হেডস্যার
হেডস্যার
১৯৮৬ সাল। তখন আমাদের ক্লাস সিক্স। গরমের ছুটিতে বাড়ি এসে এক ঘটনা শুনলাম দাদার কাছে। ও সেই বছরই মাধ্যমিক পাশ করেছে আমাদের স্কুল থেকে। ওদের ব্যাচের একজন ছাত্র মাধ্যমিক মার্কশিটের কয়েকটা ফটোকপি নিয়ে গেছে হেডমাস্টারকে দিয়ে অ্যাটেস্ট করাতে। দুপুর বেলা, অফিসে কোন ভিড় নেই। ছেলেটা ঘরের ভারী গেরুয়া পর্দাটা সরিয়ে বলল – আসব?
উনি চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন – এস।
- আমার নাম... আমি এই বছরের আউটগোয়িং ব্যাচ। মার্কশিট অ্যাটেস্ট করানোর ছিল।
- দাও। কটা আছে?
- ছটা। ছেলেটা কপিগুলো হাত বাড়িয়ে দিল, উনি নিয়ে একবার চোখ বোলালেন।
- অরিজিনাল টা এনেছ?
- হ্যাঁ, এই যে। হাতের ফাইল টা খুলে ওটা বাড়িয়ে দিল।
উনি একটা ফটোকপি আঙুল দিয়ে প্রত্যেকটা লাইন মিলিয়ে দেখলেন, তারপর বাকিগুলোতেও একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। পেনটা টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে প্রথমটাতে সই করতে করতে আটকে গেলেন – পেনের নিবটা টেবিলের একটা ফুটোতে ঢুকে গেছে কাগজ ফুঁড়ে! তার চারপাশে কালি ধেবড়ে একাক্কার!
- ওহো, এটা নষ্ট করে ফেললাম! এটা ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
- ও ঠিক আছে, আপনি কিছু একটার উপরে রেখে বাকি সইগুলো করুন।
- ঠিক বলেছ।
পাশে রাখা একটা বড় ম্যাগাজিন নিয়ে তার উপর রেখে পরপর পাঁচটা সই করলেন।
- পাশের ঘর থেকে স্ট্যাম্প দিয়ে নিও।
উনি কাগজগুলো গোছাতে গোছাতে বললেন। তারপর পাশে রাখা অরিজিনাল মার্কশিটটা তুলে নিয়ে উপর থেকে তলা অবধি এক টানে ছিঁড়ে ফেললেন এবং ফ্যালফ্যাল করে দেখতে থাকা ছাত্রটার চোখে চোখ পড়তেই ভুল বুঝতে পেরে লম্বা করে জিভ বার করলেন!
- এ, এটা কি করলেন! ছাত্রটা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল!
এরপর ঝিমোতে থাকা দুপুরের স্কুল অফিস হঠাৎ জেগে উঠল। অনেক বিচার বিবেচনা করে, ফ্যান অফ করে, জানলা, দরজা বন্ধ করে পেছন দিকে সেলোটেপ দিয়ে নিখুঁত ভাবে মেরামত করা হল মার্কশিট। ছাত্রটিকে আশস্ত করা হল যে কোথাও কোন অসুবিধা হলে স্কুল দায়িত্ব নেবে ডুপ্লিকেট বার করার।
যতদূর জানি ডুপ্লিকেট বার করার প্রয়োজন অনেকদিন পর্যন্ত পড়েনি।
এই ঘটনা শোনার কিছুদিন আগে, এপ্রিল মাসের এক সকালে স্কুলের অ্যাসেম্বলি হলে অবশ্য ওনাকে প্রথম দেখেছিলাম। আমাদের তখনকার হেডমাস্টার ওনার পরিচয় দিলেন। তারপর বিশেষ কোন স্মৃতি নেই এক বছর! কারণ আমাদের জুনিওর ক্লাসগুলোর জন্য একজন কো-অরডিনেটর ছিলেন। ওনাকেই আমরা কার্যত হেডমাস্টার হিসাবে মানতাম।
২০১৬ র ২৫শে ডিসেম্বর আমাদের ৯১ মাধ্যমিক ব্যাচের গ্র্যানড রিউনিওন ছিল। সব টিচার দের আমরা ফেলিসিটেট করলাম, কিন্তু আসল লোক – আমাদের ১৯৮৬ সালের নতুন হেডমাস্টারকেই পেলাম না সেদিন। তিনি তখন তমলুকে এক বৃহত্তর সংস্থার সেক্রেটারি। ২৬শে ফোন করে জিগ্যেস করলাম উনি থাকবেন কিনা, উত্তরে হ্যাঁ পেতেই ২৯ আর ৩০ তারিখ ছুটি নিয়ে আমি আর আমার এক ব্যাচমেট বেরিয়ে পড়লাম ওনার হাতে আমাদের সামান্য কিছু কৃতজ্ঞতার স্মারক তুলে দিতে।
আমরা দুপুরের একটু আগে পৌঁছলাম, মুখ চিনলেও আমার নাম স্বাভাবিক ভাবেই মনে করতে পারলেন না। বন্ধুর স্কুলে যাতায়াত থাকায় ওকে চিনলেন, ওর বাবার খবর নিলেন। কোনোদিন ওনাকে কোনও ব্যাপারে অতিরিক্ত আনন্দ বা রাগ প্রকাশ করতে দেখিনি, এবারেও দেখলাম না; কিন্তু ওনার কথা শুনে মনে হল খুব খুশি হয়েছেন। আমাদের থাকার জন্য পাশের গেস্ট হাউসে ঘর ঠিক করে দিলেন। ভেবেছিলাম পরের দিন চলে আসবো, কিন্তু ওনার সাথে বেশ কিছু সময় আর তমলুকের প্রচুর মন্দিরের টানে আরও দুদিন থেকে গেলাম। সেই অপূর্ব অভিজ্ঞতা পরে কখনও বলা যাবে...
প্রথমদিন সন্ধ্যেবেলায় দেখলাম উনি অফিসঘরের সামনে ক্রমাগত পায়চারি করছেন, প্রথমে ভাবলাম উনি কোন ব্যাপারে চিন্তিত। পরে সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে শুনলাম, ওটা ওনার রোজকার অভ্যাস। তাই হয়ত পঁচিশ বছর আগে যেমন দেখেছিলাম, এখনও সেইরকম ঋজু চেহারা! একটু হাঁটলাম ওনার সাথে, তাতেই হাঁপিয়ে গেলাম। ইতিহাসে ওনার আগ্রহ এখনও অটুট, তমলুকের ইতিহাস, কোথায় কোন মন্দির আছে আর তাদের ইতিহাস শুনলাম এই কদিনে। দুদিনে অটোতে, রিক্সায় আর বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে দেখলাম ঐতিহাসিক তাম্রলিপ্ত। ঘুরে এসে সন্ধ্যেবেলায় ওনাকে বলতাম কোথায় ঘুরলাম আর উনি টুকটাক প্রশ্ন করে ঠিক উত্তর না পেলে ওখানকার এক জুনিয়র মহারাজের মাধ্যমে বা নিজে বলে দিতেন। আমাদের ক্লাস এইট না নাইনে ঠিক এভাবেই উনি ইন্ডিয়ান কালচার পড়াতেন; প্রশ্নের উত্তর না পারলে বকতেন না।
পরেরদিন তক্কে তক্কে ছিলাম, বায়না ধরলাম অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে – হাঁটতে হাঁটতে কথা হবে। উনি আপত্তি করলেন না। দুটো সন্ধ্যে মিলিয়ে অনেকক্ষণ কথা হল। মুগ্ধ হলাম। ছোট করে বলি, কেন।
আমি শুরু করেছিলাম এরকম ভাবে,
- আপনি প্রায় ২৫ বছর আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার। এই সময়ে আমদের স্কুল খ্যাতির একদম চূড়ায় ছিল! শচীন তেণ্ডূলকরের মতন একটা ইনিংস! আর কেউ কি এরকম পারবে কখনও? আপনার সাফল্যের রহস্য কি?
লজ্জা পেয়ে গেলেন একটু। ছোটবেলার টিভিতে রামানন্দ সাগরের রামায়ণে, রামের (অরুণ গোভিল) সেই একপেশে হাসির মতন ছোট্ট একটা শব্দহীন হাসি!
- তুমি তো কাগজে চাকরি করো মনে হচ্ছে! তখন যে বললে ইনফরমেশন টেকনোলজিতে...
কিছুতেই মানতে চাইলেন না যে ওনার এতে কৃতিত্ব আছে। উনি নাকি অতি সাধারণ, সবটাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ! যদি কিছু ভালো হয়ে থাকে ঐ সময়ে, সেটার প্রধান স্থপতি ছিলেন স্কুলের সেক্রেটারি। ওনার মতন দক্ষ প্রশাসনিক বিরল! উনি পথ দেখাতেন আর হেডমাস্টার সেটা অনুসরণ করতেন। সাফল্যের আর একটা কারণ ওনার সাথে যে শিক্ষক আর কর্মচারীরা ছিলেন। এগুলো যে শুধু কথার কথা নয়, সেটা বুঝলাম যখন উনি বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতির কথা বললেন। একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান কর্মচারীর আত্মহত্যা, এক ছাত্রর জলে ডুবে যাওয়া বা মাঠে বাজ পড়ে মারা যাওয়া – বিভিন্ন ঘটনার কথা বলে বুঝিয়ে দিলেন স্কুলের সেক্রেটারি কতটা দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ ছিলেন। বললেন কয়েকজন শিক্ষকের তৎপরতা আর উপস্থিত বুদ্ধির কথা, যেগুলো সবাইকে আরও বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।
- আপনার লিডারশীপ অসাধারণ! এতজন টিচার, সাপোর্ট স্টাফ, তার উপর হোস্টেলের এতগুলো বেয়াদপ বাচ্চা...এরকম একটা পাঁচমিশালি টিম সামলানো তো প্রায় অসম্ভব! আপনার তখন যা বয়স, আমাদের এখন তাই। অথচ পঞ্চাশ কি একশো জনের টিম ম্যানেজ করতেই আমরা হিমশিম খাই এখন!
- তোমাদের তো হোস্টেলে সামলাতেন ওয়ার্ডেনরা - ওনারাও খুব দক্ষ ছিলেন। আর স্কুলে তোমরা যাদের শিক্ষক হিসাবে পেয়েছ, তারা তুলনাহীন; ওরকমটা হয় কি না জানি না! আমাকে বিশেষ ভাবনা ভাবতে হতো না।
- তাহলেও, আমাদের ব্যাচ যেরকম দুষ্টু ছিল – ওরকম নিশ্চই আরও অনেক ছিল...তাদের নিত্যনতুন বদবুদ্ধি!
- একজন দুজন দুষ্টু ছিল, সেটা সামলানো কঠিন নয়। তবে অনেকে একসাথে করলে সেটা একটু মুশকিল।
- আমাদের ব্যাচ যেটা করেছিল অনেক বার!
- তবে কি জানো, খুব বুদ্ধিমান ছাত্ররা যখন দুষ্টুমি করে একসাথে সেটা অনেক সময় বেশ শক্ত হয় ধরা। তবে বকা ঝকা, মারধর করে লাভ নেই...
- আপনাকে কোনদিন রাগতে দেখিনি। খুব হাসতেও দেখিনি। মনে আছে, একবার অ্যাসেম্বলি হলে হাস্যকৌতুক হচ্ছে। সবাই হেসে কুটোপাটি – কিন্তু আপনার মুখে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একরকম একটা আলতো হাসি!
ওনার মুখে আবার সেই হাসিটা খেলে গেল।
- নিজের মনকে সংযত রাখলেই সেটা তোমার কথা আর কাজকে ঠিকপথে চালনা করবে।
১৯৯০ র একটা দিন। আমাদের ব্যাচের পাঁচ থেকে সাত জনের গার্জেন কল হয়েছে, প্রায় জনা কুড়ি ছাত্র আর তাদের বাবা মা ওনার ঘরে সেদিন টেবিল ঘিরে। উনি মাথাটা কাত করে একভাবে একটা কাঁচের পেপার ওয়েট ঘোরাতে লাগলেন। প্রায় ৫ মিনিট কারোর মুখে কোন কথা নেই! অসহ্য এক নিস্থব্ধতা! আস্তে আস্তে ওনার মুখে সেই হাসিটা দেখা দিল, অত্যন্ত ধীর গলায় বললেন
- আমরা সেদিন কিছু রাশিয়ান নভেলিসট্কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম; যাতে তারা আসেন, অডিটরিয়ামে আমাদের ছাত্রদেরকে নিজেদের অভিজ্ঞতা শুনিয়ে অনুপ্রাণিত করেন। এতে সব ছাত্রদের উপকার হবার কথা, মনের বিকাশ হবে ওদের, একটা জগৎ খুলে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, এইই ছাত্ররা (ঘরের সবার উপর চোখ বুলিয়ে) সেইই সুযোগের অপব্যবহার করে সেদিন মিশনের বাইরে পালিয়ে যায়। খবরটা নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া গেছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে ওরা এখন সেটা অস্বীকার করছে।
গলার স্বর নিচু কিন্তু অসম্ভব দৃঢ়। একটা তিরিশ সেকেন্ডের বিরতি...
- ওদেরকে আপনাদের সামনে একটা লাস্ট ওয়ার্নিং দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে। পরবর্তীকালে আবার এরকম ঘটনা ঘটলে আর আপনাদেরকে এখানে ডাকা হবে না, মিশন থেকে ওদের নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ পাঠানো হবে।
সেদিন কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতাতে ছিল এক অবর্ণনীয় আতঙ্ক, অভিভাবকেরা ওনার ঘর থেকে বেরোনোর পর ছেলেদের কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না! অন্যদিকে ভেতরে আগুন জ্বললেও, বাইরেটা বরফের মতন ঠাণ্ডা রেখে আমাদের হেডমাস্টার কোন ছাত্রকেই হেনস্থা করেননি; এরকম একটা অন্যায়ের জন্য।
বেত, লাঠি, মারধর, রাগ, চীৎকার ছাড়া শিক্ষক যখন আমরা খুব কম দেখেছি, এরকম হেডস্যার তখন বিরল! কি বলেন?