ফেলুদা বনাম জটাদা: অষ্টম পর্ব
ফেলুদা বনাম জটাদা: অষ্টম পর্ব


ফেলুদা বনাম জটাদা: পর্ব ৮
শনিবার দিনটা জটাদা বাইরে বাইরেই কাটালো প্রায়। আর আমি একটা সুদোকু নিয়ে সারাদিন ধরে লড়ে গেলাম। এমনকি পিঙ্কির কলও রিসিভ করিনি যতক্ষণ না পুরো সুদোকুটা সল্ভ হয়েছে। বিকেলের দিকে জটাদা ফিরলো এবং আবার বইয়ের পাতায় ডুবে গেলো। আগামীকালের প্রস্তুতি হয়তো। কেন জানি না, আমার মন বলছিলো সবকটা সূত্র এখনো হয়তো ঠিক ঠিক সমাধান হয়নি। আর আমি মনেপ্রাণে চাইছিলাম যাতে সমাধান পাওয়া যায়। তাই ওকে একবারও বিরক্ত করলাম না।
রবিবার সন্ধ্যেবেলা আমরা পৌঁছে গেলাম ডিসুজাদের বাড়ি। ঘড়িতে ঠিক তখন সাতটা বাজে। মিসেস ডিসুজা আমাদের দরজা খুলে দিলেন। দরজার বাইরেই অনেকগুলো জুতো দেখেছিলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম ঘরে প্রায় সবাই উপস্থিত।
"আসুন মিস্টার মিত্র। আপনার অপেক্ষাতেই আছি সবাই।" সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন ডিসুজা সাহেব। তিনি অ্যালিস্টারের সাথে সোফার একদিকে বসে ছিলেন। সোফার অন্যদিকে বসেছেন সুদর্শনবাবু আর নিচের তলার সনৎবাবু।
"বাহ্, আপনারা সবাই এসে পড়েছেন দেখছি। খুব ভালো।" সোফায় বসতে বসতে জটাদা বললো। আমরা তিনজন মাঝের সোফাটাতে গিয়ে বসলাম। ঘরে শুধু মারিয়াকে দেখতে পেলাম না। আমরা গিয়ে বসতেই ডিসুজা সাহেব মেয়েকে ডাকলেন ভিতরের ঘর থেকে।
সুদর্শনবাবু একটু উঠে জটাদার সঙ্গে করমর্দন করলেন। বললেন, "আমার তো আজই আবার ধানবাদের জন্য বেরিয়ে যাবার কথা ছিলো। আজ এখানে তো কাল সেখানে পাঠায় অফিস থেকে, কী বলবো - ঘুরিয়ে মারে আরকি। বিকেলের ব্ল্যাক ডায়মন্ডে যাবার কথা। কিন্তু সেদিন আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে এতো ভালো লাগবো, আর এখানের ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে জানাও দরকার।"
"সেকি ? আপনার তো তাহলে ট্রেনের টিকিটটা নষ্ট হলো।" জটাদা বললো।
"সে অফিস বুঝবে। আমার কী। রাত্রের মুম্বাই মেলটা ধরে নেবো। আমি একদম রেডি হয়েই নেমেছি। এখান থেকে সোজা হাওড়া। ন'টার মধ্যে বেরোলে ধরে নিতে পারবো।"
সনৎবাবুকে দেখলাম সেইরকমই শুকনো মুখ-চোখ। শোকটা এখনো হয়তো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ইতিমধ্যে মারিয়া এসে একটা চেয়ারে বসলো। মিসেস ডিসুজা মেয়ের কাছেই একটা টুলে বসলেন। সবার চোখ, বলাই বাহুল্য, জটাদার উপরেই নিবদ্ধ। আমার আর পিঙ্কির মনের অবস্থাও একইরকম। অর্থাৎ অনেক প্রশ্ন তখন মনের মধ্যে। এবং তাদের উত্তর জানবার অপেক্ষা।
জটাদা সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে কথা শুরু করলো, "মিস্টার ডিসুজার অনুরোধে আপনারা সবাই আজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন। তার জন্য আপনাদের প্রত্যেককে অনেক ধন্যবাদ জানাই। আমাদের আলোচ্য বিভিন্ন মানুষের মধ্যে প্রোমোটার বিজয় পোদ্দার বর্তমানে এই ঘরে নেই। কিন্তু তার খুব একটা দরকারও নেই। আমি ওনার সঙ্গে আলাপ করে যতটা বুঝেছি, উনি নিজে কোনো ব্যাপারে হাত কলুষিত করেন না। ওনার লোক আছে। গুন্ডাবাহিনী আছে হয়তো। প্রয়োজনমতো তারা যেকোনো দুষ্কর্মই করতে পারে। কিন্তু তার সেইসব গুন্ডারা সূক্ষ্ম কোনো শৈল্পিক কাজের ধার ধারবে বলে মনে হয় না। ছুরি-বন্দুক-বোমাই হলো তাদের প্রথমতম পছন্দের অস্ত্র। অতএব, এই খুনের ব্যাপারে, মানে পিউর মৃত্যটাকে আমি খুন বলেই সাব্যস্ত করছি - সেই ব্যাপারে বিজয় পোদ্দারের যুক্ত থাকার সম্ভাবনা কম। ওনার সাথে দেখা করার পরেই তাই আমি ওনাকে সন্দেহের লিষ্ট থেকে সরিয়ে দিই। এই ব্যাপারে আমরা পরে আরো বিশদ আলোচনায় আসবো। আগে সেদিনের ঘটনার একটু পর্যালোচনা করা যাক।"
এরপর জটাদা সনৎবাবুর উদ্দেশ্যে বললো, "আমার খুব খারাপ লাগছে যে আমরা শত চেষ্টা করেও যে বাচ্চাটা মারা গেছে, তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না। সেটা আমার সাধ্যের বাইরে। কিন্তু অন্তত তার মৃত্যুটা কীভাবে হলো, কেনই বা হলো - সেটা জানাটা আমাদের কর্তব্য। আমি সেই কাজটুকুনিই আজ করবো সনৎবাবু।"
একটু থেমে জটাদা আবার বললো, "সেদিন ঠিক কী কী ঘটেছিলো, বা কোথায় কী হয়েছিলো, তা আমি ছাড়া এই ঘরে উপস্থিত আরেকজন ব্যক্তিও জানেন। হয়তো আমার চেয়ে একটু বেশিই ভালো জানেন। তার পরিচয় আমরা একটু পরে জানবো। যাইহোক, আমি আমার মতো করে ঘটনাগুলো বলার চেষ্টা করছি।"
ঘরের মধ্যে তখন অদ্ভুত এক নীরবতা। অ্যালিস্টার এতক্ষণ ঝুঁকে বসে জটাদার কথা শুনছিলো। এখন দেখলাম সোফার উপর হেলান দিয়ে দু'টো হাত মাথার পিছনে রেখে বসলো।
"ঘটনার দিন, অর্থাৎ গত ২৫শে ডিসেম্বর, আপনারা প্রত্যেকেই এখানে উপস্থিত ছিলেন। একমাত্র সুদর্শনবাবু, আপনি সেদিন এখানে ছিলেন না।"
"হ্যাঁ, আমি তখন দিল্লিতে। ফিরে এসে শুনলাম এসব কথা।"
জটাদা বলতে থাকলো। "সেদিন মিস মারিয়ার জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা কেক আনানো হলো। কোল্ড ড্রিঙ্কস এবং চিকেনের স্টার্টার ছিলো। কেক কাটা হলো। খানাপিনা গান-বাজনা চলছিলো। তারপরেই হঠাৎ পিউ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে জানা যায়, ইট ওয়াজ আ কেস অফ পয়জনিং।"
"রাইট মিস্টার মিত্র।" ডিসুজা সাহেব যোগ করলেন।
"এই কেসের সমাধান করতে নেমে, সবচেয়ে বেশি আমাকে ভাবিয়েছে দু'টি বিষয়। এক, খাবারে বিষ মেশানোর পদ্ধতি। আর দু'ই হলো, পিউকে টার্গেট করার কারণ। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী, কোনো খাবারে বিষ পাওয়া যায়নি। তাহলে বিষ এলো কীভাবে ? কখন, কীভাবে এবং কীসে মিশিয়ে দেওয়া হলো বিষ ? এইটাই সমাধান করা যাচ্ছিলো না। এবং আমার বলতে দ্বিধা নেই, যে এই কাজ করেছে, তার মাথা ভীষণই তুখোড়। সে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে যে খাবারে বিষ মেশানো সত্ত্বেও তা ফরেনসিক রিপোর্টে ধরা পড়েনি। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমি হয়তো এই বিষ মেশানোর রহস্যের সমাধান করতেই পারতাম না যদি না আমার এই ক্ষুদে সহকারীটি আমার সঙ্গে থাকতো। এর নাম প্রিয়াঙ্কা। ওর দেখানো পথেই আমি শেষ পর্যন্ত এই রহস্যের সমাধান খুঁজে পাই।"
জটাদার এই কথা শুনে সবার চোখ চলে গেলো পিঙ্কির উপর। আর সে তো লজ্জা-লজ্জা ভাব করে বসে রইলো। কী বা করবে বেচারা। সে নিজেও তো জানে না, আর আমিও জানি না যে সে কীভাবে সমাধানে সাহায্য করলো। কিন্তু জটাদা নিজেই একটু পরে সব খোলসা করে দিলো।
ইতিমধ্যে একবার ডোরবেল বাজতে শোনা গেলো। অ্যালিস্টার উঠে দেখতে গেলো কে এসেছে। তারপর একটা বড়োসড়ো কেকের বাক্স নিয়ে ভিতরে এলো। বোঝা গেলো যে দোকান থেকে অর্ডারমতো কেকের ডেলিভারিটা দিয়ে গেলো। জটাদার অনুরোধে অ্যালিস্টার কেকের বাক্সটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সবার সামনে সেটাকে খুললো। ভিতরে সুন্দর একটা চকোলেট কেক দেখা গেলো। উপরে মারিয়ার নাম লেখা আছে।
জটাদা বলতে লাগলো। "দেখতে খুব নিরীহ একটা কেক। কিন্তু বিষ দেওয়া হয়েছিলো এই কেকের ভিতরেই। আপনাদের হয়তো মনে হতেই পারে যে সেই কেক খেয়ে অন্য কেউ তো অসুস্থ হয়নি। এমনকি ফরেনসিক রিপোর্টেও বলছে কেকের স্যাম্পেলে কোনো বিষ ছিলো না। তাহলে ? ঠিক এই প্রশ্নটারই আমি উত্তর পাচ্ছিলাম না। কেকের প্রতি আমার সন্দেহ গাঢ় হয় যখন জানতে পারি যে অনুষ্ঠানের বেশ কয়েকদিন আগেই কেকের অর্ডার দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো। অর্থাৎ আততায়ীর সুযোগ ছিলো কেকের ব্যাপারে কোনো প্ল্যান করার। সেই সময়টা ছিলো। কিন্তু কেকে বিষ দেওয়া হলো তো ফরেনসিকে ধরা পড়লো না কেন ? কারণ কেকের স্যাম্পেলে কোনো বিষ ছিলো না। বিষ শুধুই ছিলো পিউ যে টুকরোটা খেয়েছিলো, সেটাতে। কীভাবে ? বলছি সেটা। কেকের দোকান থেকেও কোনো বিষ দেওয়া হয়নি। সেটা সম্ভবও ছিলো না। বিষ দেওয়া হয়েছে কেক দোকান থেকে বের হয়ে যাবার পর, এবং এখানে এসে পৌঁছনোর আগে। ইঞ্জেকশান করে তাতে সায়ানাইড পুশ করা হয়েছিলো বলেই আমার ধারণা। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে মিস্টার ডিসুজা যে, কেকটা আসতে কিছুটা দেরী হয়েছিলো সেদিন। দেরীর কারণ কিন্তু যানজট নয়। ড্রিমল্যান্ড কনফেকশনারিজ এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আর বাইকে করে গলি ধরে এলে কোনো যানজটের মুখে পড়ার কথাও নয়। দেরী হয়েছিলো কারণ কেকটা এখানে এসে পৌঁছোবার আগে অন্য জায়গায় গিয়েছিলো।"
"মাই গুডনেস!" বিস্ময়ে বলে উঠলেন মিস্টার ডিসুজা।
"কাকতালীয়ভাবে দু'দিন আগে আমার এই সহকারী, মানে প্রিয়াঙ্কা, ওর নামের একটা ক্যালিগ্রাফি আমাদেরকে দেখায়। সুন্দর নকশা করে লেখা নাম। যেমনটা আমরা কেকের উপর লেখা দেখতে পাই। এই কেকটার উপরে যেমন রয়েছে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন, মিস মারিয়ার নামের মধ্যে i অক্ষরের উপর ডট বা বিন্দুর জায়গায় সুন্দর করে একটা চেরি ফল বসানো। সেদিনের কেকটাও এই একরকমই ছিলো তো ?"
"একদম এই ডিজাইনটাই ছিলো। বোধহয় একই লোক বানিয়েছে।" মিসেস ডিসুজা বললেন।
"আর এইরকম একটা চেরি ফল ছিলো তাতে ?"
"হ্যাঁ।" জবাব দিলো মারিয়া। "আমি ওই পিসটা মনে হয় পিউকে দিয়েছিলাম। ওহ গড!" দু'হাতে নিজের মাথাটা চেপে ধরে বসলো মারিয়া।
তার দিকে ফিরে জটাদা বললো, "আপনার রুমে সেদিন দেখেছিলাম একটা কাঁচের বয়ামে অনেকগুলো চেরি রাখা আছে। আগের বছর আপনার জন্মদিনের ভিডিওটাও আমি দেখেছি। আপনি চেরি খেতে খুব ভালোবাসেন, তাই না মিস মারিয়া ?"
মিসেস ডিসুজা উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ - চেরি তো ওর খুব ফেভারিট।"
"গুড। আর এই তথ্যটা কিন্তু আততায়ীর জানা ছিলো। আততায়ীর উদ্দেশ্য ছিলো এখানে একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরী করা, যাতে সেই ফাঁকে তিনি এইটা হাতিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কেক খেয়ে মারিয়া বা অন্য যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেই ওনার উদ্দেশ্য সাধিত হতো। ঘটনাচক্রে পিউ তার শিকার হয়ে পড়ে।"
কথা শেষ করতে করতে জটাদা কাঁধের ব্যাগ থেকে সেই কাঠের বাক্সটা বার করে ডিসুজা সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলো। বললো, "দেখুন তো, এটাই আপনাদের পারিবারিক সিগারেট কেসটা কিনা।"
ডিসুজা যারপরনাই অবাক হয়ে বললেন, "আরে বাহ্! আপনি তো সত্যি সত্যিই এটা উদ্ধার করে ফেলেছেন। চমৎকার। হ্যাঁ, এটাই সেই সিগারেট কেসটা। কিন্তু এটাকে আপনি পেলেন কোথায় ?"
জটাদা একটু হেসে উত্তর দিলো, "আপনাদের বাড়িতেই চরম অবহেলায় পড়ে ছিলো। আমি কুড়িয়ে নিয়েছি শুধু। আমাকে ক্ষমা করবেন মিস্টার ডিসুজা, সেদিন সনৎবাবু যে চোরের আসার কথা আপনাকে বলেছিলেন, সেই চোর আর কেউ নয়। এই প্রজ্জ্বল মিত্র। আমিই এসেছিলাম সেদিন ভোরবেলা। নিচের ওই ভাঙা ঘরটাতে ঢুকে সামনেই কয়েকটা ইঁটের পিছনে এটাকে পড়ে থাকতে দেখি।"
"এক সেকেন্ড।" এতক্ষণে আবার সোজা হয়ে বসলো অ্যালিস্টার। জিজ্ঞাসা করলো, "এই বাক্সটা হাতিয়ে নেবার জন্যই খুনের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো, এই রাবিশ থিওরি আপনি দিচ্ছেন। আবার বলছেন এটা নাকি ওই ভাঙা ঘরে এমনি পড়ে ছিলো ? মানেটা কী ? তাহলে এটা হাতালো কেন কেউ ?"
জটাদা হয়তো এই প্রশ্নটারই অপেক্ষা করছিলো। সবার সামনে সে বাক্সটার নিচের পাটাতনে চাপ দিয়ে আলগা অংশটা খুলে ফেললো। বললো, "এটাকে দেখে যেমন খুব সাধারণ বাক্স বলেই মনে হয়, এটা আদতে তা কিন্তু নয়। এর মধ্যে একটা ছোট্ট গোপন কুঠুরি আছে। তাতে ছোট কোনো জিনিষ সহজেই লুকিয়ে রাখা যায়। খুব দামি কোনো জিনিষ এখানে লুকোনো ছিলো। এবং সেটার জন্যই এই খুন ও বাকি সবকিছু। জিনিষটা এখান থেকে সরিয়ে নেবার পর খালি বাক্সটা এমনি ফেলে দেওয়া হয়েছিলো।"
আবার সেই আগের মতোই নীরবতা ঘরে। সবাই বিস্ফারিত চোখে জটাদার হাতে ধরে রাখা খোলা বাক্সটাই দেখছিলো। মিস্টার ডিসুজা প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করলেন, "ওখানে কী ছিলো সেটা আমরা জানতে পারি কি ?"
জটাদা সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আর দু'টো হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলো ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর কাহিনী।
"এই বাক্সের প্রকৃত রহস্য জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে আড়াইশো বছর আগে। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরোদমে চেষ্টা করছে বণিকের মানদণ্ডকে এই দেশে রাজদণ্ডে পরিণত করার। ইংরেজদের সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় হয়, এবং মীরজাফরকে পুতুল হিসেবে বাংলার মসনদে বসায় ইংরেজ সরকার। এসবই ইতিহাসে আমরা পড়েছি। ইতিমধ্যে ইংরেজ শাসক ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে ইগোর লড়াইতে জড়িয়ে পড়েন মহারাজা নন্দকুমার।
"নন্দকুমারের সাথে হেস্টিংসের ঝামেলার সূত্রপাত হয় মুন্নি বেগমের আমলে। মুন্নি বেগম ছিলেন মীরজাফরের দ্বিতীয় স্ত্রী। আদতে উত্তরপ্রদেশের বাঈজী বাড়ির মেয়ে মুন্নি অল্প বয়সে বিভিন্ন মজলিসে নাচ-গান করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। আসতে আসতে নিজের ক্ষমতায় উন্নতি করতে করতে একসময় মুর্শিদাবাদ রাজবাড়ীর বউ হিসেবে প্রবেশ করেন এবং মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক ছেলেদের মসনদে বসিয়ে কার্যত রাজ্যপাট নিজেই দখল করেন। তখন এই নন্দকুমার তাঁর নিজের ছেলেকে মুন্নি বেগমের অধীনে প্রধান সচিবের পদে বসানোর জন্য ওয়ারেন হেস্টিংসকে ঘুষ দেন। ঘুষের পরিমাণ ছিলো সেই আমলের কয়েক লক্ষ টাকা। নন্দকুমারের সেই ছেলের নাম ছিলো গুরুদাস। এই অবধি সব ঠিকই ছিলো। কিন্তু সমস্যা হলো মুন্নি বেগমের সাথে তৎকালীন বিখ্যাত জমিদারনী রাণী ভবানীর সুসম্পর্ক ছিলো, আর এই রাণী ভবানীর সঙ্গে নন্দকুমারের ছিলো দীর্ঘকালীন শত্রুতা। সেখান থেকেই ক্রমশ ফাটল চওড়া হতে থাকে এবং নন্দকুমার একসময় হেস্টিংসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন ইংরেজদের বড়কর্তাদের কাছে। প্রমাণস্বরূপ তিনি নিজেরই ঘুষের বৃত্তান্ত ও তার রশিদ দাখিল করেন, সঙ্গে অন্যান্য আরো কিছু ঘুষ নেবার অভিযোগ।
"কিন্তু ইংরেজ কর্তাদের অধীনে সেই কেসের কখনোই সুবিচার হয়নি। বিচারে বিশাল পক্ষপাতিত্ব করা হয় এবং নন্দকুমারকেই উল্টে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত সতেরোশো পঁচাত্তর সালে ফাঁসির সাজা হয় মহারাজা নন্দকুমারের।
"এইখানে উল্লেখযোগ্য একটা কথা বলে রাখা ভালো। নন্দকুমার ছিলেন লর্ড ক্লাইভের বেশ পছন্দের পাত্র। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠিত করে বিভিন্ন রাজ্যের প্রভাবশালী মহলের সাথে কৌশল খাটিয়ে এদেশে ইংরেজদের উপনিবেশ তৈরী করার স্থপতি ছিলেন এই লর্ড ক্লাইভ। তাঁকে এদেশে ইংরেজ শাসনের পথপ্রদর্শক বলা যায়। তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসকেও খুব স্নেহ করতেন। সিরাজউদ্দৌলার আমলে হেস্টিংস যখন জেলে বন্দি হন, এই লর্ড ক্লাইভই ব্রিটিশ সৈন্য নিয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে হেস্টিংসের কিছু কিছু দুর্নীতির কথা ক্লাইভের কানে আসে। তিনি তখন তার বিশ্বস্ত নন্দকুমারের হাত দিয়ে হেস্টিংসকে একটি চিঠি লেখেন। হয়তো হেস্টিংসকে তার দুর্নীতির ব্যাপারে সতর্ক করেই লিখেছিলেন তিনি। এই চিঠির কথা ইতিহাসে কিছু জায়গায় উল্লেখ থাকলেও, অরিজিনাল চিঠিটা কিন্তু পাওয়া যায়নি। এমনকি হেস্টিংস সেই চিঠিটা আদৌ কোনোদিন পেয়েছিলেন কিনা, সেটাও জানা যায় না। হতে পারে নন্দকুমার চিঠিটা হেস্টিংসকে দিয়েছিলেন। হতে পারে তিনি দেননি, হেস্টিংসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওটাই চরম প্রমাণ হতে পারে কল্পনা করে তিনি সেটা নিজের কাছে হয়তো রেখে দিয়েছিলেন।
"যাইহোক, ৫ই অগাস্ট, সতেরোশো পঁচাত্তর সাল। নন্দকুমারের ফাঁসি হয়ে যায়। তখন তাঁর বয়স সত্তর বছর। ফাঁসির ঠিক কয়েক ঘন্টা আগে নন্দকুমার শেষবারের মতো একবার তাঁর জামাই জগৎচন্দ্র রাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। কিছু গোপনীয় জিনিষ তিনি জগৎচন্দ্রকে দিয়ে যান। ইতিহাসের পাতায় তার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। কিন্তু অনেকেরই অনুমান, বিচার সংক্রান্ত কিছু গোপনীয় দলিল বা প্রমাণপত্রই হতে পারে সেই জিনিষ যা তিনি তাঁর ছেলেকেও বিশ্বাস করে দিয়ে যেতে পারেননি, দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র জামাইকে।
"ইংরেজ আদালতে বিচারের নামে যে প্রহসন চলছিলো, নন্দকুমার তা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। এবং তিনি জানতেন যে এই গোপনীয় দলিল সামনে এলে ইংরেজ শাসক সেটাকেও অনায়াসে গিলে নেবে, তার কোনো দাম দেবে না। তাই তিনি সেটা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন যাতে ভবিষ্যৎ সময় তার সঠিক মূল্যায়ন ও নিরপেক্ষ বিচার করে।"
জটাদা একটু থামলো। থেমে ফ্রিজের পাশে রাখা জলের বোতল থেকে দু'ঢোঁক জল খেয়ে নিলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, "এর পরের কাহিনী সামান্যই। আর সেটা হুবহু জানাও এখন সম্ভব নয়। কিছু আমি পড়েছি, কিছু কল্পনায় মেলানোর চেষ্টা করেছি। নন্দকুমারের মৃত্যুর কিছুদিন পর তাঁর পুত্র অর্থাৎ গুরুদাসও মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। অতএব নন্দকুমার এবং গুরুদাসের সমস্ত সম্পত্তি ও জমিদারির মালিকানা বর্তায় নন্দকুমারের জামাই জগৎচন্দ্রের উপর। নন্দকুমারের কলকাতায় যে বসতবাড়ি ছিলো, অধুনা বিডন স্ট্রিটে, সেটিও জগৎচন্দ্রের অধিকারে আসে। জগৎচন্দ্র একটি কাঠের সুদৃশ্য সিগারেট কেস বানিয়েছিলেন। সেটি তিনি সর্বদা নিজের কাছে রাখতেন। সেই সিগারেট কেসটির একটি বিশেষত্ব ছিলো যে এটিতে একটি গোপন চেম্বার ছিলো এবং সেখানে কোনো জিনিষ লুকিয়ে রাখা যেত। আমার অনুমান ডিসুজা ফ্যামিলির সিগারেট বাক্সটিই ছিলো জগৎচন্দ্রের সেই সিগারেট কেস কারণ ইতিহাসের পাতায় সেই সিগারেট কেসের উল্লেখ থাকলেও, তার পরিণতি সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।
"জগৎচন্দ্রের মৃত্যুরও প্রায় একশো বছর বাদে তাঁর ফ্যামিলি যখন কলকাতায় পুরোপুরি সেটেল্ড, সেই সময় তাদের বাড়িতে একটা বড়সড় চুরি হয়ে যায়। কীভাবে সেই চুরি হয়েছিলো সেটা জানা না গেলেও, ওই অঞ্চলেই ডিসুজা পরিবারের আদিবাড়ি ছিলো এবং হাতফেরতা হয়ে সিগারেট কেসটা এসে পড়ে ডিসুজা ফ্যামিলিতে। তখন থেকেই সেটা ডিসুজা পরিবারের সম্পত্তি হয়ে রয়ে যায়। এবং এই এতো যুগ ধরে এটা অজানাই রয়ে যায় যে জগৎচন্দ্র সেই সিগারেট কেসটিতে কী লুকিয়ে রেখেছিলেন যা সম্ভবতঃ নন্দকুমার মৃত্যুর আগে জগৎচন্দ্রকে দিয়ে যান।"
জটাদা এসে আবার সোফায় আগের জায়গায় বসে পড়লো। বললো, "আমার বক্তব্যের অনেকটা অংশই প্রায় অনুমান। এই সিগারেট কেসটিই সেই সিগারেট কেস কিনা তার প্রমাণ তখনই পাওয়া যাবে যখন আমরা এর মধ্যে লুকিয়ে রাখা জিনিষটা পাবো।"
"সেটা কি আপনি পেয়েছেন ?" ডিসুজা সাহেব প্রশ্ন করলেন।
"না, পাইনি। এখনো পাইনি। কিন্তু আমি সম্ভবতঃ জানি জিনিষটা কোথায় থাকতে পারে।" তারপর জটাদা সুদর্শনবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন, "আপনি এখান থেকেই একেবারে রাত্রের ট্রেন ধরবেন বলে স্যুটকেস নিয়ে রেডি হয়েই নেমেছেন, তাই না ?"
হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন, সেটা সুদর্শনবাবুও বুঝলেন না মনে হলো। আমরাও বুঝলাম না। আমি দেখলাম সুদর্শনবাবুর পাশে একটা ব্রিফকেস দাঁড় করানো। বাইরে কোথাও গেলে তিনি ওটাই নিয়ে যান সম্ভবতঃ। তাই জটাদা এই প্রশ্নটা করেছে।
সুদর্শনবাবু উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ, একেবারে স্যুটকেসটা গুছিয়ে নিয়েই নামলাম। ডিনারটা শুধু হাওড়া থেকে প্যাক করে নেবো। কিন্তু আপনি যা সব তথ্য দিলেন, একদম লোমহর্ষক মশাই!"
অ্যালিস্টার এই সময় প্রশ্ন করলো, "মিস্টার মিত্র, আপনি সেই ব্রিটিশ আমলের সাথে এই বাড়ির বা এই ফ্যামিলির লিঙ্কটা পেলেন কীভাবে ? পুরোটাই আপনার কল্পনা নাকি এর বাস্তব ভিত্তি কিছু আছে, সেটা বলবেন কি ?"
"আছে।" বললো জটাদা। ব্যাপারগুলো খুব স্পষ্ট করে কোথাও লেখা না থাকলেও ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বাংলার নবাবী আমলের বইপত্তর পড়ে বেশ কিছু তথ্য আমি পেয়েছি। সেখানে এই সিগারেট কেসটিরও উল্লেখ আছে কিছু জায়গায়। তখন ছবি তোলার ততো রেওয়াজ ছিলো না। কিন্তু বর্ণনা যেমনটি আছে, তার সাথে এই বাক্সের নকশা অনেকটাই মিলে যায়। আর এই মিলের কথা জানাটা এখানে সবচেয়ে সহজ ছিলো কার পক্ষে ? সনৎবাবু, আমি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যোগাযোগ করে আপনার সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে গত ছয় মাস যাবৎ আপনাকে নবাবী আমলের বেশ কিছু বইপত্র বাঁধাই ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। সেটা কি সত্যি ?"
সচকিত হয়ে সবার সম্মিলিত কৌতূহল গিয়ে পড়ে সনৎবাবুর উপর। ভদ্রলোককে দেখে ভাবাই যায় না যে তিনি এতোকিছুর পরিকল্পনা করতে পারেন।
জটাদার প্রশ্নের উত্তরে সনৎবাবু একটু সম্মতিমূলক ঘাড় নাড়লেন শুধু। তারপর মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ডিসুজা সাহেব একরাশ বিরক্তি ও বিস্ময় ঝরিয়ে বললেন, "সনৎবাবু... আপনি ?! আপনিই করলেন এটা ?"
"উতলা হবেন না।" জটাদা হাত তুলে ডিসুজাকে থামালো। "সনৎবাবু বাক্সটার ব্যাপারে পড়াশুনো করতে থাকেন কয়েক মাস ধরে এবং আমার মতোই ওনার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে যে এই বাক্সে কিছু দামি জিনিষ হয়তো লুকানো আছে। বাক্সটার প্রতি ওনার আগ্রহ এবং লোভ বাড়তে থাকে। তিনি ওটাকে হস্তগত করার অভিপ্রায় পোষণ করতে শুরু করেন ঠিকই। কিন্তু খুনের পরিকল্পনা তিনি করেননি।
"ইঞ্জেকশান দিয়ে বিষটা ঢোকানো হয়েছিলো কেকের উপরে সাজিয়ে রাখা চেরি ফলটাতে। কেকের মধ্যে বিষ ছিলো না, এবং সেই কারণেই ফরেনসিক রিপোর্টেও কোনো বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। চেরিটা যদিও মারিয়ার নিজেরই খাবার সম্ভাবনা বেশি ছিলো, কিন্তু সেটা অন্য কারুর কাছেও যেতে পারতো। যদি সনৎবাবুই বিষের প্ল্যান করতেন, তিনি নিশ্চয়ই ওই পার্টিতে সেদিন নিজের মেয়েকে থাকতে দিতেন না বা অন্ততঃ তাকে এখানে একা রেখে নিচে স্ত্রীর কাছে মুহূর্তের জন্যেও চলে যেতে পারতেন না। খুনের পরিকল্পনা তিনি করেননি। তিনি শুধুই সুযোগমতো সিগারেট কেসটা নেবার কথা ভেবেছিলেন। খুনের পরিকল্পনা যার, তিনি সেদিন এই ঘরেই ছিলেন না। আর সেটাই তার মস্ত বড়ো অ্যালিবাই। কি আমি ঠিক বলছি তো সুদর্শনবাবু ?"
সবার চোখ এবার গিয়ে পড়লো নিপাট ভালোমানুষের মতো বসে থাকা সুদর্শন দত্তর উপর। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক সবাইকে দেখে বললেন, "সে কি, আমি কী করে জানবো - আপনি... আপনিই তো বলবেন। আমি থোড়াই কিছু জানি সেদিন কী হয়েছিলো।"
"ও হ্যাঁ, আপনি তো তখন এই শহরেই ছিলেন না। দিল্লি গিয়েছিলেন তার কয়েক দিন আগে।"
"হ্যাঁ।" হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচলেন সুদর্শনবাবু। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্যই।
জটাদা বললো, "এটাতে অবশ্য কিছু মিথ্যা নেই। আপনি সত্যিই ঘটনার কয়েক দিন আগে দিল্লি যান। আপনার কাছে নিশ্চয়ই নিজের নামে বুক করা সেই টিকিটটা আছে। হয়তো দিল্লির কোনো হোটেলের বিলও আছে যা আপনার কলকাতায় সেই সময় অনুপস্থিত থাকার জোরালো প্রমাণ হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু সুদর্শনবাবু, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যে অতো সহজ কাজ নয়।
"সেদিন আপনি যখন দিল্লি থেকে ফিরলেন, বাইরে আপনার জুতো দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো। একজন মানুষ যিনি দিল্লি থেকে এতোটা রাস্তা সফর করে আসছেন, তার জুতো এতো চকচকে কীকরে থাকে ? পয়েন্ট নাম্বার ওয়ান। পয়েন্ট নাম্বার টু - আপনার জুতোর নিচে একটা কাগজের টুকরো লেগে ছিলো। এই যে - আমি সেটা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম।"
জটাদা কথা বলতে বলতে বুকপকেট থেকে একটা কাগজের স্লিপ বার করে টেবিলের উপর রাখলো। "এটা দাস লন্ড্রির স্লিপ। স্লিপে ফোন নাম্বারও দেওয়া আছে। এই দাস লন্ড্রিটা এই রাস্তারই শেষ প্রান্তে, আপনারা হয়তো চেনেন।"
"হ্যাঁ, ওইদিকে একটা লন্ড্রি আছে তো। দাস লন্ড্রিই হবে মনে হয় নামটা।" মিসেস ডিসুজা সমর্থন করে জানালেন।
জটাদা সুদর্শনবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, "যে মানুষ দিল্লি থেকে ফিরছেন দশ-বারোদিন পরে, তার পায়ের জুতোয় কীকরে এখানের একটা লন্ড্রির স্লিপ আটকে থাকে সুদর্শনবাবু ?"
সুদর্শনবাবু এক মুহূর্ত থেমে তারপর শান্তস্বরেই বললেন, "আপনি কী বলছেন আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না মিস্টার মিত্র। লন্ড্রির দোকানের স্লিপ সিঁড়িতেই কোথাও হয়তো পড়ে ছিলো। পায়ের তলায় একটা দোকানের স্লিপ পাওয়া গেছে বলে আপনি প্রমাণ করতে চাইছেন যে এইসব প্ল্যান আমার করা ? কোনো মানে আছে এইসব কথার ?"
"না, আমি আপনাকে শুধু এটাই বলছিলাম যে আমার মনে সন্দেহটা কখন কীভাবে এলো। পুলিশের কাছে আপনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ দেবে এক - এই সামনের রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে এই বাড়ির মুখোমুখি যে হোটেল, পার্ক গেস্ট হাউস, সেখানের ম্যানেজার। আপনি বিপ্লব অধিকারী নামে কোনো একজনের ভুয়ো আধার কার্ড ব্যবহার করে সেখানে দিন দশেকের জন্য একটা রুম ভাড়া নিয়েছিলেন। নাম না মিললেও, ওই গেস্ট হাউসের ম্যানেজার আপনাকে চাক্ষুষ আইডেন্টিফাই করতে পারবে পুলিশের সামনে। আর দু'নম্বর হলো, এই তিনতলার মেসের ছেলেরা। ওদের মধ্যে সাব্বির আর রৌনক বলে দু'টো ছেলের সাথে আলাপ করে জেনেছি যে ওরা এর মধ্যে আপনাকে গভীর রাতে একবার-দু'বার আপনার ফ্ল্যাটে ঢুকতে বেরোতে দেখেছে, যখন এই বাড়ির বাকি বাসিন্দারা ঘুমিয়ে থাকে। আপনি আমাকে বোঝান সুদর্শনবাবু, আপনি দিল্লিতে থেকে থাকলে আপনার ফ্ল্যাটে কে যাতায়াত করলো ? কে হোটেলের ঘর ভাড়া নিলো এখানে দশ দিনের জন্য ?"
জটাদার এই লাস্ট কথাগুলোর পরে দেখলাম সুদর্শনবাবু একদম গুটিয়ে গেলেন। মুখ-চোখ তার সাদা হয়ে গেছে।
"আপনি ছকটা ভালোই কষেছিলেন। বৈধ টিকিট কেটে দিল্লিতে গিয়ে সেখানে বড়ো কোনো হোটেলে নিজের নামে ঘর বুক করে রেখে স্ট্রং একটা অ্যালিবাই তৈরী করে রাখলেন যে আপনি কলকাতাতেই ছিলেন না খুনের সময়। বাস্তবে আপনি চুপি চুপি কলকাতায় চলে এসে এখানে আস্তানা গাড়েন। এই বাড়ির ঠিক উল্টোদিকের গেস্ট হাউসে। যাতে ওখান থেকে এই ঘরের ড্রয়িং রুমটা পরিষ্কার দেখা যায়। যাতে ঘটনার দিন আপনি এই ঘরে চোখ রাখতে পারেন এবং সবাই যখন পিউকে নিয়ে ব্যস্ত, সেই সময় আপনি এসে সিগারেট কেসটা যাতে হাতিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারেন। কিন্তু আপনার সেই সাজানো প্ল্যানে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন সনৎবাবু। মারিয়া যে চেরি খেতে ভালোবাসে, সেটা আপনি জানতেন। চেরিতে সায়ানাইড পুশ করার জন্য ডেলিভারি দেওয়ার যে ছেলেটিকে টাকার লোভ দেখিয়ে আপনি হাত করেছিলেন, তাকে আমার অনুরোধে পুলিশ আজ অলরেডি নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিয়েছে। আমি তো বলতেই ভুলে গেছিলাম, সেও হতে পারে আপনার বিরুদ্ধে জোরালো তিন নম্বর সাক্ষী।"
সুদর্শনবাবু এবার আর কোনো গত্যন্তর না দেখে দু'হাতে নিজের মুখটা ঢেকে শুধু বসে রইলেন।
জটাদা ডিসুজা সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো, "সুদর্শনবাবু কীভাবে এই বাক্স এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছিলেন, সেটা আমি জানি না। তবে অনেক পড়াশুনো করতে হয়েছে ওনাকেও, সেটা নিশ্চিত। তারপরেই অ্যাকশন প্ল্যান তৈরী করেন উনি। মারিয়ার জন্মদিনের পার্টিটা ওনাকে একটা দারুণ সুযোগ এনে দেয়। সুদর্শনবাবু টার্গেট করেছিলেন মারিয়াকেই। কারণ ওর কিছু হলে আপনারা সবচেয়ে বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। দেখুন, এই ড্রয়িং রুমে কাউকে ভালো করে শোয়াবার জায়গা কিন্তু নেই। কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এখানে যাহোক করে না বসিয়ে ভিতরের বড়ো ঘরে বা বিছানার উপর নিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই অনুমান করে সুদর্শনবাবু এই ঘরের ঠিক মুখোমুখি ঘরটা ভাড়া নেন হোটেলে। ওই হোটেলের ম্যানেজার আমাকে টেস্টিফাই করেছেন যে দোতলার ওই নির্দিষ্ট রুমটি নেওয়ার জন্য বিপ্লব অধিকারী ওরফে আমাদের সুদর্শনবাবু ওনাকে পীড়াপীড়ি করেছিলেন। ওনার বক্তব্য অবশ্য ছিলো যে ওই রুমটা রাস্তার পাশে, হাওয়া বাতাস ভালো খেলবে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিলো ঘটনার দিন ব্যালকনি পার করে এই ঘরে চোখ রাখা। বিষাক্ত চেরি ফলটা মারিয়ার বদলে পিউয়ের প্লেটে গেলেও তাতে সুদর্শনবাবুর প্ল্যান একটুও কাঁচেনি। তিনি যখনই দেখলেন আপনারা সবাই পিউকে ধরে নিয়ে ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, তিনি চটজলদি রাস্তা পার করে এবাড়িতে চলে এলেন। পার্টি চলাকালীন ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিলো। কোনোভাবে যদি তিনি কারুর চোখে পড়েও যান, কোনো অসুবিধা নেই। প্ল্যান ক্যানসেল করে তিনি ভালোমানুষ সেজে যেতে পারবেন, কারণ তিনি এই বাড়িতেই থাকেন। এবং তখন গল্প দিতে পারবেন যে তিনি এই সবে দিল্লি থেকে ফিরলেন।"
"যেমন ভাবা, রাস্তা পার করে এবাড়িতে চলে এলেন সুদর্শনবাবু। সিঁড়ি দিয়ে হয়তো ওপরেও উঠেছিলেন। কিন্তু ভিতরে ঢুকতে তিনি পারলেন না। কারণ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন সনৎবাবু। তিনি সম্ভবতঃ তার মিসেসকে কেকের প্লেটটা তখন দিয়ে এসে এই ঘরে ঢুকে দেখেন সবাই ভিতরের ঘরে জটলা করেছে। কেন-কী ব্যাপার সেসব না ভেবেই তিনি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন ফ্রিজের মাথা থেকে কাঠের সিগারেট কেসটা সরিয়ে নিয়ে। ওটা নিয়েই তিনি আবার নিচে চলে যান। এবং সেটাকে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখে আবার উপরে উঠে আসেন। এসে পিউর অবস্থা দেখে তিনি সত্যিই বিচলিত হয়ে আবার নিচে যান ওনার মিসেসকে ডেকে আনার জন্য। ওনার এই বারংবার আসা-যাওয়ার কারণে সুদর্শনবাবুর প্ল্যান পুরো চৌপাট হয়ে যায়। তাকে হোটেলে ফিরে যেতে হয় খালি হাতে।"
"সিগারেট কেসটা তাহলে মিস্টার দত্ত নেননি ?" খুবই অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলো অ্যালিস্টার।
"না। জিনিষটা সনৎবাবুর কাছেই গচ্ছিত রয়ে যায়। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুশোক বুকে চেপে রেখেই তিনি নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আড়ালে কাজ গোছাতে থাকেন। বাক্সটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই তিনি ওটার কলকব্জার ব্যাপারটা ধরে ফেলেন এবং ওতে লুকিয়ে রাখা জিনিসটাও খুঁজে পান। অতঃপর বাক্সটা তিনি ওই নিচের ভাঙা ফ্ল্যাটটাতে ফেলে দেন। সম্ভবতঃ তিনি চেয়েছিলেন যে আপনারা ওটা যাতে আবার খুঁজে পান। মিস্টার ডিসুজার ক্ষতি করবার অভিপ্রায় ওনার ছিলো না, শুধু আসল জিনিষটা উনি হস্তগত করতে চেয়েছিলেন। এবং করেওছিলেন।
"সনৎবাবুর উপর আমার প্রথম দিনেই সন্দেহ হয় ওনার ঘরে ঢুকে। আমরা ভিতরে ঢুকে দেখেছিলাম একটা খুব হালকা হলুদ বাল্ব জ্বলছে। ওরকম ছোট বাল্ব এখনকার দিনে আর কে ব্যবহার করে ? এখন তো এলইডি ছাড়া কিছু কিনতেই পাওয়া যায় না দোকানে। ওরকম ছোট নাইট বাল্ব পাওয়া যায় জিরো পাওয়ারের। কিন্তু সেগুলো লোকে শোবার ঘরেই লাগায়। ডাইনিং বা ড্রয়িং রুমে ওরকম আলো দেখে আমার মনে সন্দেহ বাসা বাঁধে। উনি হয়তো চাননি কেউ ওনার ঘরে এসে খুব বেশি এদিক-ওদিক দেখুক। হলুদ আলো এমনই হয় যে তাতে পুরোনো দিনের হলদে হয়ে যাওয়া কাগজ কিন্তু চট করে বোঝা যায় না। আমি জানি না জিনিষটা তিনি ঘরের মধ্যে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু সেটা যদি কাগজ জাতীয় কিছু হয়, আমি আশ্চর্য হবো না। আর কাগজ জাতীয় কিছু হলে সেটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিঠিও হতে পারে।"
কথার মধ্যে কিছুটা রহস্য রেখে দিয়ে জটাদা থামলো। আমার মাথার মধ্যে যেটা ঘুরছিলো, সেটা আমি বলেই ফেললাম। "ওয়ারেন হেস্টিংসকে লেখা লর্ড ক্লাইভের সেই চিঠিটা ?"
ঠোঁটের কোণে হাসিটা তখনও একটু ধরে রেখে জটাদা বললো, "আমারও তাই অনুমান। কিন্তু সেটা আমাদের চেয়ে ভালো বলতে পারবেন সনৎবাবু।"
সনৎবাবু এমনিতেই ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন। এখন তিনি ডিসুজার দিকে ফিরে দুই হাত জড়ো করে শুধু বললেন, "আমাকে ক্ষমা করুন মিস্টার ডিসুজা।"
ডিসুজা সাহেব কিছু বললেন না। কোনো উত্তর দিলেন না সনৎবাবুকে। ভীষণ রাগ ও বিরক্তি হলে মানুষের যেমন মুখের ভাব হয়, তেমনি চুপ করেই রইলেন। সনৎবাবু আবার বললেন, "চিঠিটার কথা আমি আগে থেকেই অনুমান করেছিলাম। এবং সেটা পাবার পর আমি বুঝতে পারি সেটার ঐতিহাসিক মূল্য কতটা। আপনি বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে পুরো ব্যাপারটা খুলেই বলবো বলে ভেবেছিলাম। বিবেকের দংশনে মরে যাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু সত্যি কথাটা জানতে পারলে আপনি আমার সম্বন্ধে কী ধারণা করবেন, সেই ভেবেই বলে উঠতে পারিনি। যখন স্থির করলাম আপনাকে বলেই দেবো -"
"ঠিক তখনই জিনিষটা আপনার কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে গেলো।" সনৎবাবুর কথাটা সম্পূর্ণ করলো জটাদা।
"হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কীকরে জানলেন ?" অবাক হলেন সনৎবাবু।
"খুব সহজ। সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে আপনার ড্রয়িং রুমে দেখলাম টিমটিমে সেই হলুদ লাইট পাল্টে সাধারণ এলইডি লাগানো হয়েছে। তাইতেই বুঝতে পারলাম যে জিনিষটা আপনার ঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোথায় সরানো হয়েছে ?"
জটাদা এবার ডিসুজা সাহেবের দিকে তাকিয়ে ব্যাখ্যা করতে লাগলো, "আপনার মনে আছে মিস্টার ডিসুজা, পরশুদিন ভোরবেলা সেই চুরির কথা ? সেদিন যখন আমি এসে ভাঙা ঘরটা থেকে কাঠের বাক্সটা উদ্ধার করলাম, তখন ইচ্ছা করেই দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় ঠোকাঠুকি করে সনৎবাবুর মনে একটা চুরির ভয় আনার চেষ্টা করেছিলাম। কারণ তা নাহলে তার ঘরে ঢুকে জিনিষটা খোঁজার জন্য তল্লাশি চালানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সদ্য সদ্য তার মেয়ে মারা গেছে। এখন সনৎবাবুকেই দোষী সাব্যস্ত করে তার ঘরে ঢুকে খোঁজাখুঁজি করাটা, কোনো প্রমাণ ছাড়াই, আমি করে উঠতে পারতাম না। আপনারা কেউই হয়তো সেটা সমর্থন করতেন না। তাই ঘুরপথে ওনাকেই বাধ্য করতে হলো জিনিষটা লুকোনো জায়গা থেকে বের করে আনার জন্য। উনি বুঝলেন যে চিঠিটার জন্য ওনার ঘরে পুলিশ বা আর কেউ সার্চ করতে আসলেও আসতে পারে। ভয় পেলেন উনি। জিনিষটা হারানোর থেকেও বড়ো ভয় যেটা উনি পেলেন সেটা হলো এই চুরির ব্যাপারে ওনার যুক্ত থাকার প্রমাণ এভাবে ঘরে রেখে দেওয়া।
আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো জিনিষটা এই বাড়ির বাইরে কোথাও রেখে আসবেন। পরিচিত কারুর জিম্মায়। সেই হিসাবে এই বাড়ির উল্টোদিকে ওইদিনই আমি চব্বিশ ঘন্টার জন্য একটা ছেলেকে পাহারায় বসাই। কিন্তু তার কাছ থেকে রিপোর্ট পাই যে সনৎবাবু আর বাড়ির বাইরে বেরোননি। তাহলে জিনিষটা তিনি কোথায় পাঠালেন ঘর থেকে ?
ভাগ্যের কি পরিহাস দেখুন। সনৎবাবু কিন্তু জানতেন যে সুদর্শনবাবু সত্যিই দিল্লিতে গেছেন। এবং সামনের মাসের আগে ফিরবেন না। তাই সুদর্শনবাবুর ঘরটিকেই উনি এই বাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হিসাবে মনে করলেন। বাড়িতে সার্চ করা হলেও সুদর্শনবাবুর ঘরে ওনার অনুমতি ব্যতিরেকে ওনার অনুপস্থিতিতে পুলিশ ঢুকবে না। আমি ঠিক ঠিক জানি না সনৎবাবু কীভাবে ওনার ঘরে চিঠিটা লুকিয়ে রেখেছিলেন ওইদিন। কিন্তু কল্পনা করতে পারি, উনি হয়তো তিনতলায় গিয়ে সুদর্শনবাবুর ঘরের দরজার তলার সামান্য গ্যাপটা দিয়ে চিঠিটা ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন। আর একটা সুতো তার সঙ্গে বেঁধে বাইরে অব্দি রাখলেন যাতে সহজেই সেটাকে টেনে নিতে পারেন বাইরে থেকে। কী, আমি ঠিক বলছি কি সনৎবাবু ?"
সনৎবাবু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জটাদার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। শুধু বললেন, "ঝাঁটার কাঠি। সুতো নয়। একটা ঝাঁটার কাঠি ওটার সঙ্গে আটকে রেখেছিলাম, যাতে কাঠিটা ধরে টানলেই ওটা বাইরে চলে আসে।"
"যাইহোক -" জটাদা আবার বললো, "সনৎবাবু জিনিষটা নিরাপদ জায়গায় রেখে তো এলেন। সেটা ধরা পড়লেও তার নিজের ধরা পড়ার সম্ভাবনাও আর রইলো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেইদিনই ফিরে এলেন সুদর্শন দত্ত। তিনি সম্ভবতঃ আন্দাজ করেছিলেন যে সনৎবাবু নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন চিঠিটা। তার কী উদ্দেশ্য ছিলো বলতে পারবো না। তিনি বিফল মনোরথ হয়ে সব প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলেন নাকি সনৎবাবুর কাছ থেকে জিনিষটা আবার হাতানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, আমার জানা নেই। সম্ভবতঃ দ্বিতীয়টাই। কারণ তা না হলে তিনি ফিরে আসার পর মিস্টার ডিসুজাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন যে জিনিষটা সনৎবাবুই নিয়ে থাকতে পারেন। তা তিনি করেননি। কিন্তু এর পরের কাহিনীটা আপনারা ভাবুন শুধু। সুদর্শনবাবু ফিরে এসে নিজের ঘরে ঢুকেই দেখেন তার সামনেই পড়ে আছে কোটি টাকা মূল্যের সেই সম্পদ যেটার আশা তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। যার জন্য এতোকিছু প্ল্যান করে এগোলেন তিনি, শেষমেশ সেটা নিজের মুঠোয় পেয়েও গেলেন। কপাল প্রসন্ন হলে যা হয়।"
সুদর্শনবাবু বসেছিলেন দরজার সবচেয়ে কাছাকাছি। ঠিক এই মুহূর্তে হঠাৎই তিনি আচমকা সোফা থেকে উঠেই ব্রিফকেসটা নিয়ে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন দরজার দিকে। আমি সময়মতো আমার পা-টা একটু এগিয়ে দেওয়ায় হোঁচট খেয়ে উনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেঝের উপর। আর অ্যালিস্টার দেখলাম সঙ্গে সঙ্গে উঠে ওনার উপর চেপে বসে গলাটা ঠেসে ধরলো। বললো, "মিস্টার মিত্র, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এই রাস্কেলটাকে ধরিয়ে দেবার জন্য। মানুষকে বাইরে থেকে দেখে সত্যিই চেনা যায় না।"
জটাদা উঠে গিয়ে ব্রিফকেসটা তুললো। তারপর সুদর্শনবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, "আপনি কি এটার লক নাম্বারটা বলবেন নাকি আমাদের কষ্ট করে ভেঙে দেখতে হবে মিস্টার দত্ত ?"
কোনোক্রমে অস্ফুটে বললেন সুদর্শনবাবু, "থ্রি- ফোর- ফাইভ।"
ব্রিফকেসটা খুলতে সেটা থেকে বেরোলো ভাঁজ করা একটা কাগজ। বেশি বড়ো নয়। ভাঁজগুলো সাবধানে খোলার পর সেটা একটা খাতার পাতার সাইজ হলো। লালচে হলুদ রঙের বহু পুরোনো দিনের কাগজ, দেখেই বোঝা যায়। জটাদা সেটা সবার উদ্দেশ্যে মেলে ধরে বললো, "আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে লেখা লর্ড ক্লাইভের চিঠি। অমূল্য এক সম্পদ। নিলামে এর দাম কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।" চিঠির একদম নিচে রবার্ট ক্লাইভ বলে করা সইটাও দেখালো জটাদা।
আমাদের কাজ আর বেশি বাকি ছিলো না। ডিসুজাদের ফ্ল্যাট থেকে চলে আসার আগে জটাদা ডিসুজা সাহেব আর অ্যালিস্টারকে বললো, "আমার কর্তব্য এইটুকুই ছিলো। আপনারা বাকিটা দেখে নিতে পারবেন আশা করি। লোকাল থানায় আমি খবর দিয়েই রেখেছি। আপনারা যোগাযোগ করে নিলেই হবে। আর হ্যাঁ, সনৎবাবু লোভ করে একটা অন্যায় করে ফেলেছেন। তার জন্য উনি অলরেডি যে শাস্তি পেয়েছেন, তার পরিমাপ হয় না। ওনার মেয়ের মৃত্যুর কথাটা মাথায় রেখে পারলে ওনার ব্যাপারটা আর থানায় না হয় নাই বা জানালেন। জানবেন, অনুশোচনার চেয়ে বড়ো শাস্তি আমাদের দেশের আদালত দিতে পারবে না।"
রাস্তায় নেমে জটাদা একটা সিগারেট ধরালো। পিঙ্কি এতক্ষণে মুখ খুললো। বললো, "কী দারুণ একটা কেস সল্ভ করলে গো তুমি জটাদা। প্রথমে সুদর্শন দত্ত, তারপর সনৎ সেন, তারপর আবার সুদর্শন দত্ত - মানে চোরের উপর বাটপারির উপর চোর। উফ। বিশাল ব্যাপার।"
জটাদা সিগারেটে একটা টান দিয়ে সেটার ধোঁয়াটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললো, "তুই হয়তো এখনের ঘটনাগুলোই ভাবছিস। কিন্তু ভেবে দেখ, চিঠিটা লর্ড ক্লাইভ লিখেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের দুর্নীতি ও টাকা চুরির বিষয়ে। সেটা নন্দকুমার একরকম প্রায় চুরি করেই নিজের কাছে রাখেন। সেই চিঠি নন্দকুমারের ফ্যামিলির কাছ থেকে ডিসুজাদের ফ্যামিলিতে চলে আসে, সেও এক চোরের হাত ধরেই। মানে, ভেবে দেখতে গেলে, এই চিঠির পিছনে চুরির ইতিহাস কিন্তু আজকের নয়, প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো।"
(সম্পূর্ণ সমাপ্ত)