SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Horror

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Horror

ভূতের কেত্তন

ভূতের কেত্তন

5 mins
262



লেখার আগে একটাই ভয়, তেনারা না ক্রুদ্ধ হয়। 


কারণ, লেখার জন্য পারমিশান তো নেওয়াই হয় নি! অবশ্য, তা' নেওয়ারও খুব একটা উপায় বিশেষও ছিলো না! তিনি তো আর আমাদের দলের নন, তেনাদের একজন।


আমি নিজেও কি ছাই তখন ভাবতে পেরেছিলাম নাকি, যে বেঁচে বাড়ি ফিরবো, তারপর বহাল তবিয়তে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে একদিন সেই রাতের অভিজ্ঞতা সকলকে শুনিয়ে কৃতার্থ হবো!


কলেজের পাঠ চুকিয়ে তখন কি করবো, কোন পেশায় যাবো এইসব নিয়ে চিন্তাভাবনার মাঝে, হঠাৎ ইচ্ছে হলো - সিনেমায় নামবো, অ্যাক্টিং করবো! ব্যস দুম করে একদিন রোববার সকালে গিয়ে হাজির হলাম উত্তর কলকাতায় 'বয়েজ ওন লাইব্রেরী'-'তে, রূপবানী স্টপেজের কাছে।


আইফা নামের একটা ছোট সংস্থা, বেশ কয়েক জন স্বনামধন্য অভিনেতা অভিনেত্রীর সাহায্য নিয়ে অভিনয়ের এ বি সি ডি শেখানোর একটা চেষ্টা চালাচ্ছিলো - আমি গিয়ে তাদের দলে ভিড়লাম।


শ্রদ্ধেয় নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী অসিত বসু মহাশয়ের কাছে, সেই ভুতুড়ে মেসের কাহিনীটা ওখানেই শুনেছিলাম - ঐ চিত্রনাট্যে, মেয়েলি শূচীবায়গ্রস্ত ছেলেটা, মানে সেই মামদো ভূতের চরিত্রটায় আমি অভিনয়ও করেছিলাম। যাই হোক, ভূতের বিষয়ে আগ্রহ আমার তখন থেকেই শুরু।


ঐ ঘটনার বছর খানেক পর, মায়ের মামাতো ভাই, মানে আমার মামাতো মামার বিয়েতে, ঐ মামার বাড়ি গেলাম - খেঁয়াই, কাটোয়া রুটের ত্রিবেণী আর মেন লাইনের মগরা স্টেশনের ঠিক মাঝামাঝি একটা গ্রাম।


গ্রামজুড়ে ছড়ানো অজস্র প্রাচীন মন্দির, রাজার কাছারী, জমিদার বাড়ি, সিংহদ্বার এ'সবের ধ্বংসাবশেষ। আমার মায়ের দাদামশাই এবং তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার, রাজার ঐ কাছারী বাড়িটিও তাঁদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিলো।


এ যেন আমার জন্য মেঘ না চাইতে জল! ঐ মেসের ভূত সাজার পর থেকে, মনে আমার খুব সুপ্ত ইচ্ছা ছিলো - একবার সত্যিকারের ভুতুড়ে পরিবেশে গিয়ে, ভূত সেজে সেই নাটকের মত রঙ্গতামাশা করার।


আমার তো তখন মামার বিয়ের থেকে, ঐ আধ ভাঙা দুর্গম প্রাসাদ, জীর্ণ প্রাচীর বেয়ে ওঠা, বট আর অশ্বত্থ গাছের শূন্যে ঝুলন্ত শিকড়গুলো বেশি আকর্ষণীয় লাগছিলো। আমি প্রথমবার ওখানে গিয়েছিলাম, আমার মা-ও তাঁর কৈশোরে শেষবার গিয়েছিলেন ওখানে।


সেই কারণেই, কেউই আমায় কোন কাজেই বাধা দিচ্ছিলো না। উল্টে আমার উৎসাহ দেখে, তারাও সেইসব বাড়ির ইতিহাস, ঐতিহ্য সব বেশ রং চড়িয়ে শোনাচ্ছিলো। আমারও সে'সব শুনতে মন্দ লাগছিলো না। 


শুনলাম, দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারের কথা, তাঁর থেকেও প্রতাপশালিনী তাঁর গিন্নীর কথা - তিনি বোধ হয়, আমার মায়ের দাদামশাইয়ের ঠাকুরমা ছিলেন! তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হবে বোধ হয় - প্র-প্র-প্রনাতি। যাক গে, সে বিচারের পথে না হয় পরে যাবো।


তো, তাঁর অনুমতি ব্যতীত নাকি, ঐ বাড়িতে একটা কাক পক্ষীও বসার সাহস পেতো না! এ হেন জমিদার বাড়িতে, একবার বিনা-অনুমতিতে নাকি প্রবেশের সাহস দেখিয়েছিলো - এক ম্লেচ্ছ সাহেবের নাপিত!


আসলে, তারও দোষ ছিলো না। ফোঁড়া কাটার জন্য, নাপিতের ক্ষুরই তখনকার দিনে একমাত্র অস্ত্র ছিলো। আর জমিদার মশাইয়ের ফোঁড়াটা হয়েছিলো এমন এক বেরসিক জায়গায় - মন চাইলেও, নিজের গিন্নীকেও সেকথা বলতে কেমন বাধো বাধো লাগছিলো তাঁর।


তাই ঐ নাপিতকে চুপিচুপি ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। একে সে সাহেবদের ক্ষৌরকর্ম করে রোজ, তার ওপর ঘা-ফোঁড়া-কাটা-ছড়ায় লাগাবার জন্য সাহেবী ওষুধপত্র, মানে ঐ টিন্চার আয়োডিন টায়োডিন আর কি - ঐ সব থাকতো তার কাছে। সাহেবের নাপিত বলে, স্বদেশীয় অর্বাচীনদের সে আবার বিশেষ একটা পাত্তাও দিতো না। 


এটাই ছিলো জমিদার মশাইয়ের, তাকেই ডাকার মূল কারণ। তাঁর কোথায় ফোঁড়া হয়েছে তা যেন পাঁচ কান না হয়, আর নির্বিঘ্নে সেটা সেরেও যায় - এই ছিলো তাঁর চিন্তা! তাঁর গিন্নীর প্রতাপ সম্পর্কে আগেই অবগত করিয়েছিলেন তিনি নাপিতকে। বারংবার সাবধান করেছিলেন তাকে গোপনে আসার জন্য। 


কিন্তু, সে ভাবলো - আমি সাহেবের নাপিত, এখানে জমিদারের প্রাইভেট কাজে, স্পেশালী ইনভাইটেড হয়ে এসেছি। আমার কে কি করে নেবে? তাই, সাহেবী কায়দায় মশমশিয়ে জুতো পায়ে দালান পাড়িয়ে, সে সরাসরি জমিদার মশাইয়ের বৈঠক খানায় ঢুকে গেলো!


যথারীতি, এ'খবর কানে যেতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না জমিদার গিন্নীর। তাঁর অজ্ঞাতে, তাঁর অনুমতি বিনা, কি করে বাড়ির অন্দরমহলে এসে ঢোকে কেউ? তিনি তো ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে, দাপাতে দাপাতে, প্রাসাদের তৃতীয় তল থেকে পদব্রজে ভূতলে অবতরণ করলেন।


তিনি যখন বৈঠক খানায় প্রবেশ করলেন, সদর্পে দরজায় তীব্র পদাঘাত করে, নাপিত তখন সবে জমিদার মশাইয়ের লিঙ্গমূলে, ফোঁড়ার পার্শ্বদেশ ছেদনের জন্য ক্ষুর সঞ্চালন করেছে। গিন্নীমার পদাঘাতের তীব্র শব্দে শিহরিত হওয়ার কারণে, ক্ষুরের চাপে জমিদার মশাইয়ের শ্মিশ্নদণ্ডটিই আমূল কাটা গেলো!


জমিদার মশাই নিজের ঐ যন্ত্রণায় ও ততোধিক লজ্জায় তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করলেন। সতীদাহ তখন দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও, নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জায়, গিন্নীমাও সহমরণে গেলেন! সেই নাপিত বাবাজীবনকেও জমিদার বাড়ির লোকেরা রেহাই দেয়নি। প্রথমত জমিদারকে খুন, পরে তারই কারণে জমিদার গিন্নীর সহমরণে যাবার দায়ে, তাঁরা সেদিনই তার মুণ্ডচ্ছেদ করেন, ঐ বাড়িতেই!


ওখানেই নাকি একটা মজে যাওয়া কুয়োর মধ্যে, তার দেহটা ফেলে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। সে নাপিত বেচারা চালাকি করে সাহেবিয়ানা করলেও, ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীষ্টান হয়নি, সে হিন্দুই ছিলো - সে কথা অবশ্য কারোরই জানা ছিলো না। যাই হোক, শবদাহ না করে তাকে কবর দেওয়ায়, তাই তার আত্মার মুক্তি হল না। সে বেচারা স্কন্ধকাটা হয়ে এই জমিদার বাড়িতেই ঘুরে বেড়াতে লাগলো।


আজও নাকি তাকে দেখতে পায় লোকে! আমি বুঝতেই পারছিলাম, এসব মনগড়া ভাঁওতা কথা, গুজব, তবু বেশ মজা পাচ্ছিলাম শুনতে। বললাম - আজ রাতে তাহলে দেখতে হচ্ছে, ঐ স্কন্ধকাটা নাপিত বেটার দেখা পাওয়া যায় কিনা! তার মুণ্ডুটা কোথায় ফেলেছিলো তারা, জানেন?


তার মুণ্ডুটা নাকি জমিদার মশাই আর তাঁর গিন্নীর শবদাহের পর, তাঁদের অস্থির সাথেই ঐ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আগেও সেই নাপিত বেটার ভূত, রাতে দু'চার বার কুয়ো থেকে বেরিয়ে এসে, নিজের মুণ্ডুর খোঁজ করেছিলো। 


কিন্তু তাকে সাহায্য করেনি কেউ - না দেশী ভূতের কেউ, যাদের সে জীবদ্দশায় কখনও বিশেষ পাত্তাই দেয়নি; না সাহেবদের ভূতেরা, কারন সে তো খ্রীষ্টান ছিলো না। ওদিকে বেচারীর নিজের মুণ্ডু না থাকায়, কিছু দেখতেও পায় না, বলতেও পারে না - খালি এদিকে ওদিকে ঠোকা খেয়ে কষ্ট পায়!


শেষে রেগে মেগে, সে সব ধাক্কা মেরে ভেঙেই ফেলবে বলে, ঠিক করেছিলো বোধ হয়। তাই রোজ রাত গভীর হলে, শুরু করে সামনে যা কিছু পায় তাতেই ধাক্কা দেওয়া। তার জোরাল আঘাতে একে একে ধ্বংসের পথে যায় - সিংহ দরজা, প্রাসাদের কাছারী ঘর, বৈঠকখানা। এমনকি পিছনের দেওয়ালটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, প্রাসাদটাই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে! তাই, সবাই এই বাড়ি ছেড়ে বর্তমান বাড়িতে চলে আসে। তত দিনে দেশও স্বাধীন হবার মুখে, পরে তো দেশ থেকে জমিদারী প্রথাই উঠে গেল!


সেদিন সেই নাপিতের ভূত রেগে গিয়ে, নিজেরই আরো বেশি সমস্যা করে ফেলেছিলো। কারণ, তাকে আর জবাব দেবারও কেউ রইলো না, যে বলবে কোথায় রাখা আছে তার মুণ্ডুটা - দেশী এবং সাহেব ভূতের দল তো তাকে আগেই একঘরে করেছিলো, এখন আর কোন মানুষও রইলো না তাকে হেল্প করার জন্য। সেই বেচারা নাপিতের আত্মার বুঝি আর মুক্তি লাভ হল না।


ক্রমশঃ 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy