Subhashish Chakraborty

Classics Crime Horror

4.7  

Subhashish Chakraborty

Classics Crime Horror

তবু মনে রেখো

তবু মনে রেখো

9 mins
1.0K


অদ্ভুত, তাই না?

একটা ঘুপচি ঘর আর একটা দরজা, বাইরে থেকে দেওয়া। কেমন যেন একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ, ঠান্ডা দেয়ালে শ্যাওলার লেই লেগে আছে, ঠান্ডা মাটিটা যেন রোঁয়া দেওয়া সরীসৃপের গায়ের মতন।

অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না কি করে ঘরটায় এলাম। শুধু তাই না, কখন এলাম সেটাও কিন্তু মনে পড়ছে না।

আবছায়া ঘরে কিছুক্ষণ হাতড়ে হাতড়ে আবার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। কেউ দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে, তাই না? দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে এগিয়ে এসে দরজায় কান রাখলাম।

হ্যাঁ....হ্যাঁ.... কে যেন কি বলছে.....

কে....কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে, তাই না?

১.

২৫শে বৈশাখ এলে, রবীন্দ্রনাথকে যত না মনে পড়ে, মেজদার কথা মনে পড়ে বেশি। মেজদা। মেজদাদু। আমার নিজের দাদু'র মেজ-ভাই। মেজদার ও ওইদিন জন্মদিনই। ঠিক ঠিক রবীন্দ্রনাথের জন্মের আশি বছর বাদ। হয়ত ওই জন্যই ওনার নাম ও রাখা হয়েছিল ভানু। ভানু সিংহের ভানু। রবি ঠাকুরের সুভেনিয়ার। তাঁর শেষের কবিতার শেষ অক্ষরটা। মেজ-দার মধ্যে যেন দাঁড়-কাকের মতন এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অদ্ভুত এক খোরাক হয়ে।

মেজদাদু বিয়ে করেননি। সারা জীবন গান-বাজনা, আঁকা, লেখা-লেখি করেই কাটিয়েছেন। পরিবারে তাঁর পরিচিতিটি-ই ছিল হলো খাবারের টেবিলে খেতে বসে, খালি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যাওয়া। কিংবা পুজোর সময় পার্বনি পাওয়ার দিন। অথবা বাড়ির বাচ্ছাদের আইসক্রিম খাবার জন্য পয়সা চাইবার সময়।

এখন ভাবলে হাসি লাগে, তাই না? মেজদা। অদ্ভুত এক মানুষ ছিলেন। কিছু মানুষ চিরকাল থাকে ফ্যামিলিতে -- ঘাড় মটকানোর জন্য। মেজদা ওরকমই একটি লোক ছিলেন।

মেজদার সাথে শেষ দেখা সেই যে বার হায়দ্রাবাদ চলে এলাম, কলকাতা ছেড়ে। কলকাতা মুখো অনেক বছর হই নি। প্রয়োজনই হয়নি -- মা ও এসে থাকা শুরু করল সাথে, কিছুদিন বাদে বাবা ও।

পড়ে রইলো কলকাতার পুরোনো সেই লাল বাড়িটা। সাথে এক রাশ স্মৃতি নিয়ে ছোট কাকা, ছোটো কাকার ছেলে, বৌ। খুব তাড়াতাড়িই দিপু বিয়েটা করে নিয়েছিল যে। ভাইদের মধ্যে ও-ই প্রথম।

আর মেজদা।

পায়ের শিন বোনস ভেঙে শয্যা নিয়ে চুপচাপ মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়েছিল অনেক গুলো মাস, bedridden হয়ে। বিধাতার এক অদ্ভুত পরিহাস -- একা একা গান গাওয়া। তিনতলার ছাতের ঘরে খাটে শুয়ে গান গাওয়া। "....এখন আমার বেলা নাহি আর....বহিবো একাকী বিরহের ভার...", আর শুধু চাতক পাখির মতন চেয়ে থাকা -- কখন যদি কেউ কিছু খাবার নিয়ে আসে। কখন যদি কেউ একটু গল্প করতে আসে। কখন যদি কেউ একটু জল নিয়ে আসে।

ডিসেম্বরের ২০ তারিখ মেজদা বিদায় নিলেন। উত্তরায়ণ। শুনেছি নাকি উত্তরায়ণে মরলে নাকি স্বর্গ প্রাপ্তি হয়। আমি এরপরেও আসিনি। দেশে ছিলাম না। কি আর করবো। বিদেশে নিয়ম নাস্তী। ম্যানহাটানের বার্গার খেয়েই অশৌচ পালন করলাম।

যদি জল আসে আঁখিপাতে…..এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে…..তবু মনে রেখো....

উজান গাঙের উদাস হাওয়া ফিসিফিসিয়ে বলে গেলো।

***

 আইডিয়াটা আমার নয়। বিদিশার। যত্ত ভুলভাল বুদ্ধি।

"কথায় বলে....বাঙালিরা মৃত্যুকে ভালোবাসে। দেখো না, সব জায়গায়ই মৃত্যু লাগিয়ে বসে আছে। রবি ঠাকুর তো কথায় কথা টানতো, তাঁর দেখাদেখি জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, মহাস্বেতা দেবী...মায় আজকের নীল- লোহিত, শীর্ষেন্দু, সত্যজিৎ....উফফ, ভাই বুঝে পাইনা ব্যাপারটা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কি আছে।"

দিপু চা-এর কাপে চুমুক দিলো, খুব বিশ্রী একটা আওয়াজ করে। বাইরে জোড়ে হাওয়া দিচ্ছে, অনেক ক্ষণ হলো কারেন্ট গেছে,আমি আর গৌতম মুখ চাওয়াচায়ি করলাম।

বিদিশাকে আগে কখনো দেখিনি, দিপুর বিয়ের সময়ও আসতে পারিনি। এতো বছর বাদ আজ কলকাতায় এলাম, অনেক কিছুই পাল্টেছে, অনেকেই নেই, অনেক কিছুই হারিয়েছে, কিন্তু বিদিশা এসে সব যেন পূরণ করে দিয়েছে।

ওর সাথে দিদানের খুব মিল আছে। সেরকমই কাঁচা হলুদর মতন গায়ের রঙ, টানা চোখ, আর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলা। যেন এতো বছর বাদে নাতিদের নিয়ে গল্প করতে বসেছে।

গৌতম হঠাৎ বলে বসলো -- "কি বলতে চাও বল তো বৌদি? একে লৰ্ডশেডিঙ, তার ওপর ঝড়ের রাত....ভুতের গল্পের প্ল্যান এসেছে নাকি মনে?"

গৌতম আমাদের সর্ব কনিষ্ট ভাই, সামনের কাত্তিকে বিয়ে। ওটা নিয়েই আলোচনা করতে এসেছি এখন কলকাতায়। কিছুদিন বাদ মায়েরা ও আসবে। বিশাল ফ্যামিলি গ্যাদারিং।

"মন্দ বলোনি কিন্তু। আজ এমনিতেও খুব স্পেশাল একটা দিন।"

"কেন? কি দিন বলো তো?"

চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললো বিদিশা -- "কেন? মনে নেই? আজ পঁচিশে বৈশাখ।"

হ্যাঁ। রবি ঠাকুরের জন্মদিন।

আর মেজদার ও।

"তো শুনি, তোমার ভুতের গল্প?"

বিদিশা উঠে লন্ঠনের আলোটা উস্কে দিলো -- "রবি ঠাকুর নাকি কাকে যেন একবার প্ল্যানচেট করেছিলেন। সে নাকি এসে বলেছিলো: ইয়ার্কি হচ্ছে? আমি মরে গিয়ে যা জানতে পেরেছি, তোমায় কেন বলবো হে !"

গৌতম হাসলো - "হ্যাঁ...মৃণালিনী দেবীকে ও নাকি ডেকেছিলেন।"

"ওই যে বললাম -- বাঙালিদের মতন বোধহয় আর কেউ ব্যাপারটা নিয়ে অতটা ইন্টারেস্টেড-ই নয়।"

"হুম... তুমি কাকে প্ল্যানচেট করতে চাও?"

"এই যেমন ধরো", বিদিশা গলাটা নামালো -- "যদি রবি ঠাকুরকেই প্ল্যানচেট করি তো?"

এহ, যত্ত-সব unproductive আলোচনা। এসব বাঙালিদের মধ্যেই দেখা যায় বেশি। হয়ত এত বছর বাইরে থাকার পর-- খানিকটা mutated হয়ে গেছিলাম। বাঙালি বা বাঙালিয়ানার কিছুই এখন আমার মধ্যে বেঁচে নেই। উঠলাম আমি -- "ধুসস...উঠি। আমার একটা আবার কল আছে ন'টার থেকে।"

"বসো তো বড়দি", জোর করেই বসিয়ে দিলো বিদিশা আমায় -- "আমার কথার আগে জবাব দাও।"

"কি বলবো বল?"

"রবি ঠাকুরকে যদি প্ল্যানচেট করি?"

"উফফ -- তোমার এই কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথকে টেনো না তো ! এক নম্বরের নার্সিসিস্ট ছিল লোকটা।"

বিদিশা লন্টনটা নামিয়ে রাখলো টেবিলটার ওপর -- "আচ্ছা? শুনি কেন?"

"নিজেকে নিয়ে ভয়ানকভাবে obsessed ! লক্ষ করে দেখো -- নিজেকে নিয়ে পরোক্ষ ভাবে যে কত গান লিখেছেন ! আজি এ প্রভাতে রবির কর। Actuallyএখানে রবি মানে নিজেকেই বলেছে -- সূর্যকে নয়। কিংবা দেখো: এসো হে বৈশাখ, এসো এসো -- এ যেন মনে দেওয়া: ওনার জন্মমাসের কথা। অথবা দেখো -- চিরনবীনের দিলো ডাক, পঁচিশে বৈশাখ। নার্সিসিস্ট বলো না তো কি বলবো?" 

বিদিশা আমার পাশে আমার বসলো -- "তুই যা-ই বলিস, যে যাই বলে তাঁর নাম করে কালী ছেটাক -- যে কোনো আলোচনায় উনি এসেই পড়েন।"

দিপুর কাপটা টেবিলে রেখে বললো -- "বাঙালিদের ন্যাকামির চূড়ান্ত। বছরের বাকি দিনগুলোয় – Yo Yo Honey Singh, আর শুধু এই দিনটায় রবি-রবি করা...ন্যাকামি ছাড়া আবার কি হে?"

"বললাম তো -- এতো কিছু জানি না", বিদিশা বেশ ঝাঁঝালো শুরেই বললো -- "আজ কিন্তু আমার বহু পুরোনো একটা শখ পূরণ করার ইচ্ছে হয়েছে। রবি ঠাকুরের সাথে কথা বলার।"

হাসলাম আমি। ধুস, কি যে বলে। রবি ঠাকুর। প্ল্যানচেট। পঁচিশে বৈশাখ।

"কেন?", বিদিশা জোড় করলো -- "আজ ওনার জন্মদিন। এমন দিন -- যখন বিদেহী আত্মার বারবার মনে পড়ে যায় নিজের ফেলে আসা পার্থিব আকর্ষণের কথা।"

গৌতম মাথা নাড়লো -- "ধ্যার -- পুরো ভুলভাল বলছো। মানুষটা আজ থেকে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে মারা গেছে। যদি পরলোক বলে সত্যিই কিছু থেকে থাকে -- আত্মার শুদ্ধি হয়। আত্মা পৃথিবীর ইথারিয়াল তরঙ্গের অনেক ওপারে উঠে যায়, কিছু বছরের মধ্যে। প্রারব্ধের ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয় তার পরের পদক্ষেপ: পুনর্জন্ম না অন্য কিছু। "

"রাখ তো, তোর যত্ত ঢপের থিওরি -- আমার কথা শোন। আমার কাকিমা জীবনান্দ কে ডেকেছিলেন। উনি এসেছিলেন। রবি ঠাকুরকে ডাকলে কেন আসবেন না উনি?"

"প্ল্যানচেট সাধারণত earthbound আত্মাদের ওপরেই করা যায়। যেমন ধরো -- এক বছরের মধ্যেই কেউ মারা গেছে। তাকে নিয়ে আসা সোজা -- প্রেত তত্ত্ব বলে, এক বছর ধরে নাকি ফেলে আসা পরিবার পরিজনকে ঘিরেই ঘুরতে থাকে। তারপর শ্রাদ্ধ-শান্তি করলে আত্মা আসতে আসতে আরো ওপরের কোনো স্তরে উঠতে থাকে। তখন তাঁকে নিয়ে আসা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।"

চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ শুনতে লাগলাম দুই পক্ষের বচসা। অনেকক্ষণ ধরেই ঝগড়া চললো। গৌতমের বেদান্ত, কঠোপনিষদ বর্ণিত জ্ঞান-স্বরূপ আত্মা ও তার প্রবৃত্তি -- আর ওদিকে রবি ঠাকুরের প্ল্যানচেট: মৃতের মর্ত্যে আগমন।

লাস্টে হার মানলো গৌতম, ঠিক হল -- ওপরের ছাতের ঘরে ডিনারের পর প্ল্যানচেট করা হবে।

হ্যাঁ....যে ঘরে মেজদা থাকতো।

২.

বেশ ঘুম পাচ্ছিলো, এক পেট লুচি, পনিরের তরকারি আর পায়েস খেয়ে বসে থাকাটাই দায়।

বিদিশা অনেক কথা বলছিলো। কিছু কানে যাচ্ছিলো, কিছু যাচ্ছিলো না।

"তুমি আগে কখনো করেছো?", গৌতম ভীষণ উত্তেজিত -- "কখনো করেছো তুমি এসব?"

হাঁফ ছাড়লো বিদিশা -- "খুব বিশেষ কিছু করতে হবে না। ধরো এই টেবিলটায় চারধারে চারজন হাত ধরাধরি করে বসলাম --", জোর করে আমায় পাশে বসালো বিদিশা, আমার হাত ওর হাতে -- "আমাদেরকে ফোকাস করতে হবে রবি ঠাকুরের ...এই যেমন ধরো....এই ফটোটার ওপর", রবি ঠাকুরের শেষ বয়সের একটা ছবি টেবিলের ওপর রাখা --"তাঁর কথার ওপর, তাঁর লেখা গান, কবিতা, আঁকা, তাঁর কোনো স্মৃতি নিয়ে বারবার তোমার চিন্তা ঘোরাতে থাকো।"

"তারপর?"

"বিদেহী আত্মা ঘরে আসলে তার উপস্তিতি টের পাওয়াটা খুব সোজা।"

"যেমন?"

"যেমন এই টেবিলটার পায়াটা নড়ে ওঠা। অথবা ঘরে কোনো হিমেল হাওয়া। বা ঘরের ইলেকট্রিক বাল্বে ঝিরিক ঝিরিক বৈদ্যুতিন ডিস্টার্বেন্স।"

গৌতম বেশ বিরক্ত তখনও -- "আমি এসব মানি না। আত্মা সর্বজ্ঞ, সবর্ত্র -- তার আবার পরলোক থেকে এখানে ওখানে নিয়ে আসার কি আছে? যত্তসব ইউরপিয়ান সাহেবদের বুজরুকি।"   

"চুপ করে বসতো তুই", জোর করেই বসালো পাশে বিদিশা গৌতমকে -- "যা বলছি কর।"

বিদিশার উল্টোদিকে দিপু বসলো। মুখের ভাবটা দেখে খুব যে ইচ্ছাকৃত কাজটা করছে, তা কিন্তু মনে হচ্ছে না। বিদিশা লন্ঠনের আলোটা ধীমী করে দিলো।

চোখ বুজলাম।

রবি ঠাকুর? কি ভাববো ওনাকে নিয়ে? চুল-দাড়ি ওয়ালা, আলখাল্লা পড়া দাদু? বিশ্ব কবি? কবি মানে কি? ছদ্ম করে কথা বলা? নাকি কথার পিছনে অন্য কোনো কথা লুকিয়ে রাখা? "আপনারে তুমি দেখিছো মধুর রসে...আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান"

আমি? আমি তো নই -- আমি তো অন্য কিছু। অন্য কোনো সত্ত্বা আমার হয়ে যেন আত্মস্বাদ করছে: রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণকে। বারবার ফিরছি আমি, এই মাংসের কাঠামোতে, এই দেহে, এই প্রকৃতিতে। খুঁজে পাওয়া সেই আমিকে, আবার খুঁজে পেতে।

এক জন্মে সম্ভব হয় না সব উত্তর খুঁজে পাওয়া -- "একতারাটির একটি তারে, গানের বেদন সইতে নারে...  "

আরে ! একি ! মাটিটা নড়লো কি? চমকে উঠে তাকালাম। কৈ? না তো !

কিছুক্ষণ ঘরে শবাধারের নীরবতা। আমরা চারজন। অদ্ভুত এক অভিসারে বসে আছি।

কেউ আসবে। কেউ আসতে পারে।

আবার। হ্যাঁ। নড়লো। তবে মাটি নয়। টেবিলটা।

চারজনেই চোখ খুললাম। 

তবে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পেলাম না।

লন্ঠনের পড়ে আসা আলোয় দেখলাম, টেবিলটার ঠিক মাঝখানে একটা সেফটিপিন পড়ে আছে।

মেজদা খাবার পর এই সেফটিপিনটা দিয়ে দাঁত খোঁচাতো। বড় পুরনো অভ্যাস ছিল ওনার।

আর হ্যাঁ। দিপু কাঁদছে, হাউহাউ করে কাঁদছে। চোখে জল। কখনো ওকে ভেঙে পড়তে দেখিনি।

৩.

প্রায়শ্চিত্ত।

কে যেন বলেছিল কথাটা। দিপুও কথাটা কার কাছে যেন শুনেছিলো।

প্রায়শ্চিত্ত করলে মৃত্যু নাকি ত্বরান্বিত হয়। "মানে বুঝতেই তো পারছো -- এই বুড়ো আমাদের কাছে বোঝা ছাড়া কিছুই নয়", বেশ ঝাঁঝিয়েই বলেছিলো কথাটা দিপু। ঘরে বিদিশা, গৌতম আর দিপুর বাবা -- আমাদের ছোটকাকা। "এই বুড়ো হেগে-মুতে রেখে দিচ্ছে আর আমাদেরকে একটা সবসময়ের ঠিকে-ঝি রাখতে হচ্ছে তাকে দেখবার জন্যে -- এটা কি খুব কাজের কথা?", দিপু হাত পা নেড়ে বোঝাচ্ছিলো।

ছোটকাকা চিরকালই মেনিমুখো, কোনোকিছুতেই কোনো কথা বলে না।

"দাদা এভাবে বলে না", গৌতম বলল -- "তোমার জীবনে কি মেজদার কোনো দামই নেই? মনে নেই -- ছোটবেলার কথা? কত আবদার? কত মজা,ইয়ার্কি, গল্প?"

"চুপ কর", দাবিয়ে দিলো দিপু -- "মাস গেলে প্রায় দু তিন হাজার করে দিতে হয় তো আমাকেই -- তুই আর কি বুঝবি?"

"কি করতে চাও তুমি?"

"প্রায়শ্চিত্ত", আবার কথাটা বলল দিপু -- "এক প্রায়শ্চিত্তের পুজো করলেই নাকি সব কষ্ট নিরসন হয়। ছয় মাসের মধ্যে যার জন্য এটা করবে, তার মুক্তি হবেই।"

গৌতম উঠেই দাঁড়ালো -- "ইসস...এসব সেকেলে চিন্তা তোমার মাথায় কি করে আসে বলতো দাদা?"

"চুপ কর তুই", প্রায় মারতে এলো দিপু -- "ওই বুড়োর গু-মুত ঘাঁটতে পারবি চব্বিশ ঘন্টা? আমি তাহলে এখনই কাজের মাসিটাকে ছাড়িয়ে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ -- গিয়ে গিলিয়েও দিয়ে আসতে হবে তিনবেলা। নিজের হাতে খেতে পারেন না উনি।"

নাহঃ।

এরপর এ-নিয়ে আর কথা হয়নি।

অনেক জাগ-যজ্ঞ করে অনুষ্ঠান হলো দাদুর প্রায়শ্চিত্ত। এ যেন প্রিয়জনের মৃত্যু কামনায় প্রার্থণা করা। মেজদা সেই যজ্ঞের আগুন বসে বসে দেখল। এটাই নাকি নিয়ম।

"ওটা কি করছো তোমরা?"

"পুজো হচ্ছে -- তোমার পাগলামিটা যাতে কমে", দিপু চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিলো। 

নাহঃ।

মেজদার কিন্তু কিছু হলো না। ছয় মাস পেরিয়ে এক বছর হতে চললো -- মেজদা কিন্তু গেলেন না।

শেষে আর সহ্য করতে না পেরে দিপু রাগের মাথায় একদিন দুপুরে -- বালিশ চাপা দিয়ে....

***

দিপু কাঁদছে। বাচ্ছাদের মতন কাঁদছে। তবে ঠিক বোঝা গেলো না কেন। নিজের কৃতকর্মের জন্য? নিজের করা অন্যায়ের জন্য? ফেলে আসা মানুষ, ফেলে আসা সময়, ফেলে আসা স্মৃতির উদ্দেশ্যে?

মেজদার জন্য?

রাত হচ্ছে।থেমে আসা ঝড়টা যেন করুণ ভায়োলিনে বাজিয়ে উঠলো -- "আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার...."

 

শেষের কবিতা

আরে....

দরজাটা খুলে গেলো কখন? চোখ মেলে চেয়ে দেখলাম। বাইরে খুব আলো। কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমায় ডাকছে।

আমি আসতে আসতে এগিয়ে গেলাম দরজাটার দিকে। এই ঘরটায় কখন যে এলাম তা এখনো মনে পড়লো না ঠিকই -- তবে এতোক্ষণ কেন যে দরজাটা বন্ধ ছিল সেটা বুঝলাম।

কেউ কাঁদছে। উপলব্ধি করেছে কি করেছিল সে।

আমার এই কাজটাই বাকি পড়েছিল। আজ সেটা শেষ হলো। দরজাটাও খুলে গেলো।

চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে পা রাখলাম। আলো....কি সুন্দর আলো....

কে যেন গুনগুনিয়ে গাইছে -- "তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে...গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে...তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে..."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics