এখন অনেক রাত
এখন অনেক রাত


এখন অনেক রাত। ঘর অন্ধকার, কোথাও কোনো টু শব্দটি নেই, একটু শীত শীত পড়ছে বলে পাখাও চলছে না। তার উপর সারাদিন বেশ ভালোই পরিশ্রম হয়েছে, এমন অবস্থায় কতক্ষণ আর না ঘুমিয়ে থাকা যায় বলুন তো! কিন্তু আজ তো ঘুমালে চলবে না কিছুতেই। চোখটা মাঝে মাঝেই ঘুমে বুজে আসছে। পরক্ষণেই আবার বড় বড় চোখ করে চেয়ে তাকাচ্ছি। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলে সময় দেখলাম, ১২টা ৩৭ বাজে সবে। আরো মিনিট পঁচিশেক বাদে অপারেশন শুরু করতে হবে। এক ঘন্টার বেশি হয়ে গেল এরকম জেগে শুয়ে আছি, মোটেই সহজসাধ্য কাজ নয় মশাই। বউ পাশে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আশা করি টের পায়নি। আর আধ ঘন্টা কেটে যাক, সব কিছু সেরে এসে ঘুমাব একেবারে। মা মারা যাবার পর থেকে বাবা রাতে খেয়ে দেয়ে ওই দশটা, সাড়ে দশটা নাগাদই শুয়ে পড়ে। বউ আর আমি একটু টিভি দেখে ওই সাড়ে এগারোটা নাগাদ শুই রোজ। বাকি রইল ছেলে! সে রাত একটা অবধি কিসব ছাইপাশ করে কে জানে! একটা অবধি ওর ঘরের আলো জ্বলে। পাশের ঘরেই থাকে, তো বারান্দার দেওয়ালে ওর ঘরের আলোটা এসে পড়ে। শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছি আলোটা কখন নিভবে ওর ঘরের! ও একবার ঘুমিয়ে পড়লে নিশ্চিন্ত! নিশ্চিন্তে আমার স্পেশাল অপারেশনটা করা যাবে। কেউ টেরও পাবে না।
মশারির ভেতর মশাটা কি করে ঢুকল কে জানে! কানের সামনে গুনগুন করেই যাচ্ছে। বুঝি না বাপু, শরীরের এত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকা সত্বেও ওরা কানের সামনে এসেই ওড়ে কেন! এলোপাথাড়ি এক দুবার হাত চালালাম বটে, কিন্তু নিজের গালে নিজে থাপ্পড় খাওয়া ছাড়া আর কিছু লাভ হলো না। ঘরের ভেতর ঘড়িটা নির্দিষ্ট ছন্দে টিক টিক শব্দ করে যাচ্ছে। একটা টিকটিকি সেই ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে টিকটিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে মাঝেমধ্যে। গোটা পৃথিবী যখন নিস্তব্ধ, তখন কিছু এরকম শব্দ মস্তিষ্কের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে মস্তিস্কর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালায়। পশ্চিম দিকের হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যাওয়া দূরপাল্লার বাসের সাথে শব্দের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা করছে পূর্ব দিক দিয়ে চলতে থাকে একটা মালগাড়ি। কোনো অজানা কারণে রাস্তার কুকুরগুলোও ডেকে উঠেছে এক দুবার। আমি জেগে আছি, আর কিছুক্ষণ! তারপরেই ছেলে ঘুমিয়ে পড়বে।
হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম, উফফ! এত চেষ্টা করলাম না ঘুমিয়ে জেগে থাকার। সেই ঘুমিয়ে পড়লাম কি করে! যাঃ! নির্ঘাত ভোর হয়ে গেছে। বাবা তো সাড়ে ছটা নাগাদ উঠেই পড়ে। ধুর! আজ আর অপারেশন হলো না। বেশ হতাশ হয়ে পড়েই মোবাইলের দিকে তাকালাম! মনের ভিতর কে যেন গেয়ে উঠল ‘ধিনাক নাতিন তাক ধিনা ধিন’। ঘড়িতে ২টো ২৬ বাজে। ভোর হয়নি। সবাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাজটা চটপট সেরে ফেলি। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম ভাগ্যিস ঠিক সময়ে ঘুমটা ভেঙে গেছে!
ফিসফিসিয়ে বলি তবে কাজটা কি! একদম পাঁচকান করবেন না কিন্তু। আমার বউ বলে বলছি না, এমনিতেই কিন্তু ও পাটিসাপটা পিঠেটা খুব সুন্দর বানায়। খুব সুন্দর মানে সত্যিই খুব সুন্দর। গ্রামের মেলা থেকে পাঁচতারা রেস্তোরাঁ, সব জায়গায়ই পাটিসাপটা আমি খেয়েছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার বউয়ের বানানো পাটিসাপটা সবাইকে বলে বলে দশ গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আজ রাতে বউ পাটিসাপটা বানিয়ে রেখেছে। কাল সকালে ভাগ হবে। আজ কত করে চাইলাম, বললাম “একটু রাতে টেস্ট করি, ছেলে, বাবা, কেউ জানতে পারবে না যে আমি টেস্ট করেছি”। কিন্তু কিছুতেই দিল না। সোজা ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিল। অগত্যা, রাতের বেলা ফ্রিজ খুলে চুরি করেই খেতে হবে। আমার কিছু দোষ আছে এতে, বলুন তো! আমি কি করব? তো যাই হোক, বেশি খাব না, ওই খান ছয়েক মত খাব। তারপর এসে আবার বিন্দাস করে ঘুমাব। অপারেশন পাটিসাপটা শুরু করলাম নমো নমো করে।
অতি সন্তর্পণে মশাড়িটা তুলে বেরোলাম। একটু অসাবধান হলেই মুশকিল! কোনোভাবে বউ যদি টের পেয়ে যায় তাহলেই আমি আর আস্ত থাকব না। যতটা সম্ভব কম শব্দ করে মশারি থেকে বের হয়ে আবার মশারিটা গুঁজে দিলাম। দরজাটা খোলার সময়ও ক্যাঁচ করে আওয়াজ হয়। সেটাও যতটা সম্ভব আস্তে আওয়াজ করে খুলে আস্তে করে ভেজিয়ে রাখলাম আবার দরজাটা। আপাতত আর কিছুতে শব্দ হওয়ার কথা নয়, তবুও সাবধানের মার নেই। যা করার পা টিপে টিপে করাই ভালো।
দরজাটা খুলে বেরিয়ে কয়েক পা এগোতেই পায়ে কি একটা লাগল! কি লাগল সেটা আন্দাজ করার আগেই দুম করে একটা সশব্দে আওয়াজ! সেরেছে! কত সতর্কতা অবলম্বন করলাম! সেই শব্দ হলোই! নিশ্চয়ই বউয়ের ঘুম ভেঙে যাবে। বুকের ভিতরটা ছ্যাত করে উঠল! সর্বনাশ! এতো তীরে এসে তরী ডোবার অবস্থা! বিকেলে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে ছাদের ঝুল পরিষ্কার করে চেয়ারটা এখানেই রেখে দিয়েছিলাম। পায়ে ব্যাথা লেগেছে বটে, কিন্তু সে ব্যাথা এখন তুচ্ছ মনে হচ্ছে পাটিসাপটা না পাওয়ার আশঙ্কার কাছে। চেয়ারটা তুলে রেখে দরজাটা সন্তর্পণে খুললাম। বউ পাশ ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। হৃদপিণ্ডের ঢিপ ঢিপ শব্দ নিমে
ষে বদলে গিয়ে তাথৈ তাথৈ ছন্দে নৃত্য শুরু করল।
ডাইনিং রুমে ঢুকব, একটু দূর থেকেই দেখতে পেলাম ঘরের ভিতর থেকে একটা আলো আসছে। থেমে গেলাম। এ তো নাইট ল্যাম্পের আলো নয়, কেউ কি তবে ঘরে আছে! কান খাড়া করে শুনলাম খুটখাট শব্দও আসছে একটু আধটু। কে হতে পারে? ছেলে? নাকি চোর? যদি চোর হয় এভাবে খালি হাতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। মনস্থির করলাম একবার ছেলের ঘরে উঁকি মেরে দেখে আসি ছেলে ঘুমাচ্ছে তো!
পেছন ফিরে ছেলের ঘরের দিকে পা বাড়াব! ও মাগো! অন্ধকারের মধ্যে সাক্ষাৎ ছায়ামূর্তি। আমার গলার মধ্য দিয়ে একটা অদ্ভুত স্বরে শব্দ বেরিয়ে এল “ওই, কে তুই?”। কি বিকট সেই স্বর! নিজের গলার স্বর বলে মনেই হয় না। সেই স্বরের উৎপত্তিস্থল ল্যারিংস তো নয়ই, বরং ডিওডিনাম কিংবা ইলিয়ামের হবার সম্ভাবনাই বেশি। আমার সামনের ছায়ামূর্তিটিও এক ভয়ংকর গলায় চেঁচিয়ে উঠল “ওই” বলে। কিছুটা ধাতস্থ হবার পর বুঝলাম, ও হরি, সামনের ছায়ামূর্তি তো স্বয়ং আমার ছেলে। ফিসফিসিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম
- কিরে, তুই এখানে?
ছেলে ইতস্তত করে জবাব দিল
- বাথরুমে যাব বলে..
- বাথরুম তো ওই দিকে! এদিকে কি তোর! ওই, ঢপ দিস না।
- না বাবা, মানে একটু খিদে খিদেও পাচ্ছিল। অগত্যা..
- অগত্যা?
- না, ভাবলাম মায়ের তৈরি পিঠেটা একটু খেয়ে যাই তবে। প্রমিস বাবা, দুটো খাব। তার বেশি নয়।
মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বললাম ছেলেকে
- শোন, আমিও পিঠে খেতেই উঠেছি। কিন্তু একটা খটকা লাগছে, বুঝেছিস! তুই এখানে, তোর মা ঘুমাচ্ছে, তবে ডাইনিং রুমে কে?
- মানে?
ফিসফিসিয়ে ছেলেকে বললাম ডাইনিং রুমে কিছু অযাচিত আলো এবং শব্দর উপস্থিতি টের পাওয়ার ঘটনাটা। চোর আসার সম্ভাবনা আন্দাজ করে ছেলেকে ওর ক্রিকেট ব্যাটটা আনতে বললাম। খালি হাতে যাওয়ার চেয়ে হাতে কিছু একটা তো থাকুক। সেই আলোটা এখনো আসছে ঘরের ভিতর থেকে, খুটখাট শব্দটাও! সাহস করে আমিই আগে ঢুকলাম ঘরে।
ডাইনিং রুমে দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে আলো জ্বালানোর সুইচ। ঘরে ঢুকেই আলোটা জ্বালালাম। কান্ড দেখেছেন! আমার বাবা। হ্যাঁ, আমার বাবা চুপচাপ ফ্রিজ খুলে পাটিসাপটা সাটাচ্ছে। ফ্রিজের ভেতরের আলোটা বাইরে আসার দরুণ ওরম একটা অদ্ভুত আলো তৈরি হয়েছিল। আমার আর ছেলের আগমনে খানিক অপ্রস্তুত হয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাতে একটা পাটিসাপটা নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ভর্তি পাটিসাপটা নিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করল
- কিরে, পাটিসাপটা খাবি?
- বাবা, তোমার না সুগার?
- বৌমা, এত ভালো বানায় আসলে।
- তাই বলে এত রাতে তুমি…
- হে হে! তা তোরাও নিশ্চয়ই পাটিসাপটা খেতে।
খানিকটা ইতস্তত করে বললাম
- না, মানে ইয়ে মানে হ্যাঁ।
- খেয়ে নে, আমিও বলবো না যে তুই খেয়েছিস কিংবা নাতি খেয়েছে। তুইও বলবি না। আর এই যে বল্টু সোনা, তুইও কিন্তু বলিস না তোর বাবা আর দাদু খেয়েছে বলে।
তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। পাটিসাপটার প্রথম কামড়টা বসাতেই মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এল। ঠিকমত ঘুম না আসা, চেয়ারের সাথে ঠোকা লেগে পায়ে ব্যাথা পাওয়া, ছায়ামূর্তি দেখে অকারণ আতঙ্কিত হওয়া সব কিছু ভুলে গিয়ে মুখের ভিতর দিয়ে যেন অমৃত প্রবেশ করছে। অপূর্ব, অতুলনীয় এই জাতীয় কোনো বিশেষণই এই পাটিসাপটার স্বাদের বর্ণনার জন্য যথেষ্ট নয়।
এবার ঘুমটা ঠিকঠাক হবে। মনে হচ্ছে যেন স্বর্গ থেকে ঘুরে এলাম। আবারও অতি সন্তর্পণে ঘরে ঢুকে শুলাম। বউ ঘুমাচ্ছে। ভালোই ঘুম পাচ্ছে, পাশ ফিরে শুলাম। হঠাৎই পাশ থেকে বউ জিজ্ঞেস করল
- কিগো, কেমন খেলে পাটিসাপটা?
জিভ কাটলাম। এত কিছুর পরও বউ জানল কি করে? এক দুবার ঢোক গিললাম। বউ হেসে বলল
- আহা, আমি জানি তুমি পাটিসাপটা খেতেই গেছিলে। বল কেমন খেলে?
হেসে বউয়ের হাতটা ধরে বললাম
- তোমার হাতে জাদু আছে গো।
একটু অপরাধবোধও কাজ করছে। বুঝিনি তো বউ বুঝে যাবে, বুঝলে তো দুটো নিয়ে আসতাম বউয়ের জন্য। একটু আমতা আমতা করেই জিজ্ঞেস করলাম
- তুমি খাবে? দুটো নিয়ে আসি তোমার জন্য।
বউ ফিক করে হেসে উত্তর দিল
- আমাকে বোকা ভাব নাকি? আমি হাউসকোটের পকেটে পাঁচটা মত নিয়েই শুতে এসেছিলাম। ওগুলো অলরেডি পেটের ভিতর এখন জড়াজড়ি করে বসে আছে।