যা ঘটে, তা' ঘটনা
যা ঘটে, তা' ঘটনা
শোভন কাটোয়ার ছেলে, উচ্চতর পড়াশুনার সূত্রে কলকাতা নিবাসী। মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর বাড়ি ফিরে না গিয়ে, দুই সহপাঠী বন্ধুতে এখানেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে, চাকরির পরীক্ষার প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করেছিল।
শোভনের বাবা কাকারা চার পাঁচ ভাই। শোভনের বাবা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো নন, তিনি বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি। চাকুরীজীবী বলে তাঁকে কাটোয়ায় থাকতে হয়। এতে তার মায়েরও অবশ্য নিজের কর্মস্থলে যাওয়ার সুবিধা হয়েছে। শোভনের ঠাকুরদা ঠাকুমা অবশ্য গ্রামের বাড়িতেই থাকেন, মানে থাকতেন। শহরের পরিবেশ তাঁদের খুব একটা পছন্দ ছিল না - যেমন আর পাঁচজন গ্রামের মানুষের পছন্দ হয় না শহর তেমনই।
এটা নিয়ে একটু দুঃখ যেমন তাঁদের ছিল, তেমন ছিল শোভনেরও। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার খেসারত দিতে, শোভনকে বাধ্য হয়েই থাকতে হতো বাইরে। ফলে নাতির সাথে দাদু ঠাকুমার সময় কাটানো বিশেষ একটা হয়ে উঠছিল না ইদানিং। সত্যি কথা বলতে কি, এটার দুঃখ তাদের সকলেরই ছিল।
যাই হোক, জীবনে সবকিছু যেমন মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক কিছুকেই মেনে নিতে হয়, তেমনই ঠাকুরদা এবং ঠাকুমার থেকে নাতির এই বিচ্ছেদটুকু এ জনমে আর ঘুঁচলো না। একে একে দাদু এবং ঠাকুরমা পরলোক গমন করলেন। শোভন ব্যস্ত ছিল তখন নিজের কেরিয়ার গড়ার জন্য, কলকাতায়।
ঠাকুমার পরলোক গমনের কয়েক মাস পরের ঘটনা। শোভন ফ্ল্যাটে একাই ছিল সেদিন, ওর বন্ধু বাড়ি গিয়েছিল বিশেষ কোন কাজে। রাতে ভীষণ গরম লাগায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, ডাইনিংএর মেঝেতে বিছানা করে ফ্যান দু'টো চালিয়ে শুয়ে পড়েছিল সে।
হঠাৎ রাতে কোন একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে যায় তার। মনে হয় - রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, কেউ যেন তার মাথার পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে, দরজার উপরের স্টোরিং স্পেসটাতে উঠে পা ঝুলিয়ে বসলো! শোভন প্রথমে চোর ভেবে চমকে উঠে লাইটটা জ্বেলে দেয়, কিন্তু দেখে কেউ কোথাও নেই। ভাবলো, তার মনের ভুল হবে নিশ্চয়ই, ঘুমের ঘোরে কি দেখতে কি দেখেছে।
কিন্তু পরদিন রাতে, যথারীতি সেই একই ঘটনা আবার ঘটলো। এবার শোভন আলোটা না জ্বেলে, যথাসম্ভব চোখ কম খুলে সেই স্টোরিং স্পেসটার দিকে তাকিয়ে দেখল - যিনি সেখানে বসে আছেন, তিনি আর কেউ নন, তারই ঠাকুমা। ওখানে বসে তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছেন নাতিকে!
ঘটনাটা তাঁর দেহান্তের মাস দুয়েক পরে ঘটেছিল। শোভন পরদিন তার মাকে কথাটা জানাতে, মা বলল - ঠাকুমাকে নিয়ে তো নানা রকম চিন্তা করতো সে, হয়তো সেই জন্য এমন মনে হয়েছে তার। কিন্তু শোভন বুঝতে পারে, ওটা মোটেই সে'রকম কিছু ঘটনা ছিল না। এদিকে একা থাকতেও হচ্ছিলো তাকে ঐ ফ্ল্যাটে, তাই আপাতত সারা রাত লাইট জ্বেলে পড়াশোনা করা অথবা ঘুমানোর পথ ধরল সে।
এইভাবে বেশ কিছু বিনিদ্র রাত কাটানোর পর, তার বন্ধু ফিরল গ্রাম থেকে। এই সময় কিন্তু আর ওই ঘটনা ঘটেনি, ফলে শোভনও তার বন্ধুকে ওই বিষয়ে আর কিছু বলেনি। কিন্তু ঘটনাটা যে শুধুই তার মনের ভুল ছিল না, বা মায়ের কথা মতো তার চিন্তার ফসল যে ছিল না ওটা - সেটার প্রমাণ মিললো খুব তাড়াতাড়ি।
একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে শহরের বাইরে যেতে হয়েছিলো শোভনকে। ফ্ল্যাটে একাই ছিল তার বন্ধু, সে রবিবার পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় ফিরবে সোমবার। রবিবার রাতে ওর বন্ধু হঠাৎ ফোন করে বলল - হ্যা রে শোভন, তুই যে এখানে একা ছিলি এতদিন, কখনো কিছু মনে হয়নি তোর? কিছু দেখিস নি?
শোভন প্রকৃত ঘটনা সেই রাতে বন্ধুকে বলেনি, একা থাকতে যাতে সে ভয় না পেয়ে যায়। পরদিন ফিরে এসে তার মুখে শুনলো সব ঘটনা। তার ঐ বন্ধুও সেই একই রকমভাবে রান্নাঘর থেকে সেই স্টোরিং স্পেসটাতে গিয়ে বসতে দেখেছে তার নিজের দিদিমাকে, যিনি গত হয়েছেন মাস ছয়েক আগে।
শোভন তখন তাকে জানায় - তার অনুপস্থিতিতে একা থাকার সময়, শোভনের সঙ্গে কি ঘটেছিল এবং সে কিভাবে সেই সমস্যা থেকে তখনকার মত রক্ষা পেয়েছিল। দুজনে তখন ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র সিফ্ট করে যাবে ঠিক করলো। আর যত দিন না নতুন ফ্ল্যাট পাওয়া যায় থাকার জন্য, তারা নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়াই ঠিক হবে বলে মনস্থ করল।
পরের দিনই, নিজেদের মালপত্র সব গোছগাছ করে বেঁধে রেখে, নতুন ফ্ল্যাটের খোঁজ করার জন্য একজন বিশ্বস্ত লোকের সাথে কথা বলে, যে যার বাড়ি ফেরার পথ ধরল।
রাত তখন দু'টো, বারোটার সময় স্টেশনে পৌঁছানোর কথা যে মালদা টাউন লোকালটার, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সে দু' ঘন্টা লেট। শোভন যখন কাটোয়া স্টেশনে নামল তখন দু'চারজন সহযাত্রী ছাড়া চারপাশে কোথাও কেউ নজর এলোনা তার।
শোভনকে যেতে হবে মাস্টার পাড়ার দিকে। রাত বেশ গভীর। যথারীতি বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে শহর জুড়ে অন্ধকার। ভালোর মধ্যে ওই কিছু স্ট্রিট লাইট জ্বলছিল এই যা। শোভনের পথে যাবার মত কোন সহযাত্রী ছিল না, তাই সে একাই পদব্রজে বাড়ির দিকে রওনা দিল।
সার্কাস ময়দানের মাঠটার পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ নজরে এলো - মাঠের একপাশে গজিয়ে উঠেছে একটা দোতলা বাড়ি! বাড়িটার গঠন যদিও মোটেই নতুন বাড়ির মতন ছিল না, বরং একটু সাবেকি ধাঁচেরই ছিল। তার বারান্দায় আবার একটা বয়স্ক লোক হারিকেনের আলোয় কিছু একটা করছিলেন।
একটু আশ্চর্য হলেও, শোভন ভাবলো - সে তো অনেক দিন পর ফিরছে, আগে হয়তো ঠিকঠাক খেয়াল করেনি বাড়িটাকে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় - তাই বা কি করে হবে? এই মাঠে তো বহুদিন খেলাধুলা করেছে সে, বাড়িটা তো কখনই তার চোখে পড়েনি!
এমন সময় দেখে - সেই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছেন, হাতে হারিকেনটা নিয়ে। আর তাঁর শরীরের দীর্ঘ ছায়াটা এসে পড়ছে সেই বারান্দা থেকে শোভনের রাস্তার উপর পর্যন্ত! ফিজিক্সে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে এমএসসি পাস করা শোভনকে, আলোর উৎস আর তার সম্মুখীন বস্তুর দ্বারা সৃষ্ট ছায়ার দৈর্ঘ্য সম্পর্কে, বিশেষ ব্যাখ্যা দেবার কারোর প্রয়োজন নেই।
সেই মুহূর্তে, তার চোখের সামনে যা ঘটছিল তার সম্ভাব্য কারণ ও পরিস্থিতি বুঝে, শোভন খুব জোরে দৌড় দেয় বাড়ির দিকে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই, শুধুই চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের জন্য, সে নিজে এসে একবার সরেজমিনে দেখলো মাঠটা - কোথায় সেই বাড়ি? আর কোথায় সেই লোক?
মাকে ঘটনাটার কথা বলতে, তিনি সরাসরি বলে দিলেন - হয় তুমি এত রাত করে বাড়ি আসবে না, অথবা যদি আসতেই হয় কাছারি রোড ধরে ঘুরে আসবে, এই রাস্তায় আর আসবে না। গত মাসেই পাড়ার একজন এই একই দৃশ্য দেখে, মস্তিষ্কের ভারসাম্য খুইয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে!