক্ষা দাও। অনলাইন সার্টিফিকেট। খরচ কম। তবু কিছু বাতিকগ্রস্থ গুরুমশাই ছাড়বেননা। ওঁর কিছু ছাত্র এসেছে স্কুল বাঁচাতে । আর কালো গাড়ির 'ওরা', এসেছে "সবক" শেখাতে । গেরস্তের ঘরদোর বন্ধ….


তাল বুঝে সম্বর্তক ঢুকে পড়লো ঐ বাতিকগ্রস্থ গুরুমশায়ের ভেতর । দেখতে দেখতে গুরুমশায়ের গাত্রবর্ণ ঘোর শ্যাম, চেহারায় অনন্য দিব্যকান্তি, ওঁর মোটর-সাইকেল নিমেষে কালো ঘোড়া । তিনি বীর দর্পে এসে দাঁড়ালেন, ওদের সামনে। ধারাও সময় বুঝে গাছের ফাঁপা ডালে ফুঁ....তবে অদৃশ্য থেকে । কারণ রেজাল্ট কি হবে, কিছুই বলা যায়না। আর ঝামেলা বাড়াতে চায়না সে।


সবাই তো হতবাক। ইতিমধ্যে দূর থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক... ধা-রা-ধা-রা-ধা-রা-ধা—

গোল গোল তরঙ্গ নাচতে নাচতে ছড়িয়ে পডছে, অনেকটা ভূমিকম্পের মতো । আশপাশের দুয়েকটা বাড়ির জানলা দরজা খুলে গেলো। এর মধ্যে এক প্রবীণ মানুষ বেরিয়ে এসে , চোখের সামনে মাষ্টারমশাইয়ের ঐ রূপ দেখে , কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না । তারপর হঠাৎই , যতো জোরে পারলেন , --- "পেয়েছি... পেয়েছি "---বলে ঝাপিয়ে পড়লেন পায়ে। সম্বর্তক একটু বেসামাল হয়ে গেলেও সামলে নিলো। ঐ তারস্বরে "পেয়েছি"- র দ্বিত্ব শুনে ছোটো-বড়ো , কালো-ফর্সা, লম্বা - বেঁটে চেহারা ওয়ালা ছেলে-বুড়ো-মা-বোনের 

দল হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলেন ।


শশিমুখী জ্যেঠি., খুব ধার্মিক । তিনি চারবেলা গোপালকে না খাইয়ে, আদর করে না শুইয়ে শান্তি পান না। তিনি তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন,

------ ওমা ! তোরা চিনতে পারলি নি ! তিনি এয়েচেন ! ধরায় এয়েচেন----

বলেই পাদুটো ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন। 

ধারা একটু হেসে দূর থেকে গাছের ডালটা দেখিয়ে বললো,

------ এসবই "ধা-রা-ধা-রাধা" নামের কামাল বুঝলি !... তোর গ্রহটা বেঁচে গেলো বোধহয়।


সম্বর্তক বাঁশিতে বললো,

----" আসছি ! অপেক্ষা কর, বেশি 

দেরি হবে না ---- আমার বাঁশিতে কিছু দুষ্টের দমন করেই আসছি ।


ধারা একটু অবাক। বললো ,

----- বাঁশিতে  দমন ?


সম্বর্তক একটু হেসে বললো, 

----- সেই যে হ্যামিলিনে গেলাম, বাঁশি  বাজালাম, ভুলে গেলি ?


সম্বর্তক বাঁশিতে ফুঁ দিলো, একটা অদ্ভুত সুরে আচ্ছন্ন হয়ে গেল সবাই, কোথা থেকে একটা গাঢ় সবুজ ধোঁয়া পাক খেতে খেতে উঠে এলো , ওতে দুষ্ট বীজ আছে। সম্বর্তক চলতে লাগলো , ওকে অনুসরণ করলো ঐ সবুজ ধোঁয়া । ধারাও চললো তাকে অনুসরণ করে, ধোঁয়া বড় হয়, ওরাও চলতে থাকে.. ওরা নামতে থাকে সমুদ্রে, সঙ্গে বিষ-ধোঁয়াও। 


সমুদ্রের জল হু হু করে বেড়ে উঠতে থাকে, চারিদিকে ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ। সমুদ্রের জলস্তম্ভ , ধারা আর সম্বর্তককে নিয়ে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে, অনেক উঁচু হয়ে উঠলো। ওরা দেখলো দুষ্টের দমনে খুশি , পৃথ্বিবাসী আকাশে মুখতুলে স্তবগান করছে….


ধারা সম্বর্তকের পিঠ চাপড়ে বললো,

----- বাঁচিয়ে দিলি।

       


(সমাপ্ত)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics