কুমারী মা(৪র্থ পর্ব)
কুমারী মা(৪র্থ পর্ব)
দুর্গাদাসের কেমন বিদ্রোহী বিপ্লবী মনেও ভয় হচ্ছিল।স্ত্রীকে একটু ডাকা ডাকি করতেই স্ত্রী উঠে এসে চাবি খুলে দিল।কোন কথা বলল না।দুর্গাদাস জিজ্ঞেস করল,আমার চাবিতে খুলল না, আর তোমারটায় তালা খুলল কেন! তালাটা কী পাল্টেছ!
গিন্নি উত্তর দিল না।দুর্গাদাসের সন্দেহ হল,এ তো তার স্ত্রীর মত চলন নয়,পোষাকে উচ্চতায় কেমন ভিন্ন মনে হল, দুর্গাদাস ভয়ে জোরে চিৎকার করছিল, দোতলার উপর থেকে স্ত্রী আর তিন কন্যা ছুটে নেমে এসেছিল।
দুর্গাদাস জিজ্ঞেস করল "তুমি কী আগে বারান্দার চাবি খুলতে আসোনি!"
স্ত্রী জানাল,"আমি তো দোতলায় মেয়েদের সাথে ছিলাম ওরা পড়াশোনার করছিল ,আমি একটু শুয়েছিলাম।"
"তবে চাবি কে খুলল!"
"চাবি তো তোমারও কাছে আছে !"
"আমার চাবিতে খুলছিল না।"
"একই তালা এক চাবি কাল খুললে আজ খুলছিল না! কি সব ভুলভাল বকছ! পাটি পাটি করে মনে হচ্ছে মাথাটাই গেছে তোমার।"
দুর্গাদাস তর্ক না করে,ঐ তালায় ,তার চাবি দিয়ে খুলে দেখল এবার ঠিক খোলা যাচ্ছ।
দুর্গাদাস এবার ভয়ার্ত্ত স্বরে বলল " একটা শাড়ি পড়া মেয়ে মাথা ঘোমটায় ঢাকা রান্নার ঘরের দিকে দেখলাম গেল। আবছা আলোয় প্রথম তোমাকেই ভেবেছিলাম।"
মায়া বিরক্ত, বলল,
"নেশা করোনি তো! তারপর বলল, রান্নার ঘরে তোমার খাবার আছে, গরম করে খেয়ে নাও, আমরা উপরে যাচ্ছি।"
"আজ তুমিই খেতে দাও, না হলে, না খেয়েই আমি দোতলার ঘরে শুতে চললাম।"
দুর্গাদাসের ভীষণ ভয় করছিল রান্নার ঘরে কেউ ঢুকল নিজের চোখে দেখেছে, স্ত্রীকে বললে বিশ্বাস করবে না , হয়ত মাতাল ভাববে।ইদানিং মানসিক চাপে সে আবার পরিমিত মদ খাচ্ছিল, না হলে ঘুম হয় না।
যতই হোক স্ত্রী! তাই রান্নার ঘরে মায়া গেল কেউ নেই ।খাবার গরম করে খেতে দিল।
দুর্গাদাস স্ত্রীকে অনুরোধ করল ,
"আমি ঘরে ঢোকার পর তুমি তোমার মেয়েদের ঘরে যাবে।"
হঠাৎই সদরের একটা শব্দ কেউ যেন সদরের দরজার কপাট খুলে বেড়িয়ে গেল। মায়া চমকে ছুটে রারেন্দা থেকেই সদরের দরজা দেখল,ভিতর থেকেই খিল বন্ধ। মায়ার মনে কোন ভয় বা সংশয় হয়নি, ভাবছিল শোনার ভ্রম।
এ দিনের পর থেকে দূর্গাদাস রাত আটটার মধ্যেই বাড়ি ফিরত, তখন পাড়ার মানুষের অল্প হলেও রাস্তা আর দূর্গামন্ডবের পাস দিয়ে যাতায়াত করত।নটার পর যেন নির্জন নিঝুম হয়ে যেত।একা একা কেউ দূর্গা মন্ডবের পাশ বরাবর যাতায়াত করার সাহস হতো না। গেলে দুতিন জন বা তার বেশী একসাথে যাতায়াত করত। যেদিন তার বাড়ি ফিরতে বেশী রাত হবে অনুমান করত । সেদিন দুর্গাদাস বাড়িতে বলে যেত,
"গিন্নি আজ রাতে ফিরব না।পাটির কোন কমরেড ঘরে শুয়ে পড়ব।সদরের খিল ভিতর থেকে দিয়ে দেবে।"
রাতের একা ঘরে শুয়ে দুর্গাদাসের একটু ভয় ভয় করত, একা শোয়া, কিন্তু কিছু বলতে পারত না। ঘরের জানালা খোলা থাকলে রাতে মাঝে মাঝেই কিছু আবছা দেখত যেন কেউ দাঁড়িয়ে ! তাকে দেখছে ! দোতলার জনালা এত উঁচুতে কে আসবে! শেষে দুর্গাদাস গরমের সময়ও তাই সব দরজা জানালা বন্ধ করে হ্যারিকেন একটু কম উসকে হালকা আলোর মধ্যেই রাত শয়ন করত। সব আলো নিভিয়ে করে তার ঘন অন্ধকার ঘরে ঘুমের স্বভাব হলেও, এখন গাঢ় অন্ধকারে, রাতে ঘরে ঘুমাতে ভয় ভয় করত।
সে সময়ে গ্রামে বিদ্যুতে ছিল না।গরমে কষ্ট হলেও উপায় কী,তাল পাতার হাত পাখাই ভরসা। তীব্র একটা অপরাধবোধ থেকে ভ্রম বশত তার এমন ভয়! না সত্যিই কিছু একটা অলৌকিক উপস্থিতি কমিউনিস্ট দূর্গাদাস নাস্তিক মনে বার বার দ্বন্দ্ব হয়। কিন্তু কোন সঠিক উত্তর পেতো না,অন্যদের বলতে তার লজ্জা সংকোচ হতো।
শ্রাবন্তী হ্যারিকেন হাতে বাড়ি ঢুকতে দেখে মায়া জিজ্ঞেস করল,
"তুমি এত রাতে একা বাড়ির বাইরে কোথায় গেছিলে!"
"দূর্গা মন্ডবে,মাকে প্রনাম করে এলাম।"
মায়া এ কদিনের ঘটনাক্রম জানে,দীর্ঘ পাঁচ বছর এ গ্রামেরই যে মৃৎশিল্পী তাদের বারোয়ারী পুজোর দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে এবার এক মেটে করার পর আর আসেনি। জবাব দিয়ে বলেছে,
"ঐ দূর্গা মন্ডবে আর আমি প্রতিমা তৈরি করব না। আপনারা দরকার হলে আমার বাড়িতে দূর্গা প্রতিমা তৈরী করি, পূজার আগেদিন এক বারে রেডিমেড কিনে নিয়ে যাবেন।"
কেন কী রহস্য ! সে কিন্তু কিছুই খুলে বলেনি।
দুর্গাদাসের বাড়ির স্ত্রী মেয়েরা এবার পুজোয় যোগ দেবে না স্থির করলেও,দূর্গাদাস তা জানত না।তাই পাড়ার গ্রহনযোগ্যতা আবার প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক টাকা চাঁদা অগ্রিম দিয়েছিল। শ্রাবন্তীকে দেখে মায়া বলল,
"তুমিও বুঝি খুব দূর্গা মায়ের বড় ভক্ত!"
"হ্যাঁ মামীমা, মিতালীর মতই!"
মায়া কেমন দিশেহারা হয়ে বলল,
"তুমি মিতালীর বিষয়ে কী জানো!"
"আমি সব জানি ,কেন মামীমা!"
"না মানে আমি এবিষয়ে কিছুই তোমায় বলি নি তো! বিলাস বা তোমার শাশুড়ি মা হয়ত বলেছে । তবে ওরাও সব জানে না।"
"আমি সব জানি," বলে গম্ভীর হয়ে চলে গেল।
খানিকক্ষন পর মায়া ,বিলাস আর শ্রাবন্তী ঘরে চা আর হালকা টিফিন নিয়ে গেল।এতটা রাত হয়েছে একটু পরেই তো তাদের আবার ডিনার বা রাতের খেতে দেবে।ভাগনা ও ভাগিনবৌ আসবে মায়ি জানত। দূর্গাদাস আদরের ভাগনা আর ভাগিনবৌ এর জন্য খাবারের ভালো আয়োজন করেছিল। কতদিন ভাগনা এবাড়ীতে খায়নি রাত কাটায় নি।আজ তাই দূর্গাদাস আটটার মধ্যেই বাড়ি চলে এসেছিল।আর পাটির তেমন কাজও এখন নেই।
মায়া দেখল কপাট লাগানো,কপাট খুলতেই চমকে ওঠে,শ্রাবন্তী ক্রমাগত বিলাসের দুই গালে চাটিয়ে যাচ্ছে আর ক্ষোভে কী সব বলছে। কপাট খোলার শব্দ পেয়ে শ্রাবন্তী পিছন ফিরে তাকাল।চোখ দুটো লাল টকটকে মুখে ক্ষোভ আর ক্রোধ ফেটে বের হচ্ছিল। মায়াকে দেখে সংযত হল, মুখচোখ যেন শান্ত স্বাভাবিক হল।
তাড়াতাড়ি ঘুরে বসে বলল,
"আবার আপনি কেন ! আমাকে ডাকতে পারতেন মামীমা, আমি চা খাবার নিয়ে আসতাম!"
বিভ্রান্ত মায়া বলে ,
"ঠিক আছে মা অনেক জার্নি করে আজ এসেছ! একটু রেষ্ট নাও।"
তারপর মায়া চা হালকা জলখাবার তাদের খাটের এক পাশে রেখে পিছন ফিরতেই বিলাস কেমন ভয়ে বিবর্ণ মুখে বলে,
" মামীমা তুমি এ ঘরেই বসো শ্রাবন্তীর সাথে দুটো কথা বলো।"
শ্রাবন্তী আগ বাড়িয়ে বলে ,
"তাই হয় নাকি,সেসব পরে হবে এখন মামীমার অনেক কাজ আমাদের জন্য কত কিছু রান্নার আয়োজন করছেন, তাই না মামীমা!"
"তুমি তা হলে মামীমাকে একটু সাহায্য করেগে।"
মায়া পিছন ফিরে সব শুনছিল হঠাৎই বাপরে! বলে বিলাস ছুটে ঘর থেকেই পালাতে গেল।
মায়া তার হাত এমন পাকড়ে ধরেছিল মায়া দেখল বিলাস কাহিল হয়ে বলে,
" ছাড়ো ছাড়ো হাত ভেঙ্গে যাবে।"
মায়া আর দাঁড়াল না,সোজা ঘর থেকে বের হয়ে সব কথা দূর্গাদাসের ঘরে গিয়ে বলল।
হন্তদন্ত দূর্গাদাস আদরের ভাগনাকে বাঁচাতে ছুটে আসে কিন্তু ঘর ভিতর থেকে বন্ধ, ভিতর থেকে শ্রাবন্তীর হুঙ্কার আর বিলাসের কান্না আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল।
মায়া,আর দুর্গাদাসের কানে আসছিল,
"তুমি শালা ফুর্তি মারলে মিতালীর পেট করলে, ওর গর্ভে তোমার সন্তান জেনে শুনেই বাড়ি পালালে, মিতালীকে বাপ খুন করল, তুমি শালা পালিয়ে বেড়ালে ! ধান বেচে পুলিশের ঘুষের টাকা মামাকে দিলে, আর ছ মাস পর কোন বিবেক নেই দুঃখ নেই আবার আমাকে বিয়ে করলে ! মিতালীর কথা একবারও ভেবেছ ! সে তো তোমায় খুব বিশ্বাস করেছিল, ভালোবেসে ছিল, শালা লম্পট প্রতারক চিটিংবাজ শয়তান।"
সঙ্গে বার বার চপেটাঘাতের শব্দ। বিলাসে ক্রন্দন আর ক্ষমা ভিক্ষা, করে বলল,
"তুমি এত সব জানলে কী করে!"
"শালা মিথ্যুক উপরে খুব ভালোমানুষী না !"
বলে কী করল কে জানে বিলাস তীব্র যন্ত্রণার ককিয়ে কেঁদে উঠল। দুর্গাদাস মায়া জোরে জোরে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতেই তাদের ঘরের কপাট খুলে গেল। শ্রাবন্তী বিলাসের বুকের উপর চেপে বসে,ক্রোধে উন্মাদ হয়ে যেন তার চুল টেনে টেনে ছিঁড়ছিল।
মায়া ভয়ে কাঁপছিল, দূর্গাদাস ভাগনাকে বাঁচাতে এ ঘরের কপাট ভিতর থেকে লাগানো কাঠের হুড়কো করে শ্রাবন্তীর দিকে এগুতেই, সেই যেন গোঁঙ্গানীর শব্দ! দুর্গাদাসের মনে পরে গেল। তীব্র আক্রোশে শ্রাবন্তী পিছু ফিরে দুর্গাদাসের হাতের ধরা কাঠের হুড়কো টেনে ফেলেদিল ।এবার আক্রমনের লক্ষ্য দুর্গাদাস।শ্রাবন্তীর মত একটা একুশ বছরের মেয়ের শরীরে এত বল এত শক্তি! দুর্গাদাস বিলাসদের বিচলিত করছিল।
শ্রাবন্তী দুর্গাদাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, চড় থাপ্পর আর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মারছিল। নিষ্ঠুর ভাবে,এলো পাতাড়ি,মারছিল স্থানে অস্থানে। বিকট চিৎকার করে বলেছিল "শালা, দেশের ঐতিহ্য সাস্কৃতি জানিস! কুন্তিও তো কুমারীকালীন মা,তাকে তো তার বাপ, গলা টিপে মারেনি! সে কুরুর বড়রানী রাজমহিষী ছিল ,যদি কুরু না মরত তবে সেই তো পাঠরানী ,মহাভারত অন্য ভাবে লেখা সম্ভব নয় তাই অভিশপ্ত কুরুর অকাল মৃত্যু।এ সব জানিস! বেদ গীতা জানিস! পুড়ান নিয়ে মজা করে গালগল্প অনেক করিস। আসল সনাতন ধর্মে, ঈশ্বর এক, নিরাকার, বাকী সব কল্পনা।নাস্তিক হয়ে দুর্গা মন্ডব, দুর্গা পুজো করবি! কুমারী পুজো করবি ! আর কুমারী মাকে গলা টিপে খুনও করবি! শালা তোদের মত ভন্ডদের কোন ধর্মের স্থান নেই।"
এইসব কথা চিৎকার করে বলেছিল আর মারধর করছিল একানাগাড়ে। দুর্গাদাসের উপর ক্ষোভ ক্রোধ টা যেন বিলাসের চেয়েও অনেক গুন বেশী!
দুর্গাদাস বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত শরীর শ্রাবন্তীর মত নরম কোমল শরীরের এক মেয়ের শক্তির কাছে যেন তুচ্ছ। হাতির সাথে ছাগলের যুদ্ধ! না বিনা যুদ্ধে নার্ভাস দুর্গাদাস নীরবে মার খাচ্ছিল কে জানে! যেমন মিতালী সেদিন, চরম নার্ভাস দুর্বল শরীরে বাবার আকস্মিক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে শুধুই কাঁপছিল, নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা ভুলে গেছিল। আজ দুর্গাদাসের সেই হাল।
দুর্গাদাস হাঁপাচ্ছিল কষ্ট যন্ত্রণার ছট ফট করেছিল। নাক থেকে রক্ত ঝড়ছিল।বিলাস ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। মায়া হতভম্ব এতক্ষণ তার মনে হচ্ছিল ঠিক হচ্ছে।এবার ভাবল যদি লোক টা মরে যায়! বিধবা হতে তার দুঃখ নেই।কিন্তু জমির চাষআবাদ সংসারের পুরুষ সে একা,আর মরলে পুলিশ আইন কানুন কত ঝামেলা।
তাই,মায়া কাঁদতে কাঁদতে "শ্রাবন্তীর পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল,
"এবার ক্ষমা কর মা, তুই মিতালী ,শ্রাবন্তীর রূপে এসেছিস,আমি বুঝেছি, আমি তোর মা পায়ে ধরছি, সেদিন আমিও তো তোর মায়ের দ্বায়িত্ব পালন করেনি,খানিক ভয়ে আর খানিক মা দূর্গার প্রতি ভরসা করেছিলাম। আমি আর এই সব তথাকথিত দেবদেবী পূজোতে বিশ্বাস রাখি না। পরম ঈশ্বর তাকেই মানি।ওরা শাস্তি এজন্মেই পাবে,তুই কেন মা নরক থেকে দেবত্ত্ব পেয়ে, নরকের কীট দের শাস্তি দিয়ে হাত গন্ধ করছিস!"
মায়ার কথার যেন প্রতিশোধ নেেওয়া বাসনা একটু করেছিল নিজেকে সংযত করে শ্রাবন্তীর রূপে মিতালী বলল,
"যাও দূর্গার মন্ডবে শ্রাবন্তী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওকে উদ্ধার করো, আমি ওর শক্তি নিয়েই আজ আমার কিছু রাগ প্রতিশোধ নিলাম। তবে আমি ক্ষান্ত দেবো না।আরও এদের ফল ভুগতে হবে।"
কেমন যেন হুঙ্কারের সুর এসব বলে, শ্রাবন্তীর মুখটায় মিতালীর মুখ ফুটে উঠল, তার পর অদৃশ্য হল।
ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরে পাগলের মত শ্রাবন্তী শ্রাবন্তী বলে বিলাস ছুটল দূর্গা মন্ডবের দিকে, পিছন পিছন মায়া আর আহত দূর্গাদাস। দেবীর কাঠামোর একমেটে হয়ে পড়েছিল। তার সামনে শ্রাবন্তী ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রনাম করতেই তার চেতনা হারায়। বিলাস শ্রাবন্তীকে কোলে তুলে মামার বাড়ির নিয়ে এল।
অনেক সেবা শুশ্রুশা আর পরিচর্যায় শ্রাবন্তীর চেতনা ফিরল তখন ভোর হয়েছিল। তিন কন্যাদের মায়া রাতের খাবার খেতে দিলেও বাকিদের খাবার মানসিক পরিস্থিতি ছিল না।
দূর্গাদাস বুঝেছিল অলৌকিক শক্তি আছে।দুষ্ট মানুষের স্বভাব দুষ্ট, মিতালীর অতৃপ্ত ক্ষোভিত আত্মার মুক্তির জন্য নয়,জব্দ করতে তেমন কোন তান্ত্রিকের খোঁজ করছিল। অনেক কষ্টে তান্ত্রিক ভুত সিদ্ধ বাবার সন্ধান পায়।গঙ্গা সাগর মেলায় তিনি এসেছিলেন।একসময়ের শিক্ষিত আই আইটি কলেজর অধ্যাপক। এখন উনি সংসার বিরাগী হরিদ্বারে নামী আশ্রমে থাকেন।তার শিষ্য বিলাসের এক সহকর্মীর শ্বশুর। গত গঙ্গার সাগর মেলায় আলাপ ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।কয়েক দিন শিষ্য বাড়ী মগরায় ঐ সাধক উঠেছিলেন আরও কিছু মানুষ তার শিষ্য হতে ইচ্ছুক। সেই জন্যই এক ধর্মসভা আয়োজন করা হয়েছিল। তার পার্থিব ও অলৌকিক জগত বিষয়ে জ্ঞান,বিষয়ক এক ভাষন ও তথাকথিত পার্থিব জীবনের সাফল্য অভিজ্ঞতা ও তার নিরাশতা উপর আলোকপাত এই অনুষ্ঠানে মুল বিষয়।
দুর্গাদাস ও বিলাস আর দেরী করেনি, ঐ অনুষ্ঠানে মামা ভাগ্নে গেছিল। এক সময় তারা বাবাজীর অবসর সময়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করলেন।
তন্ত্র সিদ্ধ পন্ডিত বাবাজী জ্ঞানস্বামীকে তাদের এই দুষ্টা আত্মার থেকে মুক্তি ও শুদ্ধভাবে যাতে মন্ডবে দুর্গার আরাধনা করতে পারে তার বিহিত চাইলেন।
তাদের দেখেই বাবাজী খুব হাসছিলেন, রসীকতা ভরা কন্ঠে বললেন,
"নিজদের কী ভাবো! দোষ করেও ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়া যায় কী!"
দুর্গাদাস বলে "বাবা ভুলের কী ক্ষমা হয় না!"
"প্রতিহিংসা বাদ দাও,আত্মমন্থনে চিত্তশুদ্ধি করো। তোমরা চাইছ মিতালীকে ঐ তোমাদের দূর্গা মন্ডব থেকেই দুর করতে!"
"ঠিক তাই, ও আমাদের দূর্গা পূজো করতে দেবেনা।পুরোহিত জবাব দিয়েছে, মৃৎশিল্পী এক মেটে করে প্রতিমা করা বন্ধ করেছে।রাতে ভয়ে দেবীর মন্ডবে কেউ যেতে পারে না ---"
বাবাজী এবার রেগে তাদের কথা মাঝেই থামিয়ে বলল,"ওরে মূর্খ বুঝতে পারছিস না! দূর্গার রূপে ঈশ্বর নিজে, মিতালীকে নিজের করে নিয়েছে। ওকে তাড়ানো মানে দেবীকে বা ঈশ্বরকেই তো তাড়ানোর পরিকল্পনা! যা চরম পাপ। পুরোহিত আর মৃৎশিল্পী মুখে বলেনি, ওরা মায়ের স্বপ্ন পেয়ে তোদের এই দাম্ভিকতায় ভরা অনৈতিক পুজো থেকে নিজেদের দুরে রেখেছে, এবার ঢাকী নাপিত মালী কেউ আসবে না।"
দুর্গাদাস ভেঙ্গে পরে, " তাহলে মন্ডবে আর পুজো হবে না! পরিত্যক্ত হয়ে থাকবে!"
"অনেক মন্দির অনেক মন্ডব এমন পরিত্যক্ত এতে ঈশ্বরের কিছুই যায় আসে না।ঈশ্বরের ব্যপ্তি অনন্ত। ঈশ্বরের সাপেক্ষে মানুষ কেন! সমগ্র পৃথিবী তুচ্ছ। যারাকে তোরা ধর্ম প্রবর্তক বলিস, ধর্ম বলিস, সব কল্পনা,একক মনে ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। একমাত্র জগতগুরু শংকরাচার্য্যের বাণী "ব্রম্ভ সত্য জগত মিথ্যা," এই ধারনা উপলব্ধি কর।আমরা সব মিথ্যা অনিত্য আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ। ধ্যান অধ্যয়ন জ্ঞান একমাত্র মনের অন্ধকার দুর করে।
ভোগ অহংকার অন্ধ অনুকরণ ত্যাগ কর,এর চেয়ে বড় পাপ আর কিছুই নেই। নিজেকে অমৃতে সন্তান ঈশ্বরের অংশ ভাবার মত আত্মবিশ্বাসী কর। তবে তোরা যে পাপ করেছিস তা পার্থিব,এই ইহলৌকিক জীবন তাই তোদের যন্ত্রণাময় হবে। প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাধর মানেই কিন্তু সুখী নয় ,সফল নয়। অন্তর তাদের অতৃপ্ত হতাশাময়।"
দুর্গাদাস নত মুখে বলে "আমরা অনুতপ্ত হয়ত বাকী জীবন আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী আর পরিচিত মানুষ জনের অন্তরে ঘৃনা নিয়ে থাকব।"
"ঠিক,এমন কত ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নেতা ধর্ম গুরু,ধর্ম প্রবর্তক কোটি কোটি মানুষের ঘৃনা পায়।তারাও এক অনামী সাধারণ মানুষের চেয়েও নিকৃষ্ট অধম পাপী। অন্ধ অনুকরণকারীদের দাসত্বে তারা তৃপ্ত নয়,বরং অন্তরে তাদের নির্বোধ পথভ্রষ্ট অমানুষ ভাবে। যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েও অতৃপ্ত এটাই তাদের ভক্ত অন্ধ অনুগামীদের প্রতি অন্তরের কথা।"
" এখন বাবা আমাদের করণীয় কী অনুগ্রহ করে পরামর্শ দিন।"
"সত্যের কাছে আত্ম সমর্পন কর,বিনয়ী হয়ে অন্যে কোন দোষ ত্রুটি দেখার আগে নিজের অন্তরের লোভ মোহ ঘৃনা হিংসা,আমিত্ব ত্যাগ কর। অন্যদের প্রতি দরদী দ্বায়িত্ববোধ সম্পন্ন হবার চেষ্টা কর।মনকে সদা সুখী উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা কর।কদিনের এই জীবন এত অহংকার, মান ,লালসা কীসের! এটাই চরম পাপ, মূর্খতা যত দুঃখ কষ্টের কারণ। যদি কোন স্বপ্নাদেশ পাস পালন করবি, নচেৎ ঐ মন্ডবে দুর্গা পুজো করার দরকার নেই।"
মিতালীর মা , মহালয়ার রাতে স্বপ্ন পান,দেবী মঞ্চে প্রতিমা হীন, ঘটে চিন্ময়ী রূপে আমার পূজা করবি।ঐ খড়বাঁশের কাঠামোয় পাপী দুরাত্মা পা দিয়ে উঠে, তোর মেয়ের মৃতদেহ মন্ডবের ছাদের হুক থেকে ঝুলিয়েছিল। আমার ইচ্ছা ক্রমেই দড়িটা এমন নেমে এসেছিল ওটা আত্মহত্যা নয়, খুন সহজ প্রমান হয়,এ জন্য তোর মেয়ে পা মেঝেতে নেমে আসে।ওর সব ইচ্ছায় আমি সঙ্গ দিয়েছি,ও ক্লান্ত আর প্রতিহিংসা প্রতিশোধ চায় না।ওর অতৃপ্ত ক্ষোভিত আত্মার মুক্তি দিলাম।ওর আয়ু কম ছিল। দুঃখ করিস না।পুজোয় তুই অংশ নিবি,তোর স্বামী কিছু পাপ কর্মের জন্য ওর মতিভ্রমে কন্যাকে হত্যা করেছিল। অপযশ অপমান অসম্মান আর মানুষের ঘৃনা ওর প্রাপ্য ছিল।মঞ্চে মিতালী নাম যুক্ত করবি, ওকে স্মৃতিতে রাখবি। প্রথম কুমারী মিতালীর এই অকাল মৃত্যু , আমাকে ব্যাথিত করেছে। ভবিষ্যতে আর কুমারী পুজো করবি না। অনাড়ম্বর ভাবে আমার পূজা আরাধনা করবি।মন্ডবে আজ থেকে আর কোন অশুভ প্রভাব থাকবে না।"
পরদিন দেবী পক্ষের সূচনা, মায়া স্বামীকে স্বপ্নের কথা জানায়।পুরোহিত ও পাড়ার যতসব উদ্যোগী যুবকদের ডেকে সব বলা হলে, এই ভাবেই ঐ বছর পূজার আয়োজন হয়েছিল।আজও ঠিক এভাবেই পূজার আয়োজন হয়ে আসছে। এই বারোয়ারী পূজা প্রতিমা হীন ঘটে দেবীর চিন্ময়ী রূপেই দেবী প্রতিষ্ঠিত করে পুজো হয়।বাহ্যিক ফুর্তি হৈহুল্লোর নয়,ভক্তি সহকারে পূজার হয়।আর মন্ডবের নাম মিতালী সঙ্ঘ। বিশেষ কারনে গ্রামের নাম ও ঐ হতভাগা মেয়েটির নাম বাদে , বাকিদের সব নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।ঘটনাটি অনেকাংশেই সত্য সাতের দশকের প্রথমে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনা। এখন হয়ত স্থানীয় নব প্রজন্মের অনেকের স্মৃতির অগোচরে বা অজ্ঞাত।
দুর্গাদাসের মৃত্যু হয়েছিল অনেকদিন আগেই । তবে নাস্তিকতা ছেড়ে সে বড় ধার্মিক হয়েছিল।রাজনীতি ছেড়ে সমাজ সেবা আর কন্যা ভ্রুন হত্যার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। জন সচেতনতা আর সমাজে লিঙ্গ সাম্যতা গুরুত্ব বিয়য়ে সে পরে অনেক আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। তবুও তার মনের মধ্যে ছিল তীব্র দহন ,অনুতাপ আর অনুশোচনায় মাঝে মাঝেই ছি ছি ছি ছি ছি খেদোক্তিতে আত্ম ভর্ৎসনা করত। একা আপন মনে থাকলেই অহরহ এটা তার মুদ্রাদোষে পরিনত হয়েছিল। তাই কাজ নিয়ে আর মানুষের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করত।
সমাপ্ত