আরশিনগরের বন্ধুরা
আরশিনগরের বন্ধুরা
স্বপ্নিল ছেলেটা সবার চাইতেই একটু আলাদা! কোথাও বেরোয় না, প্রয়োজনের বেশি কথাও বলে না কারোর সাথে। হ্যাঁ, অন্যান্য ছেলেদের মত ওরও বিকেলবেলাটাই সব থেকে ভালো লাগে। গোধূলিবেলায় ধুলো উড়িয়ে সমবয়সী সবাই তখন ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে! স্বভাবতই সব চেঁচামেচি-হইচইয়ের শব্দতরঙ্গ সেইসময়টা কলেজ হস্টেলের ফুটবল মাঠেই উপচে পড়ে একেবারে। হস্টেলের ঘরে তখন স্নিগ্ধতার চাদর মুড়ি দেওয়া এক শান্ত পরিবেশ বিরাজ করে। সেই শান্ত পরিবেশ টাকে দু হাত আগলে জড়িয়ে ধরে স্বপ্নিল।
স্বপ্নিলের আরো একটা পছন্দের সময় আছে। যখন দু চোখ কচলিয়ে আড়মোড়া ভেঙে সূর্যমামা ঘুম থেকে উঠে, হাজার পাখি নানান সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে বরণ করে নেয় আলতা রঙের শাড়ি পরিহিতা মিষ্টি একটা ভোরকে, সেই সময়টাও স্বপ্নিলের খুব পছন্দের। মাঝরাত অবধি জেগে থাকা হস্টেলের অন্য সব ছেলেরা তখন সবেমাত্র ঘুমিয়েছে হয়তো। তাই কলরবটা অনেকটাই কম। স্বপ্নিল ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দাটা সরায় প্রথমে। সূর্যের প্রথম আলো গায়ে মেখে খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে ভোরের বাতাসের ঘ্রাণ নেয় তারপর। আজ স্বপ্নিলের মনটা একটু খারাপ। বাড়িতে অন্তত দিন সাতেকের জন্য হলেও আসার জন্য খুব জোর করছে বাবা, মা। স্বপ্নিলের বাড়ি যেতে ভালো লাগে না হস্টেল ছেড়ে। তবু যেতে হবেই। কি আর করার!
স্বপ্নিল কারোর সাথে মিশতে পারে না, আরো স্পষ্ট করে বললে তার ভালো লাগে না মিশতে। শুধু হস্টেল কেন, ছুটিতে বাড়ি ফিরলেও সে একইরকম থাকে। বাবা, মা, দাদু, ঠাম্মা সবাই যেন খুব কাছের হয়েও খুব দূরের। স্বপ্নিল সবার সাথেই বাক্যালাপ চালায় ঠিকই, কিন্তু তার মনের ঠিকানার হদিস পায় না প্রিয়জনরাও। দিনে দিনে বড্ড একা হয়ে পড়ছে স্বপ্নিল, বড্ড একা।
ছুটি শেষ হয়, আবার হস্টেলে ফিরে আসে স্বপ্নিল। ঘরের দরজাটার তালা খুলে দরজার পাল্লাটা খোলে স্বপ্নিল। আহা! মুখে হাসি ফুটে ওঠে স্বপ্নিলের। গোটা দুনিয়ায় এইটুকু জায়গাই তার খুব প্রিয় মনে হয়। ঘরে ঢুকে ছিটকিনিটা তুলে দিলেই তার একাকীত্ব উদযাপনে আর কেউ বাধা দেবে না। বাড়িতে, কলেজে, রাস্তা ঘাটে এই একাকীত্ব উদযাপনে ভীষণ বিঘ্ন ঘটে বারংবার। তাই তো এই কটা মাত্র দিনেই হস্টেলের নিজের ঘরটা খুবই পছন্দ হয়েছে স্বপ্নিলের।
তবে দূর থেকে যতই মনে হোক স্বপ্নিল একাকীত্বের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত, তবে বাস্তবে স্বপ্নিল কিন্তু মোটেই একা নয়। স্বপ্নিলের কত বন্ধু রয়েছে। কে বলল, স্বপ্নিল নাকি কাউকে মনের হদিস দেয় না! দেয় তো। সে তার বন্ধুদের মনের হদিস দেয়। এই যে তার এই হস্টেলের ঘর। স্বপ্নিল নাম রেখেছে আরশিনগর, এখানেই রয়েছে ওর বন্ধুরা। ওই যে টেবিলের উপর গোঁসা করে বসে আছে, ওর নাম রিম। জানালার গ্রিলের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রিলটার উপর দুজন মিলে রাগ দেখাচ্ছে, ওদের নাম টুনি আর বৈশাখী। এতদিন ছুটিতে ছিল, বাড়িতে দেখা করতে যেতে হয়েছিল, আরশিনগরের বন্ধুদের সময় দিতে পারেনি। তাই সবার এত গোঁসা। বাকি বন্ধুরা তো অভিমান করে কোথায় যে গেছে এখন কে জানে। অবশ্য স্বপ্নিলের চিন্তা নেই, বিকেল হলে ঠিক দেখা করতে আসবে। হাসে স্বপ্নিল। অনাবিল খিলখিল শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
না, না, এগুলো মানা যায় না। সবার জন্য খাবার, জল সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখে তবেই এক সপ্তাহর ছুটিতে গেছিল স্বপ্নিল। এমনকি রিমের জন্যও জলের ব্যবস্থা করেছিল। ওর তো আবার দিনে একবারের বেশি জল খেলে শরীর খারাপ করে, তাই ওর জন্য নিজের মাথা খাটিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল। এত কিছুর পরেও স্বপ্নিল আবিষ্কার করল ওর আরশিনগরের বন্ধুরা ঘরের মধ্যে এক অনাসৃষ্টি চালিয়েছে। আরশিনগরের মধ্যেই একটা ছোট্ট কামরাতে রিম থাকে, সে সেই কামরাতেই ফাটল ধরিয়ে নিজের রাগ দেখিয়েছে। আর টুনি, বৈশাখী ওরা! স্বপ্নিলের বিছানাপত্রে বাইরের নোংরা আবর্জনা, লতা পাতা নিয়ে এনে ফেলেছে। এত রাগের কি হল স্বপ্নিল বোঝে না। এখন কি আর করা যাবে! রিমের জন্য কিছু বাড়তি কামরার জোগাড় আগে থেকেই করে রেখেছে। নতুন কামরায় তাকে নিয়ে গেল স্বপ্নিল। তারপর নিজের বিছানা পরিষ্কার করে তবে শান্তি। দুপুরে যে দু দন্ড বিশ্রাম করবে তার উপায় আছে! বাবুদের গোঁসা কমেছে, সবাই হাজির হয়েছে আবার! এখন বসে বসে সবাইকে খাওয়াও। আর কি!
কলেজ জীবন কতদিন আর চলে! সময়ের স্রোতে সে তো শেষ হবেই আজ বা কাল! আরশিনগর ছাড়তে হয় স্বপ্নিলকেও। সে আদৌ কি করে, চাকরি পেয়েছে কি পায়নি সে খবর কেউ জানেনা। তার আরশিনগরের বন্ধুরা জানে হয়তো শুধু। হস্টেল ছেড়ে যাবার দিন চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বন্ধুদের বিদায় জানিয়েছে স্বপ্নিল। বন্ধুরা বুঝেছে, এটাই নিয়ম, যেতে তো হবেই। সব সম্পর্ক তো আর চিরদিনের নয়। তবে যাওয়ার আগে স্বপ্নিল আরশিনগরের বন্ধুদের কথা দিয়ে গেছে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে চিঠির মাধ্যমে। স্বপ্নিলের জীবন কোন গিরিখাত দিয়ে বয়ে চলবে সে খবর আর কেউ না পাক তার আরশিনগরের বন্ধুরা ঠিক পাবে চিঠির মাধ্যমে।
- স্যার! চিঠি আছে।
- কিসের গো হরি।
- ওই যে প্রতি মাসে আসে না একটা..
- তোমাকে কতবার বলেছি না ওইসব চিঠি এলে ডিরেক্ট ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। তাও আমাকে বল কেন? কাজের সময় বিরক্ত কোরো না।
- আমার কি মনে হয় বলুন তো স্যার, ওই একটা তারকাটা ছেলে থাকতো না সাতাশ নম্বর রুমে। ঘরের মধ্যে টবে গাছ ফাছ লাগতো, পাখিদের খেতে ঠেতে দিত, একা একাই আবোল তাবোল কথা বলত, ওরই কীর্তি এসব।
- হরি! তুমি জানো তো বল একজন হস্টেল ওয়ার্ডেনের কত কাজ থাকে! এসব পাগল ছাগলের গল্প শুনে আমি কি করব বল তো! ফেলে দাও না ডাস্টবিনে।