কড়চা #২০| চিন্তায় নিশ্চিন্তপুর
কড়চা #২০| চিন্তায় নিশ্চিন্তপুর


২৫ এপ্রিল ২০২০
ইতিহাসের একটু-আধটু তো আপনারা সবাই জানেন। এখনকার সময়টাকে আপনারা কতো কি গালভরা নামে ডাকেন। তার মধ্যে একটা তো আমারও জানা। ঐ যে 'স্পেস এজ সিভিলাইজেশন'! মুশকিলটা কি জানেন, এখন আপনারা গণ্ডীছুট হতে চাইছেন সেই কবির কথায় - 'থাকব না আর বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে…' সেই জগতে অখুশি আপনাদের লক্ষ্য এখন মহাজগৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড! একটু পিছিয়ে দেখুন। মানুষ তার আদিমতা ছেড়ে ক্রমশ সভ্যতার পথে হাঁটা শুরু করলো, নানান জায়গায় গড়ে উঠতে লাগলো একটার পর একটা প্রাচীন সভ্যতা। সে তালিকা দীর্ঘ, বলে শেষ করা যাবে না। আজটেক সভ্যতা, মায়া সভ্যতা, ব্যাবিলনের সভ্যতা। গ্রীস, রোম, মিশরের সভ্যতা তো আছেই তবে প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে আমার আবির্ভাবের দেশ চীন আর আপনাদের দেশ ভারতের সিন্ধু সভ্যতার নাম তো করতেই হবে।
অনেক সভ্যতাই লোপাট হলেও আপনাদের সভ্যতা কিন্তু আজও টিকে আছে বহাল তবিয়তে। সেই সভ্যতাকে ঝাড়েবংশে ধ্বংস করার জন্যেই কিন্তু আমার বস আমাকে এদেশে পাঠিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছি, কাজও করে চলেছি। আমার নিজস্ব একটা ঝোঁক আছে এই বাংলা আর বাঙালীর ওপর। এরা সবকিছুতেই নাকি সবার ওপরে, এটাই এদের গর্ব আর এদের সেই গর্বের মিনারকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবার জন্যেই আমার এই রাজ্যে আসা। কাজের দায়িত্ব দিয়ে বস যখন ব্রিফিং করছিলেন তখন উনি বিশেষভাবে কলকাতার নামটা বলেছিলেন। জনসংখ্যার ঘনত্বের হিসেবে কলকাতার স্থান ভারতের মধ্যে তিন নম্বরে। এক বর্গ কিলোমিটারে প্রায় পঁচিশ হাজার লোকের বাস এই শহরে। তাই এখানে আমার কাজ করার বা সংক্রমণ ছড়ানোর সুবিধেটা অনেকটাই বেশি। এরপরেই আছে হাওড়া। সেখানে আমার কাজ দেখে বস বেজায় খুশি। কলকাতার লোকেরা চালচলনে, স্বভাবে অত্যন্ত বেয়াড়া। সরকারি নির্দেশ অমান্য করে বাজারে অযথা ভিড় করছে। মোড়ে মোড়ে জমায়েত, আড্ডা চলছে। ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে নানা অজুহাতে। পুলিশ আটকাতে গেলে তাদের দিকে ইঁট, পাথর, বোতল সব ছুঁড়ছে। আমার তো এসবে পোয়াবারো। এর মধ্যে আবার এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আর রাজ্যপালের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, খুব একচোট চিঠি চালাচালি চলছে। সকালে কাগজ খুলেই লোকে আগে ওপরে বাঁদিকের কোণায় নজর দেয়। ওখানেই তো আক্রান্ত, মৃত আর সুস্থ হয়ে ওঠা লোকের সংখ্যা দেওয়া থাকে। সেটায় চোখ বুলিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, শিউরে ওঠে। তারপরে এই চাপানউতোরের উপাখ্যান, লোকজনের নিশ্চিন্ত হওয়ার জো আছে? দেশে এখন আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় বাইশ হাজার, মারা গেছে নাকি সাতশো। এই রাজ্যে ঐ সংখ্যা দুটো সাড়ে চারশো আর বারো। কি মনে হয় আপনাদের - দেশের বা রাজ্যের এই সব সংখ্যা কতটা সঠিক?
ইঁট আর কংক্রিটের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বিরক্তি ধরে গেছে। তাই আজকাল ক'দিন ধরে একটু অন্য জেলাগুলোতে যেমন বর্ধমান, হুগলিতে ঘোরাঘুরি করছি। কলকাতা, হাওড়ার থেকে এগুলো খুব একটা দূরে নয়, বর্ধিষ্ণু জায়গা বলে লোকও প্রচুর। তবে কলকাতা - বর্ধমান ঘোরাঘুরি করে কাজ চালানো কিন্তু যথেষ্ট কষ্টসাধ্য! গাড়ি ঘোড়া না চলায় আপনাদের অর্থনীতির মতন আমিও তাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছি। কড়চাও তাই আজকাল রোজ লিখতে পারছি না।
হুগলি জেলার একটা গ্রামে ঢুকলাম। নাম নিশ্চিন্তপুর, যদিও ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবাই বেশ চিন্তায়। স্থানীয় লোকজনদের উচ্চারণে 'নিচিনপুর'। শান্ত, সুন্দর গ্রামটার সুনাম আলু চাষের জন্যে। ফলন এবারেও ভালো হয়েছে আর ক্ষেত থেকে সেই আলু তোলার ঠিকে কাজের জন্যে অন্য অনেক জায়গা থেকে লোকেরা এই গ্রামে এসে হাজির হয় এই সময়টায়। এবার পুরুলিয়া থেকে এসেছে বেশ কিছু পরিবার। আলু তোলা যখন প্রায় শেষের মুখে, যখন নিজেদের ঘরে ফেরার পালা তখনই লকডাউনের শুরু। শুরু বিপত্তিরও, ঐ গ্রামেই বাধ্য হয়ে আটকে পড়েছে কিছু পরিযায়ী শ্রমিক পরিবার। গাড়িঘোড়া চলছে না, বাড়ি ফেরার কোনো উপায় নেই। এদিকে এখানকার কাজকর্মও শেষ। রুজি রোজগার মন্দ হয়নি বটে, কিন্তু এটা তো মানতে হবে যে নিজের ঘর ছেড়ে বিভূঁইয়ে থাকাটা খরচার ব্যাপার। ষাট বছরের রামু সোরেন থেকে ষোলো বছরের সিধু হেমব্রম, সবার কালো মুখ চিন্তায় চিন্তায় আরো কালো হয়ে গেছে। যারা ওদের কাজে লাগিয়েছিল সেই গ্রামের লোকরা এরকম অবস্থা দেখে ওদের খাবার যোগান দিচ্ছিল কয়েকদিন, এখনো দিচ্ছে। গ্রামের যে পরিবার সিধু-রামুদের কাজে লাগিয়েছিল তাদের পক্ষে এখন আটজন শ্রমিককে গত দশদিন ধরে খাওয়ানোটা একটু কষ্টের হয়ে উঠছে। এতজনের চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন, মশলা জোগাতে নিজেদের ভাঁড়ারও ফুরিয়ে আসছে। এই অসময়ে হাট বাজারও সব খোলা নেই! ফেসবুকে এই পরিবারের বড় ছেলে গৌতম, পরিযায়ী শ্রমিকদের ছবি দিয়ে আবেদন করেছে যাতে রাজ্য প্রশাসন কিছু সহযোগিতা করে, এরা যাতে দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পায়, অভুক্ত না থাকে। সেই আবেদন প্রশাসনের কাছে পৌঁছেছে কিনা জানিনা; তবে এই সাহায্যের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে ওর আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কিছু জিনিষপত্র, টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্যও করেছে। তার ওপরে আজ শহর থেকে আসা পাইকারের কাছে ভালো দাম পেয়ে বেশ কয়েক বস্তা আলুও বিক্রি করতে পেরেছে গৌতম। হাতে কাঁচা টাকা আসায় মনটাও একটু নিশ্চিন্ত। বাঁশবনের পাশ দিয়ে বাড়িমুখো হবার সময় ভাবলো একবার রামুদের খোঁজ নিয়ে যাবে। বাঁশবনের পুবদিকে দুটো টালির চালের ঘরে ওই আটজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে প্রতিবছরের মতন। দেখলো রামু আর শিবু সোরেন দু'ভাই ঘরের সামনে আমগাছের ছাওয়ায় খাটিয়া পেতে বসে বিড়ি ফুঁকছে। পাশে পাটকাঠি দিয়ে উনুন ধরিয়েছে লতা মাণ্ডি। কিছু শুকনো আম কাঠ জড়ো করা পাশে। সিধু ছোঁড়াটা একটু দূরে মাথায় গামছা বেঁধে পুকুরে ডুব মারছে। পাড়ে রাখা রয়েছে কিছু শাক পাতা।
- কি রান্না হচ্ছে শিবু?
- ফ্যান ভাত ছাড়া আর কি হবে বাবু?
- একটু দেরি করে খাস। বাড়িতে আলুর দম রান্না করবে, দিয়ে যাবো তোদের জন্যে। আর এখানে বসে বিড়ি না ফুঁকে একটু ঘুরে ফিরে দেখ, কারোর যদি কাজে লাগতে পারিস।
এতদিনে কাগজ পড়ে, টিভি দেখে আপনাদের নিশ্চয়ই জানা হয়ে গেছে যে আমেরিকায় আমি কিরকম তাণ্ডব চালিয়েছি। ব্যাটাদের খুব গর্ব ছিল ধনদৌলত, মানুষ-মারার হাতিয়ার এই সব নিয়ে। সেই গর্ব ভেঙে চুরমার করে দিয়েছি। তবে একটা কথা কি জানেন, ওখানে অন্যদের তুলনায় কালো মানুষগুলো অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে আর মারাও যাচ্ছে বেশি। পণ্ডিতরা বলছে ওরা টাকাপয়সার হিসেবে অন্যদের থেকে অনেকটাই কমজোরি, সস্তার খাবারদাবার খায়, অপুষ্টিতে ভোগে। নেশাভাঙ করে, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কাটায় না। তাই যে কোনো রোগ চট করে ওদের শরীরে বাসা বাঁধে। পয়সার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাও করাতে পারে না। নানাভাবে অবহেলার শিকার হয়।
এবার ভাবুন তো, এখানেও তো রামু, শিবু, লতা, সিধুদের অবস্থা অনেকটা ওদেরই মতো, কোনোভাবে বেঁচেবর্তে থাকে। এই সুযোগে আমি যদি ওদের শরীরে ঢুকে পড়ে মরণকামড় বসাই তাহলে বস তো খুশিই হবে, নয় কি!
আপনাদের কি চিন্তা বাড়িয়ে দিলাম?
ধন্যবাদ - শ্রী কৌশিক রায় , শ্রী অমরনাথ মুখোপাধ্যায়