Sourya Chatterjee

Drama Fantasy Others

4.5  

Sourya Chatterjee

Drama Fantasy Others

ঘরে ফেরার গান

ঘরে ফেরার গান

6 mins
249


বহু মানুষের ভিড়ের মাঝেও দেবলীনাকে খুঁজে নিতে একটুও অসুবিধা হল না দীপ্তর। কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল দীপ্ত, মুখে স্মিত হাসি। দেবলীনার মুখে স্মিত হাসিটা ক্রমবর্দ্ধমান, এই মুহূর্তটার জন্যই তো মাসের পর মাস অপেক্ষা করে থাকা। গতবার যখন দীপ্ত এসেছিল তখন এই মেরুন পাড়, হলুদ শাড়িটা দেবলীনাকে উপহার দিয়েছিল দীপ্ত। সেই শাড়ীটাই আজ পরেছে দেবলীনা। লাগেজ নিয়ে আরো কয়েক পা এগিয়ে দেবলীনার কাছে পৌঁছাতেই দীপ্তর বুকে মাথাটা রেখে দীপ্তকে আলিঙ্গন করল দেবলীনা। হয়তো সেই আলিঙ্গন দু সেকেন্ডেরও কম, তবে ওইটুকু সময়েই কত না বলা কথাদের যে আদানপ্রদান ঘটল, তা ওদের থেকে বেশি আর কে জানে! দেবলীনা দীপ্তর হাতটা ধরে বলল

-   চলো, বাড়িতে বাবা, মা ওয়েট করে আছে তুমি কখন আসবে তার জন্য।

-   সে তো যাবোই। কিন্ত তার আগে যে একটু দাঁড়াতে হবে। তোমার জন্য একটা উপহার আছে যে।

-   সে বাড়িতে গিয়ে দেবে ক্ষণ।

-   এত সুন্দর সেজেগুজে আমাকে রিসিভ করতে এসেছ, তার জন্য কোনো উপহার থাকবে না বুঝি! পেছন ফেরো।

অপেক্ষা না করে নিজেই দেবলীনাকে পিছন ফিরিয়ে দিল দীপ্ত। তার পর নিজের হ্যান্ড লাগেজে যত্ন করে আনা একটা চন্দ্রমল্লিকা ফুল দেবলীনার খোঁপায় লাগিয়ে দিল ও। হলুদ শাড়ি, হলুদ চন্দ্রমল্লিকার সাথে মিলেমিশে যে দেবলীনাকে আরো রূপসী করে তুলেছে তা আর বলার অবকাশ রাখে না। 

দীপ্ত চাকরি সূত্রে এখন পুনেতে থাকে। বছর তিনেক আগে ওখানে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। কবে যে আবার নিজের শহরে স্থায়ীভাবে ফেরার সুযোগ পাবে তা সত্যিই সময়ই কেবল জানে হয়তো। আগের দু বছর পুজোর সময় সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি নিয়ে দীপ্ত বাড়ি এসেছিল। এবছর অফিসের কাজের চাপে তার সময় হয়নি। অগত্যা ডিসেম্বর মাসে কাজের চাপ কম থাকার দরুন তখনই নিজের শহরে আসা আর কি। দেবলীনা, দীপ্তর স্ত্রী দীপ্তকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে সকাল সকালই অফিস ছুটি নিয়ে চলে এসেছিল। যে হলুদ শাড়িটা পরেছিল, সেটা গতবার পুজোয় দীপ্ত উপহার দিয়েছিল। দীপ্তও খুব ভালো করেই আন্দাজ করতে পেরেছিল, দেবলীনা ওই শাড়ীটাই পরবে। তাই তো একই রঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুল দীপ্ত আগে থেকেই নিজের হ্যান্ড লাগেজে ভরে নিয়েছিল।

বাড়ির সামনে গাড়িটা থামতেই দীপ্তর বাবা, অবিনাশবাবু বেরিয়ে এলেন। দরজার সামনেই পায়চারি করছিলেন উনি দীপ্তর ঘরে ফেরার প্রহর গুনতে গুনতে। গাড়ির শব্দ পেলেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখছিলেন। রং নম্বর হয়েছে কত বার! দরজা খুলে দেখেন অন্য গাড়ি হুস করে বেরিয়ে গেল। দু একবার এজন্য অবশ্য বকাও খেয়েছেন মালিনী দেবী অর্থাৎ দীপ্তর মায়ের কাছে। কিন্তু মুখে বকা দিলে কি হবে! মালিনী দেবীও যে কতক্ষন ধরে কান খাড়া করে রয়েছেন। শুধু উৎকণ্ঠার বহিঃপ্রকাশ ঘটান নি। আজ বাড়িতে সকাল থেকেই উৎসবের আবহ। লুচি, বেগুনভাজা, ধোকার ডালনা, পাঠার মাংস, পায়েসের গন্ধে সারা বাড়ি যে ম ম করছে। দীপ্ত যে খুব ভালো খায় এসব খাবার। অবশ্য দীপ্তর জন্য মন কেমন করলে মালিনী দেবী এইসব রান্না এমনি এমনিই রেঁধেছেন কতবার। রান্নাঘরের ঘুলঘুলি কিংবা কাঁচের শিশিতে রাখা হলুদ গুড়ো ছাড়া আর কেউ কারণ জানে না, কেন মালিনী দেবী মাঝে মাঝেই ধোকার ডালনা রাঁধেন। সে যাই হোক, আজকের আয়োজন শুধু দীপ্তর জন্যই।

অবিনাশবাবু নিজেই ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুললেন। ছেলেকে দেখার তর যেন আর সইছে না। ডাক্তারের দেওয়া হাজার ব্যথার ওষুধ যে হাঁটুর ব্যাথা কমাতে পারেনি, দীপ্ত আসার আনন্দে আজ সে ব্যাথা পুরো উধাও একেবারে। ওনার বয়স তখন যেন একাত্তর থেকে কমে সতেরোর ঘরে। মালিনী দেবী বরাবরই একটু চাপা স্বভাবের। ওনারও ইচ্ছে করছে ছুটে এসে দীপ্তকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ খুব একটা তিনি ঘটান না। তাই তো অবিনাশবাবুর এত বাড়াবাড়ি দেখে উল্টে অবিনাশবাবুকেই বকা দিচ্ছেন।

-   আহা! তোমার ছেলে তোমারই থাকবে। ওকে ঘরে ঢুকতে দাও। হাতমুখ ধুক, তারপর কথা বলবে ক্ষণ।

দীপ্তরও কি আর তর সয়! ওসব হাত মুখ ধোয়া পরে হবে ক্ষণ। ঘরে ঢুকেই ব্যাগ হাতড়ে দেবলীনা আর মা-বাবার জন্য আনা শাড়ি আর পাজামা পাঞ্জাবি উপহার স্বরূপ দিল দীপ্ত। চৌরাস্তার মোড়ের নীল-হলুদ বাড়িটায় খুশির ঝর্ণা ঝরে পড়ছে যেন তখন!

দুপুর গড়ালো, সন্ধ্যা নামলো। চৌরাস্তার মোড়ের নীল-হলুদ বাড়িটায় চপ,মুড়ি সহযোগে আড্ডা বসেছে তখন। দেবলীনা সকালে উপহার পাওয়া চন্দ্রমল্লিকা ফুলটা মাথার খোঁপা থেকে খোলেনি এখনো। ওই ফুলে যে দীপ্তর স্পর্শ আছে! থাকুক না মাথায়, ক্ষতি কি! 

মালিনী দেবী জিজ্ঞেস করলেন

-   দীপ্ত, তা কতদিন ছুটি পেলি এবার? 

অবিনাশবাবু দীপ্তকে কিছু না বলতে দিয়ে নিজেই উত্তর দিলেন 

-   এবার তো পুজোতেও ছুটি পাসনি। মাস খানেক তো থাকবিই, নাকি!

দীপ্ত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জবাব দিল

-   প্রমোশন পেয়েছি তো, এক সপ্তাহের বেশি ছুটি পাইনি গো।

অবিনাশবাবু একটু উত্তেজিত হয়েই বললেন

-   পুজোতে তো এর থেকে বেশি সময় হাতে নিয়ে আসিস! আসার কি দরকার ছিল!

মালিনী দেবী অবিনাশবাবুর কাঁধটা ধরে স্মিত স্বরে জবাব দিলেন

-   ছাড় না! এরকম করে না। ছেলেটা কতদিন পর এসেছে বল তো! ওর দিকটাও তো আমাদের ভাবতে হবে!

দেবলীনা দীপ্তর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল

-   কোনোভাবে ছুটিটা বাড়ানো যাবে না? একটু দেখ না! 

কয়েকবার ঢোক গিলে দীপ্ত উত্তর দিল

-   মনে হয় পারব না গো।

অবিনাশবাবু বেশ শান্ত এখন। উনি একটু হেসে বললেন

-   দীপ্ত আসবে, ওর জন্য অপেক্ষা করব, এই ব্যাপারটাই ভালো ছিল। দেখতে দেখতে ছ’টা দিন কেটে যাবে। আবার অসীম শূন্যতা। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অবিনাশ বাবু।

সত্যিই দেখতে দেখতে ছ’টা দিন কেটে গেল। দীপ্তর সাথে সবার কথাই বা হলো কতক্ষণ আর! সারাক্ষন তো ফোন, ফোন আর ফোন। খোঁপা থেকে খুলে একটা কাঁচের গ্লাসে জলের মধ্যে চন্দ্রমল্লিকা ফুলটাকে রেখেছিল দেবলীনা। সেই ফুলও শুকিয়ে গিয়ে করুণ নয়নে তাকিয়ে আছে যেন। অবিনাশ বাবু আজ আর বাচ্ছাদের মত লাফালাফি করছেন না, বরঞ্চ অত্যন্ত শান্ত এবং গম্ভীর হয়ে অথচ মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বসে আছেন। দেবলীনার মুখটাও ফ্যাকাসে চন্দ্রমল্লিকা ফুলটার মত। যেন আবার অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু হবে আর কিছুক্ষণ পর থেকেই। মালিনী দেবী অবশ্য সকাল থেকেই নানাবিধ রান্নার তোড়জোড় শুরু করেছেন, তাড়াতাড়ি ব্যাগপত্র গোছানোর জন্য ছেলেকে তাড়াও দিচ্ছেন। উনি কিছুতেই ছেলেকে বুঝতে দেবেন না যে উনিও কষ্ট পাচ্ছেন। দীপ্ত বেরিয়ে যাবার পর হয়তো কোনো বন্ধ ঘরে কিংবা বাথরুমে কান্নায় ভেঙে পড়বেন উনি।

চৌরাস্তার মোড়ের নীল-হলুদ বাড়িটার দোরগোড়ায় যেন স্তব্ধতা এখন দানা বেঁধে রয়েছে। দীপ্ত বেরিয়ে যাবে আর সেই স্তব্ধতা ভিতরে ঢুকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে যাবে বাড়িটায়। অবিনাশবাবুর কথা অনুযায়ী বিরাজ করবে এক অসীম শূন্যতা।

দুপুর দেড়টা নাগাদ কলিং বেল বাজল। আজ আর অবিনাশবাবুর উঠে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না কে এলো। সত্যিই তো! যেই হোক না কেন তাতে তো আর কিছুই যায় আসে না আজ। দীপ্ত নিজেই গেল দরজা খুলতে। দেবলীনা আপন মনে বসে আছে গ্লাসে রাখা চন্দ্রমল্লিকা ফুলটার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎই দীপ্তর গলার স্বর দেবলীনার কানে পৌঁছাতে নড়েচড়ে বসল ও। 

-   এই লীনা, একবার আসবে গো, খুব ভারী। একটু হেল্প করবে?

উঠে দাঁড়ালো দেবলীনা। দীপ্তর কথাটা ঠিকমতো কানে পৌঁছায়ও নি। তাও ও জবাব দিল

-   আসছি।

দরজার সামনে পৌঁছে দেবলীনার চক্ষু তো চড়কগাছ! এসব কি! এত বড় বড়, এত ভারী ভারী ব্যাগ! এতো একটা গোটা সংসার! ঘাম মুছতে মুছতে দীপ্ত বলল

-   কিগো, হেল্প করবে না ব্যাগগুলো ঘরে নিয়ে যেতে?

ততক্ষণে অবিনাশবাবু আর মালিনী দেবীও চলে এসেছেন। ঘামে মুখটা চকচক করছে দীপ্তর। মুখে হাসি নিয়ে দীপ্ত এক দিকে দেবলীনা আর অন্য দিকে অবিনাশ বাবুর কাঁধে হাত রাখলেন

-   বলছিলাম কি! পার্মানেন্টলি অফিসকে বলে পুনে থেকে এই শহরে ট্রান্সফার নিয়ে নিলাম। আমার রুমমেট যে ছিল সে আমার ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে ডোমেস্টিক কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছে। বুঝলে। সেগুলোই এল। হে হে! তোমাদের ইচ্ছে করেই বলিনি। সারপ্রাইজটা দেব বলে। এখন থেকে দীপ্ত তোমাদের সাথেই থাকবে।

মালিনী দেবী খুশিতে ডগমগ হয়ে জড়িয়ে ধরলেন দীপ্তকে। দেবলীনা আনন্দাশ্রু মুছে বলল

-   দেখ দীপ্ত, শত আনন্দ, শত দুঃখ সত্ত্বেও মায়ের কোনোদিনও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ হতে দেখিনি। আজ দেখ, তুমি শুধু দেখ দীপ্ত। মাও ইমোশনাল হয়ে পড়েছে কেমন।

আর অবিনাশবাবু! ঘরে ছুটে গিয়ে ওয়ালেটটা নিয়ে এসে দে দৌড়! 

-   আরে বাবা, কোথায় চললে?

-   আরে ধুর! ইকবালের বিরিয়ানির দোকানটা দেড়টায় বন্ধ করে দেয়। এখুনি না গেলে আর পাব না। বিরিয়ানি ছাড়া এরকম সারপ্রাইজের সেলিব্রেশন করলে ঠাকুর পাপ দেবে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama