Sourya Chatterjee

Classics Others

4.5  

Sourya Chatterjee

Classics Others

প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন

7 mins
1.3K


প্যাসেঞ্জার ভর্তি ট্রেনটা এসে থামল স্টেশনে। বেশ কিছু লোক অপেক্ষা করে আছে ট্রেনে উঠবে বলে। কয়েক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষারত সেই সাধারণ মানুষজন যেন কোনো বড় কুস্তিগীর হয়ে ওঠে। ট্রেন থামতে না থামতেই নানাবিধ সব কুস্তির প্যাঁচে একে অপরকে পর্যদুস্ত করে কে আগে ট্রেনে উঠবে তার প্রতিযোগিতা চলে আর কি!

আর অদ্ভুত ব্যাপার! ট্রেনে উঠে সেই প্রতিযোগীরাই কোনো এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় প্রানের বন্ধু হয়ে ওঠে। সিনেমা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, রাজনীতি থেকে শুরু করে বাড়ির রান্নাবান্না কত ধরনের গল্পের সাক্ষী থাকে ট্রেনের কামরাগুলো।

এই বন্ধুত্ব কবে যে আর শুধু বন্ধুত্বর আচ্ছাদনে আবৃত না থেকে আত্মীয়তার মোড়কে আচ্ছাদিত হল তা বোধহয় টেরও পায়নি রোহনরা। রোহন কলেজে পড়ে, ট্রেনের এই দলটার সব থেকে ছোট সদস্য ও-ই। বাড়ির ছোট ছেলের মত আদর যত্ন, ভালোবাসা ও পেয়ে থাকে সবার থেকেই। সেখানে ওর দাদা রয়েছে, দিদি রয়েছে, কাকারা রয়েছে, জেঠুৱা রয়েছে, মাসি পিসি রয়েছে। এক অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে ওরা এক পরিবার হয়ে উঠেছে যেন। কর্মক্ষেত্র, সংসার সব ভুলে ট্রেনযাত্রার সময়টুকু গল্প, হাসি আড্ডায় মশগুল হয়ে ওঠে ওরা। কারোর কোনো সমস্যা হলে একে অন্যকে সাহায্য করা, আবার সাফল্যে একসাথে গপাগপ বেহিসেবি রসগোল্লা খাওয়া, এসবও লেগে থাকে বৈকি।

সেদিন হঠাৎ করেই ওদের মধ্যে একজন প্রস্তাব দিল “একসাথে একসাথে একটা পিকনিক করলে কেমন হয়!” দু-এক সেকেন্ড সবার মস্তিষ্কে নিউরোনগুলো ঘুরপাক খেতে দাবি তুলল আহা! এ যে বড় উত্তম প্রস্তাব। উৎসুক কয়েকজন বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এল “হ্যাঁ” বলে। 

-   বেশ হয় কিন্তু।

-   আমার ছোট মেসোর মেজ ভাইয়ের একটা বাগানবাড়ি আছে। ওখানে করলে ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কমে হয়ে যাবে। 

-   আরে রাখো তোমার ছোট মেসো। আমাদর পাড়ার মাঠটাতেই হয়ে যাবে। টাকা পয়সার কোনো বালাই-ই নেই।

পিকনিকের কথা আসতেই সেই আড্ডার মেজাজ আরো কয়েক গুণে বেড়ে গেল যেন। ওদের স্বরের ডেসিবেল ট্রেনের পু-ঝিকঝিক শব্দের মাত্রাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। উৎসাহ, উদ্দীপনার সীমা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে কখন নামবার স্টেশন চলে আসছে তাও খেয়াল থাকছে না মাঝেমধ্যে। 

তবে এই উৎসাহ, উদ্দীপনার ফোয়ারার মাঝে পার্বতী মাসি, সমীর জেঠু আর শৈলেন কাকার মুখগুলো থেকে প্রতিদিনকার হাসিগুলো মুছে যে একটা মেকি হাসি ফুটে উঠেছে সেটা কারোর নজরেই পড়েনি। আনন্দের রংমশালে প্রজ্বলিত সবার চোখের চাহনির মাঝে তিন জোড়া চোখ যে হঠাৎ করেই হুড়মুড়িয়ে এসে পড়া অশ্রু আটকাতে ব্যস্ত সেকথা লোকে বুঝবেই বা কি করে! ওরা তিনজন জানে পিকনিকের কত খরচ! সেই খরচে পুরো পরিবারের এক সপ্তাহের সংসার চলে হয়তো। না, না, এই ট্রেনের পরিবার নয়, আসল পরিবার। সত্যিকারের ছেলে, মেয়ে, বউ কিংবা বরের পেট চালাতেই যারা হিমসিম খায়, তাদের কাছে এরকম পিকনিক বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয় আর। 

এগিয়ে আসতে থাকে পিকনিকের দিন। সবার চোখে মুখে উৎসাহ আর উদ্দীপনার পারদ ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই কদিন তাস পেটানো বন্ধ আগাম পিকনিক উপলক্ষে। সমীর জেঠুর মাথা থেকে পিকনিকের কথা সাময়িকভাবে বেমালুম উড়ে গিয়েছিল। তাই হয়তো বড় আশা করে রোজকার মতোই তাস বের করেছিল। বাকিরা পিকনিকের কথাবার্তা শুরু করতেই সব মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল, ট্রেনের পরিবারের সাথে আর্থিক তফাতের কথা, তাই ইচ্ছাও অন্য, চাওয়াপাওয়াও আলাদা। যতই সবাই বুক ফুলিয়ে মনে করুক না কেন, রোহনরা একটা ইতিহাস সৃষ্টি করছে ট্রেনে একটা আলাদা পরিবার তৈরি করে। কিন্তু সত্য, বাস্তব আজ হয়তো টের পাচ্ছে ওরা তিনজন। 

এদিকে ঘটা করে মেনু ঠিক হল। সুরঞ্জন দাদা তো আবার ল্যাপটপ নিয়ে এসে সব লিখে রাখছে। কি কি গেমস থাকবে, মিউজিক সিস্টেমের ব্যবস্থা কি হবে সব ব্যবস্থাই চলতে থাকে। তপন কাকু তো একটা টি-শার্ট কিনেছে শুধু সেই পিকনিকের দিন পরবে বলে। রান্নার ঠাকুরের ব্যবস্থাও দায়িত্ব নিয়ে করে ফেলেছে গার্গী আন্টি। স্পট বুকিং, রান্নার আয়োজন, গেমস, অন্যান্য ইভেন্টস সব ব্যবস্থাই খুব তাড়াতাড়িই সমাপ্ত হল। সুখ পাখিরা ট্রেনের কামরার এদিক সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। এরকম একটা প্রস্তাব যে এত সহজে বাস্তবায়িত করা যাবে তা সত্যিই কে-ই বা ভেবেছিল। ইচ্ছা, উৎসাহ, উদ্দীপনা থাকলে কি না হয়! সব ব্যবস্থা সমাপ্ত করে সবাই যখন একে অপরের সাথে “হাই ফাইভ” করছে, তখনও কারোর চোখে পড়লো না সমীর জেঠুৱা তাদের হাত তখন শাড়ির আঁচলের তলায়, প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে আড়ষ্টভাবে।

প্রতিজন পিছু নগদ সাড়ে সাতশো টাকা ধার্য হলো। সবাই যে যার পরিবারও আনবে বলে ঠিক হল। দু জন এলে খরচ চোদ্দশ আর তিনজন এলে দু হাজারেই হয়ে যাবে। সবাই উন্মুক্ত চিত্তে সে টাকা দিয়েও দিল। 

-   সমীর জেঠু, তা বৌদিও আসছে নিশ্চয়ই।

খানিক চুপ করে থেকে সমীর জেঠু স্মিত হেসে উত্তর দিল

-   না গো ভায়া, আমার হবে না। আমার একটা কাজ পড়ে গেছে গো সেদিন।

-   আহা! সেটা তুমি বলবে তো। তোমাকে ছাড়া পিকনিক হবে না। আমরা নেক্সট উইকে করব।

আবার খানিকটা চুপ করে থেকে সমীর জেঠু উত্তর দিল

-   না, না, এরম হয় নাকি প্ল্যান প্রোগ্রাম সব রেডি। আমার কখন কি কাজ পড়বে আমি নিজেই জানি না। তোমরা আমায় ছেড়ে দাও ভায়া। তোমরা আনন্দ করবে। পরেরদিন সেসব গল্প শুনেই পুরো আনন্দর ভাগ গ্রহণ করব।

পার্বতী মাসিও অজুহাত দিল ছেলের শরীর খারাপ, আসতে পারবে না। শৈলেন কাকার বক্তব্য সেদিন বাড়িতে কেউ থাকবে না, বাড়ি ফাঁকা রেখে আসাটা মুশকিল হবে।

কারণগুলো যে নিতান্তই অজুহাত সে বোঝার ক্ষমতা ট্রেনের পরিবারের বাকি আট সদস্যের আছে বৈকি। সবাই একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আনন্দর জোয়ারে প্লাবিত হতে গিয়ে সমীর জেঠুদের যে আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে কথা এতক্ষণে বুঝে গিয়েছে সবাই। ওরা তিনজন যে কথাবার্তায় সরাসরি অংশ নিচ্ছে না সে কথা একবারও কেউ বুঝল না। আত্মগ্লানিতে বাকি আটজন তখন যেন নিজেদেরই দোষারোপ করছে। সমীর জেঠুৱা তিনজন অবশ্য বারে বারে বলছে সবাইকে “তোমরা আনন্দ করে এস। এসে গল্প বলবে। তাতেই আমরা আনন্দের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করব”। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সবার মধ্যেই তখন এক অন্যরকম বিষন্নতার ছোঁয়া। যে সুখপাখিরা সারা ট্রেনের কামরা জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল তারা যে কখন কোন স্টেশনে নেমে পড়েছে, তা খেয়ালই করেনি কেউ।

খুশির হওয়ার গতিমুখ যে আবার এদিকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। তপন কাকু ওদের তিনজনের আড়ালে প্রস্তাব আনল ওদের তিনজনের খরচটা অন্য সবাই মিলে ভাগ করে দেওয়া গেলে কেমন হয়! সবাই তো এক বাক্যে রাজি। গেলে সবাই মিলেই যাব, না হলে কেউ নয়, এরকম দাবিতে রাজি হল ওরা আটজন। যা টাকা পয়সা বেশি লাগবে, লাগবে। 

পরের দিন ট্রেনে পরিকল্পনা মতোই সমীর জেঠুদের কাছে প্রস্তাব গেল যে ওদের তিনজনের কোনো টাকা পয়সা দেবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু কই! সুখ পাখিরা ট্রেনে উঠল না তো! এ তো হিতে বিপরীত হল। সমীর জেঠুদের মনের ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুতের কোনো চোরাস্রোত খেলে গেল। 

-   ভায়া, আমরা গরিব ঠিকই, কিন্তু দেখ, এরকমটা হলে আমাদের মোটেই ভালো লাগবে না। আজীবন মনে হবে ট্রেনের পরিবারের সবার দয়ায় আমাদের জীবন কাটছে। মুখ নিচু করে থাকতে ভালো লাগবে না ভায়া। তোমরা পিকনিক করে এস। সত্যি বলছি, আমাদের কোনো আফসোস নেই এতে।

-   আমাদের হচ্ছে তো আফসোস। এরকম ভাবছ কেন! পরিবারের লোক পরিবারের লোককে নিয়ে পিকনিকে যাবে না। এরকমটা হয় নাকি! 

-   তোমরা বুঝছ না ভায়া..

সমীর জেঠুকে কথাটা শেষ করতে দিল না সুরঞ্জন দাদা।

-   জেঠু, তুমি বুঝছ না। তুমি তো মানো যে আমরা একটা পরিবার। তো পরিবার একসাথে একটা পিকনিক করবে, তাতে কাকু, জেঠু মাসীরা আর্থিকদিক থেকে একটু উইক থাকার কারণে আমাদের জয়েন করতে পারছে না। এটা মানা যায় বল?

-   তোমরা কি চাও? আমরা যাই, কিন্তু অ্যাক্টিভেলি কিছুতে মন থেকে অংশগ্রহণ করতে পারব না। এরকম কিছু ভালো লাগবে তোমাদের? মেন্টালি তোমাদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা ফুটে উঠবে তো। সেটাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তোমরা ঘুরে এস, যাও। আমরা ট্রেনে যেরকম হইহুল্লোড় করে তাস পেটাতে পেটাতে যেতাম সেরকমই হবে। বলছি শোনো।

আর কেউই কোনো উত্তর দিল না। কি উত্তর দেবে সেটাই হয়তো কেউ ঠিক করতে পারল না। বেশ কিছু দীর্ঘশ্বাস বিরাজ করছে ট্রেনে তখন।

যখন এত ব্যবস্থা হয়েছে, রান্নার ঠাকুরকে পুরোপুরি অ্যাডভ্যান্সও দেওয়া হয়ে গিয়েছে তখন আর পিকনিকটা বাতিল করতে পারল না ওরা। হুঁ, মন মেজাজ ভালো নেই কারোরই। জোর করে ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে ওঠা যায় কিন্তু জোর করে কি আর আনন্দ করা যায়! নামমাত্র পিকনিক হলেও সমস্ত গেমস ইভেন্টস, অন্যান্য প্রোগ্রাম সেসব বাতিল করাই হল।

পিকনিকের দিন এসে গেল। নিজেদের বউ, ছেলে মেয়েকে নিয়ে সময় মতোই সবাই হাজির। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাচ্ছারা নিজেদের মধ্যে খেলাধুলায় যেমন মাতল, তেমনই গৃহিনীরাও নিজেদের মধ্যে পরিচয় সেরে গল্প আড্ডায় মেতে উঠল। তপন কাকু আর সুরঞ্জন দাদা একটু দূরে সিগারেট টানছে। বাকিরা রান্নার ওখানে গিয়ে একটু তদারকি করছে কতদূর কি হল সে ব্যাপারে। রোহন এখনো আসেনি কেবল। কি অবস্থা! ব্যাচেলর মানুষ! আর ও-ই সবচাইতে লেট করছে।

নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না কেউ। একি! ওই তো রোহন। কিন্তু সঙ্গে পুরো পরিবার সহ সমীর জেঠু, শৈলেন কাকা আর পার্বতী মাসি। এটা কি করে সম্ভব করল রোহন?

আলাদা করে রোহনকে ডাকল সুরঞ্জন দাদারা।

-   রোহন এই অসম্ভবটাকে কি করে সম্ভব করলে?

স্মিত হেসে রোহন জানালো

-   মিথ্যার প্রশ্রয়ে। 

-   মানে?

-   আমি তিনজনকে বললাম শুধু টাকা পয়সা দিয়ে কন্ট্রিবিউট করা যায় নাকি! আর তোমাদের ছাড়া পিকনিকও হবে না। তো আমরা ডিসাইড করেছি আমরা চাঁদার কোনো ব্যবস্থাই রাখব না। আমরা কেউ চিকেন স্পনসর করছি, কেউ ব্রেকফাস্ট, আবার কেউ বা পিকনিকের স্পট।

-   তো তাতে কি হল?

-   আহা শোনোই না। তো বললাম আমরা এত পার্বতী মাসির হাতে বানানো মালপোয়ার গল্প শুনি। ভেবেছিলাম পিকনিকে খাওয়াদাওয়ার পর থাকবে। খাওয়াবে না?

-   আরিব্বাস! দারুন বুদ্ধি তো। আর বাকি দুজন?

-   উমম, শৈলেন কাকাকে বললাম পিকনিক হবে, কোনো মিউজিক ব্যবস্থা নেই। তোমার ভরসাতে ছিলাম। এত সুন্দর গান কর ট্রেনে, ভাবলাম পিকনিকে জমিয়ে শুনবো মাইকে। আর সমীর জেঠু, ইভেন্ট অর্গানাইজার। সবাই রাজি।

-   বাঃ! সাবাস রোহন।

-   তোমরা শুধু এটুকু দেখো আনন্দর জন্য যেটুকু মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি সেটা যেন ওরা জানতে না পারে। না, আমি মিথ্যেকে সমর্থন করি না। কিন্তু এতটা আনন্দ পাবার আশায় একটু মিথ্যে বললাম। আই হোপ, অন্যায় করিনি কিছু।

ততক্ষনে মাইকে সমীর জেঠু “হ্যালো, হ্যালো” বলতে শুরু করেছে। সমীর জেঠুর মেয়ে, পার্বতী মাসির ছেলে ওই যে সব বাচ্চাদের সাথে ধরাধরি খেলছে। ট্রেনের কামরা থেকে উড়ে যাওয়া সুখপাখিরা যে এভাবে পিকনিকের মাঠে প্রত্যাবর্তন করবে তা ওরা কেউই হয়তো কল্পনা করেনি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics