Ranu Sil

Tragedy

3  

Ranu Sil

Tragedy

উবাসুতে

উবাসুতে

14 mins
227



প্রাচীনকালে বহুদেশেই আমাদের দেশের মতো, অদ্ভুত আর নিষ্ঠুর প্রথা, বারবার মানবিকতাকে ব্যাঙ্গ করেছে। বারবার বিঘ্নিত হয়েছে, সভ্যতা। 

আজ একজন সাধারণ মানুষের কথা বলব, যে হানসু দ্বীপের একটা ছোট্টো গ্রামে থাকতো। অনায়াসে সামাজিক প্রথাকে, ব্যঙ্গ করে, জীবনকে করেছিল সমৃদ্ধ। আসুন পাঠক, আমরাও সাক্ষী থাকি, সেই মহাজীবনের.......

                          

          ~~~~~~~হারুতো~~~~~~


 কাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি হারুতো। হই হই করে সবাই যেটুকু পারে,নিউ ইয়ার পালন করছিল। আর হারুতো ঘরে বসে, ভাবছিল, "এই তার শেষ নিউ ইয়ার"। কতো কথা মনে পড়ে তার। সে আর ইচিকা এই বাড়িটাকে মনের মত করে, সাজিয়েছিল। ইচিকা মরে যাওয়ার সময়ও মনে ছিল না, ও আমৃত্যু এখানে থাকতে পারবে না। 


আজ সকালবেলা উঠেই ক্যালেন্ডারে দাগ দিল হারুতো। এ বছরের মার্চ মাসে তার সত্তর বছর বয়স হবে। তারমানে আর তিনটে মাস আছে হাতে।  হারুতো জানে তার ছেলে কাইতো খুব খারাপ নয়। সে তার বাবাকে ভালোবাসে। কিন্তু তবুও "উবাসুতে" তাকে যেতেই হবে। হারুতো প্রাণপণে চেষ্টা করে বৌমা সারাকে খুশি করতে। ওদের বাচ্চাদের জন্য সারাদিন খাটে। সংসারের জন্য যতোটা পারে, কাজ করে দেয় । 


আজ সকালে উঠে যখন, ছেলের ঘরের সামনে দিয়ে বাগানে সবজির গাছগুলোতে জল দিতে যাচ্ছিল, তখন  শুনতে পেয়েছে, বৌমা বলছিল,

----- কোন উপায় নেই, বাবাকে উবাসুতে যেতেই হবে। কেউ আমাদের কথা মানবে না। বাচ্চাদেরকেও সবাই জিজ্ঞেস করবে! 


ও জানে এখন থেকে যদি, প্রস্তুত হওয়া যায় তবে কিছুটা সময় বাঁচার রসদ, জোগাড় করা যাবে। ইচিকা বাগানের দুই কোণে, দুটো কাকি গাছ লাগিয়েছিল। যদিও এর ফলগুলোতে বীজ থাকে না তবুও গাছ কিভাবে হয় জানে হারুতো। কাবোচা মানে কুমড়ো গাছটা ভরে আছে ফুলে । মাচা থেকে পড়েও গেছে। ভালো করে তুলে শক্ত করে বেঁধে দিল যাতে ছাদে উঠতে পারে। সারা বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখল, সবজি ক্ষেত আর বেড়ার মধ্যে অনেক আগাছা জন্মেছে। ওগুলোকে তুলে পরিষ্কার করতে হবে তুলতে তুলতে হঠাৎ ওগুলোর সাথে নিজের একটা মিল পেল। ওকেও বাহুল্য বোধে এরকম তুলে ফেলে দেওয়া হবে। 


ওর বয়স যখন কম ছিল, এই "উবাসুতে" প্রথার বিরুদ্ধে একটা দল গড়েছিল , কিন্তু কেউ সমর্থন করেনি। সবাই বলেছিল, সমাজে বেশি বয়স্ক মানুষ থাকলে, নানারকম নিয়ম তৈরি করতে হবে, অর্থাভাব হবে। সব ঠিকঠাক রাখতে, এটা বেশ কার্যকরী একটা প্রথা। ষাট থেকে সত্তর বছরের বয়স্কদের নির্বাসন দেওয়ার প্রথাটা তাই চলেই আসছিল। সবসময়, বয়সটাও ঠিক থাকেনা। কর্মক্ষম না থাকলেই, তাকে গহন কোনোও অরণ্য-পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে আসা হয় , যেখান

থেকে আর সে ফিরতেই পারবেনা। 


হারুতো "কামি", মানে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ, ওর বাবা-মাকে উবাসুতে দিতে হয়নি। বয়স খুব বড় সমস্যা। কিন্তু, নিজের থেকেও , অন্যের‌ কাছে তা আরোও বেশি অস্বস্তিকর। এটা বুঝেছে হারুতো। তাই আজকাল খুব সঙ্কুচিত হয়ে থাকে সে। তার আর কাছু চাইনা। শুধু তিলতিল করে অনাহারে,আর তৃ্ষ্ণায় মরতে না হয়, ব্যাস্ ! এটুকুই চেয়েছিল। ও এখনো, কর্মক্ষম । তারমানে ওর মরতে আরোও কষ্ট হবে। অসুস্থরা  তাড়াতাড়ি মরে। 


মার্চ মাসের আগে, হারুতোকে কয়েকটা কাজ সারতে হবে। ঘরের ডানদিকের দেওয়ালটায় একটা ফাটল ধরেছে। ওটা সারাতে হবে, নাহলে, বাচ্চাদের কষ্ট হবে। নাতিরা বলবে,‌ ওদের 'ওজিচাং' ভাঙা ঘর রেখে গেছে। কয়েকটা জামা সেলাই করতে হবে। উবাসুতে গিয়ে যদি বেঁচে থাকে, দরকার লাগবে। কয়েকটা মিষ্টি কাবোচা নিতে হবে, একটা ধারালো নাইফু। আর আগুন জ্বালানোর জন্য অনেক ম্যাচবক্স আর মোম। আর নেবে, কয়েকটা কাকি গাছের চারা। যদি কোনোভাবে জল পেয়ে যায়, তবে আর ও মরছে না খুব তাড়াতাড়ি। 


বেশিরভাগ মানুষকে উবাসুতে দেওয়া হয়, ফুজি পাহাড়ের উত্তর পশ্চিমের গাছের সমুদ্র, অওকিগাহারা জঙ্গলে। ঐ জঙ্গলে নাকি একটা পাখি পর্যন্ত থাকেনা, সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ , শুনেছে হারুতো। নিশ্চয়ই তাকেও যেতে হবে সেখানেই ! যেখানে বধির বা বোবা হলেও কোনোও অসুবিধে নেই। হারুতো হেসে উঠলো, উদাত্ত হাসি। দুটো হলুদ খঞ্জনা উড়ে গেল। হারুতো ভয়ে ভয়ে তাকালো, কেউ শুনতে পায়নি তো ?


হঠাৎ মনে হলো, চলে যাওয়াই ভালো। ঐ অওকিগাহারা জঙ্গলে অন্তত হাসতে তো পারবে গলা ছেড়ে ! কীঈঈ বা হবে ! এভাবে বেঁচে থেকে। তবে মরার আগে কয়েকটাদিন স্বাধীনভাবে কাটাতে পারবে ও। স্বাধীনভাবে বেসুরো গলায় গান তো গাইতে পারবে। ও কখনও বেড়াতে যায়নি কোথাও। বেশ বেড়ানো হবে। নাঃ, মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেনা ও। কালই ঘরটা সারিয়ে নিয়ে , আস্তে আস্তে গুছিয়ে নেবে সে । যেটুকু জমানো আছে, সেটুকু দিয়ে, টুকিটাকি জিনিস কিনে, একটা গাড়ি ভাড়া করে নিজেই চলে যাবে অওকিগাহারা, মৃত্যর জঙ্গল, গাছের সমুদ্র......

                  

         ~~~~~~~~ সাকুরা~~~~~~~~


রিও তার ভ্যানে সবজিগুলো তুলছিল। ওর দুই সাকরেদ হাসাহাসি করছিল, ওদের গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে। রিও চোখ রেখেছিল তার বাড়ির দিকে। হাতদুটো স্টিয়ারিঙে রেখে, চুপচাপ বসে ছিল। ভালো করে দেখলে, ওর চোখে একটা অস্থিরতা আর আতঙ্ক দেখা যাবে। ও সাকরেদ দুজনকে কিছুটা রূঢ় ভাবে বলল, 

----- তাড়াতাড়ি কর ! গল্পটল্প পরে হবে, অনেকটা পথ যেতে হবে....


ওকে এই সবজিগুলো সাপ্লাই দিতে হবে বিভিন্ন বাজারে। ওর বাড়িটা লোকালিটি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। অনেকটা খোলা জায়গায় রয়েছে ওর সবজি বাগান । ছোট্টো বাড়িটা, ছবির মতো দেখায় । মা আর রিও বেশ শান্তিতেই ছিল। কিন্তু....

সাকরেদদের ডাকে, চিন্তা ছিঁড়লো রিওর। গাড়ি চলতে শুরু করলো....


সাকুরা অপেক্ষা করছিল, রিও কখন বেরোয় । গাড়ির শব্দে, বুঝলো, ওরা চলে গেছে। এবার সাকুরা বেরোতে পারে। রিও ইচ্ছে করেই, এখানে করেছে বাড়িটা। ছোটবেলায় ও ওর দাদুকে উবাসুতে যেতে দেখেছিল। তখন থেকে ওর ভয়, মাকে যেন উবাসুতে যেতে না হয়। এবার বয়স হয়েছে সাকুরার, আর পারেনা বেশি কাজকর্ম করতে। হিসেব মতো, এবার ওকে ছেড়ে দিয়ে আসার কথা। সবাই জানে , সাকুরা অন্যকোথাও থাকে। নাহলে, একটা সামাজিক চাপ আসবে। একজন নিয়ম ভাঙলে, অন্যেরাও যেতে চাইবেনা। তাই মাকে লুকিয়ে রেখেছে বোকা ছেলেটা। জগতে ওর ঐ এক  মা ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু আর কতোদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে। সাকুরা ভয় পায়, রিওকে সবাই ত্যাগ না করে। ওর বিয়ের ব্যাপারেও জোর করেনা , একা থাকলে অন্তত ওকে উবাসুতে যেতে হবেনা। সাকুরা জানে, অনেকটা সময় পাওয়া যাবে এখন। ও একটু ঘুরে নেবে খোলা হাওয়ায়। তারপর আবার ঘরে ঢুকে যাবে। 


হঠাৎই চোখে পড়লো, বেড়াটা এক জায়গায় কেমন ফাঁক হয়ে আছে ! কয়েকটা কাঠি জোগাড় করে বাঁধতে বসে গেল সাকুরা। ছেলেটা একা আর কতোদিক সামলাবে !  হিনা মেয়েটি শুধু জানে সাকুরাকে লুকিয়ে রেখেছে রিও। ও পানীয় জল রেখে যায় রোজ। আজ হিনা দৌড়ে দৌড়ে আসছিল। বলল, 

------ মা শিগগিরই ঘরে যাও---- বলে নিজেই হাত ধরে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দিল।আর বেড়ার কাছে বসে বাঁধতে লাগলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি লোক আর একটি বছর দশেকের বাচ্চা এসে পড়ল। বাচ্চাটা  আঙুল তুলে বলল, 

------ঐ তো এখানে বসেছিল, বুড়ি মতো কেউ ! আমি পাথর কুড়োতে এসে দেখতে পেলাম। 

হিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 

------ আমিই তো ! বেড়া বাঁধছিলাম। আর তো কেউ নেই, আমাকেই দেখেছো তো ! 

 লোকটি সন্দেহ জনক চোখে তাকিয়ে বলল, 

------ রিও কি ওর মাকে এনেছে ? ওর মা কোথায় বলতো ?

----- না না , উনি এখানে থাকেন না তো ! কোথায় আমি ঠিক জানিনা।


লোকটির ঠিক বিশ্বাস হলোনা বোধহয়। তবু সে চলে গেল। সাকুরা বুঝলো, এখনকার মতো চলে গেলেও, পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। হয়তো রিও এলে, আবার আসবে। হিনা এসে খুব আতঙ্কের সঙ্গে বলল, 

----- তুমি বাইরে বেরোলে কেন ? এখন কী হবে ? কিছুদিন আগেও একজন দেখে ফেলল। রাস্তার ধারে কেন আসো বলতো ! আমি যাচ্ছি । পরে আসবো। 


হিনা চলে গেলে, সাকুরা ভাবলো, আর ছেলেকে বিপদে ফেলবেনা সে। এই পথটা দিয়ে গিয়ে, বাঁদিকে একটা ছোট্ট পাহাড় আর লেক পেরোলেই অওকিগাহারা জঙ্গল । ওখানেই তো যায় সবাই উবাসুতে। একদিন ঠিক পালিয়ে যাবে সাকুরা। শুনেছে, ওখানে  মৃত আত্মারা, মরে যেতে সাহায্য করেন। কেউ বেশিদিন বাঁচে না। ভালোই হবে। রিও হাঁফ ছাড়তে পারবে। ও হিনাকে বলে যাবে, রিওকে বিয়ে করে, আরোও দূরে একটা বাড়ি করে নিতে। যতদিন ওরা কাজ করতে পারে ভালো। নাহলে, যেন সবার চোখের আড়ালে ওরা নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকতে পারে। 


সেদিন সন্ধ্যায়, রিও ফিরলে, সাকুরা কিচ্ছু বলেনা সকালের কথা। খুব রেগে যাবে । ওর কথা ভেবে ভেবে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। খুব যত্ন করে রাঁধে, সাকুরা। কাছে বসিয়ে খাওয়ায়, গল্প করে । ছেলেও নানারকম গল্প করে। কাল ওর ছুটি। বিশ্রামের দিন। সাকুরা ভেবে রেখেছে, কাল ওকে বুঝিয়ে বলবে। একটা পথ বেরোবে নিশ্চয়ই। 


রোজ ভোরে সাকুরার ঘুম ভাঙে, পাখির ডাকে। কিন্তু আজ ভাঙলো দরজায় ধাক্কার শব্দে। রিও ধড়মড় করে উঠে বসলো, সামান্য বুঝে নিয়ে বলল, ------ মা , সরে যাও -----

দরজাটা খুলতেই, হিনা ঢুকে এলো। বলল, 

-- কাল যে মাকে দেখে ফেলেছিল, তারা আসছে, অনেক লোক নিয়ে। 

রিও কিছুই জানতোনা। অবাক হয়ে তাকালো মার দিকে, সাকুরা বলল, 

--- ঐ বেড়াটা ভেঙে... হিনাকে বোধহয় ওরা বিশ্বাস করেনি...


রিও ,হিনার কাছে শুনে নিল সবটা। ইশারায় মাকে‌ নিয়ে পিছন দিক দিয়ে পালাতে বলল। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই, আবার আঘাত...

রিও দরজা খুলতেই, কিছু লোক সরাসরি জিজ্ঞেস করল,

-------- তোমার মা কি এসেছেন ?

রিও ঘাড় নেড়ে জানালো, ---না--

ওরা সবাই জানতে চাইল

---- কোথায় রেখে এসেছ ?

---- মাসির বাড়ি।

 সকালে দেখা ছেলেটি ও তার বাবা বলল,

---- না, সে এ বাড়িতেই আছে, খুঁজে দেখলেই পাওয়া যাবে।

ওরা কয়েকজন ঢুকে পড়ল বাড়িতে। রিও বাধা দিতে গেল, ওরা রিওকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে গেল ঘরে। মার জামাকাপড় একটা-দুটো তখনও পড়ে আছে এদিক ওদিক। ওগুলোর দিকে আঙুল তুলে বললো,

------ এইতো!! রিও তো একা থাকে তবে এগুলো কার ?

জনতা প্রায় মারমুখী, ততক্ষনে রিওর মাথাতেও রাগ চড়ে গেছে। চেঁচিয়ে বলল,

------ আমার মা যেখানেই থাকুক, তাকে নিয়ে আমি কি করবো সেটা আমার ব্যাপার ! তোমাদের মাথা ব্যাথা হচ্ছে কেন  ? আমার যদি কোন অসুবিধে না হয়! তোমাদের অসুবিধে কোথায় ? বেরিয়ে যাও সবাই আমার ঘর থেকে....


এবার ওই ছোট জনতাও রিওকে ধমকে উঠলো,

------ মানতেই হবে সামাজিক অনুশাসন। তুমি যা খুশি তাই করলে, সমাজে স্থান হবে না। ভালো চাও তো মাকে  উবাসুতে দাও।  

ওরা চলে যাচ্ছিল, রিও মরিয়া হয়ে, বলল,

------ না, দেবোনা কিছুতেই দেবোনা।


ওদের মধ্যে একজন, বেশ বড়সড় একটা পাথর, ছুড়ে মারল, রিওর মাথা লক্ষ্য করে। কপালটা অনেকটা কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল ঝর ঝর করে। রিও কপালে হাত চেপে বসে পড়লো।

বেশ কিছুক্ষণ পর উঠল আস্তে আস্তে। বাড়ির পেছনদিকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে, কিছুটা গিয়ে দেখল, মাকে নিয়ে বসে আছে হিনা। 

রক্তাক্ত রিওকে দেখে, হিনা ছুটে এলো। বলল, 

----- ওদের সাথে ঝগড়া করতে গেলে ! ওরা আবার আসবে। 

রিও মাকে বলল,

----- বাড়ি চলো মা ----

কোনোও কথা বললনা সাকুরা। শুধু ছেলের ক্ষতটা দেখলো, হাত বুলিয়ে আদর করলো। চুপচাপ ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। 


                    

    ~~~~~~~~~হারুতো~~~~~~~~


গাড়ি থেকে নেমে, হারুতো পয়সা গুণে দেখলো, 

যা ভাড়া, তার থেকে পাঁচ ইয়েন বেশিই আছে। সবটা দিয়ে দিলো। ও যেখানে নামলো, সেটা, ফুজি পাহাড়ের কাছাকাছি। এখান থেকে জঙ্গলে যেতে হয় হেঁটে। ও জঙ্গলে না ঢুকে হাঁটতে লাগলো সোজা ফুজি পাহাড়ের দিকে। কিছুটা গিয়ে শুরু হয়েছে, ছোটো ছোটো পাহাড় । সেখানে খুঁজলে হয়তো কোনো গুহা বা বড় পাথর পাওয়া যেতে পারে। হারুতো লক্ষ্য রেখে এগোতে লাগলো। দূরে বরফ চিকচিক করছে রোদে। 


হারুতো শুনেছে এখানে ছোটো ছোটো জন্ত আছে। এন্টিলোপ, ছোটো সাইজের কালো ভাল্লুকও দেখা যায়। অনেক পাখি । ওরা বাসা করে এখানে, ডিম পাড়ে, তা দেয়, তারপর বাচ্চারা উড়তে শিখে চলে যায়। ওরাও বাসা 

ছেড়ে  দেয়। পরিত্যক্ত বাসায় আর কখনও ফেরেনা পাখিরা। বেশ লাগছে ওর । স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে কিছুদিন মৃত্যুর আগে, একী কম পাওয়া ! শুধু একটু জল আর একটু আড়াল দরকার। ও পুঁতে দেবে, কাকি গাছের চারা আর কুমড়োর বীজ। পরে কেউ এলে হয়তো ওর গাছের ফল আর কুমড়ো খেয়ে বেঁচে থাকবে কিছুদিন !! ও এগিয়ে চললো.....একটা ঝর্ণার শব্দ কানে আসছে যেন।


         ~~~~~~সাকুরা~~~~~~~


রিও দুদিন ধরে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছ। ওর কপালে সেলাই করতে হয়েছে একটা। জ্বর এসেছে একটু। হিনা সেবা করছে দিনরাত। দেখে ভালো লাগে, সাকুরার। বেশ মেয়েটি। হিনা, সাকুরার জামাকাপড় গুছিয়ে দিতে দিতে বলছিল, 

----- তুমি জঙ্গলে একদম যাবেনা। শুনেছি ওখানে আত্মারা থাকে। আমরা মাঝে মাঝে যাব । সব দিয়ে আসব। 


সাকুরা জানে, সেটা হয়তো সম্ভব হবেনা। তবু ওর কপাল ভালো। ছেলে তাকে এতো ভালোবাসে। ও একবার ছেলের কপালে হাত দিয়ে দেখলো। সামান্য জ্বর আছে। কপালে চুমু দিলো একটা। এবার যেতে হবে। গাড়িতে উঠে বসলো। আগুন জ্বালানোর জন্য বেশ কিছু মোমবাতি দিয়েছে হিনা, কিছু খাবার, আর জল। স্বচ্ছন্দে কিছুদিন চলে যাবে। কিছু সবজি আর কিছু বীজ আছে সঙ্গে। চাল আর দুচারটে বাসন....


রিও গাড়িটা চালাতে চালাতে, ওর মাকে বলছিল, কিকরে শেয়াল বা ছোটো জন্তুর হাত থেকে, রক্ষা পেতে হয়। কিছু ওষুধ দেওয়া রইলো। সাকুরার মাথায় ঢুকছিলনা কিছু। আজ ছোটোবেলার কথা খুব মনে পড়ছিল। রিওর বাবার কথাও...... 


গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়লো যেখানে, তারপর আর গাড়ি যায়না। একবার চারিদিকে তাকালো সাকুরা। সবুজ আর সবুজ। কে ভাবতে পারে, এখানে মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে ? ঐ দিকে অওকিগাহারা অরণ্য। রিও বলেছে, ওদিকে না যেতে। সেখানে জল নেই।‌ সাকুরা রিওর দিকে তাকালো একবার। এগিয়ে গেল ফুজি পাহারের দিকে.......

                         

~~~~~~~হারুতো ও সাকুরা~~~~~~~~


বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পর সাকুরা একটা ঝর্ণার শব্দ শুনতে পেল যেন। একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। যখন ভাবছে একটু বিশ্রাম নিতেই হবে, ঠিক তখনই চোখে পড়ল গুহাটা। সামনেটা বেশ পরিষ্কার, খুব আশ্চর্য হলো সাকুরা। ভাবল এখানে একটু বিশ্রাম নিলেই তো হয়! দেখাই যাক! তবে সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল, কোন জন্তু নয় তো! ঘাস পাতা মাড়িয়ে, গুহাটার কাছাকাছি পৌঁছেতেই, দেখল একটা লোক, হাতে গাছের ডাল নিয়ে, বেরিয়ে এসেছে। বোধহয় সাকুরার পায়ের শব্দ শুনে, ভেবেছে কোন জন্তু। লোকটাও সাকুরাকে দেখে, খুব অবাক হয়েছে। ওরা দুজনে কিছুক্ষন দুজনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।


প্রথমে হারুতোই কথা বলল।

---- কী ! তুমিও উবাসুতে নাকি ? তা কে দিয়ে গেল ? ছেলে ? জঙ্গলের দিকে না গিয়ে, হঠাৎ এদিকে যে ? বুঝেছি, মরবার ইচ্ছে নেই তো ?


সাকুরা দাড়িয়ে রইলো চুপ করে। এবার ও বুঝতে পারছে। এই লোকটাও তবে, উবাসুতে এসেছে। কিন্তু এও তো বেশ ভালোই রয়েছে দেখছি। মনে হচ্ছে প্রায় একই বয়স। এই এতটা জায়গা, নিজের হাতে পরিষ্কার করেছে ? তবে গুহা তো একটা! সেখানে ওই লোকটা থাকলে ও থাকবে কোথায় ? সাকুরা একটু ইতস্তত করে বলল,

---- এখানে কাছাকাছি, আর কোন গুহা আছে ?


লোকটা খুব অবাক হল! বলল, 

---- তাতো খুঁজে দেখি নি, এটা আমার পছন্দ হল তাই । বেশ বড়সড় গুহা। কিন্তু কেন ! গুহাটা পছন্দ হলো না ? নাকি আমাকে ?


সাকুরা একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল,

----- না মানে একটা গুহায় তো! আপনি আর আমি!


হারুতো হা হা শব্দে আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠলো। অনেকদিন পরে হাসলো সে। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। দম আটকে আসতে চায়, অনেক কষ্টে বলল,

------- আপনি আর আমি ! তো কী ? এখানে তোমায় মরবার জন্য রেখে যাওয়া হয়ছে। এখনো সামাজিকতা ? ইচ্ছে করছে ? হাসি পাচ্ছে, খুব হাসি পাচ্ছে!সত্যি! হা হা হা হা.....


এবার সাকুরাও হেসে ফেলল, আজন্মের সংস্কার ! সত্যিই তো ! কী মূল্য আছে এখন ! কটাদিন আর বাকি আছে ? ভয়টাই বা কিসের ? পায়ে পায়ে সাকুরা এগিয়ে গেল গুহার কাছে।  ঢুকে দেখলো, লোকটা গোছানো, বেশ । সবকিছু নিয়ে এসেছে। শুধু, রান্নার জিনিস আনেনি। ঠিক আছে, রিও তো, দিয়ে যাবে। হয়ে যাবে দুজনের কোনো রকমে। জিগ্যেস করলো, 

----- তুমি খাও কি ?

----- একটা মিষ্টি কাবোচা এনেছিলাম। ওটাই কাঁচা খেতাম। প্রায় এক সপ্তাহ চললো। দেখো গাছ হয়েছে কেমন বীজ থেকে। আর একমাসের মধ্যেই ফল হবে। এখানে গাছ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। এখন ঝর্ণার জল আর পাতা ফুল, ফল যা পাই, খাই। একটা গাছের মূল তো খেতে বেশ ভালো। কিছু বুনো ফলও পাই মাঝে মাঝে। জানো, একদিন একটা মরা পাখি পুড়িয়ে খেয়ে, বেশ শরীর খারাপ হয়েছিল। আবার সেরেও গেলাম ,হা হা হা....


সাকুরা বলল, 

----- আমি চাল এনেছি। ভাত খাব। আর লবণও আছে সাথে। আমার ছেলে আমাকে খুব

 ভালোবাসে । ও সব দিয়ে যাবে মাঝে মাঝে। 

হারুত খুশি,

---- কতোদিন ভাত খাইনি....


সেদিন সাকুরা ভাত রাঁধলো, দুজনে খেলো। একটু কম কম করেই খেলো। কিন্তু বেশ পিকনিক পিকনিক লাগলো। ওরা ছেলেমানুষের মতো হাসলো, দুজনে বাসনগুলো ঝর্ণার জলে ধুয়ে আনলো, এ ওর গায়ে জল ছুড়লো.... বনের মধ্যে ছুটোছুটি করল যতটা পারল... শেষে হাঁফিয়ে গিয়ে বসে পড়লো ঘাসের ওপর। হারুতো একগোছা বুনোফুল, পরিয়ে দিলো ওর চুলে। বলল,

---- বাহ বেশ দেখাচ্ছে তো! এক সময় ভালই ছিলে দেখতে! 

সাকুরার কোঁচকানো গালে, অল্প একটু লালচে আভা ফুটেই মিলিয়ে গেল। পুর্ণ চোখে তাকালো হারুতোর দিকে, লোকটাও খারাপ নয় দেখতে। শুধু এক মুখ অগোছালো দাড়ি, কেমন জঙ্গুলে জঙ্গুলে ভাব।

সারাদিন অনেক কাজ করতে হলো ওদের। সন্ধ্যে হতে না হতেই, ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো ওরা।


পরেরদিন সাকুরা যখন চোখ মেলল, বেশ রোদ উঠেছে। তাকিয়ে দেখে, হারুতো কাজে লেগে গেছে। ওর মুখ দেখে, সাকুরা আর হাসি চাপতে পারেনা। বলল, 

-----করেছো কি! খাপচা খাপচা করে এরকম দাড়ি কাটতে গেলে কেন ! 

----- কি করব,নাইফুটাকে একটু ধার দিয়ে, কাজ চালিয়ে নিতে হলো..

হা হা..হাসিতে যোগ দেয় সাকুরাও । যেন কোথাও কোনো দুঃখ নেই। দুঃখ টুঃখ ছিলই না কোনোদিন....কি অনাবিল দিন....ওরা পাখিদের সাথে খেলা করে।

কী নির্মল রাত্রি.... এক আকাশ চাঁদ তারার তলায় ওরা গল্প করে,খুনসুটি করে,তারপর ঘুমিয়ে পড়ে....

এভাবেই চলতে থাকে । না তারিখ, না সময়,না ভবিষ্যৎ ! নির্ভার উন্মুক্ত জীবন....


সেদিন রিও কিছু চাল ,সবজি, মাছ, এসব নিয়ে এল। এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে, একটা ঝর্ণার শব্দ শুনে আন্দাজ করলো ,যদি সেই দিকে গিয়ে থাকে মা ! অবশ্য যদি বেঁচে থাকে..... একটু এগিয়ে এসে, চোখে পড়ল, একটা জায়গা যেন একটু পরিষ্কার। কটা কাকি গাছের চারাও রয়েছে যেন। খুব আশ্চর্য হল। হঠাৎ যেন কাদের হাসি কানে এলো। মার হাসি ? এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল হারুতো আর সাকুরাকে।

সাকুরা ছুটে এসে, রিওর হাত ধরে নিয়ে গেল ভেতরে...

--- দেখ, এ হারুতো ! উবাসুতে এসেছে। 


রিও দেখলো, গুহার মধ্যে বেশ সংসার গুছিয়ে বসেছে মা। ও হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে, বলল, --- আসছি মা । ভালো থেকো। তবে দুজনকার মতো খাবার আমি দিতে পারবো না...


সাকুরা ছেলেকে ডেকেও থামাতে পারল না। হারুতো হাসছিল--

---ও আর আসবে না--হা হা হা--

ওর উদাত্ত হাসি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, গুহা-বন-পাহাড়ে।

সাকুরা ঝাপসা দুচোখে, চেয়েছিল, ছেলের অপসৃয়মান কাঁধের দিকে। দুটি শীর্ণ হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল।

----ভালো থাকুক সবাই, ভালো থাক তোরা----


      না, সত্যিই রিও আর আসেনি......


          


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy