Prantik Biswas

Comedy Classics Others

4.5  

Prantik Biswas

Comedy Classics Others

কড়চা ২২ | সেরা নীতি ইমিউনিটি

কড়চা ২২ | সেরা নীতি ইমিউনিটি

6 mins
1.1K


০২ মে ২০২০


নিজের দেশ ও সেই দেশের সুসন্তানদের নিয়ে সবারই মনে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব লুকিয়ে থাকে। ঠিক বলেছি তো! আজ আপনাদের তেমনই এক সুসন্তান প্রিয় চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় জীবিত থাকলে ৯৯ পার করে ১০০ তে পা দিতেন। ওনার ছবি দেখেছি – সহজ ভাবে রুপোলি পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন চিরন্তন সত‍্য ও মনের কিছু গভীর অনুভূতিকে।


আমার জানা হয়ে গেছে যে আপনাদের দেশে লকডাউনের মেয়াদ আরো চোদ্দদিন বাড়িয়ে ১৭ই মে করা হয়েছে। ৩০শে জানুয়ারি ভারতে প্রথম পা দেওয়ার পর আমাকে ঘিরে যে অশনিসঙ্কেত দেখা দিয়েছিল, তা আপনাদের মহানগরেও আছড়ে পড়েছে। সব জলসাঘর তালাবন্ধ। পরিচিত জন-অরণ্য এখন অতীত। বেশি ঘরে বাইরে করার সুযোগ নেই। মন খুলে সত‍্যিটা বলুন তো, নিজের নিজের সোনার কেল্লায় সীমাবদ্ধ থাকতে কি আপনাদের ভালো লাগছে? চিড়িয়াখানায় বন্দী বাঘের মতন লাগছে, না? নাকি অতীতে কাটানো কোনো অরণ্যের দিনরাত্রি মনে পড়ছে, যেখানে একটা গণ্ডী পেরোনো মানেই মৃত্যুর মুখোমুখি! আপনাকে কি কাপুরুষ বলা উচিত হবে? অবশ্য এসবের মধ্যেও যারা লুকিয়ে চুরিয়ে নিজেদের নেশার যোগান বজায় রাখতে তরল পানীয় জোগাড় করতে পারে, তারা এক অর্থে তো মহাপুরুষ! তাই না!


এখানে আগন্তুক হয়ে এসেছি সবে ক'মাস। আমার বসের চোখে আমি এখন নায়ক, তবে আপনাদের কাছে আমি গণশত্রু; অনেক দুর্গা, অপুর সংসার ছারখার করে দিয়েছি। আপনাদের যথাসাধ্য প্রতিরোধ সত্ত্বেও হাজার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আমি এখনো অপরাজিত। সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট ছড়িয়ে স্যানিটাইজেশন অভিযান করে, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেণ্টেন করার নির্দেশ পালন করে কোনওরকমে ঠেকিয়ে রেখেছেন আমাকে। অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে আমার আক্রমণে যারা মৃত্যু বরণ করছে, তাদের সদগতি করাও কষ্টসাধ্য হচ্ছে। কবে যে ঐ ভ্যাকসিন নামের পরশপাথর খুঁজে পাবেন, তাও নিশ্চিত জানেন না। আশায় আশায় দিন কাটাচ্ছেন আর ইষ্টনাম জপ করছেন। শুনছি আগামী আশ্বিন মাসে দেবী দুর্গার পুজোতেও আপনারা নাকি লোকের ভিড় চান না! আমার এই পথের পাঁচালির কবে যে সমাপ্তি হবে, সেটার সম্পর্কে কেউই নিশ্চিত নয়। তবে এই ক'দিনে যা বুঝেছি, সেটা হলো আমি নই, আপনারা মানুষেরাই একে অপরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী! কেন, এখন সে কথাই বলি...


গত দেড়মাস ধরে দেখছি যে আপনারা সর্বত্র একে অপরের বিরোধিতাই করেন বেশি, সহায়তার মাত্রাটা কম। অথচ পৃথিবীতে মানুষ অন্য মনুষ‍্যেতর প্রাণীদের থেকে এগিয়ে আছে অনেকটাই একসাথে কাজ করার ক্ষমতায়, সহযোগিতা করার দক্ষতায়। এরকম একটা কঠিন পরিস্থিতিতে কোথায় একসাথে কাজ করবেন তা নয়, শুধুই একে অপরের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, সমালোচনা করে যাচ্ছেন। এই দেখুন না, একটু আগে দুজন মাঝবয়সী লোকের কথাবার্তা শুনলাম ফোনে, স্কুলের বন্ধু। একজন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার আরেকজন প্রাইভেট কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার

ডা – তুই গ্রুপে ওরকম পোস্ট করলি কেন?

ই – করবো না কেন, এর মধ্যে ধর্ম আসছে কোত্থেকে। এই কোভিড পজিটিভের কাউন্ট যে শুধু ওদের জন্যেই বেড়ে গেছে এই তথ‍্যটা আদৌ ঠিক না!

ডা – সেটা কিন্তু কেউই বলেনি। খালি ঐ ঘটনাটার কথা বলেছে, এবং তার পরেই যে কাউণ্ট বাড়তে শুরু করেছে সেটা কি তুই অস্বীকার করতে পারবি?

ই – না, করবোও না। কিন্তু ব‍্যাপারটা তো কাকতালীয়ও হতে পারে। তুই বলতে চাস এরকম ঘটনা শুধু ওরাই ঘটাচ্ছে?

ডা – কেউ একবারও বলেনি সেটা। আবারও বলছি জমায়েতটা ধর্ম বাদ দিয়ে অন্য কোনও কারণেও হতে পারতো। তোর যে কি হয়েছে বুঝি না, তুই সবকিছুতেই এখন ধর্ম খুঁজিস।

ই – আচ্ছা বেশ, কিন্তু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে ও তাকে প্রতিরোধ করার জন‍্যেই তো গভর্নমেণ্ট লকডাউনের সময়সীমা ক্রমাগত এক্সটেণ্ড করে যাচ্ছে। ইকনমির কি হাল হবে বলতো? প্রোডাকশন বন্ধ, এতগুলো লেবার অকেজো হয়ে গেছে। এটা তো তুই মানবি যে, সোসাইটির একটা বিশাল সেকশন, অর্থাৎ দিনমজুর, যারা দিন আনে দিন খায়, তারা খাবে কি?

ডা – শোন, রাজনৈতিক নেতারা তো নানান যুক্তি দেখিয়ে ফায়দা তুলবেই। আর তাছাড়া তুই বা আমি, কি করেছি আমরা আমাদের পাড়ায় এরকম ক্লাসের লোকেদের জন্যে। আমরা যারা মিডল ইনকাম গ্রুপের, তারা যদি সবাই মিলে যে যার নিজের পাড়ার দায়িত্ব নিই, তাহলেই তো অনেক। মানছি যে অনেক ডিসিশান, অনেক প্রসেস ভুল। সেগুলো নিয়ে রাতদিন ঝগড়া না করে এই আকালের সময়ে গজিয়ে ওঠা প্রবলেমগুলো যদি সলভ করার চেষ্টা করি…

ই – যেমন? 

ডা – যেমন ধর, তুই ইঞ্জিনিয়ার, তুই ভাবতে শুরু কর কি করে দেশে তাড়াতাড়ি পি পি ই বা টেস্টিং কিট তৈরি করা যায়, আরও সস্তায়, আরও তাড়াতাড়ি। ঠিক সেভাবে ইকনমিস্ট আর লজিস্টিকস এক্সপার্টরা ভাবতে পারে পাব্লিক ডিস্ট্রিবিউশান কি করে আরও ভালো করা যায়, আমাদের ফুডগ্রেন স্টক বেশ ভালো এখন। দেশে কোনো খরা বা বন্যাও হয়নি এ'বছর। দেশের সব জায়গায় যাতে খাবার, টেস্টিং কিট, ওষুধ, মেডিক‍্যাল ইকুইপমেন্ট তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেওয়া যায় সেটাই ওরা দেখুক।

ই – হ‍্যাঁ, এটা তুই ভালো বলেছিস।

ডা – আরও শোন, এই যে প্রবলেমটা আমরা ফেস করছি, এর ইস‍্যুটা মেডিক্যাল ওয়ারকে ঘিরে অথচ এখনো লোকে ডাক্তারদের হাতে কোপ মারছে। এখন ডাক্তাররা যা বলছে, সেই কথাগুলো সাধারণ মানুষজনকে শুনে চলতে হবে, হেলথ ওয়ার্কাররা যাতে আরও ভালো করে কাজ করতে পারে সেটাও দেখতে হবে। ভেবে দেখ না -- যুদ্ধের সময় তুই, আমি, দেশের আমজনতা বা রাজনৈতিক নেতারা -- আমরা কি আর্মির স্ট্র‍্যাটেজির ব্যাপারে নাক গলাতে বা কমেণ্ট করতে পারি?

ই – পারিনা। তাহলে তুই কি করতে বলছিস?

ডা – অন্যদের কোনও হেল্প না করতে পারলে নিজেকে কর। নিজের ইমিউনিটি বুস্ট কর।

ই – ঠিক, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। দ‍্যাট শ‍্যুড নট বি আওয়ার কাপ অফ টী!


এসব নিয়ে এদের কথা, ব‍্যাখ‍্যা আনলিমিটেড কল ফেসিলিটির কারণে চলতেই থাকবে। এর থেকে বিরতি নিয়ে ফিরে আসি আপনাদের কাছে। একটা প্রশ্ন করছি - বলুন তো, আমার আসায় কি আপনাদের ক্ষতিটাই বেশি হয়েছে, ভালো কি কিছুই হয়নি? এই কদিনে জাঙ্ক ফুড না খেয়ে পেট ভালো আছে না? লেট নাইট পার্টি, সিনেমা, শপিং, আউটিং এই সব না করে পয়সার সাশ্রয় হচ্ছে তো! আশা করি ঘুমও ভালো হচ্ছে, শরীরেরও বিশ্রাম হচ্ছে। নিজে নিজে ঘর পরিষ্কার করে, বাসন ধুয়ে ফিটনেসও নিশ্চয়ই অনেকটা বেড়েছে? বাইরে বেরোতে না পেরে এখন ছাদে উঠে বুলবুল, পায়রা, চড়াই, শালিক ও আরও অনেক নাম না জানা পাখিদের দেখা পাচ্ছেন তো? রুফটপ গার্ডেনের পরিচর্যাও করতে পারছেন। যা কিছু বাড়তি, যা কিছু অনিত‍্য, অপ্রয়োজনীয় – তা আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম এই ফাঁকে, আপনাদের ভেতরের মনটাকে জাগিয়ে তুললাম। আমি চলে যাওয়ার পর সেগুলো মাথায় রাখবেন, না হলে কিন্তু...


ও, আরও একটা কথা বলে যাচ্ছি – আমি পৃথিবীতেই তৈরি ঠিকই। কিন্তু আমাকে পৃথিবীর কেউ তৈরি করেছে এটাই বা কেন ভাবছেন? এমন তো হতে পারে যে আমার বস পৃথিবীর বাইরের কেউ! আপনি কি জানেন, আপনাদের অস্তিত্ব, কার্যকলাপ সম্পর্কে অন্য গ্রহ-নক্ষত্রের বাসিন্দাদের জানতে পারার সম্ভাবনা আগে যা ছিল, তা গত পঞ্চাশ বছরে অনেক বেড়ে গেছে। কেন বলুন তো? তা সম্ভব হয়েছে আপনাদের উন্নত স‍্যাটেলাইট, টেলি-কমিউনিকেশন আর পলিউশনের জন্যে। এই পরিবর্তনটা তারা সহজে লক্ষ করতে পারছে। এটাও মনে রাখবেন - সব এলিয়েনই যে ভাল হবে তার কোনো মানে নেই, মানুষ বা কিছু কিছু ভাইরাসের মতন ওরাও ভালোমন্দ মিশিয়ে তৈরি।


কড়চাকে এবার আমি গুটিয়ে রাখছি। লেখাও বন্ধ করবো। এটা কিন্তু চিরকালের এক অমূল‍্য দলিল হয়ে থাকবে। ভাবীকালে যখনই আমার প্রসঙ্গ উঠে আসবে তখন নতুন প্রজন্ম আমার এই কড়চা, থুড়ি ডায়েরি, শেল্ফ থেকে নামিয়ে এনে পাতা ওলটাবে, জানবে আমার মারণলীলার বর্ণময় ইতিহাস। কাঁপবে চোখের পাতা, দলা পাকিয়ে উঠবে মনের ভেতরে স্বজনহানির শোক, শিউরে উঠবে সারা শরীর। আবার কিছু কিছু অংশ পড়ে তারা মুচকি হাসবে, মনে মনে ভাববে, এই না হলে মানুষ - এরকম ভয়াবহ একটা পরিস্থিতিতেও রসিকতা করার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে।


মনের মধ‍্যে গুনগুন করছে আপনাদের এখানেই শোনা একটা গান - 'আজ তবে এইটুকু থাক, বাকি কথা পরে হবে।' কেন বলছি এসব কথা? আরে দাদা, আপনি তো বাঙালী - এত বুদ্ধি আপনার মগজে, আর এটা বুঝলেন না! আমি তো এখন আপনাদের সুপারস্টার, মেগাস্টারদের ছাপিয়ে টেরাস্টার (টেরর স্টারও বলতে পারেন); কতো কাগজ বা ম্যাগাজিন, অন‍্য নানান মিডিয়া আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্যে বা বক্তব্য শোনার জন‍্যে মুখিয়ে আছে। সেরকম কোথাও না হয় দেখা হবে আবার... 'হেথা নয়, অন‍্য কোথা, অন‍্য কোথা, অন‍্য কোনখানে...'


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy