মানত
মানত
অনেকদিন আগে এক হাড়কিপটে ধর্মভীরু বাঙালি লোক অসুখে পড়েছিল। সে তো আর পয়সা খরচ করে ডাক্তারের কাছে যাবেনা, তাই অনেক তাবিজ-তুম্বা-ঝাড়-ফুক করে এবং জলপড়া খেয়েও ভাল হচ্ছিল না। তাই সে আর কি করে ভগবানকে ডাকতে থাকে প্রাণভয়ে।তখন একদিন তার স্বপ্নে ভগবান আসে আর তাকে বলে: “অষুধ-বিষুধ-টোটকা-পানিপড়ায় কোনো কাজই হবে না। তুই আমার নামে বড় রকমের একটা পশু বলি দেবার মানত কর, তাহলেই তোর রোগ যাবে, তা না হলে রোগমুক্তির কোন পথ নাই। তুই খুব কালো আর বড় ধরনের একটা মোষ বলি দে। নির্ঘাত ভালো হয়ে যাবি।”
যেহেতু লোকটা ছিল খুব কৃপণ এবং প্রচন্ড ধড়িবাজ লোক । সে মনে মনে বলে : আস্ত একটা মইষ বলি দেয়া কি চাট্টখানি কথা। সে যে ম্যালা টাকাকড়ির ব্যাপার। ব্যারাম থেইকা আরাম হওনের জন্যি এত পয়সা খরচকরণ যায় নাকি? ভগবানও সুযোগ পাইয়া শোষণ করা শুরু করছে।
তাই সে ব্যরামের কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু মোষ বলি দেয় না। বেশকিছু দিন পরে সে আবার স্বপ্নে দেখে দেবতা তাকে বলছে, কিরে কই মোষ বলি দিলি না।
স্বপ্নেই সে বলে : ‘শবরি কলা দেবতার ভোগ তা খাইলে খণ্ডায় রোগ’—এই মহাজন বাক্য ছোটকাল থেইকা হুইনা আইছি। তাই তোমারে শবরি কলা-চিড়া-নারকেল-সন্দেশ-দুধ দিয়া ভোগ দিছি। তাইতে তুমি খুশি অইয়া আমার রোগ খণ্ডাইয়া দিবা এইডা সে কথা! তা না, তুমি আমারে মইষ বলি দিবার মতন অত খরচের তলে ফালাইবার চাও ক্যা!সবকিছুর তো একটা নিয়ম বা তর তারিকা আছে। তোমার ক্ষমতা আছে বইলা তুমি দেবতা হইয়া নিজের ইচ্ছামত যা খুশি তাই করতে পারো না।
সব কথা শুনে ক্রুদ্ধ দেবতা বলে : তুই ভোগ দেওনেই তো সৎ পরামর্শ দিছি। রোগ তর কঠিন। কলা ফলার ভোগে ব্যারাম সারবো না। লোকটির ঘুম ভেঙে যায়। তাতে সে বিরক্ত না হয়ে খুশিই হয়।
বলে : ‘ঘুম ভাঙনে বড় বাঁচা বাঁইচা গেছি। দেবতা না কি ঘোড়ার ডিম, আমারে স্বপ্নের মধ্যে পাইয়া সে ক্যাচাল শুরু করছিল, আর কিছুক্ষণ অইলেই ধরা খাইয়া যাইতাম। বড় বাঁচন বাচছি। আমার কাছে আস্ত মইষ চায় মামার বাড়ির আবদার! আমি কি কম গিরিঙ্গিবাজ মইষ ফইস অইতো না। এক্কেরে যদি দিতেই হয় একটা ছোটমাট কালা পাঁঠা দিতারি। 
;
দিন যায়। রোগ বাড়ে। আবার স্বপ্ন।
সেই দেবতা আবার হাজির হয়ে বলেঃ কই,আমায় মানত অনুযায়ী মোষ বলি দিলি না?
সে সময় তার অসুখ কিছুটা সেরে গিয়েছিল।
লোকটি হাতজোড় করে বলে: দেবতা, অত যহন বলতাছেন তখন মইষ না, একটা পাঁঠা বলি দিবানে। তবে, শর্ত আছে। আগে আমার ব্যারাম পুরাপুরি সারাইয়া দেওন লাগবো, তারপরে ভাল অইয়া বলি দিমু।
লোকটির অসুখও সেরে যায়। এখন সে ভালো মতো হাঁটাচলা-কামকাজ করে। তার আয় উন্নতিও বাড়ে। কিন্তু সে পাঁঠা বলির নামও করে না। ওকথা সে মনেই করতে চায় না।
অনেক দিন পর প্রতারিত দেবতা স্বপ্নে আবার দেখা দেয়, দেবতা বলেঃ কইরে ভালো হয়ে গেলি সেই কবে কিন্তু বলি দিবার কোনো ব্যবস্থা করছিস না কেন?
লোকটি হাতজোড় করে করুন সুরে বলে : আমি গরিব মানুষ। একটা পাঁঠা কিনার সাধ্যি আমার নাই। আমি মানত করছি ঠিকই তবে সাধ্যে না কুলাইলে করব কি? তোমার দয়ার অন্ত নাই পাঁঠা বাদ দেও, ছোট কিছু চাও।
দেবতা বলে : তর কি ভয় ভক্তি কিছুই কি নাই? তর অনুরোধে মোষ থেকে পাঁঠায় নামলাম, তাও দিবার পারিস না।
লোকটি বলল : পারি তো না। সাধ্য না থাইকলে কি করুম? যাউক, একটা জলের মুরগি মানে কাছিম দিলে অইব?
দেবতা বলে : পারিস না যখন, তখন তাই দিস। তবে, কচ্ছপটা যেন বড়ো হয়।
তারপরও দিনের পর দিন যায়। লোকটির কচ্ছপ দিবারও নাম করে না। ও কথা মনেই করে না। আবার স্বপ্নে দেখা দেয় দেবতা, বলে : আচ্ছা নচ্ছার, আর পিচলারে তুই! তোর কথার কোনো মূল্য নাই। তোর মানতের জিনিস কই?
লোকটি বলে : দাবি থেইক্যা যখন নামচ, আর একটু নাম। আমি একটা ফড়িং দিব। দেবতা, রাগে বোবা হয়ে যায়। পরে বলে, তাই দে। জলদি দিবি।
দিন যায়, লোকটি ফড়িংও দেয় না। আবার স্বপ্নে দেখা দেয় দেবতা।
ক্রুদ্ধস্বরে বলে, মানতের ফড়িং কই?
লোক : তুমি নাকি দেবতা। তোমার কত শক্তি। মুলাটুণ্ডা মানুষ তো না। আমার সঙ্গে রাগ না দেখাইয়া একটা ফড়িং ধইরা কি তুমি খাইবার পার না? আমারে স্বপ্নে দিগদারি না কইরা ধইরা খাও।
নীতি : দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না।