Jeet Guha Thakurta

Comedy Classics Thriller

4.0  

Jeet Guha Thakurta

Comedy Classics Thriller

সহযাত্রী

সহযাত্রী

6 mins
689


"দাদা, কতদূর ?" উসকো-খুশকো চেহারার মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। আমার পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলেন।


বাসে এইটা খুবই পরিচিত প্রশ্ন। উদ্দেশ্য, আমি যদি কাছাকাছি নামি, তাহলে উনি জানলার সাইডটা পাবেন। কিন্তু ইনি বোধহয় সেই জাতীয় নন। কারণ আমি একদম লাষ্ট স্টপেজ পর্যন্ত যাবো শুনেও উনি আমার পাশেই জায়গা নিলেন। নিজেই বললেন, "আমি তো শিয়ালদাতেই নেমে যাবো।" সম্ভবত ইনি হলেন যাকে বলে খেজুরে আলাপ জমানো পাবলিক। তার প্রমাণও পেয়ে গেলাম একটু পরেই।


ভদ্রলোক একটু হাঁপাচ্ছিলেন। ছুটে এসে বাস ধরেছেন হয়তো। সঙ্গে ছোট্ট একটা লাগেজ ব্যাগ। সেটাকে দু'পায়ের মাঝখানে সেট করে বসিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, "অফিস থেকে ফিরছেন ?"


আমি সংক্ষেপে একটা 'হ্যাঁ' বলেই জানলার দিকে তাকালাম। গায়ে পড়ে আলাপ জমানো আমার একদম ভালো লাগে না। কিন্তু ভদ্রলোক তবু একরকম উপযাচক হয়েই আমাকে শোনালেন যে তার অফিস-টফিসের কেস নেই। তিনদিনের জন্য উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন ঘুরতে, হঠাৎই আজ ঠিক হয়েছে। বন্ধুরা শিয়ালদা ষ্টেশানে অপেক্ষা করছে ইত্যাদি। গত্যন্তর নেই বলে আমাকে বিজ্ঞের মতো সেসব শুনে যেতে হলো।


খানিক পরে ভিড় বাড়লো একটু। এইসময় বাসের সামনের দিকের জটলা থেকে একটা শোরগোল কানে এলো। এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর - "ভদ্রভাবে দাঁড়াতে পারেন না ? পিছন থেকে সমানে ঠেলে যাচ্ছেন!" প্রত্তুতরে আরেকজনের কিছু জবাব ও তার আবার পাল্টা-জবাব। এরকম চলতে লাগলো। একজন মধ্যস্থতাকারীর আওয়াজও পাওয়া গেলো, "আপনি কি নামবেন সামনে ? নাহলে ভিতরে চলে যান না, এখানে দাঁড়িয়ে গার্ড করছেন কেন ?"


আমরা বেশ পিছনের দিকে ছিলাম আর ব্যাপারটা ঠাহর করার চেষ্টা করছিলাম। চেঁচামেচিটা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার সহযাত্রী তার স্বভাবমতো শুরু করলেন, "যা-ই বলুন দাদা, মেয়েদেরও অনেক দোষ থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের অপরাধটাই বেশী থাকে অনেক সময়।"


এরকম একটা কথার সংক্ষিপ্ত জবার আর কীই বা হতে পারে। আমি বললাম, "হ্যাঁ, সে হতেই পারে।" সহযাত্রী উত্তেজিত হয়ে বললেন, "আপনি বিশ্বাস করবেন না, আমি দেখেছি এরকম যে, বউ তার স্বামীকে চার্জ করছে যে তুমি অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখো, হ্যানা-ত্যানা। এদিকে লুকিয়ে সে নিজেই হয়তো আরেকটা সম্পর্কে লিপ্ত। ঘরে ঘরে হচ্ছে মশাই আজকাল।"


আমি তার দিকে তাকিয়ে খুব চিন্তার ভান করে বললাম, "হুম।"


"এই আজকের কথাটাই ধরুন", তিনি বলে যেতে লাগলেন। "আমার বউয়ের... ওই যাকে বলে একটু উড়ু উড়ু ঝোঁক... ঠারে ঠোরে বুঝি যে স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়। আমাকে অনেকবারই বলেছিলো কেউ কেউ। আমি গা করিনি। কিন্তু আজ একদম হাতেনাতে ধরে ফেললাম। আমি যে এতো তাড়াতাড়ি আসবো, সেটা সে জানতো না। আর যাবে কোথায়। ধরে ফেলেছি। একদম খপ করে ধরেছি। আচ্ছা, এরকম মেয়েদের সাথে কী করা উচিত বলুন তো ?"


কোথায় ইনি নামবেন কে জানে, নেমে গেলেই বাঁচি এই অহেতুক আলাপচারিতার হাত থেকে। সরাসরি উত্তর এড়িয়ে আমি সৌজন্যবশতঃ একটু ছদ্ম-কৌতূহল দেখালাম, "তা, ধরে ফেলে কী করলেন আপনি ?"


"মেরে ফেললাম। অন দ্য স্পট। একদম হাপিশ।" ভদ্রলোকের আপাত-নিরীহ মুখে যেন একটা বক্রহাসি।


আমি ভালো করে তাকালাম লোকটার দিকে। কী বলতে চায় রে বাবা! মাথার গন্ডগোল আছে নাকি ? কিন্তু দেখে তো সেরকম লাগছে না। ঠিকঠাক পোশাক-আশাক পড়া, চুলটা একটু যা অবিন্যস্ত, চেহারাটা একটু বিধস্ত। কিন্তু ঠিক পাগল বলে মনে হয় না।


"মেরে ফেললেন মানে ?" আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।


"আমার ভগ্নিপতি, পুরী থেকে একটা পাথরের জগন্নাথ এনে দিয়েছিলো। বেশ ভারী মূর্তিটা। সামনেই টেবিলের উপর রাখা ছিলো। ওইটা তুলেই মাথার পিছনে এক ঘা - ব্যাস, শেষ। চেঁচানোরও সময় পায়নি। ক্লিন খালাস। এতো মটকা গরম হয়ে গিয়েছিলো, যে ওই সময় আর কিছু আমার মাথাতেই আসেনি। আমার অনুপস্থিতিতে আমারই ঘরে একটা ছেলের সাথে - কী বলবো আর। ছেলেটা অবশ্য পালিয়েছে।"


লোকটার কথাবার্তা শুনে এবার আমার একটু ভয় লাগতে শুরু করলো। কী বলছে লোকটা ? একটা খুন করে এসে আরামসে আমার পাশে বসেছে ? আমার কি চিৎকার করে লোক জড়ো করা উচিত এক্ষুনি ? বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু বুকের ভেতরটা ডিবডিব করতে লাগলো। ঢোঁক গিললাম আমি। মনে পড়লো লোকটা তখন কেমন যেন হাঁপাচ্ছিলো। ছুটে পালিয়ে এসেছে নিশ্চয়ই। শহর ছেড়েই হয়তো পালাচ্ছে।


"মারা গেছে পুরো ?" ঠিকঠাক নিশ্চিত হতেই আমি প্রশ্নটা করলাম নীচু স্বরে। চলন্ত বাসে আশা করি অন্য কেউ শুনতে পাচ্ছে না এসব।


"হ্যাঁ! বাঁচা গেছে।" ভদ্রলোক ঝাঁঝের সাথে বললেন, "মেয়েদের শিক্ষা, নারীস্বাধীনতা ইত্যাদি যেমন অনেক ভালোও করছে, তেমনি আরেকদিকে... এইসব। এরকম বউ থাকার থেকে না-থাকা ভালো মশাই।"


"দেখি টিকিটটা -।"


"একটা শিয়ালদা। ব্রিজের আগে বলবেন একটু।" ভদ্রলোক অভ্যস্ত হাতে টিকিটের টাকাটা দিলেন কন্ডাকটরকে। আমার টিকিট অবশ্য কাটাই ছিলো। কন্ডাকটর ছেলেটা পিছনের দিকে এগিয়ে যেতেই আমি কৌতুহলবশতঃ জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনারই বউ ছিলো ?"


"হ্যাঁ, সেটাই তো লজ্জার দাদা। আট বছরের বিয়ে আমাদের। সেই বউকে অন্যের সাথে এভাবে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।"


আমার গলা দিয়ে আর কোনো স্বর বেরোলো না।


তিনি নিজেই একটু পরে বললেন, "নাড়ি ধরেও দেখে নিয়েছি, বেঁচে নেই ফর শিওর। মেরে ফেলতে তো চাইনি, কিন্তু কী করবো বলুন - হুট্ করে হাত উঠে গেলো।"


এই প্রথম যেন একটু অনুতাপের সুর দেখলাম ভদ্রলোকের গলায়। আমার কী করণীয় ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এই সভ্যমতোন দেখতে লোকটা বউকে খুন করে পালিয়ে এসেছে। আর আরামসে সেটা জাহিরও করছে! আমি চেঁচাতেও ঠিক সাহস পেলাম না। এর মেজাজ ও হস্তশিল্পের যা নমুনা শুনলাম, তাতে আমার দৃঢ় সন্দেহ হলো যে এর কিছু মানসিক সমস্যা নিশ্চয়ই আছে। ওরকম একটা ব্যাগ। তার পকেটে ছুরি-টুরি থাকতেই পারে। দেবে বসিয়ে আর আমি অক্কা। তার চেয়ে চুপটি করে বসে থাকাই শ্রেয়।


কয়েক মুহূর্ত পরে ভদ্রলোক আবার বললেন, "কিন্তু ধরতে কিছুতেই পারবে না। অতো সহজ নয়।"


আমি শুধু একটু তাকালাম তার দিকে। তিনি বলে চললেন, "পাথরের ওই জগন্নাথটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে চলে এসেছি। এই-যে, আমার এই ব্যাগের মধ্যে। কোনো নির্জন জায়গায় ফেলে দেবো, পুলিশ হাতিয়ারই খুঁজে পাবে না। দ্বিতীয়ত, যখন লোকজন জানাজানি হবে, পুলিশ আসবে, আমি তখন বন্ধুদের সঙ্গে ট্যুরে আছি, অনেকদূরে। তো আমার ওপর সন্দেহই আসবে না, জেরা তো পরের কথা।"


"আপনাকে কেউ দেখেনি বাড়িতে আজ ঢুকতে ? মানে ওই সময়ে ?"


"ফ্ল্যাট তো।" ভদ্রলোক একদম ঝানু অপরাধীদের মতো ব্যাখ্যা করলেন, "নীচের কলাপ্সেবল খোলাই থাকে দিনের বেলা। সিসিটিভি কিছু নেই। সিঁড়ি বেয়ে উঠে জাষ্ট দোতলায়। কারুর সাথে মুখোমুখি হতে হয়নি। আর আশেপাশের দোকানও আজ বন্ধ ছিলো।"


আমি দ্রুত ভেবে দেখলাম, এনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো প্রমান হতে পারে ওই পাথরের মূর্তিটাই। যেটা উনি সঙ্গের ব্যাগে রেখেছেন। কিন্তু আমার এসবে জড়ানো উচিত কিনা ভাবছিলাম। উনি তখন ফিসফিস করে একটা কথা বললেন, কিছুটা স্বগতোক্তি, কিছুটা আমাকে সাফাই দেওয়া। বললেন, "একমাত্র সেই লাফাঙ্গা ছেলেটা পালিয়ে যাবার সময় আমাকে দেখে রেখেছে। যদিও একদমই অচেনা মুখ। তাছাড়া সে নিজেই সবচেয়ে আগে ফাঁসবে যদি সে এই নিয়ে সাক্ষ্য দিতে আসে। তাই নিজেই নিজের মুখ বন্ধ রাখবে সে।" কথাটা শেষ করে আবার একটা বক্রহাসি ঠোঁটে ঝোলালেন ভদ্রলোক, আর আমার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকালেন। যার অর্থ আমি বুঝলাম না।


কিন্তু একটা চিন্তা বিদ্যুতের মতো মাথায় ঝিলিক মেরে গেলো তখনই। ভদ্রলোক আমাকে এতো কথা কেন বললেন ? আমি তো চাইলে পুলিশকে এসব কথা জানিয়ে দিতে পারি। তাহলে কি কোনো গূঢ় অভিসন্ধি আছে ওনার ? আমি ঝট করে ওই ব্যাগের কাছ থেকে আমার পা-টা সরিয়ে নিলাম।


"ছেলেটার পরিচয়টা একটু জানতে পারলে ভালো হতো, জানেন।" ভদ্রলোক ক্ষেদ ভরা কণ্ঠে ব্যক্ত করলেন আবার। "হতে পারে আমার বউটার স্বভাব-চরিত্র হয়তো ভালো ছিলো না। কিন্তু ছেলেটাকেও ছাড় দেওয়া উচিত নয়। ভেবে দেখলে, তার দোষও কিছু কম নয় এক্ষেত্রে।"


কী জবাব দেবো বুঝতে পারছিলাম না। এইসময় বাইরেটা দেখেই হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বললেন, "শিয়ালদা আসছে, নামতে হবে। এর পরের চ্যাপ্টারে ছেলেটাকেও নাহয় মেরে দেবো, বুঝলেন। কোনো সাক্ষীই রাখবো না। তবে না জমবে খেলা!"


"পরের চ্যাপ্টারে ? আপনি লেখক নাকি ?"


"ইয়েস। থ্রিলার লিখছি একটা। একদম চরিত্রদের ভেতর ঢুকে যেতে হয় তো। নাহলে ঠিক প্রাণবন্ত হয় না লেখাটা। আচ্ছা, আসি তাহলে। স্টপেজ এসে গেছে।"


লোকটা দরজার দিকে এগিয়ে গেলো তার ব্যাগটা নিয়ে। আর আমি ওইখানে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy