ভাইরাসের কড়চা #১৫ । টে-নে এনজয়
ভাইরাসের কড়চা #১৫ । টে-নে এনজয়


০৮এপ্রিল ২০২০
এইমাত্র ভাবলাম, আচ্ছা, আজ যদি সুন্দরী ঈভ আধখাওয়া একটা আপেল আদমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আদুরে গলায় সেটা খেতে বলে, আদম কি করবে? পুলিশকে ফোন করে বলবে "নে, গেট ঈভ!" নিজের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কায় প্রেমিকাকে ধরিয়ে দেবে; কি ঘোর কলি! না, জেনে রাখুন, ধরিয়ে দেবে আসলে আমার ভয়ে। কিন্তু সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? বুক ঠুকে বলুন তো, হাইজিন মেণ্টেন করাটা কি আপনাদের মজ্জাগত ছিল কখনো? ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছেন বটে, বড় হয়ে বেমালুম ভুলে গেছেন। আমি এসেই তো আপনাদের নতুন করে হাইজিন শেখালাম, দেখালাম হাঁচলে বা কাশলে মুখে চাপা দিতে হয়, যেখানে সেখানে থুতু ফেলতে নেই। বাইরে থেকে ঘরে এসে জামাকাপড় ছাড়তে হয়, সাবান দিয়ে মুখ-হাত-পা ভালো করে ধুতে হয়, আরো কত কি!
ওই দেখুন, এই আলোচনা করতে করতেই দেখলাম প্রমোদবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে একদলা থুতু ফেললেন রাস্তায়। বিরক্তিতে, ঘেন্নায়! সরকারি ব্যাংক আবার সুদের হার কমালো। ১১ই মার্চে কমিয়েছিল, আবার কমালো। এখন সেভিংস ডিপোজিটে সুদ কমে হলো ২.৭৫%। এভাবে কতবার যে কমলো! এভাবে কমতে থাকলে তো না খেয়ে মরতে হবে! সঙ্গে থাকা ওনার বন্ধু রমেনবাবু থুতুর ছিটে গায়ে লাগবে সেই ভয়ে লাফিয়ে আরো দু'হাত পিছিয়ে এলেন। উনি ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট পড়ান একটা ছোটখাটো বিজনেস স্কুলে। বলতে গিয়েও বন্ধুকে বলতে পারলেন না যে শেয়ার মার্কেট ওদিকে একটু চাঙ্গা হয়েছে। কারণ, খবরে বলেছে এই প্রথম সারা বিশ্ব জুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার হার সামান্য কমেছে, চীনে তো প্রায় কমেই গেছে।এই দেশে ধাপে ধাপে লকডাউন তোলার প্রস্তাবও তুলেছে কেউ কেউ...। সরে আসতে গিয়ে একটা নেড়ি কুত্তার গায়ে পা পড়তেই সে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। রমেনবাবু আর দাঁড়ালেন না, সোজা বাড়ি এসে বাজারের ব্যাগ কলতলায় রেখে কল খুলে দিলেন, সাবান নিয়ে হাত ধুতে গেলেন বেসিনে।
রমেনবাবুরা বেশ অবস্থাপন্ন, ছেলে নীল আর মেয়ে নীলাক্ষী দুজনেই ভালো চাকরি করে। নীলাক্ষী এক বিদেশী এয়ারলাইনসের গ্রাউন্ড স্টাফ আর ছেলে একটা ফার্মাসিউটিকল কোম্পানির জোনাল সেলস হেড। অফিস বন্ধ থাকলেও ফোন আর ল্যাপটপেই কিছু কাজ চলছে। নীলাক্ষী কাল থেকে বেশ চিন্তায় - কদ্দিন চাকরি থাকবে সেটা নিয়ে নয়; আসলে ওর বয়ফ্রেন্ড অত্রি নিউ জার্সিতে কাজে গিয়ে আটকে পড়েছে। চেকিংয়ের সময় শরীরে কিছু বেয়াড়া সিম্পটম দেখা গেছে বলে আপাতত সেল্ফ-কোয়ার্যান্টিনে আছে ক'দিন। টেস্ট হয়েছে, রিপোর্টের অপেক্ষায়। আমেরিকায় আক্রান্তের একটা বিশাল অংশ থাকে নিউ ইয়র্ক-নিউ জার্সি এলাকাতে।
নীলের আজকে আর কালকে এক নামকরা ফাইভ স্টার হোটেলে ডক্টরস মীট্ ছিল। লকডাউনের জন্যে ক্যান্সেল হলেও এখুনি একটা ফোন এল। হোটেলের কর্তৃপক্ষ বলছে যে ওরা আজ থেকে হোম ডেলিভারি শুরু করেছে, বিরাট ডিসকাউন্ট দেবে যদি স্যার অর্ডার দেন। ওরাই সাজেস্ট করলো - মাইণ্ড আপলিফট্ করে দেওয়া মেনু। রান্নাঘর থেকে মায়ের একদিন দু"বেলা ছুটি হবে এই ভেবে সবার পছন্দ অনুযায়ী অর্ডার করা হলো। ডেলিভারি হলো সময়মতো। কিছু আইটেম লাঞ্চে খেয়ে কিছু রেখে দেওয়া হলো, রাতে ডিনারের জন্যে। নীলাক্ষীকে অনেক সাধ্যসাধনা করেও বেশি কিছু খাওয়ানো গেলো না। একে তো ফিগার নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, মেপে মেপে খায়, তার ওপর মাথায় ঘুরছে অত্রির চিন্তা।
সন্ধ্যেবেলায় আজ ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি কলকাতার এক শহরতলিতে। আধা গ্রাম-আধা শহর এই অঞ্চলে আমাকে ঘিরে আতঙ্কটা কলকাতার মতো অতটা জাঁকিয়ে বসেনি। একটু হালকা মেজাজ, স্থানীয় প্রশাসনও এখানে কড়াকড়ির ব্যাপারে কিছুটা ঢিলেঢালা। একটা ক্লাবঘরের সামনে দেখলাম কিছু ছোকরা মুখে মাস্ক পরে একটু দূরে দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে কি যেন সব আলোচনা করছে। ওদের কথাবার্তায় আড়ি পেতে জানলাম ওরা মহল্লায় ঘুরে ঘুরে খুঁজে বার করেছে কাদের সাহায্য দরকার। বিশেষ ভাবে খূঁজে বার করেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে। এলাকার মধ্যে এরকম প্রায় আশিটা পরিবারকে রোজ সাহায্য করছে ওরা। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে কিছু রেশন পৌঁছে দেয়। এ ছাড়াও অঞ্চলের সবাইকে ওদের ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছে। যদি কোনো বিপদ আসে ওরা পাশে দাঁড়াবে এই আশ্বাস দিয়ে। খালি শ্রম নয়, যা অর্থ লাগছে তাও ওদের নিজেদের। ক্লাবঘরের গায়ে বড় করে লেখা - দূরে দূরে থাকুন, পাশে আছি আমরা।
মনটা কিরকম যেন হয়ে গেল এসব দেখেশুনে। আমিও কি মানুষগুলোর মতন ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি নাকি! রমেনবাবুর বাড়িতে একবার ঢুঁ মারলাম। অনেক রাত হয়ে গেলেও ডিনার হয়নি। সবাই মুখ কালো করে বসে আছে। হঠাৎ মেয়ের ফোনে একটা মেসেজ ঢুকলো "টেস্টেড নেগেটিভ, এনজয়! কাণ্ট টক নাউ, টেক কেয়ার, লভ ইউ হানি"।
ডিনার সাজানো হলো। গ্রীন চিকপিজ উইথ চিকেন কারি অ্যাণ্ড সুইস্ সার্দ। ধন্য চিকেন কারি, জিভে ঠেকাতেই সবার শুরু হলো হুস হাস্। রমেনবাবুর টাকে সামান্য যে দু'চারটে চুল আছে তাও একেবারে স্ট্রেট মানে সোজা খাড়া হয়ে গেল। বেজায় ঝাল। খাওয়া ছেড়ে নীল প্রচণ্ড বিরক্তির সঙ্গে ডায়াল করলো হোটেলে...ফোনে রেকর্ডেড মেসেজ বাজছে: "ফুড ফ্রম আওয়ার হার্ট টু ইয়োর সেফ হোম; ফিল পজিটিভ, টেস্ট নেগেটিভ। থ্যাংকস ফর কলিং, উই আর ক্লোজড ফর দ্য ডে"।
ধন্যবাদ - শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়