মিথ্যাবাদী
মিথ্যাবাদী
সত্যি কথা বলতে কেউই লোকটাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখতো না। অত মিথ্যা কথা বললে কেইই আর ভালো চোখে দেখবে বলুন?
ঢপ কে না দেয়? আমি দি, আপনি দেন, সবাই দেয়। কিন্তু জিওগ্রাফি স্যারের ঢপগুলি অন্য লেবেলের। একদম মহাজাগতিক লেবেলের। এবং ঢপ দিয়ে ধরা পড়ার ও কোনো ভয় উনি পেতেন না।
সেই যে সেবার। স্কুলে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে। প্রভাত 'মহাবিশ্বে মহাকাশে' গানটা গাইলো। ভূগোল স্যার গানটা শেষ হবার পর মঞ্চে এসে মাইকে বলে উঠলেন -- "এই গানটি বরাবরই আমার খুব প্রিয়। সেবার চাঁদে যাওয়ার সময়, রকেটে গানটা গেয়ে শুনিয়েছিলাম, আমার নাসার সহযাত্রীদের।"
আচ্ছা, কোনো মানে হয় বলুন তো? উনি নাকি চাঁদে গেছিলেন। টানা তিন মাস নাকি ছিলেন -- অনেক কাজ করেছেন নাকি ওখানে। চাঁদের মাটিতে উনিই তো প্রথম মানুষ যিনি নাকি তাঁবু খাটিয়ে শুয়েছিলেন তিন মাস। নেহাত ফেরবার সময় মহাকাশ যানটায় আর জায়গা ছিল না, তাই মাটিটা আনতে পারেননি।
এই সব শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম আমরা। মানুষের ইমাজিনেশন যে কতদূর গড়াতে পারে, ওনাকে না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না।
সেই যে.....সেবার। হাসিমারা ফরেস্ট নিয়ে কথা ওঠায় --
"বুঝলি, সেবার অনেক রাত হয়েছিল। হাসিমারার ঘন জঙ্গল ভেদ করে ছুটে চলেছে আমার জিপ", চশমা নামিয়ে রেখে ক্লাসের সবাইকে দেখে নেওয়া হলো -- "একহাতে স্টিয়ারিং। এক হাতে টর্চ। আরেকহাতে বন্দুকটা ধরে আছি।"
কে একজন যেন জিজ্ঞেসা করে উঠলো -- "স্যার আপনার কটা হাত?"
"এইইইই - কে বললি রে?"
ব্যাস....যে জিগ্গেস করেছে, সে কি আর বলে? হাতে রুলারের বারী খেয়ে কে আর বাড়তি ঝামেলা নিতে যায় বলুন?
যাই হোক, কেন জানি না ভদ্রলোককে নিয়ে সবাই নানান গসিপ চালাতো, ওনার পিঠ পিছে। উনি নাকি প্রেতচর্চা করেন। মাঝে মধ্যেই নাকি শ্মশান-মশানে দেখা গেছে। মাঝে মাঝেই নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলেন -- কাছে গিয়ে দেখা গেলো -- কোই, কেউ নেই তো। ভদ্রলোক কি তবে এতক্ষণ ভুতের সাথে কথা বলছিলেন?
জানি না কি -- তবে, গেলোবার শীতে ঘুমের মধ্যেই হার্ট এট্যাক করে যে ওভাবে মারা যাবেন কেউই ভাবতে পারেনি। মুখটা জানলার দিকে করা, ঠোঁট দুটি ফাঁক করা -- ঠিক যেন কাকে কি বলছেন।
বলতে বলতে থেমে গেছেন। চিরকালের মতন।
না, না -- ওভাবে উনি চলে যাবেন কেউই ভাবতে পারেনি। খারাপ লেগেছিলো। সবারই খুব মন খারাপ।
উনি তো চলে গেলেনই -- আমাদের ও ডুবিয়ে দিয়ে গেলেন।
দু সপ্তাহ পরে যে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে, তার কথা কি কারোর মনে আছে? ভূগোলে তো আমরা চারজন চিরকালেরই কাঁচা। আর ভূগোল স্যারের পরীক্ষার আগে আসা সাজেশন মিলবেই।
কে দেবে সেই সাজেশন এবার?
শুভ অনেকক্ষণ ধরে আকাশ পাতাল ভেবে বললো -- "একটা উপায় আছে, বুঝলি?"
******************************************************************************************************
"বাজে কথা.....পুরো ঢপের কথা", জিতু খুব চেঁচিয়ে মেচিয়ে উঠলো -- "তুই প্ল্যানচেট করে ভূগোল স্যারকে আনবি? এনে ওনার কাছ থেকে জানবি কি কি প্রশ্ন আসবে পরীক্ষায়? ইয়ার্কি হচ্ছে?"
"না, না -- তুই বুঝছিস না", শুভ হেব্বি জ্ঞান দিচ্ছে -- "স্যার মারা গেছেন মোটে চার দিন হয়েছে। বিদেহী আত্মা নাকি মারা যাবার এক বছর অবধি বাড়ির ধারে কাছেই ঘুরে বেড়ায়। প্রিয় লোক, প্রিয় জায়গা, প্রিয় জিনিস পত্রের সাথে নাকি ঘেঁষে থাকে। আমার ক্যালকুলেশন অনুযায়ী -- বেশি কষ্ট আমাদের করতে হবে না, বুঝলি? যদি স্যারকে স্কুলের ছাদের ঘর থেকে প্ল্যানচেট করি, তাহলে উনি নিশ্চয়ই আসবেন। ওই ঘরটা ওনার খুব প্রিয় ঘর ছিল, বুঝলি.....ভূগোল স্যার আসতে বাধ্য।"
"আমি এসব মানি না....মানুষ মারা গেলে ওখানেই মামলা শেষ। আবার প্ল্যানচেট, ওমলেট -- এসব কি? যত্ত ঢপের কীর্তন...!!!"
আমি পেঁচার মতন তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম -- "পড়ে পাশ করতে পারবি? আর কিন্তু সাত দিনের মাথায়ই পরীক্ষা। সেকেন্ড পরীক্ষাই ভূগোল।"
জিতু আমায় একবার ভালো করে মেপে, দুদ্দাড় করতে করতে বেরিয়ে গেলো।
"চিন্তা করিস না", শুভ মুড়ি খেতে খেতে বললো -- "ব্যাটা ঠিক আসবে, দেখিস। ওই পাকিস্তানের মাটিতে শীতকালে কি কি ফসল হয় আর মায়ানমার থেকে কি কি রপ্তানি হয় -- গুলোলেই দেখবি সব হাওয়া বেরিয়ে যাবে।"
******************************************************************************************************
অতয়েব পরের দিন সন্ধ্যেবেলা...স্কুলের ভাঙা ছাদ, কোনার ঘর। আমরা তিনজন।
চাঁদু, আমি আর জ্ঞানী জৈল সিং শুভ সেন। চাঁদু কোথা থেকে একটা ভাঙা টেবিল জোগাড় করেছে। মোবাইল ফোনে স্যারের ছবি। আমরা তিনজন হাত ধরাধরি করে বসলাম। গ্রামের দিকে বিকেল থেকেই ঠান্ডা পড়তে শুরু করে....আর এখন তো বেশ রাত। কোথায় যেন কুকুর ডাকছে, কে যেন সাইকেল ক্রিং ক্রিং করে চলে গেলো পাশের গলি দিয়ে। কোথাও রেডিও চলছে, কে যেন ডিমের কোর্মা রান্না করছে।
মন দেব কি....এসবই বেশি টের পাচ্ছি।
চাঁদু দরজার দিকে বসে ছিল। ফিসফিসিয়ে বললো -- "আমার খুব হাগু পাচ্ছে।"
"চুপচাপ বোস তো", শুভ এক ধমক দিলো।
******************************************************************************************************
হ্যাঁ, ঠিকই।
আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ভেজানো দরজাটায় একটা টোকা পড়লো।
"কে...কে?", চাঁদু ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো। ভাবটা এমন -- যেন ভূগোল স্যার দরজায় টোকা দিচ্ছেন।
দরজাটা একটু ফাঁক করতেই দেখা গেলো গুনধরকে।
হনুমান টুপি আর লাল রঙের একটা সোয়েটার পরে, আর কেউ নয়.....জিতু মহারাজ।
শুভ আমার দিকে চোখ মেরে হাসলো।
******************************************************************************************************
না, না....বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ঠিক আধঘন্টার মাথায় টেবিলটা নড়তে শুরু করলো। কে যেন পায়া ধরে নাড়াচ্ছে।
হ্যাঁ....ঘরটায় কেউ আছে। কেমন যেন একটা অচেনা উপস্তিতি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চাঁদু চমকে উঠে আমার থাইয়ে খামচে ধরলো -- "ভু-ভূ....ভুত...."
"চুপ কর ছাগল", শুভ আবার ধমকালো -- "স্যার আপনি কি ঘরে আছেন?"
উত্তর নেই।
'স্যার...আপনি যদি সত্যই এসে থাকেন -- তবে প্লিস টেবিলের পায়া আবার নাড়ান।"
উত্তর নেই।
"স্যার? স্যার শুনতে পাচ্ছেন?"
ঘড়ঘড় করে একটা আওয়াজ। ভাঙা টেবিলের মাথাটা খুলে সোজা টাল খেয়ে জিতু আর চাঁদুর কোলে। চাঁদু ভয় পেয়ে সোজা জিতুর কোলে -- "নিচে নাম, ছাগল...!", জিতু খেঁকিয়ে উঠলো।
"স্যার....স্যার আপনি এসেছেন....স্যার....আমাদের কি সৌভাগ্য.....", শুভর গলা আহ্লাদে গদগদ -- "আমি জানতাম আপনি আসবেন..."
টেবিলের ওপর খাতা আর পেন এগিয়ে দিলো শুভ -- "স্যার -- আমাদের উদ্ধার করুন স্যার। এবারের মতন ভূগোলটা উতরে দিন....কথা দিচ্ছি এরপর থেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করব....."
কোনো উত্তর নেই।
"স্যার....যদি সত্যিই আপনার এই অসহায় ছাত্রগুলোর ওপর সামান্যতম মায়া থেকে থাকে, তবে -- দয়া করে এতে লিখে দিন: পরীক্ষার প্রশ্নগুলি...."
কোনো উত্তর নেই।
ঘরটায় পুরোনো আসবাবের ঘিঞ্জি গন্ধ নিয়ে ঝুলে আছে নিষ্প্রাণ বাতাস।
"স্যার....গুরুদেব...দয়া করুন গুরুদেব....", শুভ কাঁদো কাঁদো গলায় প্রণাম করলো।
আরও কিছুক্ষণ সব চুপচাপ থাকার পর, একটা কেস হলো।
হঠাৎ পেনটা নিজের থেকে খাতার ওপর দাঁড়িয়ে খসখস করে লিখতে শুরু করলো।
না, না -- আনতাবড়ি লেখা না। পাতার পর পাতা ভূগোল পরীক্ষার প্রশ্ন।
******************************************************************************************************
এরপর আর আমাদের পায় কে।
ভূগোল পরীক্ষার আগের দিন গ্রাম থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা এসেছিলাম, কম্পিউটার কিনতে। তারপর বাড়িতে ফিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
ভাবটা এমন যেন -- কাল পিকনিক আছে।
না, না -- পরের দিন যে ওরকম হবে, তা আদপেও বুঝতে পারি নি।
******************************************************************************************************
নাহঃ....একটা প্রশ্ন ও মেলেনি।
প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। বারবার প্রশ্নপত্র পাল্টে-উল্টে দেখছি।
না, না -- এতো হতেই পারে না। মরার পর কেউ মিথ্যা কথা কেন বলবে?
পরীক্ষার হলে জিতু আর শুভ আমার দিকে তাকাচ্ছে, লাল লাল চোখ নিয়ে। ওরাও ওদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
যা কখনোই ভাবতে পারি নি, তাইই হবে তাহলে? থেকে যেতে হবে পুরোনো ক্লাসে? যাদের ভাই বলতাম, তাদের সাথেই বসতে হবে শেষের বেঞ্চিতে?
ছি, ছি....এর থেকে মরে যাওয়াই ভালো ছিল।
******************************************************************************************************
"না, মরবার আগে আবার আমি প্ল্যানচেট করবো", শুভ স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো।
"কি করবি প্ল্যানচেট করে?", জিতু ম্রিয়মান গলায় জিগ্গেস করলো।
"মিথ্যাবাদী....সারা জীবন ধরে মিথ্যা বলে গেলো। আজ মরার পরেও মিথ্যা কথা বললো লোকটা?", শুভ রাগে কাঁপছে -- "এর জবাব ওনাকে দিতেই হবে...."
আমি আর চাঁদু মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।
কি লাভ? পরীক্ষার খাতায় যা লিখে এসেছি -- ভূগোল স্যারের আত্মা নিশ্চয়ই সেটা ঠিক করতে পারবে না, তাই না?
******************************************************************************************************
স্কুলের ছাদের ঘর। ভাঙা টেবিল। বিষাক্ত মশা। আমরা চারজন, আবার।
"স্যার...আপনাকে আসতেই হবে.....কোথায়? কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবেন?", শুভ প্রচন্ড চেঁচাচ্ছে -- "আসুন....আসুন বলছি?"
কোনো উত্তর নেই।
"কি হলো, আসুন?", শুভ টেবিলে চাপড় মারলো -- "ভয় লাগছে আমাদের দেখে, হ্যাঁ? মিথ্যাবাদী। ঠগ। প্রবঞ্চক। জালি লোক।"
এমন বার খাওয়ানো থ্রেট দেওয়ার পর ও কোনো উত্তর নেই।
"কি হলো? উত্তর নেই কেন?", শুভ চেঁচিয়েই চলেছে -- "আমি আপনার শ্রাদ্ধ বন্ধ করে দেব। শ্রাদ্ধের পুরোহিতকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করে রেখে দেব। এরপর ভুত হয়ে এবাড়ির পাঁচিলে, ও বাড়ির পাঁচিলে ঘুরে বেরিও, কেমন?"
হঠাৎ চাঁদুর গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বেরোলো -- "আআআআ...."
চমকে ওর দিকে তিনজনে তাকালাম। ওর চোখ দুটো সিলিঙের দিকে ফিট হয়ে আছে। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের মতন লাগছে।
"চাঁদু?", তিনজনেই চেঁচালাম।
"আমি....আমি চাঁদু নই", উত্তর এলো -- "আমি ভূগোল স্যার। এতবার ডাকলি, আসতে বাধ্য হলাম।"
******************************************************************************************************
"স্যার...আপনি আমাদের সাথে এমন কেন করলেন? কেন মিথ্যা বললেন আপনি?", শুভ প্রায় কেঁদে ফেলেছে, এমন কন্ডিশন।
"ওরে মূর্খ, কি ভেবেছিলি বিনা পরিশ্রমে পাশ করে যাবি? যারা কষ্ট করে পড়াশোনা করলো -- তাদের কি কোনো দামই নেই মেহনতের? আর ধরে নে, যদি এবার পাশ করেও যেতিস -- পরের বছর পরীক্ষার সময় কি করতিস? আবার কি আমার ডেকে আনতিস?", চাঁদুর কন্ঠে স্যারের গলা।
"তা বলে আপনি মিথ্যা বলবেন স্যার?", এবার জিতু বলে উঠলো -- "আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করে পড়াশোনাই করলাম না। মন দিয়ে ওই কদিন পড়ে নিলে হয়তো পাশ করে যেতাম।"
"ওরে গাধা -- আমি তো সেটাই বলছি। তোদের নিজেদের ওপর ভরসাটা এতোই কমে গেছে, বেঁচে থাকার জন্য এখন এক মৃত মানুষের স্মরনাপন্ন হতে হচ্ছে? এই শিখলি তোরা এতদিন ধরে?"
আমাদের আর মুখে কোনো উত্তর নেই।
চাঁদু ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ছেড়ে একসময় ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো।
******************************************************************************************************
ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রেসাল্ট বেরোলো।
অংকে আর ফিজিক্যাল সাইন্সের মার্কসটা যত না ভালো হয়েছে, তার চেয়ে প্রাণিবিদ্যাতে আরো ভালো মার্কস এসেছে। লিটারেচারেও খারাপ আসেনি। হিস্ট্রিও মোটামুটি।
জিওগ্রাফিতে একচল্লিশ। চারজনেই।
চল্লিশে পাশ।
কান ছুঁয়ে যেন লাল কালির দাগটা বেরিয়ে গেছে।