তৃতীয় রিপু
তৃতীয় রিপু
শ্রদ্ধেয় পাঠক, আমরা সাধারণ ভাবে নিজেদের নির্মল ভাবতে, নির্মল রাখতে পছন্দ করি, কিন্তু কখনও কখনও মনের দূর্গম অতল থেকে উঠে আসে একট একটি রিপু ... যা মানুষকে দিয়ে এমন কিছু কাজ করিয়ে নেয়... যা ইতিহাস হয়ে থাকে......
#########
সুগোপা ত্বরিতপদে আসছিলো, কোনো কাজে বিলম্ব রাজকুমারী সহ্য করেননা । তাঁর কঠোর স্বভাবের সাথে পরিচিত সবাই । সামান্য কারণে কঠিন শাস্তি দেওয়াই তাঁর স্বভাব। সুগোপা দ্বারের বাইরে থেকে ডাকলো,
-------- রঙ্গনা !
রঙ্গনা আবরণ সরিয়ে শুধু মুখখানি বাড়ালো, সাবধানী কণ্ঠে বললো,
-------- কি বলছিস ?
-------- রাজকুমারীর স্নানঘর প্রস্তুত...
-------- বেশ ! আমি নিয়ে যাচ্ছি, তুই যা...
সুগোপা আবার ফিরে চললো স্নানগৃহে ,
শেষবারের মতো দেখে নিতে হবে সাজসজ্জা। কোণায় কোণায় সুগন্ধি ফুলের নির্যাস রাখা হয়েছে তো ! দ্বারের সম্মুখের জলপূর্ণ রৌপ্যপাত্রে গোলাপের পাপড়ি ? সোনার রেকাবির দ্বীপে সুগন্ধি তৈল আছে তো যথেষ্ট ?
সুদৃশ্য শুভ্র ও সূক্ষ্ম কুশের আবরণে অন্তরবর্তী কক্ষটি আরোও মায়াময়। সেখানে আলোক বর্তিকাটি কোমল গোলাপী বর্ণের স্ফটিকের আড়ালে রাখাতে আরোও মায়াময় হয়েছে পরিবেশ । "গোলাপী" অনুরাগের রঙ্ । রাজার নির্দেশ, কন্যার মনে অনুরাগ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই আজ বিশেষ সজ্জা ।
কক্ষটির কেন্দ্রে গোলাকার স্নানকুন্ড। সেখানে দুগ্ধের সাথে মিশ্রিত, গোলাপের নির্যাস, কেশর ও কস্তুরী। স্বর্গীয় সুগন্ধে বাতাস মাতাল । বীণা বাদিনীর সুর শোনা যাচ্ছে দূর থেকে... বৃন্দাবনী সারং.....
রঙ্গনার সাথে রাজকুমারী কুবেরনাগ দর্পিত পদক্ষেপে প্রবেশ করলেন স্নানগৃহে। উচ্চ কণ্ঠে ডাকলেন ,
-------- সুগোপা , আজ জুঁইফুল পাসনি ? সবখানে গোলাপ কেন ? আমি বকুলফুলের মালা দেব খোঁপায় , নিয়ে আয়।
প্রমাদ গোনে সুগোপা ।
ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায়। বলে,
-------- এখন তো বকুল ফুল ফোটেনা রাজকুমারী !
রঙ্গনা তাড়াতাড়ি বলে,
-------- আমি রজনীগন্ধার মালা এনে রাখি ? বেশ দেখাবে তোমায়
সে চলে যায় তাড়াতাড়ি
রাজকুমারী স্নানকুন্ডে নামেন... তিনি অবলীলায় উন্মুক্ত করেন নিজেকে। দেহে পেশীর বাহুল্য, কোথাও কমনীয়তার লেশমাত্র নেই , নেই রমনীর স্বাভাবিক লজ্জাও। তাঁর নিরাবরণ শরীর দেখে অন্যদের লজ্জা হয়। নারীর স্বাভাবিক ঈর্ষা নয় । দাসীরা লজ্জাবনত চক্ষুতে তাঁর গাত্রমার্জনা শুরু করে । সনকা বয়স্কা। সে কুমারীকে সঙ্গ দিয়েছে , শৈশবের ক্রীড়াসাথী , তারুণ্যের সখী সে, তার ভয় কম। সে বললো,
-------- কুমারী , এবার নিজেকে সাজাতে শেখো। স্বয়ং চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য আসছেন তোমায় বিবাহ করতে ! সে কি কম কথা ! ওঁর প্রথমা স্ত্রী পরমাসুন্দরী । এ কথা সবাই জানে.....
শুনতে শুনতে রাজকুমারীর মুখ কালো হয়ে ওঠে, শত সুগন্ধি দুগ্ধস্নানও বুঝি সেই কালিমা অপসারিত করতে পারেনা....
*****
স্নান শেষে সুবিশাল এক দর্পণের সামনে এসে বসলেন, নাগ বংশীয় রাজকুমারী কুবেরনাগ। সিক্ত দেহে সূক্ষ্ম শ্বেতবস্ত্র । তাঁর চেহারায় বেশ একটা বৈশিষ্ট্য আছে । তাঁর চতুষ্কোণ মুখাবয়বে, হনু দুটি স্পষ্ট ও কঠিন। চক্ষুদ্বয় ক্ষুদ্র না হলেও টানাটানা নয় বরং ঈষৎ বসা , মণির রঙ্ তাম্রাভ। গাত্রবর্ণ, গোধুমের সাথে একটু শ্যামল কান্তির মিশ্রণ যেন। কুন্তল নাতিদীর্ঘ , অকুঞ্চিত ও ঈষৎ রক্তিমাভ। সর্বোপরি তিনি একটি বিশালদেহের অধিকারিণী, যে বিশালত্বকে নারীর ভূষণ বলা যায় না। সারা দেহে পুরুষালী কাঠিন্য থাকায় হঠাৎ দেখলে মনেহয় , তিনি বীর যোদ্ধা কিম্বা মল্লবীর। এই শরীর নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত তিনি। নিজের প্রতিচ্ছবি তিনি দেখতে চাননা। সৌন্দর্য তিনি সহ্য করতে পারেন না।
এহেন রাজকুমারীকে সুন্দরী , লাস্যময়ী করে তোলার দায়িত্ব ছিলো রঙ্গনার ওপর। কিন্তু রাজকুমারীর কর্কশ স্বভাব তার চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এর মধ্যে আর এক মহাজ্বালা উপস্থিত। মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের সাথে বিবাহ স্থির হয়েছে রাজকন্যার.......
রঙ্গনা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলো ,
------ রাজকুমারীর মুখে মেঘ কেন ? এতো খুব আনন্দর কথা.......
কুবেরনাগ ঈষৎ তিক্ত স্বরে বললেন,
শুনেছি ওঁর বর্তমান স্ত্রী অত্যন্ত সুন্দরী ?
রঙ্গনা ভাবলো , যদি...."হ্যাঁ"....বলে , হয়তো ঐ বলিষ্ঠ আঙ্গুলিতে কণ্ঠ রোধ হবে..."না" বললে মিথ্যার অপরাধে গর্দান যাবে। সুতরাং সে মিষ্ট স্বরে বললো,
------ কৈ আমি তো কিছু শুনিনি রাজকুমারী !
কুবেরনাগ চক্ষু কুঞ্চিত করে বললেন,
------ শুনিসনি ? জানিস মিথ্যার শাস্তি কি ? সনকা যে বললো সবাই জানে !
রঙ্গনা মনে মনে সনকা নামক দাসীটির মুন্ডপাত করলো, ------আর বলার কথা পেলো না ! এই পুরুষালী রাজকুমারীর বিবাহ হচ্ছে ......তায় আবার রূপসী সপত্নী....... আর কি নিদ্রা হয় ?
সে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলো ,
------ কি হবে, রূপ নিয়ে ? রাজকুমারী কুবেরনাগ বীরাঙ্গনা। রাজা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য মুগ্ধ হয়ে যাবেন.........
শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হলেন রাজকুমারী । মনে মনে ভাবলেন , ------ আমার সন্তানই রাজত্ব পাবে , সে ব্যাবস্থা আমাকেই করতে হবে । রা...আ...ণী.....কি যেন নাম ? হ্যাঁ, ধ্রুবস্বামিনীদেবী ! তুমি যতোই সুন্দরী হও রাজমাতা হতে পারবেনা.....একটা ক্রূর হাসি ফুটে উঠে কঠিন মুখটাকে আরোও একটু কুশ্রী করে তুললো।
**************
**************
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য বসেছিলেন তাঁর বত্রিশ অপ্সরী বাহিত সিংহাসনে। রাজার মনে শান্তি নেই। রাজা হওয়ার পর থেকে অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ সামলে তিনি সম্রাট হয়েছেন । এখন তাঁর ক্লান্তি আসে মাঝে মাঝে।
তিনি সত্যিই মর্মাহত। মর্মাহত সেইদিন থেকে যেদিন প্রথম দেখেছিলেন কুবেরনাগকে। রাজনৈতিক কৌশলের হাত ধরে তাঁর জীবনে প্রবেশ করেছিলো মূর্তিমতী অশান্তি।
প্রথম দিনই ঘোষণা করেন, তাঁর পুত্র রাজা না হলে, তিনি অন্ন গ্রহন করবেন না। কিন্তু রাণী কুবেরনাগকে হতাশ করে জন্ম নিলো এক কন্যা , নাম রাখা হলো প্রভাবতী। সে যেন মাতা কুবেরনাগের ছায়া । বিশালদেহী , কঠিনপ্রাণ। সে জন্মানোর পর থেকেই কুবেরনাগ নানাভাবে ধ্রুবস্বামিনীদেবীর দুই পুত্র কুমারগুপ্ত ও গোবিন্দগুপ্তের ক্ষতি করার চেষ্টা করে চলেছেন......
এ কথা শুনেছেন সম্রাট........
কণ্যা প্রভাবতীও যেন শত্রুকণ্যা। কুবের নাগকে বিবাহ করা ঠিক হয়নি.....সবার ক্ষেত্রে সব কৌশল কার্যকরী নয়। বোঝা উচিৎ ছিল তাঁর.....
একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো বুক চিরে.......
ধ্রুবস্বামিনীদেবী বাধা দিয়েছিলেন। তখন তিনি "স্ত্রীলোকের ঈর্ষা" বলে গুরুত্ব দেননি। এখন তাঁর বুদ্ধিমত্তার কাছে মাথানত করেন বার বার......
পরিস্থিতি ভালো নয়...... রাজা পৃথ্বীসেন সৈন্য সংগ্রহ করছেন। কিছুতেই তাকে বশে আনা যাচ্ছেনা। যদি বাকাটক রাজত্ব হাতে আনা না যায়, পূর্ব দক্ষিণ সীমান্তের রক্ষায় অনেক সৈন্য মোতায়েন করতে হবে.....তাতেও কি শান্তি আছে ? অযথা লোকক্ষয় তাঁর পছন্দ নয় । প্রজা স্বার্থে খরচ আরোও একটু বাড়াবেন বলে ভেবেছিলেন..... এতে রাজত্বের ভিত্ দৃঢ় হয়।
রাজা বিক্রমাদিত্য চিন্তাকুল নয়নে তাকিয়ে রইলেন তাঁর প্রিয় ময়ূরীর দিকে...... বড়ো সুন্দর তার নয়নযুগল। অনেকটা তাঁর ধ্রুবার মতো।
রাণীর সাথে দেখা হওয়া প্রয়োজন......চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য উঠে পদচারনা করতে লাগলেন, তাঁর মনে হয়না, ধ্রুবাস্বামিনীদেবী তাঁকে নিরাশ করবেন....... কিন্তু রাজা সামান্য সংকোচ বোধ করছেন। অনেকদিন তাঁর কক্ষে যাওয়া হয় না.....
********
মধ্যরাত্রি অপগত প্রায়। প্রতিহারিণীর চোখ নিদ্রাচ্ছন্ন। প্রাসাদের রাত্রিকালীন ম্লান আলোকে যেন ঝলসে উঠলো হীরকদ্যূতি। প্রতিহারিণী সচকিত হয়ে দেখলো মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য রাণীমহলে আসছেন।
প্রতিহারিনী দ্রুত পদে রাণী ধ্রুবার অলিন্দে এসে নিচু স্বরে ডাক দিলো,
-------বসুধা......
বসুধা রাণীর খাস পরিচারিকা। সে বেরিয়ে এসে অধরের ওপর অঙ্গুলি রেখে ইঙ্গিতে বোঝালো, রাণী এখনো ঘুমোননি।
প্রতিহারিনীও ইঙ্গিতে মহারাজের আগমন সংবাদ দিয়ে চলে গেল।
একটি বলিষ্ঠ পদশব্দ থামলো ধ্রুবস্বামিনীদেবীর দ্বারে। সূক্ষ্ম কুশের আবরণের ওপারে এসে দাঁড়িয়েছেন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। তাঁর কণ্ঠস্বর গমগম্ করে উঠলো !
------ আসতে পারি রাণী !
ধ্রুবস্বামিনীদেবী বসুধাকে নিষ্ক্রান্ত হতে ইঙ্গিত করলেন। ধীর পায়ে নিজেই এগিয়ে গেলেন দ্বারের কাছে। বললেন,
------ আসুন মহারাজ !
চন্দ্রগুপ্ত প্রবেশ করলেন। কক্ষ স্তিমিত আলোয় মায়াময়। তিনি দেখলেন, দেবীর পরনে নীলাভ বসন, তাঁর রূপে বয়স যেন আরোও পূর্ণতা যোগ করেছে । মুক্তা আর মরকত মণির অলংকারে মহারণী আজও মনোলোভা , ব্যক্তিত্বময়ী।
কিন্তু আজ আর আগের মতো কাছে এলেন না তিনি। বসলেন না প্রাণপ্রিয় রাজার পাশে । বক্ষে করতল রেখে শীতল মায়া ছড়িয়ে দিলেন না শরীরের প্রতিটি রোমকূপে। ললাটে অধর স্পর্শ করে সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিলেন না। তিনি দূরত্ব রেখে শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে রইলেন।
চন্দ্রগুপ্ত জানতে চাইলেন ,
------ আজ ঘুমোওনি রাণী ?
------ না , ঘুম আসছে না।
------ আজ কাছে আসছো না কেন ?
------ আজ আপনিও তো আমার মহলে আসার আগে অনুমতি নেন নি মহারাজ বিক্রমাদিত্য।
------ তোমার সাথে খুব জরুরী কথা আছে, দেবী ধ্রুবা...চিন্তিত আমি.....
------ বলুন মহারাজ....
>
-------বাকাটক রাজ পৃথ্বীসেন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। বুঝতে পারছিনা কি করা যায়......
------- এদিকে কুবেরনাগও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে মহারাজ.! ....সে আমার পুত্রদের ক্ষতি চায় , প্রভাবতীকে সামনে রেখে সে রাজ্য চায়.....
------- হুঁ-উঁ-উ-ম-ম্ !! ..... একটা উপায় ভাবো রাণী...
------ একটা উপায় ভেবেছি আমি....
------ কি বলো তো !
------ পৃথ্বীসেনের দ্বিতীয় পুত্র রূদ্রসেনের সাথে বিবাহ........প্রভাবতীর......
------- তারপর ?
------- এ রাজ্যের উজ্জয়িনীর সীমা সুরক্ষিত থাকবে আর প্রভাবতীর রাজ্যলিপ্সাও চরিতার্থ হবে .......
মহারাজ চমৎকৃত হন,
------- কিভাবে ?
------আমাদের কিছু করতে হবেনা মহারাজ ! কুবেরনাগই করবে........ঐ মাতা-পুত্রী ক্ষমতা লোভী । তার জন্য ওরা নিষ্ঠুরতার শেষ সীমায় পৌঁছে যেতে পারে.....
মহারাজ এবার স্মিতমুখে তাকান , সত্যিই এই ধ্রুবস্বামিনীদেবী তাঁর অমূল্য রত্ন........তিনি উঠে গিয়ে হাত রাখলেন রাণীর স্কন্ধে......
------ রাজনীতিটা তুমি ভালোই জানো দেবী,...
দেবী ধ্রুবা স্মিত হাসলেন, আজও ঐ জ্যোৎস্না-নিন্দিত হাসি আগুন ধরিয়ে দেয় রাজা বিক্রমাদিত্যের বুকে, তাঁর আকর্ষণ অবহেলা করতে পারেন না রাজা ।
কিন্তু বিক্রমাদিত্য লক্ষ্য করলেন, তাঁর ধ্রুবা খুব সাবধানে তাঁর হাত খানি সরিয়ে দিলেন। বললেন,
মহারাজ খুব চিন্তিত, আজ আপনি বিশ্রাম করুন। দাসীকে ডাকি, পদ মার্জনা করুক।
মহারাজ বুঝলেন, রাণী অভিমান করেছেন।
তিনি প্রিয়ার হাতদুটি ধরে কাছে বসালেন ।চোখের দিকে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে বললেন,
-------- মহারাণী ! তুমি গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রাণ, এতো অল্পে অভিমান, শোভা পায়না তোমায়..... ধ্রুবাদেবীর বাহুলতা লতার মতোই জড়িয়ে ধরে তাঁর কণ্ঠ, রাজার লোমশ বক্ষে মুখ রেখে শোনেন প্রিয় হৃদয়ের স্পন্দন.........চন্দ্রগুপ্ত প্রিয়ার মুখখানি দুইহাতে তুলে ধরেন, কুন্তলচূর্ণ সরিয়ে দিয়ে বলেন.,
------ এতে ভালো হবে বলছো রাণী ?
------ হ্যাঁ মহারাজ ! গুপ্তসাম্রাজ্যের ভালো হবে। শুধু রুদ্রসেনের জন্য দুঃখ হয়....
চারি চক্ষুতে কৌতুক খেলে যায় । ধ্রুবাদেবী কৌতুক করে বলেন,
--------মহারাজ বিক্রমাদিত্য কি বয়সের কাছে হারমানলেন ? কই আগের মতো আমায় পারবেন বাহুবন্দী করতে ? যদি পারেন এই কাজে সফল হবেন....
তিনি পালঙ্কের অপর পার্শ্ব থেকে অপূর্ব ভ্রুভঙ্গে
আহ্বান জানান,
মহারাজ সত্যই ক্লান্ত আজ, তবুও ধ্রুবাদেবীকে খুশি করতেই পালঙ্কের অপর পার্শ্বে গেলেন। হাত বাড়ালেন প্রিয়ার দিকে। ধ্রুবাদেবী সরে গেলেন। রাজার হাত লেগে কণ্ঠের মুক্তামালা ছিন্ন হয়ে গেলো, ছড়িয়ে পড়লো কক্ষে, নীলাভ আলোয় মুক্তা গুলি লাফিয়ে লাফিয়ে ঝলমল করতে থাকে......
ধ্রুবস্বামিনীদেবী তরুণীর মতো মুক্তা গুলির মাঝে ছুটোছুটি করেন। বিক্রমাদিত্য মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকেন। ভাবেন.,
------এই নারী-রত্নের কাছে গুপ্ত সাম্রাজ্য ঋণী... এঁৱ অনেক সহ্যশক্তি অনেক বুদ্ধিমত্তার মূল্যে কেনা আজকের এই সমৃদ্ধি। রাজা সস্নেহে ধ্রুবাদেবীকে আলিঙ্গন করেন, কাছে টেনে নেন। তাঁর চুলের সুবাসে মাতাল হতে হতে রাজার অসিচিহ্ন চিত্রিত আলতো হাত সোহাগে আদরে উদ্দামতায় পৌঁছে দেয় রাণী ধ্রুবস্বামিনীদেবীকে..... খসে পড়তে থাকে , মরকত মনির চন্দ্র হার, কর্ণের অবতংস, কবরীর স্বর্ণকন্টক... হস্তের কঙ্কণ... একটি একটি করে । তারা রচনা করে চলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের নতুন সীমারেখা......সদর্পে......
***********
*****************
আজ প্রভাবতীর শ্বশুরালয় যাত্রা .....পাটলিপুত্র আজ আলোকসজ্জায় অপরূপা। রাজপুরীর প্রাকারে প্রাকারে নহবৎ., মনোরম সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। রাজ্যের মানুষও খুশিতে মাতাল।
ফুল্লরা আজ অনেক মাদক বিক্রি করে হৃষ্টচিত্তে গৃহে চললো, গৃহে তার জন্য ছানুক অপেক্ষা করছে। ফুল্লরা দুটি মদ্যভান্ড ছানুকের জন্য নিয়ে নিলো। মধ্যযামে লাস্যময়ী রাজ্য , আজ বোধহয় তস্করও অবসর যাপনে প্রিয়ার বাহুবন্দী।
ফুল্লরা এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলো, সবাই বেশ খোশ মেজাজে রয়েছে। সে রাজপথ ছেড়ে গলিপথ ধরলো। গলিটি অপেক্ষাকৃত নির্জন। হঠাৎই পশ্চাতে যেন কার পদশব্দ শোনা গেল।
ফুল্লরা তাকিয়ে দেখলো, গৌতমী আসছে দ্রুত পায়ে.......
----------কি রে ! আজ তাড়াতাড়ি ছুটি পেলি রাজ প্রাসাদ থেকে ?
---------হ্যাঁ, আর বলিসনা সখি, আজ দেবী কুবেরনাগ খুব রেগে আছেন...... মেয়ে যাবে শ্বশুরালয়, আর কখনও দেখতে পাবেন না। তবু মায়ের চোখে এতটুকু জল নেই ?
-------বলিস কি রে গৌতমী ?
------তবে আর বলছি কি ?
-------উনি মেয়েকে রাজ্য দিতে চেয়েছিলেন শুনেছি। বোধহয় কানে বিষ ঢালবেন মেয়ের...সব্বাইকে ছুটি দিয়ে দিলেন।
------ যেমন চেহারা তেমনি মন.....
*************
কুবেরনাগ কক্ষে ঢুকে দেখলেন , প্রভাবতী রাণীর সাজে সজ্জিতা। তিনি কন্যার সামনে বসলেন,
------ তুমি জানো পুত্রী , তোমার মধ্যে সম্রাজ্ঞী হওয়ার সমস্ত গুণ থাকা সত্ত্বেও তোমাকে বাকাটক রাজ্যে পাঠানো হচ্ছে। ------আমি আর তুমি দুজনেই রাজার হাতের ক্রীড়নকমাত্র। ঐ অযোগ্য কুমারগুপ্ত ও গোবিন্দগুপ্ত হবে গুপ্তসাম্রাজ্যের অধিশ্বর। আর তুমি ? বধূ হয়ে অপেক্ষা করবে কখন রাজা দয়া করে তোমার কক্ষে আসবেন !!
একটু চুপ করে তাকালেন কন্যার মুখের দিকে। সেখানে নব বধূর প্রেমাচ্ছন্নতা ছাড়া কিছু নজরে পড়লো না। তিনি বুঝললেন, এখন বলে লাভ নেই , প্রভাবতীর সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠতে দেরি আছে। সম্রাজ্ঞীর মনে নারীর কোমলতা, দূর্বলতা মাত্র। তাই অপেক্ষা করতে হবে আরোও কিছুদিন....... তবে কুবেরনাগ বিশ্বাস করেন , তাঁর রক্ত বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা......
*************
*************
নন্দীবর্ধন নগরী ম্লান এখন। পৃথ্বীসেন-পুত্র রুদ্রসেনের শরীর ক্রমশ দূর্বল হয়ে আসছে। প্রতাপশালী রাজা রুদ্রসেন আজ শয্যাগত। কোনো এক অজানা ব্যাধি তাঁর শরীরকে বলহীন করে তুলছে প্রতিদিন। বমন আর অজীর্ণ তাঁকে প্রায় মৃতবৎ করে ফেলেছে। তিনি বাধ্য হয়েছেন রাজকার্যে রাণী প্রভাবতীর উপর নির্ভর করতে। তিনি সত্যই বুদ্ধিমতি......
প্রভাবতীও বিচক্ষণতার সাথে শিখে নিয়েছেন সবকিছু । কিন্তু রাজা রুদ্রসেন, যেন কিসের ইঙ্গিত পাচ্ছেন। যেন একটু একটু করে শরীরে বিষক্রিয়া হচ্ছে প্রতিদিন । রাজবৈদ্যেরও সেটাই মত। কিন্তু কি করে এমন হচ্ছে ? কে বিষ দিতে পারে !
রাজা রুদ্রসেনের মনে ধীরে ধীরে একটা সন্দেহ যেন দানা বেঁধেছে । তিনি রাণীর দেওয়া দুগ্ধ পান করলেই......কিন্তু না ! না ! তিনি এসব কি ভাবছেন ? মনেপ্রাণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন, তাঁর সন্দেহ যেন ভ্রান্ত হয় !!
রাণী প্রভাবতী এক পাত্র ধুমায়িত দুগ্ধ নিয়ে এলেন। এতো দাসদাসী থাকতেও এই সময় রাজাকে দুধটুকু তিনিই পান করান।
------ মহারাজ, এই দুধটুকু পান করুন ------
------ না রাণী, ঐ দুধ পান করার পরই আমার কেমন বমনের উদ্রেক হয়....প্রতিবার কষ্ট হয় খুব.......দিওনা আমায় দিওনা....কি ওটা ?
অধরে হাসি এনে মোহময়ী হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন প্রভাবতী।
------ কি বলছেন রাজা ! এটুকু না হলে বাঁচবেন কি করে ?
চোখে মিনতি ফুটে উঠলো মহারাজ রুদ্রসেনের, কাতরভাবে বললেন ,
------ কি তোমার নেই রাণী ? তবু কেন এ নিষ্ঠুরতা ?
প্রভাবতীর মুখ এবার কুটিল হয়ে উঠলো। আস্তে করে দ্বার রূদ্ধ করে দিলেন। ফিরে এলেন রাজার শয্যাপার্শ্বে। রাজার শীর্ণ শরীর উত্তেজনায়, আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো। বক্ষপঞ্জর ওঠা নামা করছে , অতি কষ্টে বললেন ,
------ কি চাও প্রভাবতী ?
------ রাজত্ব মহারাজ !
------ চাইলেই দিতাম.....
------ কতোটা মহারাজ ? আমার সবটা চাই। ক্ষমতা চাই....শক্তি চাই... প্রতিপত্তি চাই.....সিংহাসনের পার্শ্বের আসন নয়।
সিংহাসন চাই....তাই আপনাকে মরতে হবে
রাজা রুদ্রসেন.....মরতেই হবে।
রুদ্রসেন বলার চেষ্টা করলেন,
------ তোমাকে আমি ভালোবাসি প্রভাবতী....আমার রাজ্য সে তো তোমারই.....
কিন্তু তাঁর আর্তি মনেই রইলো.......
প্রভাবতী তার বলিষ্ঠ আঙুলের চাপে রাজার ওষ্ঠের মধ্য দিয়ে ঢেলে দিতে থাকেন বিষ মিশ্রিত দুগ্ধ। আর মাত্র একটু সময় ।
আজ অনেকটা বিষ তিনি ঢেলে দিয়েছেন
রাজার শরীরে। এ সহ্য করতে পারবেন না তিনি......একটা জয়ের হাসি ফুটে উঠলো প্রভাবতী গুপ্তর অধরে.......
রাজার দূর্বল হাত শিথিল হয়ে এলো, ঝুলে পড়লো পালঙ্ক থেকে..... চক্ষুদুটি ঘোলাটে মণিদুটি নিষ্প্রভ.... শুধু বসা গালের ঢাল বেয়ে জমা হয় অশ্রু......শুধু হিক্কার সাথে সামান্য দুগ্ধ ওষ্ঠের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়লো।
প্রভাবতী বক্ষে কর্ণ রেখে দেখলেন, কতক্ষণে স্পন্দন স্তব্ধ হয় !
----তাঁকে ক্রন্দন করতে হবে তো ! এতোক্ষণে রাজবৈদ্য হয়তো প্রেতলোকে রাজার জন্য অপেক্ষা করছেন, হেসে ওঠেন পিশাচিনী, তিনি তো সবটাই বুঝতেন, তাঁকে তো বাঁচিয়ে রাখা যেতোনা.....
তাই শুদ্রককে দায়িত্ব দেওয়া ছিলো রাজবৈদ্যকে মুক্তি দেওয়ার.....বিশ্বস্ত সে। শুদ্রক রাজকর্মচারী হলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। রাজকার্যে তার প্রয়োজন হবে.....
শুধু রাজা রুদ্রসেনের রহস্যময় মৃত্যু মুখ ঢাকবে ইতিহাসের পাতায়।