SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Horror

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Horror

ভূতের কেত্তন - শেষ পর্ব

ভূতের কেত্তন - শেষ পর্ব

5 mins
272



শুনে, আমারও বেচারা নাপিতের জন্য, মনটা কেমন সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো। ভাবলাম - এই সুযোগ, নাপিতের ঐ স্কন্ধকাটা প্রেতাত্মাকে যদি মুক্ত করতে পারি, তাহলে আমার আজীবন স্মরণীয় একটা ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা হবে, যার জন্য নিজেরও গর্ব হবে, আবার অ্যডভেঞ্চারের শখও আমার পূরণ হবে! কিন্তু কিভাবে সম্ভব হবে সেটা?


মায়ের এক পুরোহিত দাদামশাই ছিলেন গ্রামে। একজনের পরামর্শে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম আমার ইচ্ছের কথা। তিনি সব শুনে একটু হেসে বললেন - এসব কাহিনীতে বিশ্বাস করো? ওসব তো মনগড়া কথা!


বললাম - হতে পারে, আমি তো অ্যাডভেঞ্চারের জন্যই যেতে চাই ওখানে, রাতে একাকী। এখন ঐ কাহিনী যদি সত্যি হয়, মানে যদি সত্যিই সেই স্কন্ধকাটা ভূতের দেখা পাই তাহলে তার থেকে বাঁচার উপায় কি? আর যদি কোন ভাবে তার আত্মাকে মুক্তি পাওয়াতে হয় তার জন্যই বা কি করতে হবে সেই পরামর্শ দিন।


তিনি মৃদু হেসে বললেন - সে হিন্দু হলেও তার শবদাহ করেনি ওরা, মাটিচাপা, বলা ভালো পুঁতে দিয়েছিল তাকে মেরে। এখন যদি তার হাড়গোড় কিছু বেঁচে থাকে ওখানে কোথাও তবে সেটাই দাহ করে সেই অস্থিভস্ম গঙ্গায় গিয়ে বিসর্জন দিলে হয়তো সে মুক্তি পেলেও পেতে পারে।


বললাম - কিন্তু সেগুলো ঠিক কোন জায়গায় আছে জানেন? মানে সেগুলো উদ্ধার না করতে পারলে আর দাহ করা যাবে কি করে?


তিনি বললেন - তার যদি মুক্তির সময় হয় তাহলে সে নিজেই সেসবের ব্যবস্থা করে দেবে তোমায়। ভালো লাগলো তার মুক্তিলাভের জন্য তোমার সদিচ্ছা দেখে। উদ্দেশ্য মহৎ না হলে তোমাকে বারণ করতাম ওখানে যেতে। কিন্তু এখন বলবো, আজ রাতে অবশ্যই ওখানে যাও, আশা করি তোমার যাত্রা বৃথা যাবে না।


আমি তাঁর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ চাইলাম। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন - ঐ বাড়ির উত্তর ফটকের কাছে একটা মজে যাওয়া কুয়ো আছে, ‌তুমি যেটার খোঁজ করছো সেটাই হলো ওটা। সাবধানে যেও, কল্যাণ হোক।


ব্যস, রাতের বেলায় ঐ কুয়োর ধারে গিয়ে হাজির হলাম, নাপিতের সেই স্কন্ধকাটা ভূতের জন্য। সাথে নিয়ে নিয়েছি একটা লোহার রড, একটা কেরোসিনের বোতল আর একটা কাপড়ও। ব্যাটা বের হলেই, প্রথমে তাকে রড দিয়ে মেরে পাট করে দেবো, তারপর কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিলেই কাজ শেষ। 


কুয়োর পাড়ে বসে আছি তো আছিই - সে বেটা নাপিত ভূতের পাত্তা নেই। এদিকে রাত ভোর হয়ে আসছে, সকালবেলায় নিশ্চয়ই বাবাজীর দেখা পাবো না - তাহলে, সে বেটা এলোই না আজ? আর আমি তাকে মুক্তি পাইয়ে দেবো বলে বসে রইলাম সারারাত? মনটা খারাপ হয়ে গেলো। পরদিন মামার বিয়ে, তাই ফিরে গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেওয়াটাই বরং ঠিক হবে ভেবে, উঠে চলে আসতে গেলাম।


পা বাড়িয়েছি আর মাথায় একটা কিছু ঠাণ্ডা মত ঠেকলো। ভাবলাম, সেই বটগাছের ঝুড়ি নেমেছে, ওটাই বোধ হয়। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে দেখি - একটা কংকাল, পড়নে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে শাঁখা, পলা, নেড়া কপালে আবার সিন্দুরের টিপও! তিনি ঠ্যাং ঝুলিয়ে, সিংহ দরজার ভাঙা দেওয়ালের ওপরে বসে আছেন, তাঁর সেই ঝুলন্ত শ্রীচরণের শীতল স্পর্শই কপালে তখন অনুভব করেছিলাম আমি।


তাঁর আগুনের গোলার মত চোখদুটো দিয়ে, আমার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বললেন - কে রে তুই, এত সাহস তোর, আমার বাড়িতে ঢুকিস বিনা অনুমতিতে? 


আমার তো ভয়ে বুক কেঁপে গেলো। তিনি সামনে ঝুঁকে, আমার পানে তাঁর লম্বা হাতটা বাড়িয়েই দিতে যাচ্ছিলেন আমার গলাটা টিপে ধরার জন্য, এমন সময় তাঁর সামনে, মানে আমার ঠিক পাশে হাজির হলো আর এক কঙ্কাল। তাঁর পরনে আবার, যাত্রাদলের রাজ রাজাদের চরিত্রের অভিনেতাদের যেমন পড়ানো হয়, সেই রকম জমকালো রাজপোশাক, মাথায় পাগড়ি।


তিনি বললেন - আহা, কি করো গিন্নী, মরে ভূত হলে তবু সেই তোমার খবরদারির স্বভাব গেলো না! আরে ও তো আমাদের মালুর ছেলে - তোমার নাতির নাতনির নাতি, মানে ধরে নাও তোমারও নাতিই। ও এখানে আমাদের দুজনেরই ভালোর জন্যই এসেছে। কত প্ল্যান করে ওকে আমাদের সব কাহিনী শুনিয়ে, এখানে আনতে হয়েছে তুমি জানো? ব্যাটা নাপিতের কঙ্কালটা ও পুড়িয়ে দেবে বলে এসেছে। তাহলেই সে ব্যাটা নাপিতও মুক্তি পায়, আর আমরা দুজনেও। কিন্তু তোমার ভয়ে তো সে ঐ কুয়ো থেকে বেরই হচ্ছে না আজ!



বুঝলাম, এনারাই হলেন সেই জমিদার আর তাঁর প্রতাপশালিনী গৃহিণী। আহা রে, ঐ নাপিতটার জন্য ওনারাও মুক্তি পাচ্ছেন না? এবার আমার সত্যিই খুব কষ্ট হলো তিনজনের জন্যই। ভাবছি কি করা যায় এখন, এমন সময় জমিদার গিন্নী ডাক দিলেন - ও নাপিতের পো, বাইরে এসো। আমার নাতি এসেছে, আজ আমাদের তিন জনেরই মুক্তি হবে। আর ভয় পেতে হবে না, বাইরে এসো।


কুয়ো থেকে নাপিতের স্কন্ধকাটা ভূত, মানে তার কঙ্কাল চেহারাটা বেরিয়ে এলো তখন। আমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তখন ভাবছি, এবার কি করবো? জমিদার ভূত বোধ করি সেটা বুঝতে পারলেন, তাই নাপিত ভূতকে বললেন - তুই কুয়োর পাড়টা ভেঙে, তোর কঙ্কালটাকে বের করে দে। সেই নাপিত ভূতের জোরালো আঘাতে, ঐ মজে যাওয়া কুয়োর একটা ভাগ তখনই ধ্বসে গেলো। আমি নিচে উঁকি মেরে দেখি - নাপিত ভূত বেটা, নিজের গায়ের জোরেই সেই চাপা পড়া মাটির স্তুপ সরিয়ে, নিজের শিরহীন কঙ্কাল শরীরটা বের করে দিয়েছে।


আমি দেখলাম, আসে পাশে শুকনো পাতা জমে আছে প্রচুর। কঙ্কালটাকে কাপরটায় জড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে, তারওপর পাতাগুলো একত্র করে কেরোসিন ঢেলে তা'তে আগুন লাগিয়ে দিলাম। দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো আগুন। আগুন নিভতে দেখি, পড়ে আছে সামান্য ছাই। 


জমিদার গিন্নীর সেই পেত্নী বললেন - ওর সব ছাই ভস্মগুলো একজায়গায় করে ঐ বোতলে ভরো। আমি তাই করলাম। 


জমিদার ভূত বললেন - দেখো, সকাল তো হতেই চলেছে প্রায়, এখান থেকে গঙ্গাও বেশি দূর না। ঐ অস্থি ভস্ম গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেই, ওরও মুক্তি হবে, আর আমাদেরও। আট পুরুষ ধরে মুক্তির জন্য প্রতীক্ষায় আছি আমরা। আজ তোমার দ্বারা সেই প্রতীক্ষার অবসান হবে। চলো তোমায় রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, যেতে পারবে তো? 


আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে, পাশেই রাখা মামার সাইকেলটায় চড়ে গঙ্গার দিকে রওনা দিলাম বোতলটাকে নিয়ে।


ত্রিবেণী শ্মশানঘাটে এসে, বোতলটা গঙ্গায় ধুয়ে পরিস্কার করে ভাসিয়ে দিলাম। মনে মনে তাঁদের তিনজনেরই আত্মার মুক্তি কামনা করে মা গঙ্গার কাছে মিনতি জানিয়ে ডুবও দিলাম গোটা তিনেক। তারপর পাড়ে উঠে এসে দেখি - শ্বেতবস্ত্রে জমিদার মশাই, তাঁর গৃহিণী এবং সেই নাপিত পূর্ণাঙ্গ শরীরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। আমি তাঁদের তিন জনকেই প্রণাম করলাম, তাঁরাও আশীর্বাদ করলেন - কল্যাণ হোক।


ভোরের আলো ফুটতে তখন আর বিশেষ বাকি নেই, পাখপাখালিদের ডাক শোনা যায়। তাঁরা বললেন - বহু প্রতীক্ষার পর, তোমার কারণে আমরা তিন জনেই আজ ইহলোকের বন্ধন থেকে মুক্তি পেলাম। আলোয় থাকা আর এই ইহলোকে থাকার সময় আমাদের ফুরিয়েছে। এবার আমরা আসি দাদুভাই, ভালো থেকো তুমি।


তাঁরা সেই সূর্যোদয়ের কোমল আলোয় যেন, স্নিগ্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে, আমার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে উবে গেলেন। আমি, ভেজা গায়ে সাত সকালে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা স্বাস্থ্যকর হবে না ভেবে, সাইকেলটা নিয়ে মামার বাড়ি পানে দৌড় দিলাম।


।সমাপ্ত।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy