শপিং
শপিং
সকালে যখন ঘুমটা ভাঙল তখন প্রায় দশটা হবে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম, আমায় তো সাড়ে আটটার মধ্যে অফিস বেরোতে হয়। এবাবা! এবার কি হবে? অ্যালার্মটাও বাজল না। কি মুশকিল বলুন তো! মোবাইলের অ্যালার্মটাও কবে যে এরকম বিশ্বাসঘাতক হলো কে জানে? তাছাড়া মোবাইলের অ্যালার্মের দোষ দিয়ে কি হবে? আমার গিন্নি! কই! সেও তো ডাকল না। এই পৃথিবীতে কেউ কারোর জন্য নয়। ঘোর কলিযুগে বাস করি।
তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে মশারির দড়ির একটা কোণা খুলেছি সবে, মোবাইলের দিকে চোখ গেল। মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে লেখা আছে “Saturday, Nov 27”। উফফ! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। আজ শনিবার, স্বাভাবিক কারণেই অ্যালার্মটা বাজেনি। সরি অ্যালার্ম, ভুলবশত কিছু গালি দিয়ে ফেলেছি। কিছু মনে কোরো না। কেমন? না, ইয়ে মানে গিন্নিকেও তো মনে মনে গালি দিয়েছি। সরি গিন্নি, আমারই ভুল।
অবশ্য একটা খটকা লাগল, বুঝলেন। যতই শনিবার হোক গিন্নি তো ন’টায় ঘুম থেকে টেনে তুলিয়ে বাজারের থলি হাতে ধরিয়ে ঠেলে বাজার করতে পাঠিয়ে দেয়। আজ কি হলো কে জানে! আজ একবারও ডাকলো না। খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলাম একেবারে। আসলে আমার গিন্নি মানুষটা ভালোই। বুঝলেন কিনা!
কান্ড দেখেছেন! গিন্নির কথা হচ্ছিল, আর ঘরে গিন্নি এসে হাজির। একটু বোকা বোকা হাসি হেসে বললাম
- হে হে! একটু দেরি হয়ে গেল উঠতে আজ
মশারির অন্য দড়িগুলো খুলতে খুলতে গিন্নি জবাব দিল
- তাতে কি আছে? সারা সপ্তা এত পরিশ্রম যায়। আজ না হয় একটু এক্সট্রা ঘুমালে।
মনে মনে গিন্নির এই আচরণে খুশি হচ্ছি বটে, কিন্তু খটকাও লাগছে। হঠাৎ কি এমন হলো বলুন তো! এরম বদলে গেল কি করে গিন্নি এক রাতের মধ্যে। ইতিমধ্যে মশারি খুলে বিছানা গোছানোও হয়ে গেল গিন্নির। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল
- কিগো! কিছু ভাবছ?
- কই? না তো।
- যাও, হাতমুখটা ধুয়ে এস। আমি টেবিলে চা আর ব্রেকফাস্ট সাজাচ্ছি।
আবারও একবার বোকা বোকা হাসি হেসে হাতমুখ ধুতে গেলাম। উপরওয়ালার কৃপা নিশ্চয় আমার আর আমার গিন্নির উপর বর্ষিত হচ্ছে।
ব্রেকফাস্টে সবে লুচিতে প্রথম কামড়টা বসিয়েছি, গিন্নি হেসে বলল
- একটা নাগাদ লাঞ্চ সেরে বেরোবে তো তবে?
জিহ্বার উপর দিয়ে মুখের ভিতরে লুচি তখন সবে খাদ্যনালীতে প্রবেশ করতে যাবে, স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পরই সে ট্রেন যেমন ঘটাং করে মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে, জিহ্বার উপর আলুরদমের আলু সহযোগে লুচিটাও ঠিক তেমন করেই দাঁড়িয়ে পড়ল। কোথায় বেরোব আবার একটায়? মুখে লুচি নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম
- কোথায়?
- শপিং এ।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন।
- ও, বাজার করতে? লিস্টটা দাও,করে আনছি।
- আরে বাজার নয়, বাজার নয়। শপিং।
- হ্যাঁ, তো একই তো হল। নাকি?
- আজ্ঞে না। সব তো দেখছি ভুলে মেরে দিয়েছ, কাল রাতে যে বললাম আমার একটা লাল সাদা শাড়ি পছন্দ হয়েছে। তুমি বললে কিনে দেবে। আজই নাকি শপিং যাবে। কি ভুলো মন গো তোমার!
আকাশ থেকে পড়লাম! কিছুই মনে নেই। অবশ্য আমার সকালে উঠে সোমবার না শনিবার তা মনে থাকে না, আর মাঝরাতে ঘুম চোখে কি বলেছি তা মনে থাকবে কি করে! হিসাবটা পরিষ্কার মিলে গেল! সকালে ঘুম থেকে ওঠানোর তাড়া নেই, বাজারের থলি নিয়ে বাজারে পাঠানোর তাড়া নেই, আবার ব্রেকফাস্টে লুচি! তাই তো ভাবি ব্যাপারটা কি! আর কি, কিচ্ছু করার নেই এখন। গুচ্ছের টাকা খসবে, তার থেকেও বড় কথা পুরো দিনটা চলে যাবে। খেয়াল পড়ল লুচিটা এখনো খাদ্যনালিতে প্রবেশ করেনি। কর্ণকুহরে গিন্নির মধুর কন্ঠস্বর প্রবেশ করল
- কিগো! লুচিটা খাচ্ছ না কেন? খারাপ হয়েছে?
- না, না। কই! দারুন হয়েছে তো।
হেসে বললাম বটে, কিন্তু বুঝতে তো পারছিই বলি দেবার আগে খাওয়াদাওয়া একটু ভালোই পাওয়া যায়। শুধু শাড়ি তো কিনবে না, এটা সেটা, হেনা ত্যানা অনেক কিছুই জুটবে তার সাথে। আবার শুধু কেনাকাটা হলেও চলবে না, তার সাথে ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়াটাও নিশ্চিতভাবেই লাগবে। কপালে যা আছে দেখা যাবে। বেশি ভাবলে পাগল হয়ে যাব!
পৌছালাম শেষমেষ শপিং করতে। আমার তেমন উৎসাহ নেই। চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি এদিক ওদিক। শাড়ির দোকানে মহিলাদেরই ভিড় বেশী, পুরুষ আছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগ পুরুষেরই শাড়ির থেকে ঘড়ির দিকে নজরই বেশি। হ্যাঁ, মানে সেই দুপুর একটায় বেরিয়েছি, কখন যে দেখতে দেখতে সাড়ে চারটে বেজে গেল সেটাই ভাবছি। এই সবে তিন নাম্বার দোকান চলছে। এখনো পর্যন্ত একটা শাড়িও পছন্দ করে উঠতে পারেননি গিন্নি। মিল্ক হোয়াইট, ডিপ শেডস অফ ভারমেলিয়ান রেড ইত্যাদি চাহিদা। আমার কাজটা কিরকম বলুন তো! দোকানদার শাড়ি দেখান। “দাদা, এটা দেখুন! বৌদিকে মানাবে কিন্তু”। আমি হেসে গিন্নির দিকে তাকিয়ে বলি “এটা কিন্তু বেস্ট”। গিন্নি একটু মুখ কুঁচকে বলে “সত্যি বাবা, তোমার সাথে শপিং এ আসাটাই ভুল হয়েছে”। কে আমার সাথে আসতে বলেছে কে জানে! না, না, এই কথাটা শুধু মনে মনে ভাবি, মুখে উচ্চারণ করার সাহস আমার নেই মোটেই।
তিন নাম্বার দোকানেও পছন্দ হলো না গিন্নির। কি আর করা যাবে! একটু হাঁপিয়েও গেছি। মিথ্যে বলব না, চা আর মামলেট খাবার ইচ্ছেটা গিন্নির থেকে আমারই বেশি ছিল। তো, যাই হোক খেলাম সে সব। আবার হাঁটা লাগলাম অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে। কখন গিন্নির যে শাড়ি পছন্দ হবে তা কে জানে!
- এই, এটা বেশ না? আমার তো দারুণ পছন্দ হল।
বিশ্বাস করবেন না, লাফিয়ে উঠলাম। শেষমেষ কিছু পছন্দ হলো তবে। কিন্তু আশেপাশে তো কোথাও শাড়ির দোকান নজরে এলো না। হেসে উৎফুল্ল হয়েই উত্তর দিলাম
- হে হে! দারুণ ব্যাপার তো। কিন্তু দোকানটা কোথায়?
- আরে তোমার ঠিক বাম পাশে।
- কিন্তু এটা তো জামার দোকান।
- আরে, হ্যাঁ। এই হলুদ শার্টটার কথা বলছি। তোমায় পরলে হেব্বি মানাবে।
- সে ঠিক আছে, কিন্তু তোমার শাড়ি?
- সে তো কিনবই। এই জামাটা নিয়ে নাও আগে।
আমায় কিছু উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে টানতে টানতে আমায় দোকানে নিয়ে চলে এল।
- ওনার সাইজে এই শার্টটা আসবে না?
দোকানদারকে সটান জিজ্ঞেস করল গিন্নি।
- ইয়েস ম্যাম। দাদার সাইজেই এই শার্টটা।
আমার হাতে জামাটা ধরিয়ে দিয়ে বলল
- যাও, ট্রায়াল রুমে গিয়ে একবার পরে দেখে এস।
বুঝুন তো! নিজের শাড়ি, তাও নিজেই পছন্দ করে, আমার জামা, সেও গিন্নিই পছন্দ করে দেবে। সেই যখন গিন্নিকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেছিলাম সেটাই বোধহয় আমার করা কিছু শেষ পছন্দ ছিল। ট্রায়াল রুমে গিয়ে জামাটা পরলাম। ভালোই লাগছে!
- এই শোনো। তোমার জন্য কিনছি, ভাইয়ের জন্য না কিনলে ভালো দেখায়? বলো?
- কেনো না।
- ওই ব্লু টি-শার্ট টা ভালো মানাবে বল ভাইকে?
- হুঁ হুঁ।
নাঃ! শুধু দুজন নয়, আরো বেশ কিছু জামা কেন হল। এমনটা নয় কিন্তু যে আমরা গেলাম আর গিন্নির পছন্দ হয়ে গেল। কিছু জামা চোখে পড়তেই কিনে নেওয়া হয়েছে বটে, যেমন আমারটা, কিন্তু কিছু কিনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। দেখতে দেখতে ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল। ডেকে গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম
- কিগো, সাড়ে সাতটা বাজে। শাড়িই তো কেনা হলো না এখনো।
- হ্যাঁ, শোনো না আমাদের বেড কভারটা পুরোনো হয়ে গেছে তো। চলো চলো, বেরোনো তো হয় না। একটা বেড কভার কিনে নেই চলো।
আমার মুখটা আমার অজান্তেই কেমন যেন গোমড়া হয়ে গেল।
- আচ্ছা চলো
- না, তুমি না চাইলে কিনতে হবে না ।
- না, না চলো।
মনে মনে ভাবলাম সব কিছু চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে উঠে গেছে। না, না ! কিনছে যখন একদিকে ভালোই হচ্ছে, একদিনে সব হয়ে যাচ্ছে। কটা দিন নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। বেড কভার, বেড সিট, বালিশের কভার সব কিনে নিক!
তাই হলো, সব কিছু কিনে এবার আবার শাড়ির দোকানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। মাঝে রাস্তার ফুটপাথে চুলের ক্লিপ কেনার জন্য মিনিট পনেরো দাঁড়াতে হয়েছিল বটে, কিন্তু সে তো নগন্য সময়।
বিশ্বাস করবেন না মশাই! গিন্নির শেষমেষ শাড়ি পছন্দ হল। সত্যি বলছি, মাইরি। আমি তো আনন্দে ডগমগ। একটা সোনালী রঙের শাড়ি শেষমেষ গিন্নি পছন্দ করল। হে অন্তর্যামী, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি কথা শুনেছ। দাম মিটিয়ে বাড়ি ফিরবার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
এতই খুশি হয়েছি, এতই মনটা হালকা লাগছে ফট করে দুটো বিরিয়ানির প্যাকেটও কিনে নিলাম। চিকেন নয় মশাই, খাঁটি মাটন বিরিয়ানি একেবারে।
বাড়ি ফিরে গোটা দিনের কথা মনে করে এখন কিন্তু বেশ ভালোই লাগছে। এটা কিন্তু সত্যি এই যে আমার জন্য জামা কেনা, কিংবা বেড কভার পুরোনো হয়ে গেছে তার খেয়াল রাখা, আত্মীয় পরিজনদের জন্য জামাকাপড় কেনা, এসব তো গিন্নির ইচ্ছেতেই হয়েছে। শুধু পয়সা থাকলেই যে হয় না, ইচ্ছে, বড় মন এসব থাকাটাও একটা বড় ব্যাপার বৈকি। ভালো লাগছে মনটা, খুব ভালো লাগছে। সত্যি বলতে এরম একজনকে নিজের স্ত্রী করতে পেরেছি, যে কিনা সব কিছুর খেয়াল রাখে, এরমটা ভেবে একটু গর্বও হচ্ছে।
- বিরিয়ানি গরম করলাম। এসো। খেতে দিলাম।
- যাই।
দেখেছেন! এত পরিশ্রম করে এলাম। আমি বিশ্রাম করছি, গিন্নি কিন্তু ঠিক খাবার গরম করে সব গুছিয়ে রেখেছে। বিরিয়ানিটা মুখে তুলেই গিন্নি বলল
- বাহ, বেশ তো বিরিয়ানিটা
- হ্যাঁ গো ভালোই বানিয়েছে।
- এই, শোনো না, কাল কি ওই একটাতেই বেরোবো?
- হ্যাঁ? কোথায়?
- এই, আমার শাড়ীটাই তো কেনা হলো না। সত্যি! তোমার ভুলো মনের জবাব নেই।
কান্ড দেখুন একবার। মজা করছে কিরকম! হেসে বললাম
- তুমি ভালো মজা করতে পারো তো।
- কই ! না তো। সিরিয়াসলি বলছি
- এই যে গোল্ডেন শাড়িটা কিনলে!
- উফফ তুমিও না! দিবাকর জেঠুর মেয়ের বিয়ে না সামনে? এটা তো সেই উপলক্ষ্যে কিনলাম। আমার শাড়ি তো কাল কিনবো। ঠিকঠাক পছন্দই হল না। কাল একটু হাতে সময় নিয়ে বেরোবো।
ঘরে আয়না ছিল না। না হলে দেখতাম আমার মুখটা ঠিক কেমন হয়েছে।
- কিন্তু দিবাকর জেঠু তো এখনো নিমন্তন্নই করেনি। তুমি গিফট কিনে নিলে!
- আরে, নিশ্চই করবে। আর তা না হলে সাড়ে চার মাস বাদে আমার বন্ধু সুপর্ণা, ওর বিয়ে আছে। ওকে দিয়ে দেব। চিন্তা কোরো না।