Sourya Chatterjee

Comedy Classics

4.5  

Sourya Chatterjee

Comedy Classics

হরে কৃষ্ণ

হরে কৃষ্ণ

4 mins
315


তেঁতুলতলায় এরকম যে একটা ঘটনা ঘটবে তা ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারে নি। বেশ ভালোই লোকজন জড়ো হয়েছে মোড়ের মাথায়। তবে লোকজনের উপস্থিতি সত্ত্বেও জায়গাটা নিস্তব্ধ , শুধু ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস আর মাঝে মাঝে মহিলাদের ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কে যেন স্মিত স্বরে বলে উঠল “কি যে সর্বনাশ হয়ে গেল!” কোনো উত্তর এলো না, শুধু দু-একজন মহিলার ক্রন্দনধ্বনি আরেকটু জোরালো হল। আবারও বেশ কিছুক্ষণ চারিদিক শান্ত। আরেকজন কেউ স্মিত কিন্তু দীর্ঘশ্বাস মেশানো স্বরে বলে উঠল “কি করে হলো এসব?” কান্না মেশানো স্বরে উত্তর এল “ভুবনদা রোজের মতোই দুপুরে চান করাচ্ছিল। এরমধ্যে..” কথা শেষ করার আগেই ডুকরে কেঁদে উঠল উত্তরদাতা। একজন আরেকজনের পিঠে হাত রেখে স্বান্তনা দিচ্ছে তখন। তারকবাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত দুটো জড়ো করে বললেন “ভালো করে দাও ঠাকুর, ভালো করে দাও। ভাগ্যিস আরো বড় বিপদ হয়নি”। সবাই এটা ভেবেই একটু আশ্বস্ত, যে আরো বড়সড় কোনো বিপদ ঘটতে পারত! শুধু হাতের উপর দিয়ে গেছে বলে রক্ষে, মাথা ফেটে গেলে কি যে হত তা ভেবেই আতঙ্কে শিউরে উঠছে সবাই। 

-   তাড়াতাড়ি চালান গাড়িটা প্লিজ! ওর হাতটা ভেঙে গেছে, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছাতে বলছি কখন থেকে । তেঁতুলতলা থেকে মাত্র মিনিট কুড়ি লাগে হাসপাতাল পৌঁছাতে। আর আপনি! ইতিমধ্যে আধ ঘন্টা লাগিয়ে দিয়েছেন! আরো কতক্ষণ লাগাবেন?

ভুবনবাবু বেশ উত্তেজিত হয়েই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল। 

-   হামি কি করব! এতো জ্যাম। হামি তো কসিস করছি।

-   রাখো তোমার কসিস! চলো তাড়াতাড়ি! 

ভুবনবাবু সত্যিই খুব চিন্তিত। রোজ এত সন্তর্পণে চান করায়! আজ কি যে হল! কি করে পড়ে গেল, কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ভুবনবাবু শুধু ভেবে চলেছে ওকে সুস্থ করে তেঁতুলতলায় না ফেরাতে পারলে কাউকে আর মুখ দেখাতে পারবে না। চোখ দিয়ে মাঝেমধ্যে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করলেও তা সঙ্গে সঙ্গেই মুছে নিচ্ছে ভুবনবাবু। এখন যে একদম ভেঙে পড়ার সময় নেই। বরং শান্ত থেকে পরিস্থিতিটা সামলানোই শ্রেয় এখন। দেখে দেখে আজই জ্যাম হতে হল রাস্তা! কোন মন্ত্রী যাবেন, তার জন্য জ্যাম! ড্রাইভার আর ভুবনবাবু অনবরত লাল কাপড় নেড়ে চলেছে! কিন্তু তাতেও একটুও ফাঁকা রাস্তা পাচ্ছেন না। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে ভুবনবাবুর, কিন্তু প্রতিমুহূর্তে সামলে নিচ্ছে নিজেকে।

অবশেষে দীর্ঘ সময় শেষে হাসপাতালের গেটের কাছে পৌঁছালো ট্যাক্সিটা। হয়তো ঘড়ির কাঁটা বলছে মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট, কিন্তু রুগীর প্রিয়জন, পরিজনদের কাছে এই সময়টাই অনেকখানি সময়। ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাতের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো কিছুতেই শান্ত হতে পারে না তারা। হাসপাতালে প্রবেশ করতে যাবে ট্যাক্সিটা, কিন্তু সেখানে আরেক বিপদ উপস্থিত হল। আজ আর বিপদ পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। একজন লোক পান চিবোতে চিবোতে বলল “এদিকের গেট বন্ধ আছে, সাউথ গেট দিয়ে ঢুকুন”! ভুবনবাবু চিৎকার করে উঠল “যা ইচ্ছে তাই নাকি!” লোকটি পরম নিশ্চিন্তে দেওয়ালে পানের পিকটা ফেলে জবাব দিল “চিৎকার করে লাভ নেই দাদা! এদিকে কাজ হচ্ছে। আপনাকে ঘুরেই আসতে হবে”। ভুবনবাবু অসহায়তা, বিরক্তির বশবর্তী হয়ে বাম হাত দিয়ে নিজের মাথার চুলের মুঠি ধরে ড্রাইভারকে বলল “সাউথ গেটে চলুন তাড়াতাড়ি, ওকে বাঁচাতে তো হবে!”

অন্য গেটটা বন্ধ থাকার দরুণ সাউথ গেট দিয়ে ঢুকেও “এমারজেন্সি” অবধি বেশ ভালোই জ্যাম! গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে গেছে ভেতরে। খুব অসহায় লাগছে ভুবনবাবুর! ট্যাক্সির সিটের উপর দুটো ঘুষি মারল সজোড়ে। অবশেষে জ্যাম কেটে “এমারজেন্সি” বিভাগের সামনে এসে দাঁড়ালো গাড়িটা। 

দরজাটা খুলে দৌড়ে “এমারজেন্সি” বিভাগে ঢুকল ভুবনবাবু। খালি ট্রলি নিয়ে একজন ওয়ার্ড বয় আসছিল রুগীকে ট্রলিতে তোলার জন্য। তার সাথে রীতিমত একবার ধাক্কাই লাগল ভুবনবাবুর। হতচকিত হয়ে ওয়ার্ড বয়টি তাকালো ভুবনবাবুর দিকে। 

-   পেশেন্ট কই!

-   ট্যাক্সিতে।

কথাটা বলেই “এমারজেন্সি” বিভাগে ছুট লাগালো ভুবনবাবু। ওয়ার্ড বয় হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল ভুবনবাবুর দিকে। ট্যাক্সি তো ফাঁকা। পেশেন্ট কই!

অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ভাঙা গলায় ভুবনবাবু চেঁচিয়ে উঠলো 

-   ডাক্তারবাবু! 

-   প্লিজ একটু ওয়েট করুন। দুজন পেশেন্ট অলরেডি রয়েছে, একজনের হেড ইনজুরি, আরেকজন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। আপনার পেশেন্টের..

নার্সের কথাটা শেষ করতে দিল না ভুবনবাবু। 

-   ওর হাতটা ভেঙে গেছে। প্রায় দু টুকরো হয়ে যাবার জোগাড়! প্লিজ বাঁচান। 

-   প্লিজ একটু ওয়েট করুন। আমরা অ্যাডমিটেড পেশেন্টদের রেস্পেকটিভ ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। আপনি পেশেন্টকে নিয়ে আসুন।

-   ট্যাক্সিতে আছে।

-   ওকে, নিয়ে আসুন। দেখুন, ওখানে ওয়ার্ড বয় আছে। ও নিয়ে আসবে।

-   সিস্টার, সিস্টার.. আমি কোলে করে নিয়ে আসব। প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করুন। 

-   ওকে, নিয়ে আসুন।

ইতিমধ্যে “এমারজেন্সি” বিভাগের পেশেন্ট বেড ফাঁকা হয়েছে। ভুবনবাবু রুগি নিয়ে ঢুকতেই হাসির রোল উঠল “এমারজেন্সি” বিভাগে। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে আর হেসে উঠছে। ভুবনবাবু উদ্বিগ্ন কণ্ঠেই বলল 

-   ডাক্তারবাবু প্লিজ! আমার গোপালের হাত ভেঙে গেছে। প্লাস্টার করে দিন, ও খুব কষ্ট পাচ্ছে।

হাসি থামিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন

-   যা খুশি, যা ইচ্ছে তাই করবেন এখানে! পাগলামো, ছাগলামো মারার জায়গা পান না! একটা মাটির মূর্তি নিয়ে চলে এসেছেন।

ভুবনবাবুর কন্ঠ আরো খানিকটা উদ্বিগ্ন হল

-   প্লিজ! ফেরাবেন না আমায়। আপনি প্লাস্টার করে দিন। আমি পয়সা দেব। প্লিজ! ফেরাবেন না।


না, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাটির গোপাল ঠাকুরের চিকিৎসা না করে ফিরিয়ে দেননি ভুবনবাবুকে। প্রথমদিকে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়রা বিড়ম্বনায় পড়লেও কিংবা তাদের মধ্যে হাসির রোল উঠলেও ভুবনবাবু তথা তেঁতুলতলার এলাকাবাসীদের বিশ্বাস, ভালোবাসা, ভাবাবেগকে সম্মান জানিয়ে ওনাদের আদরের গোপালকে “শ্রী কৃষ্ণ” নামে নথিভুক্ত করিয়ে তার ভাঙা হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। ভুবনবাবু পরের দিন তেঁতুলতলার মানুষজনের পক্ষ থেকে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স সহ সমস্ত ওয়ার্কিং স্টাফদের জন্য মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন। হাসপাতালের যারা ঈশ্বর মানেন তারা তো তারপর থেকে তেঁতুলতলার উপর দিয়ে কোথাও গেলে গোপালের মন্দিরে প্রণামও করে যান। কথায় বলে না “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!”


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy