করোনা মোকাবিলায় প্রফেসর শঙ্কু
করোনা মোকাবিলায় প্রফেসর শঙ্কু
সেদিন পার্কের কাছে হঠাৎ প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে দেখা। মাথায় বিরল পক্বকেশ, মুখে সেই লম্বা সাদা দাড়ি। পরনে হাফ হাতা পাঞ্জাবি। একটা সুতোর আগায় একটা ম্যাগনেট বেঁধে পেন্ডুলামের মতো ঝুলিয়ে সেটা পর্যবেক্ষণ করছেন। দেখেই চিনতে পারলাম, প্রফেসর শঙ্কু না ?
ভদ্রলোক নিজের মনেই কী যেন বিড়বিড় করে বলছিলেন। আমি ডেকে বললাম, "প্রফেসর কী ব্যাপার - আপনি মাস্ক পড়েননি ? আপনাদের বয়সটাই তো সবচেয়ে রিস্কে আছে।"
"রিস্ক ? কীসের রিস্ক ?" প্রফেসর মানুষ তো। প্রথমটায় তাই হয়তো ঠাহর করতে পারলেন না।
"করোনা, করোনা। ওই যাকে সাধুভাষায় কোভিড বলছে আরকি। ভীষণ ছোয়াঁচে ভাইরাস জানেন তো ? মাস্ক না পড়লেই যেকোনো দিক থেকে দুম করে অ্যাটাক করতে পারে।"
"ওহ তাই বলো, করোনা! ওসব ভাইরাস তো আমার কিছুই করতে পারবে না।"
"কেন ?"
"দেখাচ্ছি।" এই বলে প্রফেসর ম্যাগনেটখানা গুটিয়ে পাঞ্জাবির একটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর দেখলাম অন্য পকেট থেকে ছোট্ট একটা বোতলের মতো কিছু বার করলেন।
আমি বললাম, "আরে - ওসব হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বড়ো জোর হাতটা নাহয় পরিষ্কার করলেন। কিন্তু নাক-মুখের কী হবে ? তার জন্য তো একটা মাস্ক লাগবে। সেও N95 মাস্ক হলে ভালো হয়।" আমি টিভি দেখে দেখে যেটুকু শিখেছি, সেই জ্ঞানটুকুই সুযোগ পেয়ে ঝেড়ে দিলাম।
"এটাকে তোমার হ্যান্ড স্যানিটাইজার বলে মনে হলো ?" প্রফেসর দেখলাম বেজায় চটে গেলেন আমার কথা শুনে। "জানো এটার নাম কী ? এটা হলো আমার আবিষ্কৃত অ্যান্টি ভাইরাল জেল। স্নানের আগে এটা দু'ফোঁটা জলের মধ্যে ফেলে দিলে পরবর্তী ছাব্বিশ ঘন্টা সারা শরীর ভাইরাসমুক্ত থাকবে। ভাইরাস গায়ে এসে লাগলেও সঙ্গে সঙ্গে মরে যাবে। তোমাদের বিজ্ঞান এসবের খোঁজ পায়নি এখনো। রোজ এটা আমি স্নানের সময় ব্যবহার করি।"
আমি হাঁ হয়ে গেলাম প্রফেসরের কথা শুনে। "বলেন কী ? তাজ্জব আবিষ্কার তো।"
"হ্যাঁ। অনেক গবেষণা করতে হয়েছে এটা তৈরী করার জন্য। গত বছর জুলাই মাসে চীনের হুয়ান শহরে আমার একটা কনফারেন্স ছিলো। সেখানে একদল বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচয় হয় যারা বাদুড়ের উপর কিছু এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন। ওদের সঙ্গে থাকার সময়ই আমি নিজের সুরক্ষার জন্য এই ভাইরাসনাশক জেলটা তৈরী করি। সেটা এখন কাজে লেগে যাচ্ছে। এতে আছে হিং, রুবিডিয়াম সালফেট, মারকারি এক্সট্র্যাক্ট, সর্পগন্ধা গাছের পাতা আর কিছুটা জিলিপির রস।"
"জিলিপির রস ?" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
"হ্যাঁ, ওই সলিউশনের বেস-টা বানাবার জন্য।"
"ও আচ্ছা। মারাত্মক জিনিষ বানিয়েছেন তাহলে। এরকম কিছু যদি মার্কেটে পাওয়া যেত, খুব ভালো হতো। নাহলে আমাদের যে কী হবে!"
প্রফেসর দয়া-পরবশ হয়ে আমাকে ওই ছোট্ট বোতলটা দিয়ে বললেন, "রাখবে তুমি ? রাখতে পারো চাইলে। আমার অসুবিধা হবে না।"
আমি অসংখ্
য ধন্যবাদ দিয়ে বোতলটা হস্তগত করলাম। মনে হলো কুবেরের ধন পেয়ে গেছি। প্রফেসরকে বললাম, "সত্যিই বিশাল আপনার প্রতিভা। আপনি এমন একটা মেশিন আবিষ্কার করতে পারেন না, যাতে দূর থেকেই বোঝা যায় কেউ করোনার রোগী কিনা ?"
প্রফেসর তার বাঁহাতের কব্জিটা দেখিয়ে বললেন, "এটা তাহলে কী ?" দেখলাম ওনার কব্জিতে ঘড়ির ডায়ালের মতো ছোট্ট একটা যন্ত্র আটকানো। সবুজ রেডিয়ামের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে সেটা থেকে।
"কী এটা ?" জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
"এটা হলো করোনা-নির্ণক-কম্পাস। চারদিকে দশ মিটারের মধ্যে কোনো করোনার রোগী থাকলে এটার ডায়াল লাল রঙের হয়ে যাবে। আর ডায়ালের কাঁটাটা ঘুরে গিয়ে দিক নির্দেশ করবে কোনদিকে সেই রোগী আছে।"
আমার মুখ থেকে কথা সরছিলো না। হতভম্ব হয়ে আমি প্রফেসরকে নমস্কার করে বাড়ি ফিরে এলাম। মনে মনে ভাবলাম, উচ্চ মাধ্যমিকে যদি সায়েন্সটা ভালো করে পড়তাম, আজ তাহলে সারাক্ষণ মুখে মাস্ক লাগিয়ে হাঁফাতে হতো না।
পরদিন সকালে উঠেই আগে এক বালতি জলে ওই অ্যান্টি ভাইরাল জেল দু'ফোঁটার জায়গায় চারফোঁটা মিশিয়ে সুন্দর করে স্নান করে নিলাম। বেশ দারুন একটা গন্ধ অনুভব করলাম জলে। যেন সব দূষিত পদার্থ সরে গেলো চারপাশ থেকে।
স্নান করে হিরোর মতো বাইরে বেরোতে পারলাম সেদিন। মাস্ক ছাড়াই, নিশ্চিন্তে। নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো লাগছিলো। আনন্দের আতিশয্যে চেনা-অচেনা বহু লোককে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, "সাহস রাখো, একদিন এই অভিশাপ যাবেই যাবে।"
কোয়ারেন্টাইনে যা যা শখ বুকে চেপে বসে ছিলো, সব মেটালাম। একটা গোটা কবিরাজি কাটলেট খেলাম বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে। মিষ্টির দোকান থেকে গোটা চারেক রসগোল্লা সাঁটালাম। একটা ঘুগনির দোকান খোলা ছিলো দেখলাম স্টেশানের কাছে। এক প্লেট সেই ঘুগনি খেয়ে মনে হলো, আঃ প্রাণ ফিরে পেলাম আবার। অনুভব করলাম, জীবনের কতো তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিষ থেকেও বঞ্চিত হয়ে ছিলাম এতোদিন।
সন্ধ্যেবেলায় পার্কে গেলাম আবার। প্রফেসরকে ধন্যবাদ জানাতে। একটু এদিক ওদিক ঘুরতেই চোখে পড়লো, পার্কেরই একটা বেঞ্চে বসে আছেন পক্বকেশ বৃদ্ধ। আর দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে আকাশের দিকে চেয়ে কী জানি কী ভাবছেন। কালকের সেই পোশাক, কিন্তু মাথায় আজ একটা কাশ্মীরি টুপি চাপানো।
আমি কাছে গিয়ে বললাম, "প্রফেসর, খুব কাজে দিয়েছে আপনার ওই লোশন। সত্যিই দারুণ একটা আবিষ্কার!"
বৃদ্ধ আমার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, "কে প্রফেসর ? দাঁড়াও তো, মেলা গোল কোরো না। গীতাঞ্জলির উর্দু অনুবাদটা নিয়ে ভাবছি। একটু ভাবতে দাও।"
"গীতাঞ্জলির উর্দু অনুবাদ ?" আমি হতচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
বৃদ্ধ বললেন, "হ্যাঁ। কালকে আমি প্রফেসর শঙ্কু ছিলাম। আজ আমি রবীন্দ্রনাথ। লোকে আমাকে পাগল বললে কী হবে, আমি পাগল নই। বুঝলে ? আগামীকাল ঠিক করেছি লেনিন হবো।"
~ সমাপ্ত