Prasun Dutta

Comedy Crime

3.8  

Prasun Dutta

Comedy Crime

তিব্বতি পুঁথি

তিব্বতি পুঁথি

18 mins
634


আই এন এ বাজারের বিপরীতে ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দিল্লি হাট। তখন থেকেই যায়গাটা জনপ্রিয়। দিল্লি আর তার সন্নিহিত অঞ্চলের তো বটেই, ভারতের অন্যান্য রাজ্য আর বিদেশের মানুষরা এখানে আসেন। কাছেই চানক্যপুরি। বিদেশি দূতাবাস ক্ষেত্র। এই দূতাবাস গুলোয় কর্মরত বিদেশিরাও আসেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাস, দিল্লি আই আই টি আর জেএনইউর মত প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও আশেপাশে। তাই ছাত্র ছাত্রীরাও আসে দলবেঁধে আড্ডার আমেজে বা জুটিতে প্রেম করতে। একর ছয়েক জমিতে ছড়িয়ে থাকা দিল্লি হাট একটা মুক্ত বাজার। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বিক্রেতাদের পোশাক পরিচ্ছদ আর হস্তশিল্পের দোকান। বিভিন্ন প্রদেশের খাবার দোকানও আছে। লক্ষ্ণৌর কাবাব, কাশ্মীরের রোগেন জোস বা রাজস্থানের ডালবাটি চুর্মা সব পাওয়া যায়। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পীরা লোক সঙ্গীত বা নৃত্যের আসর বসান। খোলা হাওয়ায় নির্ঝঞ্ঝাট অবসর বিনোদনের আদর্শ পরিবেশ। সংলগ্ন মেট্রো স্টেশন জায়গাটার আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০২১ এর জুলাই মাস। ভয়ংকর তাণ্ডবের পর অনেকের জীবন অকালে কেড়ে নিয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হপ্তা তিনেক আগে প্রশমিত হয়েছে। লক-ডাউনের পর দিল্লি হাট দিন কয়েক আগেই খুলেছে। ভিড় তেমন নেই। অর্ধেক দোকান খোলা নেই। যে কটা আছে তাড়াও মাছি তাড়াচ্ছে। তিন বন্ধু পরিতোষ, বটু আর অনিকেত এসেছে আড্ডা মারতে পড়ন্ত বিকেলে। দুপুরে বৃষ্টি হয়েছ। আকাশ মেঘলা কিন্তু ভ্যাপসা গরম আর নেই। লাদাখ আর অরুণাচলের ভৌগোলিক দূরত্ব যাই হোক না কেন এখানে এদের খাবার দোকান দুটো বেশ কাছাকাছি। খাবার দোকানগুলোর বাইরে পাতা আছে গোটাকয়েক টেবিল আর চেয়ার। তারই একটায় বসেছে তিনজন অরুণাচলের মোমো আর লাদাখের মাখন চা নিয়ে। পঞ্চাশ বছরের অনিকেত বাকি দুই স্কুল বন্ধুর চেয়ে বছর পনেরো বড়। পরিচয়ও বেশি দিনের নয়। আড্ডায় তাই সে শুনছে বেশি বলছে কম।

পরিতোষ দিল্লির ছেলে। চিত্তরঞ্জন পার্কের অভিজাত এ ব্লকে ওদের বেশ বড় বাড়ি। বাবা কলকাতায় আই টি সিতে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে স্কুলের পড়াশোনাটা কলকাতায় করেছে। বটু ওর স্কুলের সহপাঠী। বটুর নাম বটু অবশ্য নয়। সুধাংশু বটব্যাল। বটব্যাল থেকে বটু। বন্ধু মহলে বটু নামেই স্বনামধন্য। পরিতোষ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। গুরগাঁওতে একটা মাঝারি কোম্পানিতে উঁচু পদে আছে। এখনও অকৃতদার। একটা ব্রেক আপের পর বছর দুয়েক আগে নতুন গার্ল-ফ্রেন্ড। বটু বিয়ে করেছে। বৌ থাকে কলকাতায়। ওদের একটা ছোট ট্রাভেল কোম্পানি আছে। অফিস মধ্য কলকাতায় ক্যামাক স্ট্রিটে। বটু আর ওর বৌ চালায়। জনা পাঁচেক কর্মচারী আছে। ব্যবসা চলত ভালই। দেশবিদেশের পর্যটকদের আবদার রাখতে নাজেহাল হতে হত বটে, মা লক্ষীর অকৃপণ কৃপা কিন্তু ছিল। ব্যবসায় ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এলো করোনা। বিদেশী পর্যটক আসা বন্ধ। করোনা বিধির ঝামেলা স্বত্বেও কিছু দেশী পর্যটক আছে বটে, তবে সংখ্যায় কম। মাসের পর মাস অফিস ভাড়া, আনুষঙ্গিক খরচ আর কর্মচারীদের মাইনের দায় সামলাতে নাস্তানাবুদ ছিল বটু আর তার বৌ। ওদের অবশ্য দিল্লিতে একটা ছোট অফিস ছিল বিকাজি কামা প্লেসে। একটা ছেলে দেখাশোনা করত। তাছাড়া একটা বছর তিরিশের ছেলে শেরিংকেও রেখেছিল। শেরিংএর বাড়ি লাদাখে। ছেলেটা মে থেকে অক্টোবর অবধি লেহ্ শহরে কোনো হোটেলে খাতা লেখার কাজ করত। বছরের বাকি মাস গুলো দিল্লিতে তিব্বতিদের ডেরায় একটা দোকানে। বছর তিনেক আগে লেহ্ শহরে শেরিংকে প্রথম দেখেছিল বটু। তারপর থেকে বছর দুয়েক নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস অবধি সে ছিল বটুর কর্মচারী।

শেরিং অবশ্য আর বটুর কাজ করে না। গতবছর মানে ২০২০র অক্টোবরে বটু তার দিল্লির অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। দুই কর্মচারীর চাকরি গেছে। পরিতোষের বেসমেন্টটা খালি পড়ে ছিল। সেটাই এখন বটুর অফিস। তবে কমার্শিয়াল এলাকা নয়। কোম্পানির বোর্ড লাগানোর অনুমতি নেই। ব্যবসার কাজকর্ম বটু মোটামুটি কলকাতা থেকে দেখাশোনা করে। তবে প্রায়ই দিল্লি আসতে হয়। বেসমেন্টে থাকার ব্যবস্থা নেই। তিনতলার ছাদে একটা ঘর আর বাথরুম। এখানে এটাকে বর্ষাতি বলে। বটু দিল্লি এলে এখানেই থাকে। বৌ কখনও আসে নি। বাড়ির মালিক মানে পরিতোষের বাবা ভাড়া নেন নি। বটু কৃতজ্ঞ কিন্তু ঋণী থাকতে চায় না। নিজের মনে প্রতিজ্ঞা করেছে একটু আয় বাড়লেই ন্যায্য ভাড়া দিয়ে থাকবে। করোনার প্রকোপ কমেছে তাই পর্যটন সামান্য বেড়েছে। কলকাতায় ততটা না হলেও দিল্লিতে অবশ্যই। ব্যবসার শুরুতে বটু প্রতিজ্ঞা করেছিল কর্মী ছাঁটাই করবে না। পরিস্থিতির চাপে করতে হয়েছে। দিল্লি কলকাতা মিলিয়ে মোট চারজনকে। ওরা আজ বেকার। বেরোজগার পরিবারগুলোর কষ্ট সে অন্তর দিয়ে অনুভব করে। ভাবে সুদিন এলে আবার তাদের ফিরিয়ে আনবে। মাঝে মাঝে নিরাশায় মূষরে পড়লেও মূলত সে আশাবাদী।

গতবছর মানে ২০২০তে লাদাখে পর্যটক খুবই কম ছিল। লক-ডাউনের পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে লাদাখ ফিরে শেরিং হোটেলে কাজ পায় নি। দিল্লিতে বটুও ওকে কাজ দেয় নি। নভেম্বরে দিল্লিতে করোনার আর একটা উত্তাল ঢেউ। আবার লক-ডাউন। জীবিকার তাগিদে শেরিং সবজি বিক্রি করত। তখন আলাপ হয় হিমাচলের রতন নেগির সঙ্গে। লোকটা দিল্লি হাটে লাদাখি খাবার দোকানটার মালিক। শেরিংকে এই দোকান দেখাশোনার কাজ দিয়েছে। বটু জানত শেরিং কাজ পেয়েছে। বটু খুব খুশি। শেরিংও খুশি। তিনজনের মাখন চায়ের দাম সে নেয় নি।

অনিকেত পেশায় সত্যান্বেষী। কর্পোরেট অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তবে আকর্ষক কেস পেলে কর্পোরেট জগতের বাইরেও কাজ করে। আগে পূর্ব দিল্লিতে ইস্টার্ন নেস্ট নামে একটা আবাসনে থাকত। ওখান থেকে নয়ডায় মক্কেলদের অফিসে যাতায়াত সহজ ছিল। নতুন মক্কেলদের অফিস গুরগাঁওতে। অনিকেত দিল্লিতেই থাকতে চায়। তাই দক্ষিণ দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে ভাল থাকার যায়গা খুঁজছিল।

বাবা মায়ের সঙ্গে পরিতোষ বাড়ির এক তলাটায় থাকে। দোতলাটা খালি পড়ে আছে। অনিকেতের বৌ সুধা আর পরিতোষের গার্ল-ফ্রেন্ড ঝিনুক ইস্টার্ন নেস্টে প্রতিবেশী ছিল। সমবয়সী না হলেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। অনিকেতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ঝিনুকের অনুরোধে পরিতোষ ভাড়া দিয়েছে। বাড়ির দোতলার বাসিন্দা সস্ত্রীক অনিকেত এখন পরিবারের সদস্য। যেমন বটু।

বাড়ি পৌঁছে বটু বলল ও একটা জিনিস দেখাতে চায়। বেসমেন্টের অফিসে আলমারির ভেতরে একটা বাক্স খুলে যে জিনিসটা দেখাল সেটা একটা পুঁথি। সামনে আর পেছনে প্রচ্ছদ পাতা দুটোয় জোড়া সোনালি মাছের ছবি। বটু বলল তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের শুভ প্রতীক। মাঝে আরও তিনটে পাতা। প্রথম দুটো পাতায় পুরো পাতা জুড়ে আর তিন নম্বর পাতায় আধ পাতা লেখা। পাতাগুলো একটা ম্যাড়ম্যাড়ে লালচে সুতো বেঁধে জোড়া। বাদামি হয়ে যাওয়া মলিন কাগজে পোকায় কাটা কয়েকটা ফুটো দেখে বোঝাই যায় পুঁথিটা কয়েকশ বছরের পুরনো। বটু বলল প্রাচীন তিব্বতি ভাষা আর লিপি। অনিকেত বলল এ জিনিস রাখা বেআইনি। বটু বলল ও কিনেছে ২০১৯শে শেরিংএর কাছ থেকে মাত্র ত্রিশ হাজার টাকায়। কোনো এক তিব্বতি লামা ওকে বেচেছিল। কি দামে তা বটুকে বলে নি। অনিকেতের মুখ গম্ভীর। কেননা এই রকম একটা প্রাচীন জিনিস এই ভাবে কেনাবেচা করা একেবারেই বেআইনি। অনিকেতের অনুরোধে বটু একটু ইতস্তত করে শেরিংকে ফোন করল। সে জানাল পুঁথিটা ওকে বেচেছিল সিকিম থেকে আসা একটা লামা। উনি সিকিম ফিরে গেছেন। কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর নেই। অনিকেত পুঁথিটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে মুঠো ফোনটা বের করে পাতাগুলোর ফটাফট ফটো নিয়ে নিল। পুঁথিটায় ন্যাপথলিনের হাল্কা গন্ধ। পোকা লাগা থেকে বাঁচাতে বটু পুঁথির বাক্সে ন্যাপথলিন দিয়েছে।

পুরনো জিনিস কেনার শখ বটুর নেই। তবে পর্যটনের ব্যবসা। কোভিডের আগে বিস্তর ঘোরাঘুরি করতে হত। মওকায় দাঁও মারার সুযোগ নিয়েছে বৈকি। সস্তায় কিনে বেশি-দামে বেচা। কেনার লোক অনেক। এই কোভিডের সময় বিদেশি পর্যটক নেই। ধান্দা মন্দা। তাই পুঁথিটার কোনো গতি করতে পারে নি। তবে বটু জানে পয়সাওয়ালা কেউ লাখ খানেক টাকাও দিতে পারে। বটু এটাও জানে এই শখ পোষার সামর্থ্য যাদের ছোটখাটো আইন ভাঙ্গার তোয়াক্কা তারা করে না।

২০২১শের আগস্টের মাঝামাঝি মাঝামাঝি পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হল। সুধা কোলকাতায় মায়ের বাড়িতে মাস খানেক থাকবে। অনিকেত বলল হপ্তা খানেকর জন্য লাদাখ ঘুরে এলে কেমন হয়। পরিতোষ রাজি। বটু যেতে চাইল না। তবে সুন্দর ব্যবস্থা করে দিল। ওর ইচ্ছে ছিল পরিতোষ আর অনিকেত প্লেনে শ্রীনগর গিয়ে ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে শ্রীনগর লেহ্ হাই ওয়ে ধরে কারগিলে এক রাত কাটিয়ে লেহ্ আসুক। মন ভরে হিমালয় দেখা আর দেহটাকে ধীরে ধীরে উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য এটাই সমীচীন। ওরা অনেক ভেবে চিন্তে অবশ্য প্লেনে সোজা লেহ্ যাবার সিদ্ধান্ত নিল। লাদাখে সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে আট রাত থাকার প্রোগ্রাম। তিন রাত লেহ্ শহরে কাটিয়ে পরের তিন রাত নুবরা উপত্যকা। পরের রাতটা প্যাংগং হ্রদের ধারে আরামদায়ক টেন্ট ক্যাম্পে আর ফিরে এসে এক রাত আবার লেহ্। লম্বা লম্বা পাহাড়ের রাস্তা। তবে অধুনা কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে আর সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে নতুন পিচ ঢালা রাস্তা গুলো খুব ভাল। গাড়িতে ঝাঁকানির ক্লান্তি নেই। গাড়িটা নতুন ইনোভা। চালক আঠাশ বছরের যুবক ব্যাঙ্কো।

লেহ্ শহরের উচ্চতা সাড়ে তিন হাজার মিটার মানে এগারো হাজার ফুট। দিল্লি থেকে সরাসরি প্লেনে এসে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া এই উচ্চতা মানিয়ে নিতে সময় লাগে। প্রথম দিনটা বটু হোটেলে বিশ্রাম নিতে বলেছিল। পরের দিন লেহ্ শহরের উপকন্ঠে আর্মি মিউজিয়াম, হেমিস আর থিকসে মনাস্টেরি দেখে শহরে ফিরে লেহ্ প্যালেস। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের এই মনাস্টেরি দুটো দেখবার মত। শুধু ভগবান বুদ্ধ নয় আরও দেবদেবীদের মূর্তি আছে। অনেক প্রাচীন পুঁথি এখানে আছে। লামারা শাস্ত্র চর্চা করেন। লাদাখকে এক সময় পশ্চিমি তিব্বত বলা হত। পাহাড়ের ওপর তিব্বতের রাজধানী লাসার পোটালা প্রাসাদের আদলে তৈরি থিকসে মনাস্টেরি। এই মনাস্টেরিতে দুতলা উঁচু বুদ্ধ মূর্তি আছে। পাশের বিশাল ঘরটায় অন্য অনেক মূর্তি। হিন্দু দেবদেবীদের মতই, তবে একটু আলাদা। পরিতোষ খুব মনযোগ দিয়ে দেখছিল। অনিকেত ঢোকে নি। নিচে চাতালটায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। পরিতোষ মূর্তিগুলো দেখে ঘরের বাইরে লম্বা বারান্দায় এসে দেখল কাঠের চওড়া বেঞ্চিটায় একজন বয়স্ক লামা বসে আছেন। পরিধানে সোনালি ডোরাকাটা মেরুন পোশাক। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। হাতে রোলেক্স ঘড়ি। একটা ইংরিজি বই পড়ছিলেন। দোষের মধ্যে পরিতোষ ওনাকে প্রশ্ন করেছিল মা দুর্গার ষোলো হাত কেন। এই অর্বাচীনতায় রেগে গিয়ে উনি পরিতোষকে হিন্দু আর বৌদ্ধ ধর্ম গুলিয়ে না ফেলে একটু পড়াশোনা করে মনাস্টেরিতে আসতে বলেছিলেন। থতমত খেয়ে আর বিরক্ত হয়ে পরিতোষ কথা বাড়ায় নি।

ওপরে বারান্দাটা থেকে নিচে চাতালে নামার সময় পরিতোষ দেখল অনিকেত ওপরে উঠছে। ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকায় মূর্তিগুলো সে দেখে নি। এবার দেখবে। অনিকেতের ঔৎসুক্য অনেক বেশি। তাই বারান্দায় বসে থাকা বদমেজাজি লামা সম্পর্কে সাবধান করে দিল।

ড্রাইভার ব্যাঙ্কো কলেজে পড়েছে। সাবলীল হিন্দি আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরিজি বলতে পারে। হোটেল ফেরার সময় অনিকেত ওকে প্রশ্ন করেছিল শেরিংকে চেনে কি না। হঠাৎ প্রশ্নটা করার কারণ কি পরিতোষ বোঝে নি। উত্তরটায় অবাক হয়েছিল। শেরিং নামে অনেককে ও চেনে। বলল একজন নাকি আমাদের কারাকোরাম গেটওয়ে হোটেলে কাজ করত। থিকসে মনাস্টেরিতে প্রায়ই আসত। বছর দুয়েক আগে সিকিম থেকে আসা এক বৌদ্ধ মংককে লাদাখ ঘুরিয়েছিল অক্টোবরের শুরুতে পর্যটন মরশুমের শেষ দিকে। ব্যাঙ্কো জানাল সব লামা আর মংকই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। লামা হতে গেলে মংকদের তিব্বতি শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করতে হয়। অনেক বছর লাগে। বলল থিকসে মনাস্টেরিতে নাকি আড়াইশো মংক আর তিরিশ জন লামা আছেন।

পরের দিন লাঞ্চের আগে সিন্ধু আর জান্সকার নদীর সঙ্গম দেখা হল। তারপর লেহ্ শহরের সুন্দর সেন্ট্রাল মার্কেটে কেনাকাটার জন্য এসেছিল অনিকেত আর পরিতোষ। ঝিনুক আর সুধার জন্য শাল আর নিজেদের জন্য মাফলার কেনা হল। সন্ধ্যে হতে দেরি আছে। পরিতোষ বলল আর্মি মিউজিয়ামে লাইট এ্যান্ড সাউন্ড দেখতে যাবে। অনিকেত যেতে চাইল না। ও যাবে লাদাখ ইউনিভারসিটি। দুটো যায়গা কাছাকাছি মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের তফাৎ। ঠিক হল ব্যাঙ্কো পরিতোষকে আর্মি মিউজিয়ামে ছেড়ে ইউনিভারসিটি যাবে। বক্তৃতার পর আবার এসে পরিতোষকে নিয়ে ফিরবে।

পরিতোষের কৌতূহলের জবাবে অনিকেত বলল থিকসে মনাস্টেরির সেই বদমেজাজি লামাটা তাকে আসার অনুরোধ করেছেন। উনি নাকি তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের ওপর বক্তৃতা দেবেন। শুনে পরিতোষ আদৌ খুশি নয়। ওর গম্ভীর মুখ দেখে অনিকেত সান্ত্বনার সুরে বলল, আরে রেগে যাচ্ছিস কেন, মূর্তির বদলে পুঁথির বিষয়ে জানতে চাইলে তোকেও বক্তৃতা শুনতে ডাকত।

পরের তিন রাত ওরা ছিল নুবরা উপত্যকায়। লেহ্ শহর ছেড়ে আঠেরো হাজার ফুট খারদুংলা পাস পেরিয়ে এই উপত্যকা। নুবরা একটা নদীর নাম। সিয়া-চেন হিমবাহ থেকে বেরিয়ে ডিস-কিট শহরে শ্যোক নদীতে মিশেছে। পরিতোষরা ছিল হুন্ডার শহরে নুবরা রিট্রিট রিসর্টে। এখান থেকেই রোজ বেরিয়ে ব্যাঙ্কোর গাড়িতে হুন্ডারের শীতল মরুভূমি, ডিস-কিট মনাস্টেরি, তুর-তুক সব দেখেছে। শীতল মরুভূমিতে দুটো কুজ ওয়ালা উটের পিঠে চড়েছে। লাদাখ পর্বতমালায় উচ্চতার কারণে সবুজত্ব নেই। শীতে বরফের আচ্ছাদনে চোখ ঝলসানো ধবধবে সাদা হলেও এই সেপ্টেম্বর মাসে মূলত বাদামি, ধূসর বা হাল্কা জলপাই। দিনের বেলায় ছায়াতে তাপমাত্রা আরামদায়ক হলেও রোদে প্রচণ্ড গরম। এত গরম যে আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করে।

আইসক্রিম সহজলভ্য নয়। তুর-তুক থেকে বালতিস্তান সীমান্তে ভারতের শেষ গ্রাম থঙ্গ্ যাবার পথে এক যায়গায় আর্মি পরিচয় পত্র পরীক্ষা করে। লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীদের জন্য আর্মির লোকেরাই সুস্বাদু আইসক্রিম বিক্রি করে। চাঁদিফাটা রোদে দাঁড়িয়ে তারিয়ে তারিয়ে আইসক্রিম উপভোগ করতে করতে পরিতোষদের আলাপ হল অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল খান্ডেলওয়ালের সঙ্গে। সস্ত্রীক এসেছেন। এনারা গতকাল এসে পরিতোষদের রিসর্টেই উঠেছেন। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় দেখা হয়েছিল কিন্তু তখন আলাপ হয় নি। থঙ্গ্ গ্রামটা বালতিস্তানের অংশ ছিল। বালতিস্তান এখন পাক অধিকৃত। কিন্তু গ্রামটা ভারতে রয়ে গেছে। এক বালতিস্তানি মহিলা এখানে বালতিস্তানের পাহাড়ের কোলে নিজের বাড়িতে পর্যটকদের জন্য ছোট একটা ক্যানটিন খুলেছেন। সেখানেই মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশে মাখন চা খেতে খেতে কথা বলছিল খান্ডেলওয়াল দম্পতি, পরিতোষ আর অনিকেত। খান্ডেলওয়ালরা জয়পুরে থাকেন। লাদাখ খুব ভাল লাগে তাই প্রায় প্রতিবছর আসেন। শেষ এসেছিলেন কোভিডের আগে ২০১৯শে। অনিকেতের পরিচয় জেনে বললেন লাদাখে অপরাধ বড় একটা হয় না। তবে মনাস্টেরিগুলো থেকে চুরি করা ছোট খাটো জিনিস দেশ বিদেশে পাচার হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বললেন ২০১৯শে ডিস-কিট মনাস্টেরিতে শেরিং নামে এক লাদাখির সঙ্গে দেখা হয়। ওর সাথে একজন মংক ছিল। শেরিং ওনাকে একটা তিন চার পাতার চোরাই পুঁথি বিক্রি করতে চেয়েছিল। উনি পুলিসে খবর দেওয়ার ধমকি দেওয়ায় কথা না বাড়িয়ে সটান কেটে পরে। বেড়াতে এসে খান্ডেলওয়াল সাহেবও পুলিশই ঝামেলায় জড়াতে চান নি। শেরিং ব্যক্তিটার সম্যক পরিচয় যে পরিতোষদের জানা আছে সেটা তারা খান্ডেলওয়ালকে জানতে দেয় নি।

পরের দিন পরিতোষ আর অনিকেত গিয়েছিল প্যানামিক। নুবরা নদীর ধারে পাহারে ঘেরা সুন্দর যায়গা। সিয়া-চেন বেস ক্যাম্প থেকে দুরত্ব মাত্র পঁয়ষট্টি কিলোমিটার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়া এখানকার মূল আকর্ষণ পাহাড়ের ওপর উষ্ণ প্রসবন। বাত আর চর্মরোগ নীরোগের অভিপ্রায়ে অনেক পর্যটক এখানে আসেন। গরম জলের উৎস পাহাড়ের ওপর। পাইপে ওই গরম জল আসে নিচের স্নানাগারগুলোতে। কোভিডের জন্য সব বন্ধ। তাই পর্যটকের সংখ্যা নগণ্য। অনিকেত অবশ্য এখানে আসে নি। আসার ইচ্ছেও ছিল না। এখানে আসার রাস্তায় সুমুর মনাস্টেরিতে নেমে গেছে। লাদাখ বিশ্ববিদ্যালয়ে থিকসের সেই লামার বক্তৃতা শুনে নাকি সুমুর মনাস্টেরি দেখার গভীর কৌতূহল। পরিতোষের মনে হয়েছে নিছক আদিখ্যেতা। ঘন্টা দুয়েক বাদে ফেরার পথে সুমুর মনাস্টেরিতে এসে পরিতোষ দেখল অনিকেত মনাস্টেরির প্রবেশ দ্বারে প্রশস্ত চাতালটায় দাঁড়িয়ে আপেল গাছগুলোর ছবি তুলছে। গুচ্ছ গুচ্ছ আপেল ঝুলছে গাছগুলোয়। অনিকেত বলল এই মনাস্টেরির প্রধান লামা খুব আমায়িক লোক। এই গরমে পাহাড়ে উঠে গরম জলের ফোয়ারা দেখেই পরিতোষ খুশি। খিধেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। মনাস্টেরি আর তার লামাতে তেমন কোনো আগ্রহ নেই।

হোটেলে ফিরে সাড়ে তিনটে নাগাদ আলু পরোটা আর দই খেয়ে দুই বন্ধু একটু ঘুমিয়ে নিল। পরিতোষের ঘুম ভাঙ্গল পাঁচটা নাগাদ। পাহাড়ে ঘেরা এই বিশাল রিসর্টের প্রতিটা ঘরই গ্রাউন্ড ফ্লোরে কটেজ। প্রচুর আপেল, এ্যাপ্রিকট আর এ্যামন্ড মানে বাদাম গাছ। অনিকেত নিজের ঘরে ছিল না। বাগানে একটা বাদাম গাছের নিচে রাখা চেয়ারগুলোর একটায় বসে পড়ন্ত রোদে বিয়র খাচ্ছিল। উল্টোদিকের চেয়ারে গ্লাস হাতে রিসর্ট ম্যানেজার গনজালভেস। সামনের গোল টেবিলটায় দুটো বিয়র বোতল আর কিছু বাদাম রাখা আছে। দুটো চেয়ার খালি। তারই একটায় বসল পরিতোষ। ও মদ খায় না। ওর জন্য আপেলের রস আসার পর অনিকেত নিজের মুঠোফোনে একটা ছবি দেখাল। একটু আগেই গনজালভেস পাঠিয়েছে। চারজন আছে ছবিটায়। পরিতোষ দুজনকে চেনে। শেরিং আর গনজালভেস। বাকি দুজন বেড়াতে এসেছিলেন। স্বামী স্ত্রী। মিস্টার আর মিসেস নেগি। দুজনেই মনে হয় পঞ্চাশের কাছাকাছি। সপ্তাহ তিনেক আগে পনেরোই আগস্টে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। শেরিংও সঙ্গে ছিল।

রাতের খাবার সেরে বাগানটায় হাল্কা ঠাণ্ডায় হাঁটছিল দুই বন্ধু। এত নির্মল বাতাসে শ্বাস নেবার সুযোগ দিল্লিতে কল্পনাও করা যায় না। মুঠো ফোনে একটা স্কুলের গ্রুপে ওয়া মেসেজ দেখে পরিতোষ বলল, এই রে আবার খেপেছে। অনিকেত ঘড়ি দেখে বলল, নটা বেজে গেছে। মন্তব্যটা বটু প্রসঙ্গে। কোভিডের কারণে ব্যবসার অবস্থা খারাপ তাই মানুষটা নৈরাশ্যে ভোগে। রাত নটার পরে প্রায় প্রতিদিনই অর্থহীন প্রলাপ পোস্ট করে স্কুল বন্ধুদের হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে। ভাষাটা শালীনতার সীমায় থাকে না। ছেলেদের স্কুল বলে গ্রুপে কোনো মেয়ে নেই তাই রক্ষে। গ্রুপের সবাই ধরেই নিয়েছে মাতালের প্রলাপ। এক সহপাঠী তো লিখেছিল রাত নটার পর রাম খেয়ে নটরাজ সাজে। পরিতোষ মানতে পারে নি। ওদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘর থেকে এই প্রলাপের গোলাবারি আগেও হয়েছে। পরিতোষ জানে ও মদ খায় নি। পরিতোষের বাবা আইটিসির চাকরি করতেন। সিগরেট ছাড়েননি এখনও তবে ওনার বাড়িতে মদ খাওয়ার অনুমতি নেই। ভাড়াটেদেরও এই শর্ত মানতে হয়। বটু বলেছে, এক সময় তার পাঁচতারা হোটেলের বিলাসবহুল পানশালায় দামি বিদেশি মদ খাওয়ার সখ থাকলেও বর্তমানে সেই আর্থিক সামর্থ্য তার নেই। আজকের পোস্টটা করার পর বটু গ্রুপ ছেড়েছে। এই গ্রুপ ছাড়াটা প্রায়ই ঘটে। গ্রুপ এ্যাডমিনের ডাক নাম জেঠু। দিন তিনেক বাদে জেঠু বটুকে গ্রুপে ফিরিয়ে আনবে সেটা পরিতোষ জানে। গ্রুপে বটু বিতর্কিত হলেও জনপ্রিয়।

পরের দিন সকালে যথাসময় গাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্কো হাজির। গন্তব্য প্যাংগং লেক। গাড়িতে ওঠার সময় বটুর মেসেজ এল। একটা ফরাসি পর্যটন কোম্পানি আসাম আর অরুণাচল নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাবার প্রস্তাব দিয়েছিল বটুর কোম্পানিকে। চুক্তি নিয়ে কোনো গোলমাল বেধেছে। বৌ একা সামলাতে পারছে না। বটু কলকাতা যাচ্ছে। কবে ফিরবে জানে না।

হুন্ডার থেকে শ্যোক নদীর ধারে ধারে প্যাংগং যাবার রাস্তাটা লম্বা হলেও চমৎকার। রাত্রিবাস হ্রদের ধারে পরিচ্ছন্ন আর আরামদায়ক টেন্টে। টেন্টগুলোর দুটো অংশ। বাইরেটা বসবার আর ভেতরটা শোবার। প্রায় চৌদ্দ হাজার ফুট উচ্চতায় এই হ্রদের ধারে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। টেন্টের ভেতরে তাপমাত্রা কিন্তু বেশ আরামপ্রদ। প্রায় সন্ধ্যে আটটা। টেন্টে বসেছিল দুই বন্ধু। পরিতোষের সামনে ছিল চায়ের কাপ আর ফ্লাস্ক, অনিকেতের সামনে দিল্লি থেকে আনা সিঙ্গলমন্টের বোতল আর গ্লাস। বাইরে মাত্র দেড়শ মিটার দূরে চাঁদের মায়াবী আলোয় ঝিকমিক করছে হ্রদের নীলচে কালো জল।

পরের দিন প্রায় আঠেরো হাজার ফুট চ্যাংলা পাস পেরিয়ে আবার এক রাত লেহ্ শহরে। হোটেলে রাতটা কাটিয়ে ওদের দিল্লি ফেরার পালা। ব্যাঙ্কো এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসে জানাল দিল্লি থেকে আসা যে প্লেনটায় ওরা ফিরবে তাতে মিস্টার নেগি আসছেন। গতমাসে সস্ত্রীক এসেছিলেন এবার একা। যাতায়াতের জন্য ব্যাঙ্কোর গাড়িটাই ব্যবহার করবেন।

এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে উবারে অনিকেত বলল, কথাটা শুনলে বটু দুঃখ পাবে। পরিতোষের অনেক অনুনয় সত্ত্বেও এর বেশি কিছু বলল না।

লাদাখ ঘুরে এসে পরিতোষ আর অনিকেত নিজেদের পেশার কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অক্টোবরে ছিল দুর্গাপুজো। তবে কোভিড নিষেধাজ্ঞার কারণে পুজোর কোনো জুলুস নেই। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পরিস্থিতির উন্নতি আর কোভিড বিধি শিথিল হওয়ায় কালীপূজো আর দীপাবলি ভালই কাটল। অবশ্য পরিবেশ দূষণ রুখতে বাজি পোড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল।

বটু তখনও ফেরে নি। ভাইফোঁটার দিন কয়েক পরেই ভাইরাল হল একটা ছোট কিন্তু মজাদার খবর। দিল্লি হাটে লাদাখি খাবারের দোকানে কামোদ্দীপক চা বিক্রি হচ্ছে। লাইন দিয়ে লোকে দেড়শ টাকার এই চা মাটির ভাঁড়ে খাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এই চা পরীক্ষাও করিয়েছে। নিষিদ্ধ কিছু পাওয়া যায় নি।

 পরিতোষের কৌতূহল বেশি। ও তো সামনের রবিবারেই গিয়ে এই চা চেখে দেখতে চাইল। অনিকেত বলল বটু ফিরলে সবাই মিলে যাবে। বটু ফিরল নভেম্বরের শেষে। ফরাসিদের সঙ্গে চুক্তিটা সই হয়েছে। ও খুশি।

ডিসেম্বরের প্রথম রবিবারে দুপুর বেলায় পাঁচজন মিলে দিল্লি হাটে বেড়াতে এসেছিল। তিন বন্ধু তো বটেই, ঝিনুক আর সুধাও ছিল। কোভিড বেশ ঝিমিয়ে পড়েছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচা মানুষেরা শীতের দুপুরে ঘুরতে বেড়িয়েছে। দিল্লি হাটে ভিড় বেশ। এখানে বাঙালি খাবারের দোকান বলতে বিজলি গ্রিল। সেখানে লাঞ্চ করতে আসা মানুষের ভিড়। লুচি, কষা মাংস আর কবিরাজি কাটলেট উদরপূর্তি করে দুপুরের খাওয়াটা বেশ জম্পেশ হল। তারপর একটু কাপড় জামা আর আসবাবপত্রের দোকানগুলোয় ঢুঁ মেরে খামোখা দরাদরি করে লাদাখি খাবারের দোকানে পৌঁছে ওরা অবাক। জনা পঞ্চাশেক সেই কামোদ্দীপক চা খেতে লাইন দিয়েছেন। অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে তো বটেই মাঝবয়সীরাও আছেন। স্বাস্থ্য বিভাগ নিজের কাজ করেছে। দোকানের বাইরে ওদের নোটিস। বলা হয়েছে কামোদ্দীপনা একটা বিজ্ঞাপনী প্রচার মাত্র। বিজ্ঞাপনে প্ররোচিত না হয়ে জনগণ যেন নিজের দায়িত্বে এই চা পান করেন। পরিতোষের মনে হল চা খেয়ে ফল নিশ্চয়ই পাওয়া যাচ্ছে, নইলে এত ভিড় হত না।

শেরিং আর নেগি দুজনেই দোকানে ছিল। শেরিংই নেগির সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দিল। পরিতোষ আর অনিকেত অবশ্য নেগির ফটো আগেই দেখেছে। দোকানের সামনে বসবার চেয়ার খালি নেই। ওরা একটু দূরে নাগাল্যান্ড স্টলের সামনে বসল। শেরিং দু ফ্লাস্ক চা নিজেই এনে দিল। পয়সা নেয় নি।

কত টাকায় তুমি পুঁথিটা কিনেছ শেরিং? বটুর এই প্রশ্নের উত্তরে শেরিংএর জবাব চমকে দেবার মত। বলল লামাটা খুব ভাল। মাত্র পাঁচশ টাকা নিয়েছে। বলল লাদাখ ঘোরার খরচও ওই লামাটাই দিয়েছে।

অনিকেত চুপচাপ শুনে একটাই কথা বলেছিল। লোকটা লামা নয় সাধারণ মংক মাত্র।

বটু রাগ সামলে দাঁতে দাঁত চেপে অতি কষ্টে ভাষা সংযত রেখে বলল, বাহ্ পাঁচশয় কিনে ত্রিশ হাজারে বেচা! এত ডাকাতি। মহিলাদের উপস্থিতিতে বটু বরাবরই মার্জিত। নতুবা এতক্ষণে খিস্তির তুবড়ি ছুটত।

কোনো রকম ভণিতা না করে শেরিং সাফ জানাল কোভিডের কামড়ে কাজ গেছে। পেটের দায়। টাকাটা দরকার ছিল।

বটুকে সান্ত্বনা দিয়ে বা হয়ত ওর কাটা ঘায়ে নুন ছড়িয়ে শেরিং আরও বলেছিল, খাঁটি মাল। সবুর করুণ ভাল দাম পাবেন।

চা খেতে খেতে পরিতোষ আর ঝিনুকের ওপর এই চায়ের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে রসিকতা শুরু করল সুধা। উদ্দেশ্য ছিল বটুর গোমড়া মুখে হাসি ফোটানো। কিন্তু হল না। চায়ের পর আড্ডাও আর জমল না। ঝিনুক মেট্রো নিয়ে আই পি এক্সটেনশনে ফিরে গেল। বাকি চারজন পরিতোষের গাড়িতে চিত্তরঞ্জন পার্ক।

আগেই ঠিক ছিল রাতের খাবার খাবে সবাই এক সঙ্গে অনিকেতের ফ্ল্যাটে। ও চাইনিজ আনাবে।

সাড়ে আটটায় পরিতোষ এলো অনিকেতের ফ্ল্যাটে। বটু খিধে নেই বলে আসতে চায় নি। তবে সুধা জোর করায় বিমর্ষ মুখে এসেছিল।

সবাই বসার পর বটুকে স্বাভাবিক করার জন্য অনিকেত আন্দামান বেড়ানো নিয়ে একটা আলোচনা শুরু করতে চাইছিল। বটু ওই প্রসঙ্গ এড়িয়ে প্রশ্ন করল, বেচে কত পাব বলত?

বলা বাহুল্য ওর মাথায় পুঁথি ঘুরছে।

সবজান্তা মুচকি হাসিটা ঠোঁটের কোনে ফুটিয়ে অনিকেত নির্বিকার মুখে বলল, তা হাজার খানেক পাওয়া তো উচিত।

মানে? বটু এত জোরে কথাটা বলল যেন বোমা ফেটেছে। সুধা বলল ইস! এই ‘ইস’ অবশ্য বটুর ‘মানের’ প্রত্যুত্তর নয়। চমকে উঠে ও একটা মেসেজ ভুল করে অন্য কোথাও করে ফেলেছে।

অনিকেত আরও নির্বিকার ভাবে বলল. একটা নকল পুঁথির দাম এর চেয়ে বেশি কি ই বা হবে?

নকল! এবার শুধু বটু নয়, পরিতোষ আর সুধার ও অবাক হবার পালা।

রেগে আগুন বটু। অশ্রাব্য ভাষার কার্পেট বোমাবাজি হতে পারত। সুধার উপস্থিতিতে অতিকষ্টে নিজেকে সংযত রেখে সে বলল, ধোকাবাজ শেরিংটা শেষে আমাকে এইভাবে মুরগি বানাল!

অনিকেত নিরুত্তাপ। বলল, না। পুঁথিটা যে আসল নয় সেটা শেরিং জানে না।

ভণিতা না করে এবার রহস্যটা খোলসা করলে হয় না? ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেনের অর্ডারটা ভুল করে মিষ্টির দোকানে হোয়াটসআ্যপ করেছিলাম। শুধরে নিয়েছি। মিনিট পনেরোয় ডেলিভারি। সুধা বলল।

তাহলে খোলসা করেই বলি। অনিকেত বলতে শুরু করল।

শেরিং মাঝেমধ্যে থিকসে মনাস্টেরি যেত। সেখানে সিনিয়র লামাদের ফাই ফরমাস খেটে কিছু উপরি আয় নিশ্চয় হত। সেখানেই সিকিমের রুম-টেক মনাস্টেরি থেকে আসা একজন মংকের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। উনি একজন মহাযান বৌদ্ধ শাস্ত্রে পণ্ডিত লামার কাছে শিক্ষা নিতেন। এই লামার সঙ্গে প্রথমে পরিতোষের পরে আমার পরিচয় হয়। পরিতোষের প্রশ্নে উনি একটু রেগে গেলেও আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছিলেন। লাদাখ ইউনিভার্সিটিতে ওনার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনেছি। মংকটা ওনার অনুমতি নিয়েই একটা খুব পুরনো পুঁথির নকল করেছিল, সিকিম থেকে আনা চিনের তৈরি এক বিশেষ কাগজের ওপর। ওনার অনুমতিতেই মংকটা সেই নকল পুঁথি নিজের কাছে রাখে। পুঁথিটা যে আসল নয় তার সার্টিফিকেটও লামাজি ওই মংককে দিয়েছিলেন।

এক ঢোক জল খেয়ে অনিকেত আবার বলতে শুরু করল।

বটুর পুঁথিটার একটা ফটো নিয়েছিলাম। ফটোটা দেখেই লামাজি চিনতে পেরেছিলেন। কোথায় পুঁথিটা দেখেছি প্রশ্ন করায় বলেছিলাম শেরিং বটুকে উপহার দিয়েছে।

ত্রিশ হাজার টাকার ঘোল খাইয়ে উপহার! বটু ফোঁস করে উঠল।

আমল না দিয়ে অনিকেত বলতে থাকল।

লামাজি বলেছিলেন থিকসে মনাস্টেরির বিশাল লাইব্রেরিতে শুধু যে ধর্মীয় পুঁথিই আছে তা কিন্তু নয়। দৈনন্দিন জীবন যাপন বিষয়েও অনেক পুঁথি আছে। সিকিম থেকে আসা মংকটা এরকমই একটা পুঁথি নকল করেছে। তবে লিপিটা খুবই প্রাচীন। এই লিপি লামাজি পড়তে জানেন না। বললেন একমাত্র হয়ত সুমুর মনাস্টেরির প্রধান লামা পড়তে পারেন। তবে উনি অজানা লোকের সঙ্গে কথা বলেন না। তাই একটা ছোট চিঠি লিখে সই করে দিলেন। এই চিঠি নিয়ে আমি সুমুর মনাস্টেরির প্রধান লামার সঙ্গে দেখা করেছিলাম।

সিকিমের মংকটার টাকায় শেরিং ওকে লাদাখের কিছুটা মানে লেহ্ শহরের আশপাশ আর নুবরা উপত্যকা দেখিয়েছিল। বিনিময়ে পাঁচশ টাকায় সে শেরিংকে নকল পুঁথিটা দেয়, লামাজির সার্টিফিকেটের ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গিয়ে। শেরিং সেটা অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল খান্ডেলওয়ালকে বেচার চেষ্টা করে। অসফল হয়ে শেষ অবধি বটুকে ভাল দামে গছায়।

আমি একটা আহাম্মক। বটুর ক্ষুব্ধ স্বীকারোক্তি।

অনিকেত আবার বলতে শুরু করল।

আমার ধারণা পুঁথির লেখাটা যে ধর্ম নয় বরং সাধারণ জীবন যাত্রা সংক্রান্ত সেই ইঙ্গিত মংকটা শেরিংকে দিয়েছিল। বটুকে দেওয়ার আগে পুঁথিটার ফটো শেরিং নিয়ে রেখেছিল। দিল্লি হাটে তিব্বতি খাবারের দোকানে কাজ পেয়ে সে দোকানের মালিক রতন নেগিকে এই সব জানায়। নেগি ব্যবসা বোঝেন। ভাবলেন পুঁথিটায় যদি কোনো অজানা তিব্বতি খাবারের পুরনো রেসিপি থাকে, তবে বিক্রিবাটা রমরমা হবে। আমরা লাদাখ যাবার কিছু দিন আগে উনি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে সস্ত্রীক শেরিংকে নিয়ে লাদাখ এলেন। নুবরাতে আমরা যে রিসর্টে ছিলাম সেখানেই উঠেছিলেন। থিকসে মনাস্টেরির পণ্ডিত লামাজির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ওনার চিঠি নিয়ে উনি সুমুর মনাস্টেরি গিয়ে প্রধান লামার থেকে পুঁথির লেখাটার মানে জেনে আসেন। পরে আমিও জেনে এসেছিলাম।

কি খাবারের কথা তুই জেনে এলি? প্রশ্নটা পরিতোষের।

খাবার তো কিছু ছিল না। অনিকেত জানিয়ে দিল।

শুনে বটু আশ্বস্ত হল। বলল, তাহলে শুধু আমিই নয় জোচ্চোরটা নেগিকেও ঠকিয়েছে।

অনিকেত খুব শান্ত গলায় জবাব দিল। নেগি ঠকে নি। খাবার নয় অন্য কিছু ছিল।

কি সেটা? এবার বলা যায় কি? সুধা জানতে চাইল।

যৌনতা উত্তেজক চা। কিছুক্ষণ আগে আমরা যে চা খেয়ে এলাম সেটা তৈরি ওই পুঁথিতে লেখা রেসিপি মেনেই। উপাদান হল নুবরা আর শ্যোক নদীর ধারে প্রাকৃতিক ভাবে গজিয়ে ওঠা ঝোপঝাড়ের ফুল, পাতা আর শিকর। তার সন্ধানে নেগি পরে একাই লাদাখ এসেছিলেন। দিল্লি থেকে যে ফ্লাইটে উনি লেহ্ আসেন ওতেই আমরা দিল্লি ফিরি।

শুনে বটুর মুখটা কেমন যেন চুপসে যাওয়া বেলুনের মত ম্যাদামারা হয়ে গেল। ত্রিশ হাজারের চা এই তিনটে শব্দ বার তিনেক বিড়বিড় করে সৌজন্য-বোধের তোয়াক্কা না করে সটান ওপরে নিজের ঘরে চলে গেল। খাবার আসার পর অনেক ডাকাডাকিতেও খেতে এল না। সুধা খাবার পৌঁছে দিয়েছিল। বটু অবশ্য ফিরিয়ে দেয় নি। সুধাকে শান্ত গলায় বলেছিল, ত্রিশ হাজার জলে যাওয়া টা বড় ব্যাপার নয়, বেমক্কা বোকা বানাটা সে মেনে নিতে পারছে না।

কিছুক্ষণ পরে ঘুমোবার আগে হোয়াটসএ্যাপে স্কুলের গ্রুপে পরিতোষ পোস্টগুলো পড়ছিল। ফরোয়ার্ড করা পোস্ট বটুর কখনই পছন্দ নয়। একে মেজাজ খারাপ তার ওপর পরপর দুবার ফরোয়ার্ড করা একই পোস্ট। এক সাংবাদিক আর এক আমলা বন্ধু করেছে। বটুর প্রতিক্রিয়া যেন সাইক্লোনের তাণ্ডব। খিস্তির আর বিদ্রূপাত্মক শব্দের ভয়ংকর মিসাইল। প্রতিবাদে সাংবাদিক বন্ধুর গ্রুপ ত্যাগ। তার পরেই বটুরও। দিন-কয়েক বাদে এ্যাডমিন জেঠু যথারীতি দুজনকে জুড়ে দিয়েছিল।

 

লেখক : প্রসূন দত্ত

দিল্লি, মার্চ ২০২২

prasun.kr.dutta@gmail.com



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy