Sourya Chatterjee

Classics Inspirational Others

4.5  

Sourya Chatterjee

Classics Inspirational Others

লাল সুতো

লাল সুতো

7 mins
438


পাহাড়ী এলাকায় যেমন ঝুপ করে দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যে নামে , ঠিক তেমন এই অঞ্চলটাতে দাঁড়ালে মনে হয় ঝুপ করে যেন শহরটা শেষ হয়ে গ্রাম শুরু হল। ওই যে পুকুরটা রয়েছে, তার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে, সেটা দিয়ে মিনিট দেড়েক হাঁটলেই ডানদিকে একটা একতলা বাড়ি পড়বে। ওটা রূপালীদের বাড়ি। রূপালী এখন ছোট্ট মেয়ে, স্কুলে পড়াশুনা করে ক্লাস থ্রিতে, বয়স ওই দশ কিংবা এগারো হবে। 


সেদিন রূপালী স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে বাড়িতে সে কি হুলস্থূল কান্ড। বাড়ির উঠোনে একটা পাতকুয়া আছে, ঠাকুমা সেই পাতকুয়ার আশপাশের শ্যাওলাতে পা পিছলে ধপাস! কোমরে ব্যাথা লেগেছে, এখন সেবা শুশ্রূষা চলছে। বয়স হয়েছে, ধীরে সুস্থে চলতে ফিরতে পারে তো। না, কথা শুনবে না, এখন ফল ভুগছে। যাই হোক, ঠাকুমা পা পিছলে পড়ে গেছে বলে কথা, রূপালীর জেঠু হুকুম করল কালকেই পাতকুয়ার আশপাশের সব শ্যাওলা পরিষ্কার করতে হবে। কথা মত কাজও শুরু। রূপালীর বাবা আর কাকা মিলে পরদিন সকালেই শ্যাওলা পরিষ্কার করতে লাগল। রূপালী দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে সে শ্যাওলা উচ্ছেদ পর্ব। স্কুল থেকে জঙ্গল সাফাই অভিযান যেমন হয় ঠিক যেন অনেকটা সেরকম। খুব যত্নসহকারে কিন্তু গল্পগুজবে মত্ত হয়ে বাবা আর কাকা কি সুন্দর জায়গাটা পরিষ্কার করছে। নিজের বেখেয়ালেই রূপালীর মুখের কোণে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে উঠেছে। রূপালীর মা চেঁচিয়ে বলল “ওই অশ্বথ্থ গাছের যে ডালটা দেওয়াল থেকে বেরিয়েছে ওটা উপড়ে ফেলো তো। না হলে দুদিনে দেওয়াল ফাটিয়ে দেবে”। “চিন্তা করবেন না মেজবৌদি”, পিয়ালীর কাকার আনন্দ-সুধায় টইটম্বুর এক জবাব এল। 


সেদিন রূপালীদের বিদ্যালয়ে শিখিয়েছে এরম দেওয়ালের ফাটল থেকে গাছ বের হলে কি করে তাকে রোপন করে সেই গাছের যত্ন নিতে হয়। বাঃ! এতো একদম হাতে কলমে শেখা যাবে তবে। এরকম সুযোগ আর ক’জন ছাত্রীই বা পেয়েছে! রূপালী চেঁচিয়ে বলল


-   বাবা, তোমরা যখন ওই ডালটাকে উপড়াবে তখন আমাকে বোলো তো। 

শ্যাওলা পরিষ্কার করতে করতেই বাবা উত্তর দিল 

-   কেন রে, কি করবি?

-   ওটা দিয়ে বড় গাছ তৈরি করব। দিদিমণি আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে গাছ বড় করতে হয়।


-   বোঝো কান্ড। মা, পাগলামি করিস না। 


-   আমি সত্যি বলছি, আমি জানি। আমাদের স্কুলে শিখিয়েছে একটা বড় গাছ হবে। আর গাছ রোপন করা, গাছ বড় করা, গাছের যত্নআত্তি করা, এসব খুব ভালো বাবা। আমার কিন্তু চাই-ই।


বেশ রেগেমেগে জবাব দিল রূপালী। রূপালীর বাড়িতে সবাই জানে মোটামুটি রূপালীর জেদ কিরকম। প্রচন্ড জেদী মেয়ে রূপালী। ওর মাথায় কিছু একটা এলে ও সেটাকে করে তবেই ছাড়বে। কিন্তু তাই বলে অশ্বথ্থ গাছের যত্ন নেবে বাড়িতে বসে, এমন আবদারও মেনে নেওয়া যায় না। ভুরু নিচিয়ে রূপালীর কাকার দিকে তাকিয়ে রূপালীর বাবা জিজ্ঞেস করল “কি করা যায় রে!” কাকা মিষ্টি হেসে বলল


-   রূপ মা, শোন্। কাল আমি একটা চারা গাছ কিনে আনব বাজার থেকে। ওটাকে যত্ন নিস। কেমন?


জেদী মেয়ের মাথায় জেদ যেন আরো চেপে বসল খানিকটা। সে ওই গাছটাকেই যত্ন করবে। কার সাধ্য আছে রূপালীকে বোঝায় যে এই গাছ আগামী এক দেড় বছরের মধ্যে বিশাল আকার ধারণ করবে, এরকমভাবে হয় না। কিন্তু কে শোনে কার কথা, সে একরত্তি মেয়ে কেঁদে কেটে চোখ লাল করে মুখ ফুলিয়ে একাকার অবস্থা করেছে তখন। 

না,পেরে উঠতে পারল না বাড়ির কেউ। বাচ্ছা মেয়ে, না বুঝতে পেরে চাইছে যখন তাকে সেই অশ্বথ্থ গাছ দেওয়া হল। অবশ্য বাড়ির সবার এইটুকু বিশ্বাস আছে যে রূপালী এখন জেদের বশে বলছে বটে, কিন্তু দু তিন দিন যেতে না যেতেই সেই জেদ আর থাকবে না। আর তাছাড়া ওরম দেওয়াল থেকে একটা উপড়ে ফেলা গাছ আদৌ যে বাঁচবে কি বাঁচবে না তার কি কোনো ঠিক আছে নাকি! দুদিন পর যে জিনিসের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এমন জিনিস নিয়ে জেদ করছে রূপালী। অবশ্য রূপালীর মায়ের একটা চিন্তা হচ্ছে বটে, যে গাছকে নিয়ে মেয়ে এত জেদ করছে সেই গাছ মরে গেলে মেয়ের কষ্ট লাঘব করবে কি করে!


জেদ, বিশ্বাস আর চিন্তারা রইল যে যার নিজের মত। রূপালী পরম স্নেহে সেই অশ্বথ্থ গাছকে নিয়ে এল নিজের কাছে। কি যেন বলেছিলেন দিদিমণি! ও, হ্যাঁ, টব বা মাটিতে রোপন করার আগের সময়টুকু জলে চুবিয়ে রাখতে হবে। একটা গামলা জোগাড় করে তাতে জল ভরে সেই অশ্বথ্থ গাছকে চুবিয়ে রাখল রূপালী। তিন-চার দিনের মধ্যে টবের জোগাড়ও করে ফেলল ও। যত্ন করে এবার সেই টবে স্থান দিল তার প্রিয় গাছটাকে। বাড়ির সবাই যতই অপেক্ষায় থাকুক, এই বুঝি রূপালীর মাথা থেকে গাছের যত্ন নেবার ভূত নামল কিংবা গাছটা বোধহয় এই মারা গেল, কিন্তু কোথায় কি, সে যে রূপালীর যত্নে তরতরিয়ে বড় হচ্ছে তো। রূপালীর মুখের হাসিতে সাফল্য প্রতিফলিত হচ্ছে তার সাথে। রোজ সকালে ঘুম ভেঙেই ছুট্টে গাছটার কাছে যায় রূপালী। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে গাছটার দিকে। তারপর গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় সস্নেহে, যেন কোনো মা তার সন্তানের মাথায় হাত বোলাচ্ছে। গাছের ডাল পাতাগুলোকে নিজের বুকে যত্ন করে ধরে চোখ বন্ধ করে পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন গোগ্রাসে পান করে তখন রূপালী।

দিন কাটে, সন্ধ্যে নামার আগে আবারও গাছটার কাছে ছুটে যায় রূপালী। এবার যে সেই গাছকে ঘুম পাড়ানোর পালা। গাছের ডাল পাতায় আবারও হাত বোলায় রূপালী। ও বুঝতে পারে গাছটা ওর আদর খেতে খেতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

একবছর পেরিয়ে যায়। গাছটা বেশ বড় হয়েছে এখন। টব ফাটিয়ে গাছের শিকড় বের হতে চাইছে যে। রূপালীর কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে। কি করা যায়? যে দিদিমণি এইভাবে গাছের যত্নআত্তির কথা বলেছিলেন তার কাছে ছুটে গেল রূপালী। রূপালীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিদিমণি বললেন

-   গাছকে তো এবার কোনো জমিতে রোপন করতে হবে। তুমি তো ওই গাছকে সন্তানরূপে স্নেহ করেছ, তোমার কষ্ট হবে বুঝতে পারছি, কিন্তু গাছটিকে কোনো জমিতে না রোপন করলে তো সেই গাছ আর বড় হতে পারবে না। তুমি কি চাও সেটা, বল?

খুব মুশকিলে পড়ল রূপালী। ওই গাছকে ও কাছ ছাড়া করবে কি করে। আবার বাড়ির আশেপাশে তো কোনো ফাঁকা জমিও নেই। মুখ কাঁচুমাচু করে রূপালী জিজ্ঞেস করল

-   আমার কি করা উচিত দিদিমণি? 

-   দ্যাখো রূপালী, আমার তো মনে হয় পাড়ার মোড়ের মাথায় তুমি গাছটিকে রোপন কর। ওখানে আরো অশ্বথ্থ গাছ আছে, তাই বলছি, ওখানে নিঃসন্দেহে গাছটির বৃদ্ধি ভালো হবে।

হাপুস নয়নে কেঁদে ফেলল রূপালী। সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে বটে, কিন্তু হয়তো রূপালীর মনের ভিতর কি চলছে সেটা ঠিক বুঝজে না কেউই। দিদিমণির কথা অনুযায়ী গাছটিকে পাড়ার মোড়ে রোপণ করল রূপালী। আরো কিছু অশ্বথ্থ গাছের মাঝে রূপালীর অশ্বথ্থ গাছটাকে আরো ভালো লাগছে, আরো প্রাণখোলা লাগছে। রূপালী বুঝজে বটে, কিন্তু ওর কান্না থামছে না। কোনো কিছুতেই মন বসছে না তার। বারবার ছুটে ছুটে গিয়ে সে গাছটাকে দেখে আসে।

দিন এগোয়, আস্তে আস্তে শান্ত হয় রূপালী। এখন শুধু স্কুলে যাবার সময় আর স্কুল থেকে ফেরার সময় সেই গাছকে দেখে রূপালী। সেই গাছ তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে দিব্যি আছে। 

যতই টান থাকুক না কেন, অশ্বথ্থ গাছ আর রূপালী যেন ক্রমশ দূরে সরতে থাকে। রূপালীর বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় অন্য শহরে। আবারও হাপুস নয়নে কান্না আসে রূপালীর। কিছু করার থাকে না, আরো দূরে চলে যায় রূপালী। যতই বাবা, মা কথা দিক না কেন মাসে দুবার রূপালীকে নিয়ে আসবে, কিন্তু কথা যে কেউ রাখতে পারবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। খুব ছোটবেলায় রূপালীর হাতে একটা লাল সুতো পরিয়ে দিয়েছিল ওর ঠাকুমা। বলেছিল “এই সুতোটা কাছ-ছাড়া করবি না একদম। তোর মঙ্গল হবে। বিপদ হবে না”। সেই সুতো চলে যাবার দিন রূপালী তার অশ্বথ্থ গাছকে বেঁধে দিয়ে গেছে। কোনো ঝড় ঝাপটা যেন তার প্রিয় গাছের কাছে আসতে না পারে।

পেরিয়ে গেল অর্ধশতক। এখনো অবসরে সেই গাছটার কথা মনে হয় রূপালীর, চোখের কোণে জল আসে। একটা ডায়রীতে সেই গাছটা নিয়ে কত কবিতা জমতে থাকে। কেউ হিসেব রাখে না। এখন রূপালীর ভরা সংসার। নিজের স্বামী, ছেলে, ছেলের বউকে নিয়ে বেশ সুখে জীবন কাটছে। তবে নিজের শহর থেকে অনেক দূরের একটা শহরে আজকাল থাকে রূপালী। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে একবারও নিজের শহরে আসেনি রূপালী। বাবার কর্মক্ষেত্র, স্বামীর কর্মক্ষেত্র সবই বহুদূরের সেই শহরে। মাঝে দু একবার কথা উঠলেও নিজের শহরে ফেরা হয়নি আর রূপালীর।

আজ এত যুগ পর নিজের স্বামী, ছেলে, ছেলের বউকে নিয়ে নিজের শহরে বেড়াতে এসেছে রূপালী। বদলে গেছে সেই শহরটা। বদলে গেছে সব কিছু। গাড়িটাকে সেই অশ্বথ্থ গাছের মোড়টার মাথায় থামতে বলল রূপালী। একটু উত্তেজনা তো থাকবেই, নিজের পুরোনো বাড়ি দেখবে, সেই অশ্বথ্থ গাছটাকে দেখবে। বাড়িতে ঢুকবার আগেই একবার সেই অশ্বথ্থ গাছটাকে দেখবে বলে মনস্থির করল রূপালী। 

একি! বেশ ভিড় তো ওখানটায়। লাইন করে বেশ কিছু মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাছে এগলো রূপালী তার ছেলে, ছেলের বউকে নিয়ে। এটা তো সেই অশ্বথ্থ গাছটাই। কত বড় হয়ে গেছে। গাছ জুড়ে বাঁধা রয়েছে হাজার লাল সুতো। মহিলারা সেই অশ্বথ্থ গাছের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে লাল সুতো বাঁধছে। 

একজন লোক, একটু গরিব-ই মনে হল, প্যাকেট করে কিসব বিক্রি করছে। প্রতি প্যাকেটে সিঁদুর রয়েছে, নকুলদানা রয়েছে, ফুল রয়েছে আর রয়েছে একটা লাল সুতো। গরিব লোকটি একটু হেসে রূপালী কে বলল

-   আন্টি, একটা প্যাকেট কিনুন না! একান্ন টাকা দাম। লাল সুতোটা গাছে বেঁধে দিন। স্বামীর মঙ্গল হবে, পরিবারের মঙ্গল হবে।

রুপালী একটা প্যাকেট কিনে ছেলের বউয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল “যাও মা, বেঁধে এস”। লোকটা আরেকটা প্যাকেট এনে বলল “আন্টি, আপনিও বাঁধুন না। মঙ্গল হবে।”

রূপালী হেসে “না” বলল বটে, কিন্তু মনে মনে বলল “প্রথম সুতোটা তো আমিই বেঁধেছিলাম”। হাসল রূপালী নিজের মনেই। অশ্বথ্থ গাছ থেকে একটা পাতা ঝরে পড়ল রূপালীর গায়ে। পরম স্নেহে পাতাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল ও। না বলা কথাদের ভিড়ে কত অনুভূতি তখন বিরাজ করছে রূপালীর মনে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics