জিভে প্রেম করে যেই জন
জিভে প্রেম করে যেই জন
জিভে প্রেম করে যেই জন
শুভময় মণ্ডল
আজ অনেকদিন পরে আম আঁটির ভেঁপু বইটি খুঁজে পেলাম। আমের আঁটির কথাটা দেখলাম, শৈশবের কয়েকটা মজার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। শৈশবের সব স্মৃতি তো আর সকলের মনে থাকে না, আমারও নেই। তবে কিছু কিছু ঘটনা মনে দাগ কেটে যায়, কিছু ঘটনা আবার আমাদের সমগ্র জীবনের জন্যই শিক্ষা দিয়ে যায়। আর সেগুলোকে ভোলা সম্ভব হয়না কখনই। যাক গে, এখন একটা মজার ঘটনায় আসি।
ঠাকুরমা খুব যত্ন করে কুল এবং আমের আচার বানাতেন প্রতিবছর। তারপর সেগুলো সাবধানে রোদে শুকিয়ে, কাঁচের বয়ামে তুলে রাখতেন পরে খাবার জন্য। আমার আবার বরাবরই মিষ্ট দ্রব্যাদির প্রতি একটু মাত্রাধিক দুর্বলতা আছে, আর তাতে উৎসাহ দিয়েছে স্বয়ং আমার দাদা।
শৈশবে আমাদের দু'জনের দ্বারা কৃত অসংখ্য অপকর্মের পিছনে, তার উর্বর মস্তিষ্ক বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তখন বাবা-মায়ের মার এবং ঠাকুরমার জ্বালাময়ী ভাষণের ভয়ে, নীরব থাকাই শ্রেয় মনে হতো। আশৈশব সত্যের পূজারী এবং সত্যবাদী যুধিষ্ঠির রূপে পরিবারে আমার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। যদিও মহাভারতের আমার প্রিয় চরিত্রটি ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
তাই, প্রয়োজন মতো কখনও কখনও অগ্রজকে আশু বিপদ থেকে রক্ষা করতে, 'অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ' জাতীয় পদক্ষেপও অবশ্যই গ্রহণ করতে হয়েছে। মোট কথা, তখন আমাদের সেই সমস্ত অপকর্মগুলিকে অস্বীকার করলেও, আজ আর স্বীকার করতে বাধা নেই - বরাবরই দাদাই ছিল তখন ঐসব অপকর্ম সাধনে আমার মেন্টর।
তার সোজাসাপ্টা পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি এবং খুবই উৎসাহ ব্যঞ্জক বক্তব্য ছিল - জিভে প্রেম করে যেইজন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। নিজেকে আবার সে স্বামী বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য বলে দাবি করতো, অবশ্য সেটা ছিল আমার কাছে তার বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার একটা হাতিয়ার। স্বামীজী নিজে তাঁর এমন ভক্তকে দেখলে এবং তার মুখে তাঁর বাণীর এমন রোমহর্ষক প্যারোডি শুনতে পেলে কি করতেন, জানিনা!
যাই হোক, এবার মূল কাহিনীতে ফিরি। ইট ওয়াজ অ্যান ওপেন সিক্রেট দ্যাট, ঠাকুরমার সেই সব আচার লুকিয়ে সাবার করার দায়িত্ব ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের। আর সেই জন্যই, ঠাকুরমা বরাবরই আমাদের কাছে সযত্নে গোপন করতেন - ভাঁড়ার ঘরে ঐ আচারের বয়ামগুলো আসলে ঠিক কোন জায়গায় রাখা হয়েছে। আগেই বলেছি, এইসব ব্যাপারে দাদার ছিল অদ্ভুত ক্ষুরধার বুদ্ধিদীপ্ত সব পরিকল্পনা।
ভাঁড়ার ঘরে মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যাদি রাখলে, তাতে পিঁপড়ে ধরবেই। কিন্তু আমাদের ভাঁড়ার ঘরে যা প্রোটেকশন নেওয়া হতো, তাতে পিঁপড়ের সেখানে বাসা করার যো ছিল না! তাহলে তারা নিশ্চয়ই বাইরে থেকে আসতো! দাদার পরিকল্পনা হলো - বাইরে থেকে ওই পিঁপড়ের দল যখন আচারের বয়াম পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে, আমাদের তাহলে আর বেশি পরিশ্রম করার প্রয়োজন নেই, শুধু ওই পিঁপড়ের দলকে খুঁজে বের করে তাদের অনুসরণ করলেই চলবে।
এ ছিল একেবারে যথার্থ পরিকল্পনা। ঠাকুরমা যতই লুকিয়ে রাখুক না কেন, আমরা ওই পিঁপড়েদের সহযোগিতায় আচারের বয়াম পর্যন্ত প্রতিবারই ঠিক পৌঁছে যেতাম। এবং এটা সত্য ঘটনা ছিল যে, দাদার এই পরিকল্পনা কখনোই ব্যর্থ হয়নি। যদিও কিছু আনুষঙ্গিক সতর্কতা গ্রহণ এইক্ষেত্রে একান্ত জরুরী এবং তা ভুলে গেলে ফল ভালো নাও হতে পারে। তাই কেউ এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে, সে দিকটায় খেয়াল রাখবেন।
অন্যথায় ফল কি হতে পারে তারই একটা দৃষ্টান্ত রাখছি। একবার যথারীতি ঐ পদ্ধতি অনুসরণ করেই, দাদা ভাঁড়ার ঘর থেকে গোপনে আচার হাতাচ্ছে, আর আমি দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে নজর রাখছি। হঠাৎ দাদার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠার আওয়াজ শুনে, তার কাছে ছুটে গিয়ে দেখি - আচার সরাতে সরাতেই, সে মুখে পুরে নিয়েছে দু'খান আমের টুকরো, যেটা আগে থেকেই অধিকার করে রেখেছিল বড় বড় লাল পিঁপড়ের দল!
স্বাভাবিকভাবেই, নিজেদের দখলীকৃত খাদ্যভান্ডারে সাম্রাজ্যবাদী শোষণমূলক সেই আগ্রাসনকে তারা কোন মতেই মেনে নিতে রাজি ছিল না। ক্ষুদ্র হোক, তারা তুচ্ছ নয়। তাই তাদের সেই পূর্বে দখলীকৃত খাদ্যভান্ডারের ছিনতাইকারীর লোভী ঠোঁটে ঠোঁট রেখে তারা জানিয়েছে জ্বালাময়ী সবিষ প্রতিবাদ ও শানিয়েছে তীব্র আক্রমণ।
তাদের সেই আক্রমণের কোনোও প্রতি-আক্রমণ করার মত অবস্থায় তখন ছিল না দাদা। তার তখন এক হাতে আচার ভর্তি কাঁচের বয়াম, আর অন্য হাতে বিপুল পরিমাণে সংগৃহীত আমের আচার! তাই তার দু'ঠোঁট জুড়ে বিষাক্ত কামড় দিয়ে প্রতিবাদ জানানো সেই বিদ্রোহী লাল পিঁপড়ের দলের সামনে নিরস্ত্র অবস্থায় অগত্যা পরাভূত হতে হয়েছিলো আমার বেচারা দাদাকে!
আমি তখন কাঁদবো, নাকি হাসবো, নাকি পালাবো - ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কারণ, তাদের সেই মিলিত প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদা যে তীব্র যন্ত্রণাকাতর ক্রন্দনের আওয়াজ করে ফেলেছিল, তা বোধহয় নিশ্চিত রূপেই কর্ণগোচর হয়েছিল ঠাকুরমার। কাজেই ভাঁড়ার ঘরের দিকে তাঁর আগমনের আভাস পেতেই, আমি পত্রপাঠ সেখান থেকে বিদায় নিলাম।
হাতেনাতে ধরা পড়ায়, ঠাকুরমার ঐ যত্নে বানানো সাধের আচার চুরির অপরাধে, পরবর্তীকালে দাদাকে যে কিঞ্চিত বেত্রাঘাত সহ্য করতে হয়েছিল বাবার কাছে, সে বর্ণনা আর না হয় নাই বা দিলাম। আমি তো আর অপরাধ করিনি, বরং তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম তার অপকর্ম এবং তার পরিণতিও। আমাকে তখনও কেউ দোষারোপ করেনি, এখনও করে না। আমি তো বরাবরই ভালো ছেলে, সব্বাই জানে।