যমের অরুচি
যমের অরুচি
যমালয়ে স্বাগতম
চোখটা খুলতেই দেখলাম চারিদিক অন্ধকার। প্রথমে ভয় হল, ভাবলাম অন্ধ হয়ে গেলাম না তো! তারপরেই মনে হল ধুরর ওই ছোটখাটো এক্সিডেন্টে কি আর কেউ অন্ধ হয় নাকি, নিশ্চয় যেখানে আছি সেই জায়গাটাই অন্ধকার। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমার এখন থাকার কথা হয় নিজের বাড়িতে নয়তো হাসপাতালে আর সেখানে এমন ভয়ঙ্কর অন্ধকার হবে কি করে!
আর বেশি ভাবতে হলোনা, তার আগেই একটা তীব্র আলো এসে পড়ল আমার শরীরের ওপর। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আলোটা সোজাসুজি শুধু এসে পড়ছে আমার ওপরেই, চারপাশটা আগের মতোই অন্ধকার। কি হল ব্যাপারটা! মনে পড়ে গেল টিভিতে দেখেছি যে পুলিশি জেরার সময় ঠিক এইভাবেই অপরাধীর মাথার ওপর আলো জ্বালিয়ে জেরা করা হয়। কি কান্ড, হামি তো কুছু করিনি!
খট… আরেকটা আলো জ্বলে উঠল সামনে। চমকে উঠে দেখলাম একটা লোক বসে আছে সামনের চেয়ারে। যাহ বাবা, এ আবার কখন এলো! লোকটা চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে, জল না থেকেও বিষম খেলাম আমি। লোকটার চোখদুটো জবা ফুলের মত লাল। লোকটার মাথায় দুটো এত্তো বড় শিং, হ্যাঁ সত্যিই বলছি ওদুটো শিং, একমাথা কোঁকড়ানো চুলের ভেতর থেকে সগৌরবে মাথা উঁচিয়ে আছেন তেনারা। লোকটার নাকের নীচে পুরুষ্ট একটা গোঁফ। আর সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল লোকটার গায়ের চামড়াটা কেমন যেন সবুজ সবুজ। কালো জোব্বার মত পোশাকের ভেতর থেকে ওই লাল চোখদুটো যে ঠিক কি বলতে চাইছে তা আমার কাছে কুয়াশার মতোই দুর্ভেদ্য ঠেকলো। ওহ হ্যাঁ, লোকটার আশেপাশে কুয়াশার মত সাদা কি যেন জমাট বেঁধে আছে। যাহ বাবা বাড়ি নয়, হসপিটাল নয়, মায় রাস্তাও নয়, এ কোন নাটকের মঞ্চে এসে পড়লাম রে বাবা! আর পড়লাম তো পড়লাম, কিভাবে পড়লাম!
একটা ঢোঁক গিললাম আমি। কোনোমতে আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলাম, "এটা কোনো জায়গা স্যার?"
"অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমারা আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।" বজ্রগম্ভীর কিন্তু যান্ত্রিক স্বরে বলল লোকটা।
অবাক হলাম আমি, "কি!"
লোকটা আগের মতোই যান্ত্রিক গলায় বলে উঠল, "যমালয়ে আপনাকে স্বাগত।"
"যমালয়!" আঁতকে উঠলাম আমি, "আরে মশাই কি বলছেনটা কি! আপনি কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন?"
"নো… নট এট অল।"
"হুহু বললেই হলো… যমালয়ে নাকি ইংরেজি বলবে! ইয়ার্কি পাতা হ্যা মশাই!"
"যমালয়ে ইংরেজি কেন নয়?"
লোকটার প্রশ্নে আর বাক্যস্ফূর্তি হলো না আমার, সত্যিই তো আমরা সাধারণ মানুষরা যদি একসাথে একাধিক ভাষা বলতে পারি তাহলে যমালয়ের লোকেরা কেন বলতে পারেনা!
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল লোকটা। আমি চমকে উঠলাম। লোকটা তার ওই লাল কুতকুতে চোখ দুটো নিয়ে চোখ রাখলো আমার চোখে,
"শুনুন, আপনাকে কয়েকটা কথা বলার আছে।"
"ব...বলুন।"
"আমি সাধারণত এভাবে সরাসরি কারুর সাথে দেখা করিনা কিন্তু আপনার ব্যাপারটা আলাদা।"
"কিরকম!"
"আমার লোকেরা ভুল করে আপনাকে এখানে নিয়ে চলে এসেছে। আপনার পাপের ঘড়া এখনও পূর্ণ হয়নি, চিত্রগুপ্ত তাই এখনই কোনো শাস্তি বিধান করে উঠতে পারছে না।"
"ম… মানেটা কি! রিক্সার সাথে ধাক্কা লেগে কেউ মরে নাকি?"
"ওটাই তো বললাম, ভুল বশত অন্য একজনকে আনতে গিয়ে আপনাকে তুলে নিয়ে চলে এসেছে আমার লোকেরা। তবে চিন্তা করবেন না, আপনাকে আবার আমরা ফেরৎ পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি, তবে কিছু সময় লাগবে তার জন্য।"
"ততক্ষণ কি করব আমি!"
"এখানে বসে অপেক্ষা।"
"পাগল নাকি! এই অন্ধকার ঘরে বসে অপেক্ষা আমার পোষাবে না, আমি কি যমালয়টা একটু ঘুরে দেখতে পারিনা?"
"না।"
"এ কেমন কথা, আমি কি করব ততক্ষণ।"
"বসে থাকুন, ঘুমোন… যা ইচ্ছে আপনার।"
"ধুসস...পারবো না। আচ্ছা আপনারা ভুল করে আমাকে যে নিয়ে চলে এলেন তার জন্য ক্ষতিপূরণ কে দেবে?"
"যমালয় থেকে আবার সশরীরে পৃথিবীতে ফিরতে পারবেন এটাই যথেষ্ট নয় কি?"
"একটুও নয়, ফিরতে কে চায়! পৃথিবীতে বড় চাপ বুঝলেন, মাঝেমাঝে মনে হয় সবকিছু ছেড়ে পালাই। তাই এখন যখন সুযোগ পেয়েছি আর ফিরে যাবো না সেখানে।"
"যাবো না বললে তো হয়না, যেতেই হবে। নয়তো আমাদের সিস্টেম গন্ডগোল হয়ে যাবে।"
"কিন্তু আমার যে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছেনা…!"
"এহেম এহেম… কি যেন ক্ষতিপূরণের কথা বলছিলে… কি ক্ষতিপূরণ চাই তোমার? এখানে থাকার বায়না করা বাদে বলবে।"
"উম্ম… তাহলে চাই আপনার একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ।"
"ইন্টারভিউ! আমার!"
"হ্যাঁ, রাজি?"
"কিন্তু আমার তো অনেক কাজ পড়ে আছে।"
"ক্ষতিপূরণ…"
"আচ্ছা আচ্ছা তাড়াতাড়ি সারবে কিন্তু।"
"ওকে।"
সাক্ষাৎকার পর্ব
আমি - আচ্ছা তবে গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। যমরাজ আপনার ছেলেবেলার কথা কিছু বলুন।
যম - ছেলেবেলার কথা কি আর বলবো বিশেষ, কত যুগ আগের কথা সে কি আর মনে আছে!
বাবা ছিলেন সূর্যদেব বিবস্বান আর মা শরন্যা। আমি আর আমার বোন যমুনা একসাথে জন্মেছিলাম, মানে তোমরা যাকে ওই যমজ বলো আরকি। আমাদের আরও দুই ভাই ছিলো তবে তাদের সাথে আমার ঠিক বনিবনা হত না। যমুনাই তাই ছিলো আমার সুখ দুঃখের সঙ্গী, আমাদের আদরের বোন।
আমি - আচ্ছা যমরাজ আপনারও মৃত্যু হয়েছিল, এ কথা কি সত্যি?
যম - আলবাত, নয়তো এখানে এলাম কি করে!
আমি - এই বিষয়ে আরেকটু কিছু যদি বলেন…
যম - তাহলে গল্পটা বলি শোনো। ঋষি মৃকন্ডু আর তাঁর স্ত্রী মধুমতি ছিলেন দেবাদীদেব মহাদেবের খুব ভক্ত। মহাদেবের আশীর্বাদে এদের এক পুত্র সন্তান জন্মায় যার নাম মার্কণ্ডেয়। মার্কণ্ডেয়র ভাগ্যে লেখা ছিল যে সে খুব উচ্চ মেধাসম্পন্ন হবে কিন্তু জীবনকাল হবে খুবই স্বল্প। চিন্তায় পড়ে গেলেন ঋষি আর তাঁর পত্নী। তারা দিনরাত একাগ্র চিত্তে মহাদেবের কাছে পুত্রের আয়ু প্রার্থনা করতে লাগলেন। এদিকে মার্কণ্ডেয় যত বড় হতে লাগলো সেও মহাদেবের উপাসনা করতে লাগল।
এরপর এলো সেই দিন, মার্কণ্ডেয় সেদিন ষোলো বছরে পা দেবে। ভাগ্যের লিখন অনুযায়ী ওই দিনই হবে তার মৃত্যুদিন। আমার দূতেরা এসে খবর দিতেই গেলাম মার্কণ্ডেয়কে আনতে… আমার কাজই তাই। গিয়ে দেখি মার্কণ্ডেয় একমনে শিবলিঙ্গের সামনে বসে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। আমিও আমার ফাঁস প্রস্তুত করে ছুঁড়ে দিলাম মার্কণ্ডেয়র দিকে, কিন্তু মহাদেবের চাতুরীতে সেই ফাঁস গিয়ে আটকালো শিবলিঙ্গের গায়ে। শিবলিঙ্গ থেকে আবির্ভুত হলেন স্বয়ং দেবাদীদেব। ক্রোধে অগ্নিশর্মা তিনি। ক্ষমা চাইলাম আমি, কিন্তু তিনি শুনলেন না। তার ক্রোধের আগুনে শেষ করে ফেললেন আমাকে।"
আমি - তারপর?
যম - তারপর আর কি, বাকি দেবতারা দেখলেন মহাবিপদ। আমি না থাকলে মৃত্যুকে আনার মত অপ্রিয় কাজটা কে করবে! আসলে কি জানো মানুষের মৃত্যু হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু কোনো দেবতাই প্রত্যক্ষ ভাবে সেই মৃত্যুর সাথে জড়িত থেকে বদনামের ভাগীদার হতে চায় না । সবাই মানুষের কাছে ভালো সাজতে চায়। তাই তো তাদের নির্দেশে মহাদেব আমাকে আবার জীবিত করলেন, তবে অন্যরূপে। দেবতার মর্যাদা দেওয়া হল আমাকে, কিন্তু সেও সান্ত্বনা পুরস্কারের মত বলতে পারো। স্বর্গে থাকতে দেওয়া হলোনা আমায়, আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল এখানে।"
আমি - আচ্ছা আপনার রাগ ওঠেনি তখন? মনে হয়নি আপনাকে চক্রান্ত করে এই অন্ধকার পাতালে ঠেলে দেওয়া হয়েছে?
যম - রাগ হতো, ভীষণ রাগ হতো একসময়। রাগে চিৎকার করতাম পাগলের মত, মনে হত সবকিছু জ্বালিয়ে দিই। সব কিছু ছারখার করে দিই। কিন্তু তারপর…
আমি - তারপর কি?
যম - ভেবে দেখলাম, সব কিছুরই একটা না একটা ভালো দিক থাকে। স্বর্গে থেকে কি লাভ হত আমার! ওখানে একসাথে সব দেবতারা থাকে, যখন তখন ঝগড়া লাগে ওদের মধ্যে। দেবীদের মধ্যে রূপ আর ক্ষমতা নিয়ে চুলোচুলিও কিছু কম হয়না। আর আমি একলা এই গোটা পাতালপুরীর রাজা। এখন আমার অঙ্গুলী হেলনে চলে এই গোটা সাম্রাজ্য।
আমি - হ্যাঁ, কিন্তু তবু… যতই হোক আপনি স্বয়ং সূর্য দেবের সন্তান, যে সূর্যদেব কিনা আমাদের সকল আলোর উৎস। সেখান থেকে এই অন্ধকার দুনিয়াতে থাকতে মন্দ লাগেনা?
যম - অন্ধকার না থাকলে আলোর কদর কি করে বুঝবে হে? আমার তো মনে হয় আমি বাবার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পেরেছি। সত্যিকারের বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছি।
আমি - সত্যিই যমরাজ এভাবে তো কখনও ভেবে দেখিনি।
যম- হুমম, আর তাছাড়া এই অন্ধকারে থেকেও আমার চিত্রগুপ্তের মত বিশ্বস্ত সঙ্গী আছে, বন্ধু আছে অগ্নির মত। আর কি চাই আমার?
আমি - তা ঠিক, একজন প্রকৃত বন্ধু থাকলে আর কিছুর প্রয়োজন হয়না আমাদের।
এবার আপনার পরিবারকে নিয়ে কিছু বলুন।
যম - বলবো না। (ক্রুদ্ধ স্বরে)
আমি - কেন?
যম - বলার আর কি আছে ছেলেমেয়েগুলো তো গবেট একেকটা, কোনো কাজকর্ম করেনা। আর মহারাণী তো সারাদিন মহারাণীর মতো থাকে অঙ্গ সজ্জা নিয়ে। এই বুড়ো মানুষটার খোঁজ কি আর কেই রাখে ওরা!
আমি - আহা আপনি বুড়ো হতে যাবেন কেন! আপানি তো স্বয়ং যমরাজ; জরা ব্যাধি সব আপনার হাতের মুঠোয়।
যম - হাতের মুঠোয় কিছুই নয়। কাল, জরা, ব্যাধি, ক্রোধ এবং অসুয়া ওরা আমাকে সাহায্য করে মাত্র, আমি ওদের নিয়ন্ত্রক নই। আমি সবাইকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়ায় বিশ্বাসী। আমার মতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কাজের অনুপ্রেরণা কমিয়ে দেয়।
আমি - বাহ্ চমৎকার একটা কথা বললেন তো মহারাজ।
যম - হেঁ হেঁ
আমি - আচ্ছা যমরাজ আপনি তো হিন্দুদের মৃত্যুর দেবতা, অন্য ধর্মের মৃত্যুর দেবতাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
যম - আরে দাঁড়াও দাঁড়াও বাছা, কি বললে আমি হিন্দুদের মৃত্যুর দেবতা! হাঃ হাঃ হাঃ (যমরাজের অট্টহাস্যে কেঁপে উঠল গোটা ঘরটা)
আমি - হাসছেন কেন?
যম - হাসবো না! তোমায় কে বললো যে আমি হিন্দুদের দেবতা? শোনো হে বাছা কোনো দেবতা কোনোদিনও গিয়ে বলেননি যে এই তোমরা অমুক ধর্মের তোমরা তুসুক ধর্মের… এসব তোমরা মানুষরা বানিয়েছো, এর সাথে আমাদের জড়িও না বাপু।
আমি - মানে?
যম - মানে দেবতার কোনো ধর্ম হয়না বুঝলে। মানুষ নিজের ইচ্ছেতে ধর্ম বানিয়েছে, আর সেই অনুযায়ী দেবতাদের একেকটা নাম দিয়ে দিয়েছে নিজেদের মতন করে। আমি যেমন তোমার মৃত্যুর দেবতা, তেমন অন্য কোনো দেশের অন্য কোনো ধর্মের আরেকজনেরও তাই।
আমি - তাহলে আপনার এই বেশ… এতো হিন্দু পুরাণের যেমনটা পড়েছি ঠিক তেমনটাই!
যম - হুমম। কারণ আমার আসল যা রূপ তা দেখলে মানুষ সহ্য করতে পারবে না। তাই যে যেমন রূপে আমাকে কল্পনা করতে অভ্যস্ত আমাকে সেই রূপেই তার সামনে যেতে হয়।
আমি - তারমানে আমি এখন আপনাকে যে রূপে দেখছি সেটা সত্যি নয়?
যম - নাহ, এটা মায়া।
আমি - ওহ।
বড্ড কনফিউসিং (মনে মনে)
আচ্ছা যমরাজ আপনিও দেবতা কিন্তু সমগ্র পৃথিবীতে আপনার একটামাত্র মন্দির কেন? আর যদিও বা আছে তাতেও তো সবাই যেতে ভয় পায়। আপনার রাগ হয়না?
যম - তুমি কি আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ?
আমি - আমি? কই নাতো।
যম - আমাকে দেখার আগে পেতে?
আমি - উমম… তা একটু পেতাম বৈকি।
যম - জানি। আসলে মানুষ মনে করে তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, তাদের অজ্ঞাত কিছুই নেই। কিন্তু এটা তো সত্যি নয়, এমন অনেক কিছু আছে যা মানুষের জ্ঞানের পরিধিতে নেই। আর এখান থেকেই মানুষের ভয়ের উৎপত্তি। মানুষ হেরে যেতে ভয় পায়; যে জায়গাটা আসলে তার অজ্ঞানে থেকে গেছে সেটাকে মনে মনে সে তার পরাজয়ের জায়গা বলে ভাবে। মৃত্যুও ঠিক তাই, মানুষ বারেবারে নানা কৌশলে মৃত্যুকে জয় করতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। আর তাই মৃত্যু তার কাছে পরিণত হয়েছে তার হারের জায়গায়, তার ভয়ের জায়গায়।
এবার তুমিই বলো মৃত্যুর দেবতার আরাধনা মানুষ করবে কোন সাধে? আর আমিই বা রেগে কি করব! তোমরা আমার সন্তান, তোমরা অবুঝ, কিন্তু আমি তো নই।
আমি - তারমানে আপনি বলছেন মৃত্যুকে ভয় পাওয়া অনুচিৎ?
যম - উচিৎ অনুচিৎ এর কথা আমি বলছিনা। আমি বলছি মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। জন্মকে যদি ভয় না পাও তাহলে মৃত্যুকে কিসের ভয়?
আমি - কি যে বলেন না আপনি, জন্মকে খামোকা ভয় পেতে যাবো কেন! জন্ম তো আনন্দ নিয়ে আসে।
যম - হাঃ হাঃ হাঃ (আবার যমরাজের অট্টহাসিতে কেঁপে উঠল আমার চেয়ারটা।)
আমি - হাসলেন কেন?
যম - হাসবো না? জন্ম হলে যে মৃত্যু অনিবার্য। মানুষ যে মুহূর্তে জন্মাচ্ছে সেই মুহূর্ত থেকে তার মৃত্যুর কথা লেখা হয়ে যাচ্ছে আমার খাতায়। জন্ম মানেই মায়ার দুনিয়ায় তোমার প্রবেশ, সেখানে কতরকম মায়া ওৎ পেতে আছে তোমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরার জন্য। আর তাই ভয় যদি পেতেই হয় তাহলে মৃত্যুর চেয়ে বেশি তো ভয় পাওয়া উচিৎ জন্মকে।
আমি - আমার মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে… বলছি তাহলে আমাদের কি করা উচিৎ?
যম - বেশি কিছুনা, শুধু মৃত্যু নিয়ে অতিরিক্ত ভয় না পেয়ে, জীবৎ কালে মৃত্যুর পর কি হবে সেই নিয়ে এটা সেটা না ভেবে, তার জন্য হাজারটা আচার অনুষ্ঠান না করে মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করতে শেখো। মৃত্যু তো আসবেই একটা না একটা দিন তাই তাকে নিয়ে অহেতুক জীবনকালের সময় নষ্ট করবে কেন! ওই সময়টা ভালো ভালো কাজ করো, যাতে দেশের দশের হিত হয়। বুঝলে?
আমি - হুঁ।
যম - আর কানে কানে একটা কথা বলি শোনো ওই যে তোমরা মৃত্যুকে নিয়ে হাজার রকম আচার অনুষ্ঠান পালন করো না, বলো না যে ছেলের হাতে আগুন দিলে নাকি স্বর্গে পৌঁছাবে… ওসব আসলে কিছুই নয় বুঝলে? সবই তোমাদের মনগড়া। তোমরা যা পাপ করবে যা পুণ্য করবে, সবকিছুর হিসেব রাখা তোলা হয়ে যাচ্ছে আমার খাতায়। মৃত্যুর পর শাস্তি বা শান্তি সবই পাবে সেই অনুযায়ী, কাজেই ওসব আচার পালন করা বৃথা।
আমি- আচ্ছা আচ্ছা। আর…
যম - আর কোনো আর নয়, তোমার ফেরার সময় হয়ে গেছে। আমাকেও ফিরতে হবে কাজে।
আমি - কিন্তু…
যম - উঁহুঁ, নো কিন্তু। সময় শেষ। চলো টাটা।
এই বলে আমার চোখের সামনে থেকে হুশ করে ভ্যানিশ হয়ে গেলেন যমরাজ।
মর্ত্যে ফিরল মৃত মানুষ
চোখের পাতাদুটো ভীষণ ভারী হয়ে আছে, কোনোমতে কষ্ট করে খুললাম। আর খুলতেই দেখলাম একটা লুঙ্গি পরা লোক ঝুঁকে আছে আমার মুখের ওপর। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই সে তার পান খাওয়া দাঁত গুলো বের করে বলল, "বাঁচালেন দিদিমণি, কি ভয়টাই না পেয়ে গেছলুম!"
পাশ থেকে বাজার ফেরৎ এক জ্যেঠিমা ফোড়ন কাটালেন, "আজকালকার ছেলেমেয়েরা সত্যিই অদ্ভুত, সব ফুলের ঘায়ে মুর্চ্ছা যায়!"
জ্যেঠিমার কথা শুনেই চকিতে আমার মনে পড়ে গেল সব কিছু। বাড়ি থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গেছিল বলে তাড়াতাড়ি সাইকেল চালাচ্ছিলাম, বাস স্ট্যান্ডের কাছে একটা রিক্সার সাথে আচমকা ধাক্কা লাগে। তারপর…
তারপরের যে অংশটা মনে পড়ছে… হেঁ হেঁ। ভাবলাম আপনাদের কাছে গপ্পোটা করেই ফেলি, এতো কষ্ট করে এমন একজন পার্সোনালিটির ইন্টারভিউ নিলাম আর সেটা গোপন রাখলে চলে! এবার বিশ্বাস করবেন কিনা সেটা আপনাদের ব্যাপার।